সায়েমের সাথে আমার গুনে গুনে ১৬৩০ দিনের প্রেম।বছরের হিসেবে পাঁচ বছর প্রায়।আমি আর সায়েম একে অপরকে খুব ভালোবাসি।আমরা একসাথে লেখাপড়া করেছি।একই কলেজ একই বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এখন দুইজনেরই পড়ালেখা শেষ।সায়েম অনেকদিন ধরে চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে আসছে।কিছুদিন আগে সায়েম একটা ভালো চাকরিও পেয়েছে।বেতন ও ভালো।প্রায় মাস তিনেক পর আমি আর সায়েম সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা বিয়ে করবো।যখন বিয়ের জন্য সায়েম আর তার পরিবার আমার বাসায় প্রস্তাব পাঠিয়েছে তখন আমার মা রাজি ছিল না।মা জানতো আমাদের সম্পর্ক ছিল তাই এই বিয়েতে মত ছিল না।অনেক কষ্টে মাকে রাজি করিয়েছি।সায়েমের পরিবার বলতে তার একটা বোন আর বাবা আছে।কয়েকমাস আগে তার মা মারা যায়।বোনটার বিয়ে হয়ে গেল কিছুদিন আগে।এখন শুধু বাবা আর সায়েম।সায়েমের বাবাও সায়েমকে চাপ দিচ্ছিলেন বিয়ের জন্য।তার বয়স হয়েছে তাই একমাত্র ছেলের বউকে দেখে যেতে চান।আজকাল শরীরটাও খুব একটা ভালো না। যাই হোক কিছুদিন পর আমাদের বিয়েটা হয়ে যায়।বিয়ের পর পর তিন চারদিন প্রায় অনেকজন ছিল বাসায় সায়েমের ফুফু খালা আরো অনেকেই।আস্তে আস্তে সবাই যার যার বাসায় চলে গেল।এখন সায়েমের ছোট বোন মানে আমার ননদ আছে বাসায়।আমার ননদ এতদিন সবটা সামলে নিয়েছে।মেয়েটা খুব ভালো।একেবারে শান্ত।তারও বিয়ে হয়েছে সেও শশুর বাড়ি চলে যেতে হবে।
সপ্তাহ খানেক পর বাবার ঔষুধ পত্র কখন কোনটা খাওয়াতে হবে কিভাবে খাওয়াতে হবে সবটা বুঝিয়ে দিয়ে সেও চলে গেল।এখন বাসায় আছি আমি সায়েম আর বাবা। বাবার সকাল সকাল গরম গরম চা খাওয়ার অভ্যাস আছে।তাই সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে চা দিতে হয়।এত সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে করে না।যদি উঠতে দেরি হয় দরজায় এসে ডাকে। বাবার এই কাজটা খুব বিরক্ত লাগে।
বিয়ের আগে ঘুম থেকে উঠতাম ৯টা বাজে আর এখন উঠতে হয় ৬টা বাজে।বাসায় তেমন কাজ করতাম না এইখানে এসে সব কাজ আমাকেই করতে হয়।সকালে সেই যে রান্না ঘরে ঢুকি সারাদিন যেন আর বের হতেই পারি না।মাত্র তিন জনের খাবার।এর পরেও কাজের শেষ নেই।আমি আর সায়েম একটু ঝাল পছন্দ করি।কিন্তু বাবা ঝাল খেতে পারেন না।তার জন্য ঝাল কমিয়ে আলাদা করে রান্না করতে হয়।এমনকি চা ও আলাদা করে বানাতে হয়।আমি আর সায়েম একটু চিনি বেশি দিয়ে চা খেতে পছন্দ করি আর বাবার চায়ে চিনি একেবারে দিতে পারি না।ডাক্তার চিনি বেশি খেতে মানা করেছে।আর রোজরোজ মেহমান তো আছেই। বাবার বাড়িতে থাকতে মা আমাকে কোনো কাজ করতে দিত না আর এইখানে এসে আমাকে সারাদিন খাটতে হচ্ছে।সব কিছু অসহ্য লাগছে।বিয়ের পরের দিনগুলো যত সুন্দর হবে ভেবেছি তত সুন্দর হয়নি।বরং দিন দিন আরো কষ্টের হয়ে উঠছে।
বাবাকে সন্ধ্যায় চা দিয়ে সোফায় বসে টিভি দেখছি এমন সময় কলিং বেলটা বেজে উঠল।দরজা খুলতে দেখি সায়েম।সায়েম রুমে ঢুকে বিছানায় বসে শার্টের বোতাম খুলছে আমি তার পাশে গিয়ে বসেছি।সায়েম বলছে একটু গরম গরম চা দাও তো মাথাটা ধরেছে।সায়েমের কথার পাত্তা না দিয়ে আমি বললাম আমি চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিতে চাই।সায়েম বলল তোমার চাকরি করতে হবে না।আমি বললাম তোমার রেজাল্ট যা আমার রেজাল্টও তা তাহলে আমি কেন চাকরি করতে পারব না?সায়েম শার্টটা খুলে রেখে আমার খুব কাছে এসে হাতটা শক্ত করে ধরে বলল আমার বাবার তো বয়স হয়েছে উনি টুকটাক নিজের কাজ করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেন না।একটু বাবার দেখাশুনো করো।আজকে যদি আমার বাবার জায়গায় তোমার বাবা হতো তুমি দেখতে না বলো!সায়েম কথা শুনে আমি মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ চুপ থেকে সায়েমকে বললাম আমি টেবিলে নাস্তা দিচ্ছি তুমি ফ্রেস হয়ে নাও।
সব কিছু আগের মতোই চলছে।হঠাৎ একদিন বাবা আমাকে ডেকে বলছে বউমা শার্টটা তো ময়লা হয়েছে আরেকবার ধুয়ে দিও।কথাটা আমার ভালো লাগেনি।বাবার শার্টে ময়লা লেগে ছিল।শার্টটা আমি ধুয়েছিলাম।এত কষ্ট করে পরিষ্কার করে ধুয়েছি এর পরেও যদি পরিষ্কার না হয় কেমন লাগে!আর পড়ে নিলেই তো পারে আবার কেন ধুয়ে দিতে হবে এত কাজ করি সারাদিন এখন আবার এক কাপড় দুইবার পরিষ্কার করা।আজকে সায়েমকে বলে কোনো একটা ব্যবস্থা করতে হবে।তা না হলে আমি সারাদিন এই সংসারে কাজ করতে করতে মরব।বাবার বাসায়ও তেমন যেতে পারি না।বাবার দেখাশুনার জন্য।বিয়ের আগে ফুফুরা এসে দেখতো বাবাকে।আমি আসার পর তারাও আসে না।
সন্ধ্যা হতে সায়েম যখন বাসায় ফিরল আমি টেবিলে নাস্তা রেখে রুম থেকে সায়েম কে ডেকে আনলাম।দুইজন নাস্তা শেষ করে বসে টিভি দেখছি।সায়েমকে নিচু গলায় বললাম তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।সায়েম বললো কি কথা বলো।আমি বললাম সংসারটা আর করতে পারবো না তোমার সাথে!সায়েম তখন টিভির দিক থেকে চোখ সরিয়ে অসহায়ের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।কিছুই বলছে না।আমি বলছি বিয়ের পর থেকে সংসারে খেটে মরছি তাও আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ!কেন?সায়েম বলছে তুমি কি তাহলে আমাকে ডিভোর্স দিতে চাও?আমি বললাম তাছাড়া আর উপায় তো দেখছি না।
কথা গুলো বলার সময় কে যেন আমাদের রুমের পাশ দিয়ে হেঁটে চলে গেলো।আমি আর সায়েম রুম থেকে বের হয়ে দেখলাম বাবা লাঠিতে ভর করে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছেন।আমরা বুঝতে পারলাম বাবা আমাদের কথা গুলো শুনেছেন।সায়েম আমার দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বললো এইবার খুশি হয়েছ তো তুমি??আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি।কথাটা বলে সায়েম হনহন করে বাইরে চলে গেল।
রাত ১০টা বাজতে চলেছে বাবার জন্য খাবার দিচ্ছি টেবিলে। এমন সময় বাবা বউমা বলে ডাক দিলেন।আমি বাবার রুমে গিয়ে দেখছি রুমটা অন্ধকার করে রেখেছেন।রুমের জানালা খোলা।চাঁদের আলো জানালার গ্রিল ছুঁয়ে রুমে ঢুকছে।বাবাকে চাঁদের আলোয় আবছা দেখা যাচ্ছে।ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বাবা বসে আছেন।আমি বলছি বাবা ডেকেছেন?বাবা মাথাটা একটু বাকিয়ে আমার দিকে ফিরে বলছেন বসো!কথা আছে।আমি আস্তে করে গিয়ে বাবার সামনে রাখা সোফায় গুটিশুটি হয়ে বসলাম বসে বললাম জ্বি বাবা বলুন!বাবা খুব নরম গলায় বলছেন তোমাকে বরাবরই আমি আমার মেয়ে ভেবে এসেছি কখনো ছেলের বউ ভাবিনি এই কয়টা দিনে তুমি আমার অনেক যত্ন নিয়েছ।সত্যি আমি সন্তুষ্ট। কিন্তু আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি আগামী মাসের এক তারিখে বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাব।আমি যেই না কিছু একটা বলতে যাব বাবা আমাকে চুপ করিয়ে দিয়ে বললেন তুমি কিছু বলো না।এইটা আমার ব্যাক্তিগত সিদ্ধান্ত আর হ্যাঁ তুমি এই ব্যাপারে সায়েমকে কিছু বলো না।যা বলার আমি বলবো।আমি মাথা ঝুকিয়ে বাবার কথা শুনছি।কিছুই বলছি না।
বাবা নিজের কথা শেষ করে বললেন তুমি যাও এইবার কাজ সেরে নাও।আর হ্যাঁ আজকে আমার খাবারটা এইখানে দিও আমি টেবিলে যাবো না।জ্বি দিচ্ছি বলে আমি চলে গেলাম।বাবা খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।রাত ১২টা বাজতে চলেছে আমি সায়েমের জন্য অপেক্ষা করছি।সায়েম তো ফিরছে না।এই প্রথম সায়েম আমার উপর এত রাগ করেছে।ছেলেটা ভীষণ শান্ত।বাবার বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়ার কথা শুনলে না জানি কি করে!এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেও জানি না।
চোখ খুলতে দেখি সকাল হয়ে গেল।সায়েম আমার পাশে ঘুম।রাতে ঘরে ফিরে একবার ও ডাকলো না আমাকে!আমি উঠে রান্নাঘরে চলে গেলাম সকালের নাস্তাটা তৈরি করে বাবাকে ডাকলাম সায়েমও টেবিলে এসেছে আমিও বসেছি নাস্তা করতে।বাবা সায়েম কে বলছে আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি কারো পরামর্শে না বলতে পারিস এইটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।আগামী মাসের এক তারিখ আমি বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাবো।এই বিষয় নিয়ে আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না।তুই বউমার সাথেও এই ব্যাপারে কোনো কথা বলবি না।কথাটা বলে নাস্তা শেষ করে বাবা নিজের রুমে চলে গেলেন।সায়েম রাগ করে নাস্তা না করেই অফিসে চলে গেল। ১তারিখ আসার আর মাত্র পাঁচদিন।এই কয়দিন বাবা আর রুম থেকে বের হয়নি।খাওয়া দাওয়া সব নিজের রুমে।সায়েমও আমার সাথে ভালো করে কথা বলছে না।রাত করে বাসায় ফিরে।
১তারিখ সকালে বাবা চলে যাচ্ছেন।সায়েম বাবার হাতটা ধরে আছে।বাবা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন ভালো থাকিস!তারপর বাবা এক পরিচিত লোকের সাথে চলে গেলেন।সায়েম রুমে দরজা আটকে বসে আছে।আমি অনেক ডেকেছি কোনো সাড়াশব্দ নেই।প্রায় ঘন্টা খানেক পর সায়েম বাসা থেকে বেরিয়ে গেল।আজকে অফিসেও যায়নি।এইরকম কিছু হোক সেটা আমি চাইনি।আমারো খারাপ লাগছে খুব।কেন জানি না অপরাধবোধ কাজ করছে নিজের মধ্যে।
সায়েম আমার সাথে সংসারটা করতে হচ্ছে বলে করছে।আমরা একই ছাদের নিচে আছি কিন্তু আমাদের মনের দূরত্ব অনেকটা।সায়েম আমাকে বলেছে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে।এখনো দেওয়া হয়নি।আমার ছোট ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে।তাই ভাবলাম বিয়ের ঝামেলাটা শেষ করে তবেই চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিব।কয়েকদিন পর ছোট ভাইয়ের বিয়ে।বাবার বাড়িতে যেতেও ভালো লাগে না তেমন।বাসায় একা থাকি এখন।নিজের মত করে রান্না করি।এখন আর এক খাবার ২রকম করে রান্না করতে হয় না!
কয়েকদিন পর আমি আর সায়েম বাবার বাড়িতে গেলাম।কাল ভাইয়ের গায়ে হলুদ পরশু বিয়ে।বিয়ের সব ধরনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে কয়েকদিন পর আমরা আমাদের বাসায় চলে আসি। এর মধ্যে আমাদের সাথে বাবার আর কোনো যোগাযোগ হয়নি।সায়েম বেশ কয়েকবার বৃদ্ধাশ্রমে গিয়েছিল বাবাকে দেখতে।বাবা দেখা করতে নারাজ।কিছু কিছু বাবা এমনও আছেন ভিতরে ভিতরে ভেঙ্গে যাবে কিন্তু উপরে মচকাবে না।
সায়েম আর তার আত্মীয়স্বজনদের কাছে শুনেছি বাবা তার আত্মসম্মান কমে যাবে এমন কাজ করেননি এই জীবনে।তাই উনি চাননি আমার আর সায়েমের মধ্যে এইসব নিয়ে ঝামেলা হোক।বিশেষ করে সেদিনের কথা গুলো শুনে উনি মনে কষ্ট পেয়েছেন খুব ভালো করে বুঝতে পারছি।বিষয়গুলো খুব কষ্টের তাও কেমন যেনো শান্ত শান্ত পরিবেশে দূরত্ব তৈরি হল সম্পর্কে। না আমি ভালো আছি না সায়েম।বাবার কথা আর কি বলা যায়! যাই হোক বেশ কিছুদিন পর গেলাম ইন্টারভিউ দিতে।এখন যে জায়গায় ইন্টারভিউ দিতে এসেছি সেটা আমার বাবার বাসার পাশেই।
এই জায়গায় ইন্টারভিউ দিতে এসেছি শুনার পর থেকে মা কল দিয়েই যাচ্ছে।সেই যে ভাইয়ের বিয়েতে গেলাম আর যাওয়া হয়নি প্রায় পাঁচ মাস।মা বেশি জোর করাতে ইন্টারভিউ শেষে গেলাম বাসায়।আমি বাসায় ঢুকতে ভাইয়ের বউ এসে সালাম দিল।তখন দুপুর বেলা ছিল তাই সে রান্না ঘরে চলে গেল আমাকে খাবার দিতে।ভাই তার রুমে বসে অফিসের ফাইল গুলো দেখছে।মা গোসল করছে।
মা টা ও আজকাল অসুস্থ থাকে নিজের কাজ নিজে করতে পারে না।একটু পর মা গোসল করে বের হয়ে আমার ছোট ভাইয়ের বউকে বলছে বউমা আমার শাড়িটা একটু পরিষ্কার করে ধুয়ে দিও।আজকে আমি পারলাম না।এই কথা শুনে আমার ভাইয়ের বউ হনহন করে নিজের রুমে গিয়ে ভাইকে বলছে আমি কি কাপড় পরিষ্কার করে ধুতে পারি না নাকি?বলে দেওয়ার মানে কি?তোমার মা আমাকে কি পেয়েছে বল তো!আমার ভাই আর তার বউ এই বিষয়গুলো নিয়ে তর্ক করছে।তাদের ঝগড়া এত বেশি হচ্ছিল যে একসময় ভাইয়ের বউ ভাইকে বলছে তোমাকে বিয়ে করার পর থেকে এই ঘরে কাজের মেয়ের মত কাজ করতে করতে আমার ক্যারিয়ারটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।হয় ডিভোর্স দাও আমাকে না হলে তোমার মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাও আজকে এর একটা বিহিত করতেই হবে।
এই কথা শুনে আমার মাথার উপর আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।আমার মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর কথা আমি ভাবতেও পারছি না।
আর সায়েমের বাবা!সেও তো কারো বাবা।যদিও আমি চাইনি এমনটা হোক।তাও তো আমার জন্যই বাবা আজ তার ঘরে নেই।আমার এই অবস্থা তাহলে সায়েমের কেমন লাগছে!বাবা তো তার আপন বাবা। না আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না বাসা থেকে বেড়িয়ে পড়লাম।একটা গাড়ি নিয়ে সোজা চলে গেলাম বৃদ্ধাশ্রমে।গিয়ে দেখছি একটা ময়লা চাদর গায়ে জড়িয়ে একটা পুরনো আধভাঙ্গা চেয়ারে বাবা বসে আছেন। এই প্রথম মনে হচ্ছে আমি নিজের বাবার কাছে এসেছি।আমি আস্তে করে গিয়ে বাবার পাশে বসেছি বাবা আমার দিকে তাকাতে আমি বললাম বাবা আমাকে ক্ষমা করা যায় না?
বাবা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলছেন কি বলছ এইসব তুমি তোমাকে কখনো পরের মেয়ে মনে করিনি আমি।জানো তো আমার কাছে আমার আত্মসম্মানটা সবার উর্ধে। সায়েম বেশ কয়েকবার এসেছে আমি ইচ্ছে করেই দেখা করিনি।আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম বাবা জানেন!আমি আমার বাবাকে ছোটবেলায় হারিয়েছি।বাবার আদর কি জিনিস আমি জানি না।মন ভরে বাবা বলেও ডাকা হয়নি বাবাকে। বাবা এইবার ফিরে চলুন নিজের ঘরে অনেক হয়েছে।বাবা গায়ের চাদরটা ঠিক করতে করতে বলছেন পৃথিবীতে বোধহয় তুমিই প্রথম বউমা যে কিনা বৃদ্ধাশ্রমে এসেছে শশুরকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে।
আর কথা না বাড়িয়ে আমি আর বাবা বাসায় চলে এলাম।সায়েম অফিসে।অনেকদিন পর বুকের বোঝাটা হালকা হয়েছে।সন্ধ্যায় সায়েম বাসায় ফিরেছে বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে সায়েম আর বাবার রুমে যায়নি।বাসায় আসতেই হঠাৎ বাবার ডাক শুনে সায়েম বাবার রুমে ছুটে গেল।গিয়ে দেখছে বাবা জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে।সায়েমের চোখে পানি ছলছল করছে।বাবা আর ছেলে দুজন দুজনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে।আমি পাশে দাঁড়িয়ে আছি।সায়েম অশ্রু ভরা চোখে আমার দিকে অসহায়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
এখন আমাদের মধ্যে সব ঠিক।বাবার জন্য আগের মত খাবার তৈরি করছি।সায়েম বাবা আমি আমাদের এই ছোট্ট সংসারে আমরা তিনজনে ভালো আছি।সায়েম যখন অফিসে চলে যায় বাবার সাথে গল্প করতে করতে রান্না করি।পুরনো দিনের গল্প।মায়ের সাথে বাবার বিয়ের গল্প,প্রথম দেখতে যাওয়ার গল্প,মা রাগ করলে মায়ের অভিমান ভাঙ্গানোর গল্প।গল্প করতে করতে কখন যে সব কাজ শেষ হয়ে যায় নিজেও টের পাই না। একদিন বাবা আমাকে বলছে বউমা আমার একজন পরিচিত লোকের সাথে আমি তোমার চাকরির কথা বলেছি।বেশ ভালো কোম্পানি বেতন ও ভালো।আমি বললাম থাক বাবা এখন আর চাকরি করবো না।এখন বেশ ভালো আছি চাকরির ঝামেলা পোহাতে ইচ্ছে করছে না।বাবা বললেন এইটা আমার আদেশ!তুমি চাকরি করবে।তা না হলে আমি আবার চলে যাব এই কথা বলে বাবা নিজেও হাসছেন আমিও হাসছি।
সকাল সকাল গরম গরম চা খাওয়া বাবার পুরনো অভ্যাস।আজকে অনেক বেলা হয়ে গেল কিন্তু বাবা চা দিতে বলেননি।এত পুরনো অভ্যাস বাবার কিন্তু কি এমন হল যে চায়ের কথা তিনি ভুলেই গেলেন।আমি বাবার রুমে গেলাম চায়ের কাপ হাতে নিয়ে।দেখছি বাবা ঘুমাচ্ছেন আমি চায়ের কাপটা বিছানার পাশে রাখা টেবিলে রেখে জানালার পর্দা সরিয়ে বাবার হাত ধরে বাবাকে ডাকছি কিন্ত বাবার তো কোনো সাড়া শব্দ নেই।হাত পা ঠান্ডা।আমি সায়েমকে ডাক দিলাম সায়েম এসে বাবার গায়ে হাত দিয়ে ডাক্তারকে ফোন দিল।ডাক্তারের চেম্বার কাছে হওয়ায় বেশি সময় লাগল না আসতে।ভালো করে চেক করে বললেন বাবা আর আমাদের মাঝে নেই।এই কথা শুনতেই পুরো পৃথিবীটা আমার কাছে কেমন যেন থমকে গেল।চায়ের কাপে চা আছে বাবা নেই।মনে হচ্ছে কেউ একজন আমার কলিজায় ধরে টান দিচ্ছে।বুকের ভিতর চিনচিন ব্যথা হচ্ছে।বাবা আমাদের রেখে চলে গেলেন।
তার কিছুদিন পর আমার চাকরিতে জয়েন দেওয়ার জন্য আমার কাছে একটা কল এসেছে এইটা সেই চাকরিটা যেটা বাবা আমার জন্য ঠিক করেছিলেন। ভাবছি বাবার শেষ যাত্রাটা যদি হতো বৃদ্ধাশ্রম থেকে আমি কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না।জানি না নিজের শেষ জীবনটুকু কিভাবে কাটাবো তবে বৃদ্ধাশ্রমে গেলে যখন হাজারো বাবা মাকে দেখি তখন মনে মনে ভাবি বৃদ্ধাশ্রম ও একটা ঘর তবে সবার শেষ যাত্রাটা নিজের ঘর থেকে হয় না।বাস্তবতা বড্ড কঠিন।