নেকলেস

নেকলেস

মাত্র সাত বছর আগে। মেরিনার জন্ম দিনে আমি দিলাম এক জোড়া জুতো। আমার বন্ধু ফিলীপ দিলো সোনার নেকলেস। মেয়েটা সেদিন ভীষণ কষ্ট পেলো! সেই কষ্টেই হয়তো সে বিশ ইউরোর জুতো ফেলে দিয়ে সোনার নেকলেসওয়ালাকেই গলায় জড়িয়ে নিলো! প্রেমিক বদল করা আজকাল আর তেমন কী? তারপর ঢেউহীন নদীর মতো জীবন চলতে থাকলো। ভেবেছিলাম বিয়ে করবো না। সে বেঈমানী করেছে তাতে কী? আমি ঠিক আজীবন ভালোবেসে যাবো।

আমার বাবা ছিলেন অতি সামান্য একজন গাড়ির মিস্ত্রি। মেরিনার পাশে অন্য কাউকে বসতে দেখলে আমার গায়ে আগুন লেগে যেতো। কিন্তু কিছুই করার নেই। মেরিনা তখন অন্য কারো। বাবাকে বললাম তোমার সাথে নিয়ে চলো আমাকে। লেখাপড়া আমার দ্বারা হবে না। বড় ভাই রবার্টসন তখন পাশে ছিলেন। গালে জোরে একটা থাপ্পড় দিলেন। তারপর আমাকে নিয়ে এলেন ম্যানচেস্টারে।

আমি কখনো জুয়েলারির দোকানের সামনে দিয়ে যেতাম না। গেলেও চোখ বন্ধ করে। সোনার নেকলেস দেখলে আমার মেরিনার কথা মনে পড়ে যায়! নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়।  রবার্টসনের জুতোর দোকান ছিলো। ভার্সিটি শেষে ভাইয়ের সাথে দোকানে বসতাম। একদিন উল্টো দিকের জুয়েলারির দোকানের মালিক ভিয়েরার কঠিন রোগ হলো। ভদ্রলোক ফরাসি। দোকানটা বিক্রি করে দিবেন। রবার্টস পাশাপাশি দোকান বলে ঋণে কিনে নিয়েছিলো। দেড় বছর লাগলো সব টাকা পরিশোধ করতে। সেই থেকে ব্যবসায় হাত। যে গহনার ছোঁয়ার হৃদয়ের পাখিটা অন্য বাসায় নায়রী গিয়েছে। সে গহনা নিয়েই আমাকে সারাদিন থাকতে হতো। পাঁচটা বছর গিয়েছে এই জুয়েলারির ব্যবসার পিছনে।

শেষ জুলাইয়ে আমার ব্যক্তিগত সহকারী হিসাব দিয়েছে। আমি খুব তাড়াতাড়ি ইংল্যান্ডের শীর্ষ দশজন ধনী ব্যক্তিদের একজন হতে যাচ্ছি! এর মাঝে এলিটা নামের এক মেয়ে একদিন ভুল করে ফোন দিয়ে গালিগালাজ করেছিলো! আবার দুঃখিত বলতে দেখা করতেও এসেছিলো! মারবেলের মতো চোখ, কী অপরূপ দেখতে! রবার্টস আর মেয়েটাকে যেতে দেয়নি। আমার জন্য রেখেই দিলো! সেই ভুলে ফোন করে গালিগালাজ করার অপরাধে মেয়েটা এখন আমাকে ভালোবেসে যায়! রোজ সকালে কফি বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। হঠাৎ একদিন এলিটা বললো তাঁর এক পরিচিত বড় বোন আছে। দুটো মেয়ে নিয়ে খুবই বিপদে আছে। একটা চাকরী দিয়ে দিতে। একমাত্র বৌয়ের একমাত্র অনুরোধ তো আর ফেলা যায় না। আমি বললাম, “ দেখা করতে বলো, হয়ে যাবে। ”

মারবেল চোখওয়ালী সঙ্গে সঙ্গে একটা চুমু এঁকে জবাব দিলো, “ উনি বাসাতেই আছেন। দাঁড়াও ডেকে দিচ্ছি। ” কোলে একটা ফুটফুটে বাচ্চা নিয়ে একটা মেয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসলো! এলিটা বসতে বললো। আমরা সবাই বসলাম। কিন্তু আমার যেন কিছু একটা হয়েছে! আমি যেন থমকে গিয়েছি! এলিটা, “ কথা বলো তোমরা। ” বলে কফি আনতে গেলো। আমি অস্ফুট গলায় জিজ্ঞেস করলাম, “ আপনি, আচ্ছা আপনার নাম কী মেরিনা? ” মেয়েটা মনে হয় আমাকে চিনতে পারেনি। দাড়িগুলো কতো লম্বা হয়েছে। মাথায় তো আর চুল নেই! ভদ্রভাবে মাথা নাড়লেন।

“ চাকরীটা, মানে আপনার কোনো কাজ খুবই দরকার? ”
“ হ্যাঁ স্যার। খুবই বিপদে আছি দুটো ছেলে নিয়ে! ”
“ বাচ্চাদের বাবা? ”

বাচ্চাদের বাবার কথা শুনতেই মেয়েটার চোখে এক রাশ রাগ দেখতে পেলাম। ভনিতা করলেন না। বলে দিলেন, “ এদের জন্ম দিয়েছে, জন্মভার ঐ কুকুর নেয়নি! নতুন বিয়ে করে সুখেই আছে। ” মেয়েটার কষ্টের কথা আর শুনতে চাইলাম না। সুন্দর করে উনার কাজটা বুঝিয়ে দিলাম। “ সকালে এলিটার গলায় একটা সোনার নেকলেস পড়িয়ে যাবেন। দুপুরে এসে আবার খুলে যাবেন। তারপর ঠিক রাত সাড়ে এগারোটায় আমার সামনে এসে আবার আরেকটা সোনার নেকলেস এলিটার গলায় পড়িয়ে যাবেন। এটুকুই, পারবে না? ” মেয়েটা খুব খুশি হলো। সুন্দর একটা হাসি দিলো। “ এটা কোনো কাজ হলো স্যার? অবশ্যই পারবো। ” আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, “ আমি জনসন। ফিলীপের বন্ধু জনসন। আর আমাকে স্যার ডাকবেন না। আমরা একই কলেজের ব্যাচমেট ছিলাম। ”

মেরিনা আর কোনো কথা বললো না! চোখ থেকে দুফোঁটা পানি পড়লো গাল বেয়ে! এলিটা আসার আগে মুছেও নিয়েছে। নিশ্চুপ হয়ে বের হয়ে গেলো। কিন্তু একেবারে নয়। এখন সে রোজ তিন বেলা আমার বাসায় আসে। রাত্তিরে আমার চোখের সামনে এলিটাকে রোজ সোনার নেকলেস পড়ায়! আর চুপটি করে কাঁদে! এলিটা বলে, “ আপু আপনি কাঁদেন কেনো? আমার কিন্তু নেকলেস পড়া খোলার কোনো বিলাসিতা নেই! কিন্তু জন বলে নেকলেসে নাকি আমাকে রাণী এলিজাবেথের মতো লাগে! ” মেরিনার মুখে কোনো জবাব নেই!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত