ছুঁয়ে জ্যোৎস্নার ছায়া

ছুঁয়ে জ্যোৎস্নার ছায়া

মাহের আমার চেয়ে বারো বছরের বড়। আমি মাহের কে ভালবাসি। এই ভালবাসা এতোটাই দৃঢ়, মাঝেমাঝে আমার মাহেরের জন্য মরে যেতে ইচ্ছে করে। ঘটনার শুরু আজ থেকে না, এই বীজ আমার মাঝে হয়তো ছেলেবেলা থেকেই লুকানো ছিল। মাহের আমার ফুপাতো ভাই, সবাই ওকে, বড় ভাই মেজো ভাই বা ভাইয়া ডাকলেও ও ছিলো আমার কাছে শুধু মাহের। চার বছর বয়সী আমাকে ও কোলে নিয়ে বেড়াতো। কেউ যদি আমায় জিজ্ঞেস করতো, তোমার বরের নাম কি! আমি উত্তর দিতাম – মাহের, মাহের।

ফুপুও আমাকে ‘আমার বৌমা, আমার বাড়ির বৌ কইগো? বলে ডাকতেন। কেউ কিছু মনে করতো না। আমার বয়স যখন ‘ ছয় ‘ তখন মাহের বাংলাদেশ এগ্রিকালচার ভার্সিটিতে পড়তে চলে যায়। যাওয়ার আগে, আমার গাল টেনে বলে যায় যাই বৌ, লক্ষ্মী হয়ে থাকিস। এর কিছুদিন পরেই আমরা ঢাকায় চলে আসি। মাহের ময়মনসিংহ থেকে সরাসরি রাজশাহী চলে যেতো। তাই দেখা হতো খুব কম।

আমার বয়স বারো, আজকাল ‘ ভালোবাসা’ শব্দ টা শুনলেই গাল লাল হয়। এক ঈদে রাজশাহীতে আমার সাথে মাহেরের দেখা হয়ে গেলো। সবাই চাঁদ রাতে মার্কেটে চুড়ি মালা কিনতে গেলো। মাহের যাচ্ছে না। তাই আমি বাসায় রয়ে গেলাম। ঈদের দিন মাহেরের পা ছুঁয়ে সালাম করলাম, ও অনেক সাধলেও আমি সালামি নিলাম না। পনেরো’র আমি স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম। প্রায় স্বপ্নই মধুর, কিন্তু কষ্টের। স্বপ্নে আমি আর মাহের যেন বর বৌ, কখনো, সাজেক, কখনো নীলাচল ওর হাত ধরে ঘুরে বেড়াতাম।

এর মাঝে মাহেরের সাথে দুবার দেখা হয়েছে, ও ভীষণ আনন্দপ্রিয়। ও সবার সাথে সাপ লুডু খেলছে, বা বাজি ধরে ঝাল ফুঁচকা খাচ্ছে, আমি মুগ্ধ হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। একদিন শুনি মাহের একটি মেয়েকে পছন্দ করে। আমার মাথা খারাপের মতো হয়ে গেল। সারাদিন কাঁদলাম। তারপর সন্ধ্যেয় এগুলো মন্দ লোকেদের রটনা। এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম।

মাহের আজকাল চাকরি করে। হঠাৎ আমাদের বাসায় আসে। একদিন বিকেলে ঘুমিয়ে আছি। কলিংবেলের শব্দে ঘুম ভেঙেছে। ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুলে দেখি মাহের এসেছে। ওকে দেখেই আমি কাঁপতে থাকলাম, আবেগে চোখে জল এসে গেল। মাহের অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ তোর কি হয়েছে রে অনু, আমার দিকে তাকাতো একবার! ‘ আমি তাকাতে পারলাম না। পালিয়ে গেলাম।

আমার বয়স এখন বিশ, আমি মাহের কে আগের চেয়েও বেশি ভালবাসি। প্রতিদিন অপেক্ষায় থাকি ও কবে আসবে। রাতে স্বপ্ন দেখতাম দুজন একসাথে হাত ধরে ঝিল পাড়ে হাঁটছি। একদিন কাংখীত কল এলো, মাহের ফোনে আমায় ডাকলো। ‘ অনু কাল আমি এক জায়গায় যাবো, তুই যাবি আমার সাথে! আমি ওর কণ্ঠের মুগ্ধতায় পাগল হতে হতে বললাম ‘ হ্যা যাবো। ” কাল তৈরি থাকবি ঠিক সকাল সাতটায়। আমি তোদের বাসার সামনে বাস স্ট্যান্ডে অপেক্ষা করবো। আমি হাতে মেঘমালা পাওয়ার মত খুশি হলাম। আবেগে কাঁপছি তখন। কোনমতে বললাম ‘ আসবো। ‘

পরদিন খুব ভোরে রেডি হয়ে নিলাম। অবাধ্য চুলগুলো কাঁটায় আঁটকে একটা হলুদ সালোয়ার কামিজ পড়লাম। আমি জানি হলুদ তার প্রিয় রং ঘড়িতে দেখি সাতটা বাজে। আমি দৌড়ে বাসা থেকে বের হলাম। বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছলাম সাতটা দশে। সে মনে হয় খুব বিরক্ত। ডাব ওয়ালার সাথে ঝামেলা পাকিয়েছে। রাগে ওর নাকের পাতলা চামড়া তিরতির করে লাফাচ্ছে। আমি ভয়ে চুপ হয়ে গেলাম। ও আমাকে দেখে শুধু ঘড়ির দিকে তাকালো। তারপর ডাকলো ” আয়। ”

দুজন রিক্সায় যাচ্ছি। পাশ দিয়ে আচার ওয়ালা, আইসক্রিম ওয়ালা, ঘণ্টি বাজিয়ে চলে যাচ্ছে। সামনেই একটা আলুপুড়ির দোকান। মাহের একবার আমার দিকে চাইলো। আটটায় বাস। আমরা আর একটু হলেই ফেল করতাম। হুড়মুড় করে বাসে উঠলাম। মাহের টিকিট কেটে নিয়ে এলো। আমি বসে আছি ও দাঁড়িয়ে। বেশ খানিকক্ষণ পরে আমার পাশের সিটের লোকটি উঠে যেতেই মাহের ওখানে বসল। আর জানালায় মাথা রেখে দিব্যি ঘুমিয়ে গেল। আমি শক্ত হয়ে বসে ওকে পাহারা দিলাম। যেন ও অচিন দেশের রাজপুত্তর মায়া বলে কোন ডাইনী ওকে ঘুম পারিয়ে গেছে। আমি ওর দিকে চেয়ে রইলাম। সেই কালঘুম ভাঙবার।

সকাল দশটার মাঝে ময়মনসিংহ চলে এলাম। এর মাঝে মাহেরের ঘুম ভেঙেছে। সে কানে হেড ফোন লাগিয়ে আনমনে গান শুনছিল। বাস থেকে নেমে আমরা একটা রেষ্টুরেন্ট এ গেলাম। নাস্তা খেতে গিয়ে ও আমার দিকে মেন্যু কার্ড এগিয়ে দিল। পরোটার দাম নিয়ে ওয়েটার কে ধমক দিল। এক ধমকেই আমার অবস্থা খারাপ। কোন মতে একটু খেয়েই আবার রিক্সা। গন্তব্য কৃষি ভার্সিটি। দুইপাশে গাছ আর মাঝখানে পথ, কি অপূর্ব জায়গা। আমি কেন এখানে ভর্তি হলাম না এই ভেবে যখন নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছি, তখনই একটা পুরাতন বিল্ডিং এর সামনে রিক্সা থামলো।

আমাকে দাঁড়া করিয়ে মাহের ভেতরে চলে গেল। এর মাঝে দুটি ছেলে আমায় অনেকক্ষণ হল বিরক্ত করছে। আমি অচেনা জায়গায় ভয়ে ভয়ে শুধু বিল্ডিং এর দিকে তাকাই। একসময় মাহের বের হয়ে এলো। ওর মুখ হাসি হাসি। কিন্তু আমার মুখের দিকে চেয়েই যা বোঝার বুঝে গেল। সোজা ওই দুই ছেলেকে দুই হাতে দুজনের কলার চেপে ধরল। বাইরে থেকে এসে ভার্সিটিতে বদমাইশি? ফোট এখুনি। নইলে টুঁটি ছিঁড়ে ফেলবো। ছেলে দুটি পালিয়ে গেল। আমরা আরো দুইঘণ্টা ভার্সিটিতে ঘুরলাম। দুপুরে খেয়ে যখন আবার বাসে উঠেছি। তখন দিগন্তে সূর্য গড়াচ্ছে। মাহের আমায় ডাকল ‘ অনু ‘ তোকে কেন এনেছিলাম জানিস? আমি উৎসুক চোখ মেলে তাকালাম।

‘ আমি তোর চেয়ে একযুগের বড়। আমার ভাল লাগা ব্যাপারটা যখন শুরু হয়েছে। তখন তুই হাঁটতে শিখেছিস। আমি যখন কলেজে কিশোরীদের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় বাসায় এসে ঘামি, তখন তুই কথা বলতে পারিস স্পষ্ট। আমি যখন ভার্সিটি, সেবার তুই স্কুলে ভর্তি হলি। একেবারে শিশু। আমি যখন আমার সাথে পড়ুয়া মেয়ের চুলের দৈর্ঘ্য মাপি। তখন ও তুই খালি গায়ে, পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়াস। এক সময় বুঝতে পারলাম তুই আমায় ভালবাসিস। এটা যে ভালবাসা না মোহ সেটা প্রমাণ করতেই আজ তোকে নিয়ে এসেছি। আমি যখন ডাব ওয়ালার সাথে ঝামেলা পাকালাম।

তখন তুই নিরবে দেখে গেলি নিজেও ভয়ে সিঁটকিয়ে গেলি, তুই আমার কাছাকাছি বয়সের হলে, তুই আমায় বকতি, ডাবওয়ালাকে ন্যায্য পাওনা দিয়ে আমায় নিয়ে আসতি। আমাদের পাশ দিয়ে ফুচকা আইসক্রিমের গাড়ি চলে গেল, তুই একবারো বায়না করিসনি। ভার্সিটিতে বিপদে পড়লি তবু একটা ফোন দিয়ে আমায় ডাকিস নি, যদি কিছু মনে করি। বাসে আমি ঘুমিয়েছি, কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনেছি। তুই আমায় ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিস’নি। কান থেকে হেডফোন কেড়ে নিস’নি। রেষ্টুরেন্ট এ তোর ইচ্ছেমত খেলি না। ভার্সিটিতে একটা অচেনা ফুলের আবদার ধরলি না। আমি যদি কিছু মনে করি এই ভেবে তাই না?

আমাদের মাঝে যে একটা যুগের ব্যবধান সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিস। আমি মাহেরের মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। আমার চোখে জল। ‘ অনু আমার বিয়ে সামনের মাসে, তারপর আমি বাইরে চলে যাবো। আমি চাইনা এর মাঝে খানিকটা কষ্ট বুকে নিয়ে তুই তোর জীবন থেকে দূরে থাকিস। মহাখালী এসে গেছি। আয় বাস থেকে নামি। আমরা সিএনজিতে করে ফিরছি। আমার প্রিয় মানুষ’টি আমার পাশে বসে আছে। এই জীবনে এটাই হয়তো তার সাথে আমার একসাথে পথ চলা। আমি আকুল হয়ে কাঁদছি।

বাসার সামনে সে আমায় নামিয়ে দিয়ে গেলো। আমার হাতে দিলো, একটা কাগজে মোড়ানো জিনিস। আর একটা চিঠি। বললো ‘ বাসায় গিয়ে গোসল করে খেয়ে ঘুমানোর আগে এটা খাবি, আর চিরকুট টা পড়বি। আমি ক্লান্ত শরীরে বাসায় এলাম। গোসল সেরে যখন টেবিলে খেতে বসলাম। আম্মা আঁতকে উঠলেন আমায় দেখে।’ অনু তোর কি জ্বর? ‘

– না আম্মা ঠিক আছি। প্রায় কিছু না খেয়েই আমি ঘুমাতে আসলাম। মোড়কটা খুলে দেখি দুটো পান। আমি পান পাশে রেখে, চিরকুট পড়তে লাগলাম।

প্রিয় অনু মামির সাথে মামার বয়সের তফাত চৌদ্দ। তাদের মত সুখী কাপল আমি খুব কম দেখেছি। ( আরে গাধা তোর মা বাবার কথা বলছি )। আমার মা বাবার বয়সের ফারাক জানিনা তবে আমার দাদা দাদির ‘ষোল।’ তুই কি তোর চেয়ে বারো বছরের বড় বুড়ো’কে বিয়ে করতে রাজী আছিস! থাকলে পান দুটো খা, আর আমার নাম্বারে একটা কল দে প্রেমিকা তো হতে পারলিনা। হবু বধূর গলার স্বর শুনে দেখি কেমন লাগে। ইতি মাহের

আমি একসাথে দুইপান মুখে দিলাম, এক চাবানো দিয়েই বুঝলাম এতে জর্দা দেয়া। আমার মাথা ঘুরছে। প্রাণপণে মাথা চেপে ধরে তার নাম্বারে কল দিলাম। এক রিং বাজতেই সে কল রিসিভ করলো। ” মুখ থেকে পান ফেল, আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখ কি সুন্দর জোৎস্না উঠেছে। এরপরে লক্ষ্মী মেয়ের মত ঘুমা। কাল মার্কেটে গিয়ে বিয়ের শাড়ি কিনবি বুঝলি! ” বলেই কট করে ফোন কেটে দিলো। আমি মাথা ঘোরা অবস্থায়ই একটা গান দিলাম। মাথা ঘুরছে তবুও পানগুলো মুখ থেকে ফেলতে পারছি না। প্রিয় মানুষের দেয়া প্রথম উপহার আমি ফেলি কি করে?

আমি তোমাকেই বলে দেব
সেই ভুলে ভরা গল্প
কড়া নেড়ে গেছি ভুল দরজায়
ছুঁয়ে কান্নার রঙ
ছুঁয়ে জ্যোৎস্নার ছায়া

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত