ভালোবাসা নাকি মায়া!

ভালোবাসা নাকি মায়া!

-আজ একটু বাজার করে আনবে, রেশমা’র বাপ?

-সবসময় তোমাদের বাজার লাগে কেনো শুনি? মোটে তো মা মেয়ে দুইজন!

-তুমি তো গত দুইবার হাঁটে গেছো, আমাকে তো একবার জিজ্ঞেসও করো নাই। আমিও সামান্য বাজার ছিলো বলে, তোমাকে যেতে দেখেও থামায় নাই। অনেকদিন পরই না আজ বললাম।

কিছুটা অভিমানের সুরেই বলে রাহেলা।

-আচ্ছা, যাও। প্যাঁচাল পেরোনা, টাকা, থলে আর বাজারে কি কি লাগবে লিস্টি লিখে নিয়ে আসো।

-তিন চারটে মোটে বাজার!

-যাও তো, যা বলছি তা করো, বেশি কথা বলো।

রেশমা’র মা দৌড়ে টাকা আনতে যেতে, দরজার সাথে ধাক্কা খায়।

আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ..

বলে, সে বসে পড়ে। 

আর রেশমা’র বাপ, মোটামুটি   উচ্চস্বরেই বলে,

-আন্ধি…

রেশমা’র মা, রাহেলা চোখে কম দেখেন। কম মানে অনেক কম, ঝাপসা ঝাপসা। 

এতো বছরের চেনা ঘর, পথ ঘাট, পরিচিত সব মানুষজন বলে, মনের জোরে আন্দাজে চলাফেরা করে। এরপরেও প্রায়সময় ধাক্কা খেয়ে ব্যথায় কুঁকড়ে যায়।

প্রতিবার ব্যথা পেয়ে সে আলহামদুলিল্লাহ বলবেই।

ছোট মেয়ে ঝুমা জিজ্ঞেস করে,

-মা, ব্যথা পেয়েছো, তাতে কষ্ট হলো তোমার। আলহামদুলিল্লাহ বলো কি কারণে?

-মারে, আমি তো খুব অল্প ব্যথা পেয়েছি। আরো অনেক বেশি আঘাত পেতে পারতাম। পাই নাই, সে কারণে আল্লাহ’র কাছে শোকরিয়া আদায় করি। যতো বড় কষ্ট পাসনা কেনো, শোকর করবি, ধৈর্য ধরবি। দেখবি, খুব সহজে বড় বিপদ থেকে রক্ষা পাবি।

হয়তো মায়ের কথাই ঠিক, কিন্তু ঝুমা’র মাথায় এতো কঠিন কথা ঢুকেনা।

অথচ, একটা সময় লোডশেডিং হলে,  চাঁদনি রাতের আলোতে দিব্যি খালি চোখে উঠোনে বসে কোরান পড়তো রাহেলা।

রেশমা’র বাপ বাজার এনে, দুয়ারে ঝুমাকে ঢেকে হাতে ধরিয়ে দিয়ে, তাদের নিজের জন্য আনা বাজার নিয়ে দ্বিতীয় পক্ষ আরিফের মায়ের ঘরে ঢুকে যান।

রেশমা’র মা, তাদের জন্য আজ এক কেজি গরুর মাংস আনিয়েছে। যদিও গরুর মাংসের বাজারদর খুব বেশি। তবুও মাঝেমধ্যে এক, দেড় কেজি আনতে বলে সে। কারণ, রেশমা’র মা, রাহেলা ছোটকাল থেকেই মাছ বেশি খেতে পারেনা, গন্ধ লাগে তার। মাছ দিয়ে ভাত খাবার পর সুপারি নয়তো আচার মুখে না দিলে তার বমি হয়ে যাবে মনে হয়।

সে মুরগি’র মাংসও খায়না। ফার্মের মুরগি বিক্রি শুরু হবার পর থেকে, দেশি মুরগির দাম বেড়েছে হুহু করে, তাই তাও খাওয়া প্রায় অসম্ভব! 

ফার্মের মুরগি কুটতে গেলেই তার গন্ধে বমি আসে, মুখে দেবে তো পরের কথা।এরপরেও ঝুমা’র জন্য আনতে হয়।

সবজি আর ডিম দিয়ে আর কতো খাওয়া যায়!

ছোট মেয়ে ঝুমাও হয়েছে মায়ের মতো, মাছ একদম খেতে চায়না।

রাহেলা সুন্দর করে গরু মাংস রাঁধে। একটু বরকত হবার জন্য, দুইটা আলুও দেয় তাতে।

রান্না শেষে খাবার আগে, গরম গরম এক পেয়ালা বেড়ে ঝুমাকে ডেকে বলে,

-যা, তোর বাবাকে দিয়ে আয়।

-কেনো?

-বারে, কেনো আবার কি! তোর বাপ না?

নিজের হাতে সে বাজার করে আনলো, একটু মাংস না দিলে কেমন লাগে?

-নিজের হাতে আনছে, নিজের টাকা দিয়ে আনে নাই। বাজারে আসা যাওয়ার গাড়ি ভাড়াটাও তো সমানভাগে নিয়ে ফেলেছে।

-বেশি কথা বলিস তুই..

যা, তোর যাওয়া লাগবেনা। আমিই দিয়ে আসছি।

-যাও যাও, তোমার এতো প্রেম আসে। আমার নাই।

-বেয়াদব মেয়ে…

বলে, রাহেলা বাটি নিয়ে দিতে যায়।

রাহেলা আসলে, মা মেয়ে খেতে বসে এবার।

-জানিস, আজ আরিফদের ঘরে কচু শাক রান্না করেছে আর শুকনো মরিচ তেলে ভেজে প্লেটে রেখেছে, দেখে এতো লোভ হলো! শুঁটকি মাছের ভর্তার খুশবোও লেগেছে নাকে। এখন আর মাংস খেতে ইচ্ছে করছেনারে।

-কেনো, তুমি মাংস নিয়েছো, ঐ বাটিতে খানিকটা দিতে পারেনি তোমার ছোট বোন?

বিদ্রুপ করেই বলে ঝুমা।

-ধুর বাদ দে, হয়তো খেয়াল করেনি।

খেতে মন চেয়েছে তাই বললাম।

-হুম।

রাহেলা’র একটা হাঁস আছে। তিন চারমাস হলো কিনে এনেছে। এই প্রথমবার ডিম দিচ্ছে। রাহেলা খুব খুশি। প্রতিদিন একটা একটা করে ডিম দেয়, সে সুন্দর করে ধুয়ে একটা মাটির হাঁড়িতে তা জমায়। 

দশটা যেদিন হয়, রাহেলা পাঁচটা ডিম পলিথিনে মুড়িয়ে নিয়ে হাঁটা দেয়।

-মা, ডিম নিয়ে কই যাও?

-তোর বাপকে দিয়ে আসি। খুশি হবে।

-তা পাঁচটা কেনো?

-বারে, ওরা পাঁচজন নাহ! একটা ডিম দেবো নাকি, কি বলিস তুই?

-মা, তুমি কি পাগল! কেনো শুধু শুধু এতো মায়া করো? তোমাকে তো ভালোবাসেনা। খাওয়ায় না, পরায়ও না,  তবুও…

-কি যা তা বলিস, আগে দিয়েছে না! এখন বেচারার টাকা পয়সা কমে গেছে, সংসার ডবল হয়েছে, কিভাবে দেবে?

-আর তুমি আমি আমরা কিভাবে চলছি? তোমার বড় মেয়ের টাকা দিয়ে, ছিঃ

যদি তোমার মেয়ে টাকা না দিতো, ভিক্ষে করতে, না?

-চুপ কর, তুই। সবসময় প্যাঁচ করিস।

-হুম, আমি প্যাঁচ করি, আর তুমি শুদ্ধ। তিন মেয়ে পেটে ধরেছো বলে, তোমার জামাই বিয়ে করেছে সেটা শুদ্ধ। আমাদের ভরণ পোষণ দেয়না সেটা শুদ্ধ। তুমি ওদের সব ছেলেমেয়েদের নিজের মনে করো সেটা শুদ্ধ। আমরা তাদের পর হয়ে গেছি সেটাও শুদ্ধ, তাইনা, মা?

-বেশি কথা না বলে,  যা ডিমগুলো দিয়ে আয়।

-না, মা, তুমি যাও।

রাহেলা ডিম দিয়ে আসে। নিজ গরজে খানিকক্ষণ বসেও আসে।

সতীনের মুড ভালো থাকলে, কখনো বসতে বলে। কিন্তু প্রায়সময় রাহেলা হেঁটে চলে আসে, সে না দেখার মতো চুপচাপ থাকে। 

তবে আরিফের মা আসলে, রাহেলা মোড়া টেনে দেবে, না পাটি বিছিয়ে বসতে দেবে, দিশেহারা হয়ে যায়। তাড়াতাড়ি চুলাতে চায়ের ডেকচি বসিয়ে দেয়!

তবে আরিফ,  রাজু, রিমা সব ছেলেমেয়েগুলো রাহেলাকে  মা মা করে পাগল। বলতে গেলে রাহেলাই তাদের কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। তারা টয়লেট করলে রাহেলা পরিষ্কার করতো বলে, ঝুমা সেই ছোটবেলা থেকেই মায়ের হাতে ভাত খেতোনা।

অনেকসময় আরিফের মা খাইয়ে দিয়েছে!

এখনো, সারাক্ষণ আরিফেরা এই ঘরে রাহেলা’র কাছে পড়ে থাকে।

 তাই ঝুমা ঘরের মধ্যেও কখনো সখনো তার বাপকে নিয়ে এটা ওটা বললে, রাহেলা’র বুক কাঁপতে থাকে। কোনওসময় ওরা এসে যদি শুনে ফেলে! তাদের নিশ্চয় এসব কথাবার্তা ভালো লাগবেনা। তাদেরও তো বাপমা।

আবার কি থেকে কি হয়ে যায়, ঝগড়া ঝাটি, তুলকালাম কান্ড বাঁধতে পারে।

তাই রাহেলা ঝুমাকে চুপ করিয়ে রাখতে চায় সবসময় ।

ঝুমা’র মনে অনেক ক্ষোভ, অনেক রাগ, কষ্ট।

হওয়ায় স্বাভাবিক। যদিও বাপকে সে কিছুই বলেনা। তবে বাপের প্রতি মায়ের প্রেম দেখলেই রাগে গা জ্বলে যায় তার।

জ্বলবেনা! দ্বিতীয় বিয়ের পর মা, স্বামী কি জিনিষ, সেভাবে আর একবারের জন্যও পায়নি।

সধবা হয়েও বিধবা হয়ে থেকেছে এতোটা বছর।

ঝুমা’র মেজবোন আসমা’র বিয়েতে বাবা সামান্যই খরচ করেছে। বিয়ের পরের আসা যাওয়া, বারো মাসের এতো এতো ফলফলাদি, নাস্তা, দেয়া তোয়া কিছুই আর ফিরেও তাকাইনি। মা কোত্থেকে দেবে! 

তাই আসমা একেকবার নাইওর আসলে, মায়ের হাতে বিয়েতে পড়া উপহারের, কখনো একটি আংটি, কখনো ছোট একজোড়া স্বর্ণের দুল দিয়ে যেতো। বিক্রি করে ঐসব খরচ করার জন্য।

আসমাকে বিয়ে দিয়েছে ভরা ঘরে। তাই কেউ কিছু খোঁটা দেবার আগেই সে চাহিদা পূরণ করার চেষ্টা করতো এভাবে । কখনো রেশমা ঘর খরচের টাকা দিলে, সেখান থেকেও মা খরচ করতো। মাস শেষে আবার অন্যের দ্বারস্থও হতে হতো, টাকা ধারের জন্য!

রেশমা তার বরের সাথে বিদেশ আছে, চাকরি করে বলেই, মায়ের জন্য কিছু টাকা পাঠাতে পারছে।

এরপরেও রাহেলা’র স্বামীর বিরুদ্ধে কোনো আক্ষেপ নেয় যেন।

একদিন ঘরের সামনে দিয়ে স্বামী হেঁটে না গেলে, তার গলার আওয়াজ না শুনলে সে অস্থির হয়।

বলে,

-যাই, তোর বাপকে একটু দেখে আসি। আজতো রাস্তা দিয়ে হাঁটতে দেখলামনা, আমাদের ঘরেও আসেনি। মনে হয় শরীর খারাপ।

-যাও মা, দেখে আসো। পারলে কাউকে দিয়ে কিছু ফলমূল কিনে এনে দেখতে যাও।

-তুই সবসময় বেশি কথা বলিস কেনো?

-বেশি কথায় বলি মা। আর তো কিছু করতে পারবোনা।

কলেজ শেষ হয়। একসময় বোনরা মিলে এবং খুবই সামান্য, না দিলে ভালো দেখায়না, এমন পরিমাণ টাকা খরচ করে বাপও তাকে বিদায় দেয়। বিয়ে হয়ে যায় ঝুমা’র।

বড় মেয়ে রেশমা, মায়ের চোখের অপারেশন করার জন্য টাকা পাঠায়, চোখের জ্যোতি একেবারে নিভে যাচ্ছিলো মায়ের।

অপারেশন শেষে ঝুমাকে একদিন রাহেলা বলে,

-একটা কথা বলবো, রাগ করবি নাতো?

-কি কথা মা, বলো…। রাগ করবো কেনো?

-এতো বছর আমি ভেবেছি, তুই এবং আমার সব সন্তান, সব মানুষ অনেক কালো। কিন্তু এখন দেখছি, মাশাআল্লাহ তোরা সবাই খুব সুন্দর।

-তাই মা! আমিও কি সুন্দর?

-অবশ্যই সুন্দর।

মায়ের কথা শুনে ঝুমা হাসে।

-মা, তুমি কি নিজেকে আয়নায় দেখেছো? তুমি নিজেও এখনো অনেক বেশি সুন্দরী।

-ধুর, আমি তো বুড়ি হয়ে গেছি।

-বুড়ো হলেও সুন্দর আছো অনেক।

মাও হাসেন।

এক রাতে খাবার খেয়ে, রাহেলা শুতে যাবে। 

হঠাৎ কেমন যেন খারাপ লাগতে থাকে। 

কেমন যেন লাগে, অস্থির অস্থির। তিন মেয়েকে পাশে পেতে, কাছে পেতে ইচ্ছে করে।বুকে খুব করে জড়িয়ে অস্থির বুকটা শান্ত করতে ইচ্ছে করে।

 রেশমা’র বাপকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে। বুকটা খালি খালি লাগে, কেমন হাহাকার করছে, মনে হয়।

ঘরে আরিফ ছিলো। তিনি আরিফকে ডেকে বলেন,

-এদিকে আয় বাপ, আমার কাছে আয়। আমাকে একটু ধর। ধরে তোদের ঘরে, তোর বাপের কাছে নিয়ে যা। আমার শরীর খুব খারাপ লাগছে।  তোর বাপকে দেখতে ইচ্ছে করছে, তাড়াতাড়ি নিয়ে যা, সময় নেয়, তাড়াতাড়ি।

আরিফ কি করবে, দিশেহারা হয়ে পড়ে। বড়মায়ের কথা মতো জড়িয়ে ধরে তাদের ঘরে নিয়ে যায়।

রাহেলা, স্বামী’র কাছে গিয়েই যেন একেবারে ঢলে পড়ে, তার শরীরের সব শক্তি নি:শেষ হয়ে গেছে মনে হয়। 

স্বামীও তাকে ধরে রাখে।

অস্ফুট স্বরে রেহালা বলে, 

-রেশমা’র বাপ, আমাকে মাফ করে দিও, অপরাধ যদি কিছু করি, মাফ করে দিও।

তার চোখ বন্ধ হয়ে আসতে চায়। 

প্রায় পঁচিশ বছর পর স্বামী’র বাহুডোরে সে!

এ যেন বেহেশতের স্পর্শ, সান্নিধ্য! 

এতো আরাম লাগছে তার,  এতো ভালো লাগছে। সুখে বারবার চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে।

স্বামীও মাফ করে দিও জাতীয় কিছু বলেন। সে হালকা শুনতে পায়। তা কি আর বলতে হবে? সেতো কবেই মাফ করে দিয়েছে!

স্বামী  একটু পানিও পান করায় রাহেলাকে। আরিফের মাও মুখে পানি দেয় চামুচ দিয়ে ।

রাহেলা’র এখন সুখ আর সুখ। এতো সুখ যে, নি:শ্চিন্তে ঘুম এসে যাচ্ছে। কোথাও কোনো কষ্ট নেয়। ভারী ভারী লাগা মনটা মুহূর্তেই একেবারে হালকা হয়ে গেছে। মেয়েদের কথাও আর মনে আসেনা। 

শেষ মুহূর্তে তার প্রিয় স্বামী’র বাহুডোরে জড়ানো অবস্থায় চোখ বন্ধ করা, কয়টা মেয়ের কপালে জোটে!

#বহ্নি শিখা

১৫.০১.১৮

-আজ একটু বাজার করে আনবে, রেশমা’র বাপ?

-সবসময় তোমাদের বাজার লাগে কেনো শুনি? মোটে তো মা মেয়ে দুইজন!

-তুমি তো গত দুইবার হাঁটে গেছো, আমাকে তো একবার জিজ্ঞেসও করো নাই। আমিও সামান্য বাজার ছিলো বলে, তোমাকে যেতে দেখেও দাঁড় করাই নাই। অনেকদিন পরই না আজ বললাম।

কিছুটা অভিমানের সুরেই বলে রাহেলা।

-আচ্ছা, যাও। প্যাঁচাল পেরোনা, টাকা, থলে আর বাজারে কি কি লাগবে লিস্টি লিখে নিয়ে আসো।

-তিন চারটে মোটে বাজার!

-যাও তো, যা বলছি তা করো। তুমি বেশি কথা বলো।

রেশমা’র মা দৌড়ে টাকা আনতে যেতে, দরজার সাথে ধাক্কা খায়।

আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ..

বলে, সে বসে পড়ে। 

আর রেশমা’র বাপ, মোটামুটি   উচ্চস্বরেই বলে,

-আন্ধি…

রেশমা’র মা, রাহেলা চোখে কম দেখে। কম মানে অনেক কম, ঝাপসা ঝাপসা। 

এতো বছরের চেনা ঘর, পথ ঘাট, পরিচিত সব মানুষজন বলে, মনের জোরে আন্দাজে চলাফেরা করে। এরপরেও প্রায়সময় ধাক্কা খেয়ে ব্যথায় কুঁকড়ে যায়।

প্রতিবার ব্যথা পেয়ে সে আলহামদুলিল্লাহ বলবেই।

ছোট মেয়ে ঝুমা জিজ্ঞেস করে,

-মা, ব্যথা পেয়েছো, তাতে কষ্ট হলো তোমার। আলহামদুলিল্লাহ বলো কি কারণে?

-মারে, আমি তো খুব অল্প ব্যথা পেয়েছি। আরো অনেক বেশি আঘাত পেতে পারতাম। পাই নাই, সে কারণে আল্লাহ’র কাছে শোকরিয়া আদায় করি। যতো বড় কষ্ট পাসনা কেনো, শোকর করবি, ধৈর্য ধরবি। দেখবি, খুব সহজে বড় বিপদ থেকে রক্ষা পাবি।

হয়তো মায়ের কথাই ঠিক, কিন্তু ঝুমা’র মাথায় এতো কঠিন কথা ঢুকেনা।

অথচ, একটা সময় লোডশেডিং হলে,  চাঁদনি রাতের আলোতে দিব্যি খালি চোখে উঠোনে বসে কোরান পড়তো রাহেলা।

রেশমা’র বাপ বাজার এনে, দুয়ারে ঝুমাকে ঢেকে হাতে ধরিয়ে দিয়ে, তাদের নিজের জন্য আনা বাজার নিয়ে দ্বিতীয় পক্ষ আরিফের মায়ের ঘরে ঢুকে যান।

রেশমা’র মা, তাদের জন্য আজ এক কেজি গরুর মাংস আনিয়েছে। যদিও গরুর মাংসের বাজারদর খুব বেশি। তবুও মাঝেমধ্যে এক, দেড় কেজি আনতে বলে সে। কারণ, রেশমা’র মা, রাহেলা ছোটকাল থেকেই মাছ বেশি খেতে পারেনা, গন্ধ লাগে তার। মাছ দিয়ে ভাত খাবার পর সুপারি নয়তো আচার মুখে না দিলে তার বমি হয়ে যাবে মনে হয়।

সে মুরগি’র মাংসও খায়না। ফার্মের মুরগি বিক্রি শুরু হবার পর থেকে, দেশি মুরগির দাম বেড়েছে হুহু করে, তাই তাও খাওয়া প্রায় অসম্ভব! 

ফার্মের মুরগি কুটতে গেলেই তার গন্ধে বমি আসে, মুখে দেবে তো পরের কথা। এরপরেও ঝুমা’র জন্য আনতে হয়।

সবজি আর ডিম দিয়ে আর কতো খাওয়া যায়!

ছোট মেয়ে ঝুমাও হয়েছে মায়ের মতো, মাছ একদম খেতে চায়না।

রাহেলা সুন্দর করে গরু মাংস রাঁধে। একটু বরকত হবার জন্য, দুইটা আলুও দেয় তাতে।

রান্না শেষে খাবার আগে, গরম গরম এক পেয়ালা বেড়ে ঝুমাকে ডেকে বলে,

-যা, তোর বাবাকে দিয়ে আয়।

-কেনো?

-বারে, কেনো আবার কি! তোর বাপ না?
নিজের হাতে সে বাজার করে আনলো, একটু মাংস না দিলে কেমন লাগে?

-নিজের হাতে আনছে, নিজের টাকা দিয়ে আনে নাই। বাজারে আসা যাওয়ার গাড়ি ভাড়াটাও তো সমানভাগে নিয়ে ফেলেছে।

-বেশি কথা বলিস তুই..

যা, তোর যাওয়া লাগবেনা। আমিই দিয়ে আসছি।

-যাও যাও, তোমার এতো প্রেম আসে। আমার নাই।

-বেয়াদব মেয়ে…

বলে, রাহেলা বাটি নিয়ে দিতে যায়।

রাহেলা আসলে, মা মেয়ে খেতে বসে এবার।

-জানিস, আজ আরিফদের ঘরে কচু শাক রান্না করেছে আর শুকনো মরিচ তেলে ভেজে প্লেটে রেখেছে, দেখে এতো লোভ হলো! শুঁটকি মাছের ভর্তার খুশবোও লেগেছে নাকে। এখন আর মাংস খেতে ইচ্ছে করছেনারে।

-কেনো, তুমি মাংস নিয়েছো, ঐ বাটিতে খানিকটা দিতে পারেনি তোমার ছোট বোন?

বিদ্রুপ করেই বলে ঝুমা।

-ধুর বাদ দে, হয়তো খেয়াল করেনি।

খেতে মন চেয়েছে তাই বললাম।

-হুম।

রাহেলা’র একটা হাঁস আছে। তিন চারমাস হলো কিনে এনেছে। এই প্রথমবার ডিম দিচ্ছে। রাহেলা খুব খুশি। প্রতিদিন একটা একটা করে ডিম দেয়, সে সুন্দর করে ধুয়ে একটা মাটির হাঁড়িতে তা জমায়। 

দশটা যেদিন হয়, রাহেলা পাঁচটা ডিম পলিথিনে মুড়িয়ে নিয়ে হাঁটা দেয়।

-মা, ডিম নিয়ে কই যাও?

-তোর বাপকে দিয়ে আসি। খুশি হবে।

-তা পাঁচটা কেনো?

-বারে, ওরা পাঁচজন নাহ! একটা ডিম দেবো নাকি, কি বলিস তুই?

-মা, তুমি কি পাগল! কেনো শুধু শুধু এতো মায়া করো? তোমাকে তো ভালোবাসেনা। খাওয়ায় না, পরায়ও না,  তবুও…

-কি যা তা বলিস, আগে দিয়েছে না! এখন বেচারার টাকা পয়সা কমে গেছে, সংসার ডবল হয়েছে, কিভাবে দেবে?

-আর তুমি আমি আমরা কিভাবে চলছি? তোমার বড় মেয়ের টাকা দিয়ে, ছিঃ

যদি তোমার মেয়ে টাকা না দিতো, ভিক্ষে করতে, না?

-চুপ কর, তুই। সবসময় প্যাঁচ করিস।

-হুম, আমি প্যাঁচ করি, আর তুমি শুদ্ধ। তিন মেয়ে পেটে ধরেছো বলে, তোমার জামাই বিয়ে করেছে সেটা শুদ্ধ। আমাদের ভরণ পোষণ দেয়না সেটা শুদ্ধ। তুমি ওদের সব ছেলেমেয়েদের নিজের মনে করো সেটা শুদ্ধ। আমরা তাদের পর হয়ে গেছি সেটাও শুদ্ধ, তাইনা মা?

-বেশি কথা না বলে,  যা ডিমগুলো দিয়ে আয়।

-না, মা, তুমি যাও।

রাহেলা ডিম দিয়ে আসে। নিজ গরজে খানিকক্ষণ বসেও আসে।

সতীনের মুড ভালো থাকলে, কখনো বসতে বলে। কিন্তু প্রায়সময় রাহেলা হেঁটে চলে আসে, সে না দেখার মতো চুপচাপ থাকে। 

তবে আরিফের মা আসলে, রাহেলা মোড়া টেনে দেবে, না পাটি বিছিয়ে বসতে দেবে, দিশেহারা হয়ে যায়। তাড়াতাড়ি চুলাতে চায়ের ডেকচি বসিয়ে দেয়!

তবে আরিফ,  রাজু, রিমা সব ছেলেমেয়েগুলো রাহেলাকে  মা মা করে পাগল। বলতে গেলে রাহেলাই তাদের কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। তারা টয়লেট করলে রাহেলা পরিষ্কার করতো বলে, ঝুমা সেই ছোটবেলা থেকেই মায়ের হাতে ভাত খেতোনা।

অনেকসময় আরিফের মা খাইয়ে দিয়েছে!

এখনো, সারাক্ষণ আরিফেরা এই ঘরে রাহেলা’র কাছে পড়ে থাকে।

তাই ঝুমা ঘরের মধ্যেও কখনো সখনো তার বাপকে নিয়ে এটা ওটা বললে, রাহেলা’র বুক কাঁপতে থাকে। কোনওসময় ওরা এসে যদি শুনে ফেলে! তাদের নিশ্চয় এসব কথাবার্তা ভালো লাগবেনা। তাদেরও তো বাপমা।

আবার কি থেকে কি হয়ে যায়, ঝগড়া ঝাটি, তুলকালাম কান্ড বাঁধতে পারে।

তাই রাহেলা ঝুমাকে চুপ করিয়ে রাখতে চায় সবসময় ।

ঝুমা’র মনে অনেক ক্ষোভ, অনেক রাগ, কষ্ট।

হওয়ায় স্বাভাবিক। যদিও বাপকে সে কিছুই বলেনা। তবে বাপের প্রতি মায়ের প্রেম দেখলেই রাগে গা জ্বলে যায় তার।

জ্বলবেনা! দ্বিতীয় বিয়ের পর মা, স্বামী কি জিনিষ, সেভাবে আর একবারের জন্যও পায়নি।

সধবা হয়েও বিধবা হয়ে থেকেছে এতোটা বছর।

ঝুমা’র মেজবোন আসমা’র বিয়েতে বাবা সামান্যই খরচ করেছে। বিয়ের পরের আসা যাওয়া, বারো মাসের এতো এতো ফলফলাদি, নাস্তা, দেয়া তোয়া কিছুই আর ফিরেও তাকাইনি। মা কোত্থেকে দেবে! 

তাই আসমা একেকবার নাইওর আসলে, মায়ের হাতে বিয়েতে পড়া উপহারের, কখনো একটি আংটি, কখনো ছোট একজোড়া স্বর্ণের দুল দিয়ে যেতো। বিক্রি করে ঐসব খরচ করার জন্য।

আসমাকে বিয়ে দিয়েছে ভরা ঘরে। তাই কেউ কিছু খোঁটা দেবার আগেই সে চাহিদা পূরণ করার চেষ্টা করতো এভাবে । কখনো রেশমা ঘর খরচের টাকা দিলে, সেখান থেকেও মা খরচ করতো। মাস শেষে আবার অন্যের দ্বারস্থও হতে হতো, টাকা ধারের জন্য!

রেশমা তার বরের সাথে বিদেশ আছে, চাকরি করে বলেই, মায়ের জন্য কিছু টাকা পাঠাতে পারছে।

এরপরেও রাহেলা’র স্বামীর বিরুদ্ধে কোনো আক্ষেপ নেয় যেন।

একদিন ঘরের সামনে দিয়ে স্বামী হেঁটে না গেলে, তার গলার আওয়াজ না শুনলে সে অস্থির হয়।

বলে,

-যাই, তোর বাপকে একটু দেখে আসি। আজতো রাস্তা দিয়ে হাঁটতে দেখলামনা, আমাদের ঘরেও আসেনি। মনে হয় শরীর খারাপ।

-যাও মা, দেখে আসো। পারলে কাউকে দিয়ে কিছু ফলমূল কিনে এনে দেখতে যাও।

-তুই সবসময় বেশি কথা বলিস কেনো?

-বেশি কথায় তো বলি মা। আর তো কিছু করতে পারবোনা।

কলেজ শেষ হয়। একসময় বোনরা মিলে এবং খুবই সামান্য, না দিলে ভালো দেখায়না, এমন পরিমাণ টাকা খরচ করে বাপও তাকে বিদায় দেয়। বিয়ে হয়ে যায় ঝুমা’র।

বড় মেয়ে রেশমা, মায়ের চোখের অপারেশন করার জন্য টাকা পাঠায়, চোখের জ্যোতি একেবারে নিভে যাচ্ছিলো মায়ের।

অপারেশন শেষে ঝুমাকে একদিন রাহেলা বলে,

-একটা কথা বলবো, রাগ করবি নাতো?

-কি কথা মা, বলো…। রাগ করবো কেনো?

-এতো বছর আমি ভেবেছি, তুই এবং আমার সব সন্তান, সব মানুষ অনেক কালো। কিন্তু এখন দেখছি, মাশাআল্লাহ তোরা সবাই খুব সুন্দর।

-তাই ! আমিও কি সুন্দর?

-অবশ্যই সুন্দর।

মায়ের কথা শুনে ঝুমা হাসে।

-মা, তুমি কি নিজেকে আয়নায় দেখেছো? তুমি নিজেও এখনো অনেক বেশি সুন্দরী।

-ধুর, আমি তো বুড়ি হয়ে গেছি।

-বুড়ো হলেও সুন্দর আছো অনেক।

মাও হাসেন।

এক রাতে খাবার খেয়ে, রাহেলা শুতে যাবে। 

হঠাৎ কেমন যেন খারাপ লাগতে থাকে। 

কেমন যেন লাগে, অস্থির অস্থির। তিন মেয়েকে পাশে পেতে, কাছে পেতে ইচ্ছে করে। বুকে খুব করে জড়িয়ে অস্থির বুকটা শান্ত করতে ইচ্ছে করে।

রেশমা’র বাপকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে। বুকটা খালি খালি লাগে, কেমন হাহাকার করছে, মনে হয়।

ঘরে আরিফ ছিলো। তিনি আরিফকে ডেকে বলেন,

-এদিকে আয় বাপ, আমার কাছে আয়। আমাকে একটু ধর। ধরে তোদের ঘরে, তোর বাপের কাছে নিয়ে যা। আমার শরীর খুব খারাপ লাগছে। তোর বাপকে দেখতে ইচ্ছে করছে, তাড়াতাড়ি নিয়ে যা, সময় নেই, তাড়াতাড়ি।

আরিফ কি করবে, দিশেহারা হয়ে পড়ে। বড়মায়ের কথা মতো জড়িয়ে ধরে তাদের ঘরে নিয়ে যায়।

রাহেলা, স্বামী’র কাছে গিয়েই যেন একেবারে ঢলে পড়ে, তার শরীরের সব শক্তি নি:শেষ হয়ে গেছে মনে হয়। 

স্বামীও তাকে ধরে রাখে।

অস্ফুট স্বরে রেহালা বলে, 

-রেশমা’র বাপ, আমাকে মাফ করে দিও, অপরাধ যদি কিছু করি, মাফ করে দিও।

তার চোখ বন্ধ হয়ে আসতে চায়। 

প্রায় পঁচিশ বছর পর স্বামী’র বাহুডোরে সে!

এ যেন বেহেশতের স্পর্শ, সান্নিধ্য! 

এতো আরাম লাগছে তার,  এতো ভালো লাগছে। সুখে বারবার চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে।

স্বামীও মাফ করে দিও জাতীয় কিছু বলেন। সে হালকা শুনতে পায়। তা কি আর বলতে হবে? সেতো কবেই মাফ করে দিয়েছে!

স্বামী  একটু পানিও পান করায় রাহেলাকে। আরিফের মাও মুখে পানি দেয় চামুচ দিয়ে ।

রাহেলা’র এখন সুখ আর সুখ। এতো সুখ যে, নি:শ্চিন্তে ঘুম এসে যাচ্ছে। কোথাও কোনো কষ্ট নেয়। ভারী ভারী লাগা মনটা মুহূর্তেই একেবারে হালকা হয়ে গেছে। মেয়েদের কথাও আর মনে আসেনা। 

শেষ মুহূর্তে তার প্রিয় স্বামী’র বাহুডোরে জড়ানো অবস্থায় চোখ বন্ধ করা, কয়টা মেয়ের কপালে জোটে!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত