-আইচ্ছা বাবা আমাগো গরুডা কিছু খাইতে চায়না কেন? আর সারাদিন খালি কান্দে। ছেলের মুখে এই কথা শুনে নিজেরও চোখের এক কোণে পানি চলে আসছিল রহিম মিয়াঁর। ছেলেকে সান্তনা দিতে বলে,
-বাবা আমগো গরুটা হাটে ব্যাইচ্চা দেমু। এইডা কোরবানী হইব।আর কোরবানীর আগে গরুরা এমনে কান্দে।
-কেন বাবা ব্যাইচ্চা দিবা কিহারে?
-দেখ বাবা, আমরা গরুডা কিনছি তো কোরবানির হাটে ব্যাইচ্চা দেওয়ার লাইগা। এইডা ব্যাচলে আমরা অনেক টেকা পামু। তোর স্কুলের টেকা দিতে আর দেরি হইব না। তোরে নতুন নতুন জামা কাপড়ও কিন্না দেমু।
বাবার মুখে নতুন জামা কাপড়ে কথা শুনে মিঠুর মন ভরে উঠল। কিন্তু গরুর প্রতি মায়াটা ঠিকই কাজ করছে। তাই আবারও বলে,
-আমার নতুন জামা লাগবনা। তুমি গরুডা ব্যাইচ্চ না। রহিম মিঁয়া ছেলেকে বুজিয়ে বলে,
-বাবা আমরা গরিব মানুষ, এই গরুডা তোর বড় খালার থাইক্কা টেকা হাওলাত আইন্যা কিনছি। তোর খালার টেকা ফিরাইয়া দিতে হইব। আমরা গরুডা ব্যাইচ্চা মেলা টেহা পামু। এইহান থাইক্কা তোর খালার টেকাটা ফিরত দিয়া বাহি টেকা দিয়া আমগোর ঘরের ভাঙ্গা টিন গুলা পাল্টাইয়া নতুন টিন লাগামু। মেঘ আইলে আর আমাগো ঘরে পানি পড়ব না।তোরে ঈদের নতুন জামা কিন্না দেমু আর তোর মারে একটা শাড়ি কিন্না দেমু। হেই যে তুই হইবার পর একটা শাড়ি আইন্না দিছি আরতো দিতে পারলাম না।
– তাইলে আমাগো কষ্ট কমব। তাইনা?
-হ রে বাজান।
-আইচ্ছা বাবা তোমার লাইগা কিছু কিনতানা?
-না বাজান। আমার কিছু লাগত না।
-তুমিও নতুন পাঞ্জাবি কিন্না নিও। আমরা সবাই নতুন কাপড় পইড়া এইবার নানাগো বাড়ি বেড়াইতে যামু। কতো মহা হইব। না বাবা??
-আইচ্ছা বাজান আমিও কিনমু। এহন যা-তো গরুডার লাইগ্গা কয়ডা ঘাস কাইট্টা লইয়া আয়। বেশি কইরা খাওয়াইতে হইব। বেশি কইরা খাওয়াইলে না বেশি টেকা পাইতাম।
বাবার কথা শুনে মিঠু কাচিঁ-টুকরি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল গরুর জন্য ঘাস আনতে। এ কাজটা মিঠু খুব আনন্দেই করে। গরুর প্রতি মায়া থেকে সে এই কাজটা করে। গরুর দেখাশোনাটা সে একটা দায়িত্বের মতো নিয়ে নিয়েছে। নিয়ম করে খড় দেয়া,ঘাস দেয়া সবকিছু সে নিজেই করে। বাবা মহল্লা মহল্লা ঘুরে ঘুরে বিছানার চাদর,কাভার,বালিশ বিক্রি করে বলে সকালে বেড়িয়ে পড়ে। ফিরতে কোনদিন রাতও হয়। আর মা সংসারের অন্যকাজে ব্যস্ত থাকলেও যখন গরুর গোবর ফালানো, গোছল করানো ইত্যাদি কাজগুলো করে তখনও মিঠু তার মায়ের সাথে সাহায্য করে।
একবার গরুর শরীর খারাপ ছিল,সেদিন মিঠু খুব কান্না করছে।তার বাবাকে বলে, বাবা আমাগো গরুডা কি মইরা যাইব। বাবা বলে,এমনে কয় না বাজান। আমি গঞ্জে যাইতাছি পশু ডাক্তার আনতে। দেখিস আল্লাহর রহমতে আমাগো গরু ভালা হইয়া যাইব।
তার পর থেকে গরুর প্রতি মিঠুর যত্ননা আরও বেড়ে যায়। কাল সকালে গরু নিয়ে বাজারে যাবে। মিঠুও তার বাবার সাথে যাবে। গরু বাজার তার খুব ভালো লাগে। সেখানে সে অসংখ্য গরু একসাথে দেখে। অনেক গরু যেগুলা সাজানো থাকে ফুলের তোড়া দিয়ে।সাথে মাথায় একটা আয়নাও বসানো থাকে। সেখানে হাজারো মানুষের ভিড়াভিড় ।এ সব কিছু সে খুব কৌতুহল নিয়েই দেখে। গরু বাজারে নিয়ে যাওয়ার কথা বলায় মিঠুর মাথায়ও গরু সাজানো বুদ্ধি আসল। তাই বাবাকে বলে,
-বাবা আমরাও আমাগো গরুডা সাজাইয়া বাজারে বেচতে নেমু। তাইলে টেকা আরও বেশি পামু। ছেলেকে খুশি করতে রহিম ছেলে কথায় সম্মতি জ্ঞাপন করে বললেন,
-আইচ্ছা বাজান আমরাও গরু সাজাইয়া নেমু।
পরদিন সকালে মিঠু সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে গেল। চোখ কচলাতে কচলাতে সে গোয়াল ঘরের সামনে গেল। গিয়ে দেখল ঘরের তালা ভাঙ্গা। তারপর ভেতরে ঢুকে দেখে গরু নাই। দৌড়িয়ে বাবার কাছে আসে। আর কাঁদতে কাঁদতে বলে,বাবা আমাগো গরু চুরি হইয়া গেছে। রহিম মিঁয়া এক দৌড়ে গোয়াল ঘরে যায়। গিয়ে দেখে স্যতিই তালা ভাঙ্গা আর গরুর রশি ছুড়ি দিয়ে কাটা। রহিম মিয়া এক চিৎকার দিয়ে মাটিতে বসে পড়লেন। আর দুই হাতে কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বললেন। আল্লাগো! আমার সব শেষ। রহিম মিয়াঁর ঘরের ফুটো চাল আর বদলানো হলোনা। হলোনা ঈদে নতুন কাপড় কিনে ছেলের হাসিমুখ দেখা।