অপূর্ণতার ঈদ

অপূর্ণতার ঈদ

রিতু স্যাঁতস্যাঁতে ঘরের ভেতর চৌকির উপর বসে বসে আকাশ দেখছে। আকাশটা কালো মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আছে, মনে হচ্ছে আকাশ ফেটে বৃষ্টি নামবে এখনি।

বৃষ্টি আসলে ওর মন বিষণ্ণ হয়ে যায়। ও ঠিকমত ঘুমাতে পারেনা, ওদের চৌকির ঠিক মাঝ বরাবর চালটাই ফুটো। সেবার ওদের ঘরের উপর ঝাপটে থাকা করই গাছের ডাল কাটার সময় মোটা ডালটা চালের উপর পড়ে ওদের দুচালা ঘরের টিন একেবারে ফুটো হয়ে গেছে।

রিতু যে চৌকিতে ঘুমায়, সে চৌকির মাঝ বরাবর সে ফুটো দিয়ে গড়গড় করে পানি পড়ে। পুরো চৌকির উপর চপচপে পানির উপর রিতু ঘুমালে তার মনে হয় সে মাঝ সমুদ্রে ভাসছে। তার জন্য এটা কোনো ব্যাপার না, বেশ ভালো একটা অনুভূতি জন্মে তখন। প্রতিদিনের অভ্যাস হয়ে গেছে তার।

আর মানুষ যা পায়, সে প্রাপ্তিকে খারাপভাবে নিতে হয়না, তার উপর সন্তুষ্ট থাকতে হয়। এটা তার বাবা বলেছেন। আমাদের যা আছে আমরা তা নিয়েই সুখী, দুবেলা দুমুঠো খেয়েপড়ে বাঁচাটাই আমাদের কাছে সোনায় সোহাগা।

কিন্তু আসমানের পানি খাওয়াটা পাওয়া থেকে ঈষৎ বেশি। সে বেশিটাকে প্রতিহত করার জন্য রিতুর বাবার অধীর প্রচেষ্টা, কিন্তু পারেনা কিছু করতে। একবার খড়ের আঁটি দিয়ে বেঁধে দিয়েছিলো, তাও পচে গলে শেষ।

এখন ফুটো দিয়েতো একেবারে আসমানির সাথে কথা বলা যায়, তবে বৃষ্টি না আসলে মুহূর্তটা খারাপ যায় না। সে ফুটো দিয়ে রিতু তারা গনতে পারে। রিতুর মনে অদ্ভুত সব প্রশ্ন জাগে। আচ্ছা সন্ধ্যা তারা আছে, সুখ তারা আছে কিন্তু দুঃখ তারা কেন নেই! সুখের সাথে দুঃখের একটা আড়াআড়ি ব্যাপার আছেনা! ওদের তো দুঃখ বেশি, তার মানে ওদের চাল বরাবর একটা দুঃখ তারা থাকা চাই।
আবার ভাবে, নাহ্ সুখ, দুঃখের সংমিশ্রণেই মানুষের জীবন।

সে একসাথে অদ্ভুতভাবে তারমত করে তারা গনতে থাকে। এক তারা, দুতারা, সুখ তারা, দুঃখ তারা।

তারা গনার মত আনন্দ আর কি হতে পারে! ফুটো দিয়ে যতটুকু আকাশ দেখা যায়, তাতে আকাশটা খুব সংকীর্ণ দেখায়। আর এই সংকীর্ণ আকাশের তারা গনে শেষ করতে পারাটা ভীষণ মজার।

কিন্তু বর্ষার আকাশে তারাদের দেখা পাওয়া বড্ড ভার। এই আকাশ দেখলে তাদের ছুট্টির অনেক কান্না পায়।

ও তার দিদির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, দিদি! বৃষ্টি আসবে বুঝি আজ। বৃষ্টির চপচপে পানিতে গড়াগড়ি করে শুলে ওর সর্দি জ্বর পায়।

বৃষ্টির রাতে ঘুমায়না ওরা। রাতটা তখন বিষণ্ণ হয়ে যায়। আকাশের মত তাদেরও মন খারাপ হয়ে যায়।

আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আছে। তিনচারদিন ভরে বৃষ্টি হচ্ছে।
রিতুর বাবা খুকখুক করে কাশছেন।
আর কয়দিন পরই কোরবান ঈদ।

ঈদের কথা মনে পড়লেই রিতুর মত খুশিতে আনচান করে উঠে। অনেকদিন হলো সে গোস্তের ঘ্রাণটাও পায়না। আর ঈদ হলে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গোস্ত আনতে পারবে। আর ওর বাবা কষাইয়ের কাজ করে প্রতিবার অনেকগুলো গোস্ত আনে। গোস্তের কথা মনে পড়তেই জিবে জল চলে আসে রিতুর।

এই যে বৃষ্টি হচ্ছে, রিতুর কোনো হুশ নেই। ওপাশ থেকে ছুট্টি ডেকেই যাচ্ছে তার দিদিকে। ভেজা শরীর নিয়ে ঘুমাতে তার সহ্য হয়না। ঘুম আসেনা ছোট্টুর। তাই সে চৌকির এককোনায় জড়সড় হয়ে বসে আছে।

এই ছোট্ট শরীরটায় একটা ছেঁড়া কাঁথা জড়িয়ে আছে। ছোট্টুর শরীরটা ওর নামের মত এতই ছোট্ট যে ওর জন্মের পর ওদের বাবা ওর নাম দিয়েছিলো ছোট্টু। তবে থেকেই ও আর বড় হয়না, ছোট্টই রয়ে গেলো। রিতুর মনে হয় ও প্রতি বছর বছর চার ইঞ্চি করে বাড়ে। ওর বয়সের তুলনায় শরীর এতোটাই ছোট্ট যে রিতুর সমবয়সী সবাই রিতুকে প্রায়ই বলে, তোর ভাইটাকি প্রতিবন্ধী রে রিতু?

জানিস, প্রতিবন্ধীদের এখন সরকার ভাতাও দেয়। তোর বাবাকে বলে তোদের ছোট্টুর জন্য প্রতিবন্ধী কার্ড করতে পারিসনা?

রিতু, ওদের সাফসাফ বলে দেয়, আমার ভাই মোটেও প্রতিবন্ধী নয়, ওর শরীরটা এমনেই ছোট্ট। তবে প্রতিবন্ধী কার্ডের কথা শুনে রিতুর মন স্বস্তির নিশানা পায়, অন্ততপক্ষে ওদের পরিবারের কূল হবে তাতে।

সে জানে ওর ভাই প্রতিবন্ধীই। সমাজের মানুষরা ওকে সে দৃষ্টি দিয়েই দেখে। না হয় ও বড় হয়না কেন! রিতু এটা বুঝেও বুঝার চেষ্টা করেনা।
নিজেকে নিজে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য ভাবে, তার ভাই পুরোপুরিই সুস্থ। আর কোন সুস্থ মানুষকে প্রতিবন্ধী বলেনা।

ছোট্টু দমছেড়ে আবার তার দিদিকে ডাকে। বৃষ্টি আসলেই রিতু আনমনে চৌকির একপাশে বসে থাকে। ছোট্টুর এই ছোট্ট দেহটাযে শীতে কাঁপছে, এই দিকে তার খেয়াল নেই।

ছোট্টুর ডাকে রিতু ভাবনা ছেড়ে ওকে কাঁথা দিয়ে জড়সড় করে ধরে দুই ভাইবোন চৌকির এককোনায় ঘুমিয়ে থাকে। কিন্তু ইদানীং রিতুর ঘুম হয়না। ওর বাবার খুক খুক আওয়াজটা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। প্রায় একবছর হলো, সে এভাবে প্রতিদিন রাতে কাশে।

কিন্তু এখন কাশির সাথে বোমি বোমি ভাব। গা পুড়ে যায় জ্বরে। ওর মা জ্বর দেখে ওদের গাছের নারিকেল আর রিতুর পালিত হাসমুরগী গুলোকে বিক্রি করে ডাক্তারে কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য যত সামান্য খরচ জোগায়। রিতুর প্রিয় মুরগিটা বিক্রি করার সময় ওর খুব মন খারাপ হয়েছে।

কিন্তু ওর বাবার অসুখের কথা মনে পড়তেই ও সব ভুলে যায়।

একটা প্রিয়কে বাঁচানোর জন্য হলেও সে অনেকগুলো প্রিয়কে বিয়োগ করতে রাজি।

রিতুর বাবাকে সদর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ঈদের আর মাত্র পাঁচ দিন বাকী। ওদের দুই বাইবোনকে রেখে ওর মা হাসপাতালে খাবার নিয়ে চলে যায়। এর একদিন পরই ধরা পড়ে ওর বাবার ডেঙ্গুজ্বর হয়। সেদিন ওদের পরিবারের সবাই কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছিলো। ডেঙ্গুজ্বরে পুরো শহরের মানুষজন মারা যাচ্ছে শুনে ওদের বুক ধপ করে উঠে।

ওরা ওর বাবাকে দেখতে হাসপাতালে যায়। রিতু দেখে ওর বাবাকে একটা মশারি টাঙ্গীয়ে হাসপাতালের বারান্দায় শুইয়ে রেখেছে ওর মা। ওর বাবার মত এখানে অনেক রোগীদের ভিড়। ডাক্তারের আনাগোনাও দেখা যায়না। ডেঙ্গু সারাতে নাকি অনেক টাকা লাগে, কিন্তু ওদেরতো এতো টাকা নেই। তাহলে কি ওর বাবা চিকিৎসার অভাবে মারাযাবে! এই কথা রিতু ভাবতেও পারেনা।

ধরকার হলে ওর সব প্রিয় কিছু বিয়োগ করে দিবে তবুও ওর বাবাকে সুস্থ চাই। কিন্তু ওর বাবা রিতুদের একা করে এর ঠিক দুইদিন পরেই ওদের চিরজীবনের জন্য ছেড়ে চলে যায়।

রিতু বুক ফেটে কেঁদেছিলো তখন। এবারের ঈদটা ওর বাবাহীন। চারদিক থেকে গোস্তের ঘ্রাণও আসছেনা। কেমন অম্লান হয়ে গেছে সবকিছু।

ও কয়েকটা বাড়িতে গোস্তের জন্য গিয়েছিলো, কিন্তু গিয়ে দেখে সেখানে ওর মত আরো অনেকেই হাত পেতে গোস্ত নিয়ে নিয়েছে। রিতু বিষণ্ণ মনে বাড়ি ফিরে অল্প কিছু গোস্ত নিয়ে আর ওর বাবার কথা মনে করে। প্রতিবার যখন ওর বাবা কষাইয়ের কাজ করে ব্যাগ ভরে ভরে গোস্ত আনতো, কিন্তু আজ ওর বাবাও নেই। গোস্তর ঘ্রাণও নেই ওদের ঘরে।
রিতুর ভাই ছোট্টু গোস্তের জন্য কেঁধে কেঁধে মারা যাচ্ছে ।
প্রকৃতি বড়ই নিষ্ঠুর। অসহায়দের শেষ সম্বল টুকুও কেড়ে নিয়ে আরো অসহায় করে দেয়। একটু পাওয়া থেকেও না পাওয়াটা জুড়ে দেয়।
এই নিষ্ঠুরতার খেলা খেলে মানব হৃদয়ে অষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত