আমার কলেজ যাওয়ার পথে “শবনম ভিলা” নামের একটা দোতলা বাড়ি দেখতে পাই। প্রতিদিন দোতলার বারান্দায় মাঝবয়েসী এক লোককে দেখি, সে চেয়ারে বসে গালে হাত দিয়ে নিচের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আমার দীর্ঘদিনের পদচারণায় আমি কোনো দিন এর ব্যাতিক্রম দেখিনি। তাকে দেখলে আমার মনে হয়, যেনো কোনো শিল্পী পাথর খোদাই করে বানিয়েছেন এই ভাষ্কর্য। আমার ইচ্ছে হয় গিয়ে দেখতে আসলে লোকটা সেখানে এভাবে বসে থেকে কী করেন? অনেকদিন নিজেকে সংযত রেখেছি,আজ আর পারলাম না। কলেজে না গিয়ে উঠলাম সেই বাড়ির দোতালায়, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেলে কয়েকটা চাপ দিয়ে দাড়িয়ে আছি। স্বাভাবিক এর চেয়ে কিছুটা বিলম্ব করেই যেনো একজন বয়স পনেরো কি ষোল বছরের মেয়ে ভেতর থেকে দরজা খুললো,রিনরিনে কন্ঠে জানতে চাইলো
~কাকে চাই? আমি আশেপাশের মানুষজনকে জিজ্ঞেস করে লোকটার নাম জেনেছিলাম, উনার নাম “মো: রমজান আলী”। তাই মেয়েটিকে বললাম
—রমজান সাহেব এর সাথে দেখা করতে এসেছি।
মেয়েটি আমাকে দরজার বাহিরেই অপেক্ষা করতে বলে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে আমাকে নিয়ে গেলো বসার ঘরে, ঘরের ভেতরে ঢুকলেই সামনের দেয়ালে টাঙানো ছবিটা সবার আগে দৃষ্টি কেড়ে নেয়। এক কিশোরী মেয়ে কলেজ ড্রেস পড়ে গোল্ড-মেডেল গলায় ঝুলেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ছবিটি দেখতে দেখতে যেনো কোথাও হাড়িয়ে গিয়েছিলাম, এতো সুদর্শনা মেয়ে আগে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না। ভরাট একটা পুরুষ কন্ঠে ভাবনায় ছেঁদ পড়লো, আমি যে সোফায় বসেছি তার বাঁপাশে এসে বসেছেন রমজান সাহেব। আমাকে বলতে লাগলেন ” এটা আমার স্ত্রীর ছবি,ও যখন কলেজ দাবা প্রতিযোগিতায় প্রথম হয় তখনকার ছবি এটা।” ছবির বিষয়ে বলেই ভদ্রলোক জানতে চাইলেন:-
রমজান- তোমাকেতো ঠিক চিনলাম না?
আমি- আমি সাঈদ, আপনাদের পাশের মহল্লায় থাকি।
রমজান- তা কী মনে করে আমার বাসায় এসেছো?
এর মাঝে সেই মেয়েটা চা-বিস্কুট দিয়ে গেলো,রমজান সাহেব ইশারায় তা খেতে বললেন। আমি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বললাম–
আমি- আসলে আংকেল প্রতিদিন কলেজ যাওয়ার পথে আপনাকে দেখি বারান্দায় বসে থাকেন স্থীর হয়ে,তাই জানতে আসলাম কী কারণে আপনি এভাবে বসে থাকেন?
রমজান- তাই বলো! হাহাহা তুমি দেখছি ভালো কৌতুহলী ছেলে। তা দাবা খেলতে পারো?
আমি- হ্যাঁ।
রমজান- ঠিক আছে চলো আমরা বারান্দায় যাই।
রমজান সাহেব তার চায়ের কাপ হতে নিয়ে হাটতে শুরু করলেন, আমিও তার পেছন পেছন গেলাম। বারান্দাতে একটি ছোট আকৃতির টেবিল আর বসার জন্য একটি চেয়ার এবং একটি প্লাস্টিকের টুল বসানো আছে।টুল, টেবিল রাস্তা থেকে দেখা যায় না, তাই মনে হয় রমজান সাহেব একা চেয়ারে শুধুশুধু ঝিম মেরে বসে থাকেন।
টেবিলটাতে শোভা পাচ্ছে একটি সুন্দর দাবা, রমজান সাহেব যে পাশটাতে সবমসময়-ই বসেন সে পাশেই বসলেন তার চেয়ারের উপর। আমি লক্ষ্য করলাম “দাবার গুটিগুলো এমন ভাবে আছে দেখে মনে হচ্ছে কেউ খেলছিলো।” তবে কি রমজান সাহেব একা একাই দাবা খেলেন? সে মেয়েটিও যদি খেলতো তবেতো তাকেও দেখা যেতো কিন্তু একদিনওতো দেখি নি, একা খেলে কী আনন্দ পান তিনি? ‘বসো’ রমজান সাহেবের কন্ঠশুনে সেই টুলটাতে বসলাম, তিনি গুটি সাজাতে শুরু করলেন। আমি উনার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম-
আমি- আন্টিকে দেখছি না যে?
রমজান- সে প্রায় বিশ বছর আগে মারা যায়।
আমি- আমি অত্যন্ত দুঃখিত, আমার হয়তো জিগ্যেস করাটা ঠিক হয় নি।
রমজান- না না ঠিক আছে, তুমিতো জানতেই এসেছো।
আমি- আপনি কি একাই প্রতিদিন দাবা খেলেন এখানে?
রমজান- হ্যাঁ তা বলতে পারো, তবে….
আমি- তবে!
রমজান- তুমি বিশ্বাস করবে কিনা? শেষে না আমাকে পাগল ঠাওরাও।
আমি- আপনি বলুন প্লিজ।
রমজান- আচ্ছা তোমাকে প্রথম থেকেই বলি সব।
রমজান সাহেব বলতে শুরু করলেন- আমি তখন ক্লাস টেনে পড়ি,দাবা খেলায় স্কুল চ্যাম্পিয়ন ছিলাম। তাই স্যাররা আন্তঃজেলা স্কুল দাবা টুর্নামেন্টে আমাকে খেলতে বলে, আমিও স্যারদের কথা মানি। আমি ফাইনালে খেলার সুযোগ পাই,আর ফাইনালে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হয় একটা মেয়ে। আমি প্রথম তাকে দেখি ফাইনাল খেলার দিন, এর আগে দেখে থাকলেও আমি খেয়াল করি নি।
সেদিন আমি আমার প্রতিদ্বন্দ্বীকে দেখছিলাম, কিন্তু তাকে দেখারপর আমি যেনো মস্তিষ্কশূন্য একজন মানুষ হয়ে গেলাম। তার রূপের বর্ণনা আমি এখন করবো না, তবে এতটুকু বলে রাখি সে আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর মেয়েছিলো। সে বার আমিই চ্যাম্পিয়ন হই,তবে মেয়েটা খুব ভালো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। খেলা শেষে আমিই যেচে পড়ে মেয়েটার সাথে কথা বলি, কথা বলে বুঝতে পারি মেয়েটা যেমন সুন্দরী, তেমন বুদ্ধিমতী ও মিশুক।আমার তার সাথে বন্ধুত্ব হয়ে যায় সেদিন থেকে, আমরা প্রায়ই দেখা করতাম, দাবা খেলতাম,আড্ডা দিতাম, এভাবে ধীরে ধীরে আমাদের বন্ধুত্ব প্রেম রূপ দেয়।
আমরা স্কুল জীবিন শেষ করে কলেজে উঠি, আমাদের পড়ালেখা, দাবা, প্রেম সবই চলছিলো সমান তালে। কলেজে উঠে আমার দাবা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করি, সে বারও আমি আর সে ফাইনালে উঠি,আমার স্পষ্ট মনে ছিলো স্কুলে আমার কাছে হেরে তার মন কতটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো, তাই এবার ইচ্ছে করেই তার কাছে হেরে যাই। সে এতোটা খুশি হয়েছিলো! সবার সামনেই আমায় জড়িয়ে ধরে।আমি আমিও খুশিছিলাম তার খুশি দেখে। সময় তার মতো চলে যাচ্ছিলো, আমাদের প্রেমও চলছিলো তাল মিলিয়ে। আমি অনার্সে উঠে আমাদের সম্পর্কের কথা বাসায় জানাই, আমার বাবা বিষয়টাকে গুরুত্ব সহ নেয়, বাবা তাদের বাসায় যায় এবং আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করেন।
অনার্স চলাকালীন আমাদের বিয়ে হয়ে যায়, আমি পড়ালেখা শেষ করে জব নেই, আমার স্ত্রীও জব করতে চায়, আমি বাধা দেই নি। আমাদের কয়েক বছরের চেষ্টায় আমরা এই বাড়িটি করি, আর তার নামানুসারেই বাড়ির নাম রাখি “শবনম ভিলা”। আমাদের দিন ভালোই কাটতে লাগলো, অবসরে দাবা খেলে সময় পার করতাম ঠিক এই জায়গাতেই; শবনম চেয়ারে বসতো না, সে বসতো টুলে। এর মাঝে শবনম সন্তান সম্ভবা হয়,দিন যত যেতে থাকে শবনম আর আমার অস্থিরতা ততই বাড়তে থাকে। অবশেষে কাঙ্খিত সময় চলে আসে, আমি শবনম কে নিয়ে হাসপাতালে রওয়ানা হই।
কিন্তু রাস্তায় আটকা পরি আমরা, এদিকে অসহ্য ব্যথায় কাতরাতে থাকে শবনম। হাসপাতালে পৌঁছাতে পৌঁছাতে তার অবস্থা অনেক ক্রিটিকাল হয়ে যায়, আমি ভীষণ চিন্তায় অস্থির হয়ে যাই,বহু কষ্টে শবনমের সামনে আমার চোখের জল আটকে রাখি।অপারেশন থিয়েটারে যাওয়ার আগে শবনম আমার হাত ধরে বলে ” আমার যদি কিছু হয়ে যায় প্লিজ আমাকে ভুলে যাও না।” তার হাতে মৃদু চেপে ধরে বলি “তোমার কিচ্ছুটি হবে না লক্ষ্মীটি, এসব অশুভ কথা ভেবো না তুমি।” শবনম কে অপারেশন রুমে নিয়ে যাওয়া হয়, আমি বাহিরে বসে কান্না করতে থাকি আর প্রার্থনা করতে থাকি “আল্লাহ যেনো শবনম কে আমার কাছ থেকে দূরে না নিয়ে যায়।”
কত সময় পেরিয়েছে আমি বলতে পারবো না, এক নার্স এসে খবর দেয় “আমার একটা মেয়ে হয়েছে “, আমি শবনম এর অবস্থা জানতে চাইলে নার্স বলে ” আপনি নিজেকে শান্ত করুন, ভেঙে পরবেন না। ” আমি একথা শুনে যেনো আরো পাগলের মতো হয়ে যাই,আমি শবনম কে দেখতে চাই।। সেদিন দেখেছিলাম তাকে, তবে জীবিত নয়।
ধীরে ধীরে শোক কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করি, মেয়েটা দেখতে তার মায়ের মতোই হয়েছে, অফিস শেষে মেয়ের সাথে সময় কাটাতে কাটাতে শবনম কে প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম। এর মাঝে এক রাতে আমি শুনতে পাই শবনম আমায় ডাকছে দাবা খেলার জন্য, বেঁচে থাকতে এমনটা সে প্রায়ই করতো, মাঝ রাতে ঘুম থেকে উঠিয়ে দাবা খেলার জন্য ছেলেমানুষী করতো। আমি ভাবলাম আমি বোধ হয় স্বপ্ন দেখছি তাই ঘুমানোর চেষ্টা করতে থাকি, কিন্তু কিছুক্ষন পর বুঝতে পারি সত্যিই শবনম আমাকে দাবা খেলার জন্য ডাকছে।
প্রথমে আমি ভয় পেয়ে যাই, অদৃশ্য থেকে শবনমের কন্ঠ শুনে। আমি রুমের লাইট জ্বালিয়ে দেই কিন্তু কোথাও তাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না।আমি সেরাতে লাইট জ্বালিয়ে রেখেই ঘুমিয়ে যাই।পরের রাতে আবার তার কন্ঠে ঘুম ভাঙে,এবার আমি মনে সাহস নিয়ে বলি “আমার সামনে আসো শবনম, আমি তোমায় বড্ড মিস করি। ”
আমি শুনতে পাই সে বলছে “বারান্দায় আসো।”
আমিও তার কথা মতো বারান্দায় যাই, বারান্দায় গিয়ে আমি যেনো স্তব্ধ হয়ে গেলাম, দেখি শবনম তার টুলে বসে আছে আর দাবার গুটি সাজাচ্ছে। আমি তাকে পেয়ে কিছুটা ভয় কিছুটা ভালোলাগায় এগিয়ে যাই, তার সামনের চেয়ারে বসি, সে রাতে আমাদের অনেক কথা হয়, অনেক দিন পর তাকে পেয়ে আমি বহুদিনের অব্যক্ত কথা বলতে শুরু করি।
সেদিনের পর থেকে প্রতিটি সময় শবনম আমার সাথেই থাকে,এখনতো চাকরি থেকেও রিটায়ার্ড হয়ে গেছি তাই সারাদিন বারান্দায় বসে তার সাথে দাবা খেলি। রমজান সাহেবের কথা শুনে আমি পুরাই অবাক হয়ে যাই, অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। তিনি যেনো ব্যাপারটা বুঝেই বলে উঠলেন “শবনম সাঈদের চালটা তুমিই দিয়ে দাও।” আমি অবাক দেখলাম কারো হাতের স্পর্শ ছাড়াই আমার ঘোড়া রমজান সাহেবের এক সৈন্যকে কতল করলো। রমজান সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন “কি এবার বিশ্বাস হলো? আর আশাকরি তোমার কৌতুহলটাও মিটেছে। ”
আমি- হ্যাঁ, আচ্ছা আন্টিকে কি আপনি ছাড়া আর কেউ দেখতে পায় না?
রমজান- না, আমি ছাড়া আর কেউ দেখতে পারে না।
আমি- অহ, আপনার মেয়ে কোথায়?
রমজান- মেয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ইউরোপ এ আছে।
আমি- মাশা আল্লাহ! আচ্ছা আংকেল আমাকে এবার যেতে হবে, অনেক সময় হয়ে গেলো।
রমজান- হ্যাঁ, তুমি তাহলে চলে যাও, আর শুনো আর কখনো আমার বাড়িতে এসো না, আমি শুধু আমার পাগলীটার সাথেই সময় কাটাতে চাই।
সমাপ্ত