“কী সাব মধু লাগবো নাহি? খাইলে কন একদম হস্তায় পাইবেন কিন্তু ”
রাত প্রায় দুইটা বেজে ছুইছুই। আমি তখন যমুনা ব্রিজের উপরে রেলিং এর পাশে দাঁড়িয়ে আছি। জীবনের দেনা-পাওনার হিসেব মিলাচ্ছিল। এমন সময় এক নারী কন্ঠে উপরের কথাটি শুনতে পাই। তাকিয়ে দেখি বোরকা পড়া একজন মেয়ে দাড়িয়ে আছে।আশেপাশে খেয়াল করে বুঝলাম কথাটা আমাকে উদ্দেশ্য করেই বলা হয়েছে। অনেকটা অবাক হয়েই তাকালাম তার দিকে। এতো রাতে কেউ মধু বিক্রি করার জন্য বের হয় নাকী। তখনও আমার মাথায় খারাপ কোনো ভাবনা আসে নি। কৌতুহল বশত আমি তাকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, “এতো রাতে মধু বিক্রি হওয়ার জন্য কেউ বের হয়?” বলার একটু পরেই সে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে, “এই এলাকায় কি সাব নতুন আইছেন নি? ভাব লইতাছেন বাচ্চা পোলাপাইনের নাহান। মধু কারে কয় বুজেন না?” উত্তর শোনার সাথে সাথে আমার যা বুঝার বুঝা হয়ে যায়। আমি মেয়েটাকে আমার কাছে ডাক দিতেই সে আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। তাকে জিজ্ঞেস করি,
-কি নাম তোমার?
-নাম দিয়া কি করবেন?কা করবেন নি হেইডা কন। এহন ধইরা একটাও কাস্টমার পাই নাই। না হইলে কন আমি অন্য দিকে যাই।
-কত টাকা নেও ঘন্টায়?
-এহন আর ঘন্টায় কেউ নেয় না সাব। এহন তো আর বেশ্যার অভাব নাই। এক রাইতের লাইগা যার লগে যা বনে আর কি?
-আজ রাতের জন কত নিবে?
-আমনে আইজকার প্রথম কাস্টমার। হেইয়ার লেইগা আমনে ৫০০ দিলেই হইবো।
-৫০০ টাকায় সারা রাত?
-হ।আমি কিন্তু বেশী চাইনাই। এর নিচে আর কমাইতে পারুম না সাব।
-আচ্ছা যদি তোমাকে ১০০০ টাকা দিয়ে বলি সারারাত এখানে আমার সঙ্গ দিতে তাহলে কি রাজী হবে?
-হাহাহা আমনেরে কি পাগলা কুত্তায় কামরাইছে নাকী যে আমনে ১০০০ টাহা দিবেন খালি এই যায়গায় খাড়াইয়া থাহনের লাইগা।আমার ফাও সময় নষ্ট কইরেন না তো।হইলে কন না হইলে অন্য কাস্টমার খুজা লাগবো।
আমি মেয়েটির দিকে ১০০০ টাকার নোটটি বাড়িয়ে দিতেই কেমন যেন অবিশ্বাসের চোখে চেয়েছিলো। খপ করে হাত থেকে নিয়ে তার বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলে। আমি তার কান্ড দেখে একটু মুচকি হেসে ফেলি। সে আমার হাসি দেখে মাথা নিচু করে ফেলে। কেমন যেন তাকে অস্বস্তি ঘিরে ধরে। অচেনা মানুষের কাছে শরীর বিকিয়ে দিতেও যে অনুভূতি না হয় তা শুধুমাত্র কয়েক মুহূর্ত কথা বলায় হয়ে যায়। তার দিকে তাকিয়ে আবার ঠিক আগের প্রশ্নটাই করলাম,
-কী নাম তোমার?
-সাব কত মাইনষে কতকিছু কইয়া ডাহে। কেউ কয় বেশ্যা,কেউ কয় মাগী। এহন তো এইয়াই নাম হইয়া গেছে।
-আমাকে দেখেও কি তাই মনে হয় যে আমি ও এসব নামে ডাকবো?
-হাসাইয়েন না সাব। আপনার মতো কত সাহেব আইলো আর গেলো। কয়ডা কাগজের টুকরা দিয়া এই শরীরডারে খুবলাইয়া খাইলো।
-সবাই কিন্তু এক না।
-তয় এই কতা ডা হাচা কইছেন।আইজ পযন্ত এমন পাগল দেহি নাই যে কয়েক ঘন্টা কতা কওয়ার লাইগা হাজার টাহার নোট দেয়।তাও আবার আমাগো মতো বেশ্যার লগে।
-প্রশ্নের উত্তরডা কিন্তু দিলে না।তোমার নাম কী?
-এইসব হুনতে হুনতে নিজের নামডা ভুইলাই গেছি।বাপ মায় শখ কইরা নাম রাখছিলো নুসাইবা আক্তার।এই ধান্ধায় আহনের পর মালকিন নাম রাখছিলো চুমকি।এহন কেউ আর নাম ধইরা ডাকে না।দোকানদার হালারপুতেও মাগী কইয়া ডাক দেয়।
-আমি তাহলে নুসাইবা বলেই ডাকবো।তা নুসাইবা এই পথে এলে কীভাবে?
-সাব আমনে কি হাচাই এইসব কয়নের লাইগা টাহা দিছেন?এহনো সমস্যা নাই আমনে চাইলে করবার পারেন।
-তোমাকে আমার প্রতি মায়া না দেখিয়ে যা জিজ্ঞেস করি তার উত্তর দাও।আমি এর জন্যই টাকা দিয়েছি।
-হইলো।আমনের যা ইচ্ছা।তয় আজান দিলে কিন্তু জোর করবার পারবেন না কইলাম।
-কেন?আজান দিলে কি হয়?
-পাপ যা করার তো করি।তবুও আশা করি উপরওয়ালায় মাফ করে নি।আর কেউ আমারে জানুক বা না জানুক হেয় তো আমার সবই জানে।
-আচ্ছা এবার বলো এই লাইনে কীভাবে এলে?
-সাব সব পোলাপাইনের মতো আমার ও বাপ-মা ছিল।তয় বাপ গরীব ছিল।নুন আনতে পান্তা ফুরায় এই অবস্থা।আমার লেহাপড়া করার ইচ্ছা ছিল অনেক।কষ্ট কইরা বাপে পাচঁ ক্লাস পযন্ত পড়াইছিলো।আমি কিন্তু ছাত্রী ভালা ছিলাম সাব।সব থেইকা ভালা নাম্বার পাইতাম।সব স্যার মেডামরা কইতো আমি অনেক ভালা ছাত্রী।কিন্তু পয়সার অভাবে বাপে আর পড়াইলো না।আমার আর দুই বছর পড়ালেহা হইলো না।সবাই যহন লেহাপড়া করতে যায় তহন আমি মার লগে মিদ্দা বাড়ি কাম করতে যাই।মায় আর আমি কাম কইরা পেটে ভাতে খাইয়া আহি।মাঝে মাঝে কিছু দিয়া ও দিতো বাপজানের লাইগা।বাপে মাইনষের জমিতে কাম করতো।কাম একদিন থাকলে দুইদিন থাকতো না এমন অবস্থা।এমনে কষ্ট হইলেও আমগো ভিতরে কিন্তু মেলা আনন্দ ছিলো সাব।কত রাইত আমরা গল্প কইরা পার কইরা দিছি।কি করুম কন?হেই রাইতে তো আর খাওন থাকতো না।
-টিস্যুটা দিয়ে চোখ মুছে ফেলো।তারপর?
-একদিন মিদ্দা বাড়ির ছোড পোলায় বাড়িত আইলো।আইয়াই আমার দিকে ক্যামনে যেন চাইয়া রইছিলো।আমি মার পিছনে গেছিলাম গা।মায় সালাম করলে জিগায় আমি কে?মায় আমার কতা কইলে হেয় কিছু না কইয়াই বাড়িত ঢুইকা যায়।হেরপর থেইকা কোনো কিছু দরকাই হইলেই আমারে ডাকতো।আর কতায় কতায় গায়ে হাত দিতো।আমি হেয় ডাকলে আর সহজে যাইতাম না।মায়রে কয়োনের পর ডাক পড়লেই মায় যাইতো।একদিন দুপুরের সময় বাড়ি যাইবার সময় দেহি বাপের লগে হ্যায় কি যেন কইতাছে।আমি দেইখা বাড়ি আইয়া পড়ি।রাইতে বাপে কয় যে ছোড মিদ্দায় কইছে আমারে নাকী ঢাকায় লইয়া যাইবো।হেই জায়গায় নাকী কাম দিয়া দিবো।আমি কাম করলে নাকী টাহাও পামু।আমাগো আর কষ্ট থাকবো না আর।মায় রাজী হয় না।আমি ও রাজী হইনাই।পরে বাপে কইলো যে আমারে নাকী লেহাপড়াও করাইবো।তবুও মায় রাজী না হইলেও আমি রাজী হইয়া যাই।আইয়া পড়ি গ্রাম থেইকা শহরে।বিশ্বাস করবেন না সাব হেইদিন ই আমার জীবনে সবচেয়ে সুন্দর দিন ছিলো।কত্তকিছু দেখছি সাব।
-পানি খাবে?
-দেন।
-তারপর?
-হেইদিন দুপুরে আমারে এক মহিলার সামনে লইয়া গেলো।মহিলাও আমার দিকে যেন কেমন কইরা চাইলো।হেয় কইছিলো যে আমি বাচ্চা মাইয়া,এইসব পারুম না।কিন্তু ছোড মিদ্দায় কইলো আমি পারুম।আমি ও ভাবছিলাম মনে হয় কামের কথা কয়।তাই আমি ও কইছিলাম পারুম।দেখলাম মিদ্দার হাতে অনেক টাহা ধরাইয়া দিলো।মিদ্দায় একটা শয়তানি হাসি দিয়া আমারে একটা ঘরে নিয়া আইলো।আইয়াই নিজের সব কাপড় খোলা শুরু কইরা দিলো।তারপর……..।ওই কুত্তারবাচ্চায় ই আমারে প্রথমে বেশ্যা বানাইলো সাব।আমার সব কাইরা নিলো।আমারে নরকের যন্ত্রণা দিলো।আমার সব শেষ কইরা দিলো………..
-……………………
-একদিন সুযোগ বুইঝা ওই নরক থেইক্কা পলাইয়া আহি।কত মাইনষের কাছে কামের লাইগা গেছি সাব হিসেব নাই।গার্মেন্টস এও জায়গা পাই নাই।আমার যে কিছুই নাই সাব।সব জানোয়ারেরা খালি দেহডাই চায়।তারপর আর কি করমু।যহন এই একটা জিনিসই আছে তহন নে খা।খাইয়া তোগো স্বাদ মিটা।এরপর থেইকাই এই যমুনার তীরে একটা রুম ভাড়া কইরা একলা থাকি সাব।এই আমার জীবনকাহিনী।তয় আমনের চক্ষুতে কিন্তু জানোয়ারের মতো কোনো লোভ ছিলো না সাব।একটা কষ্ট দেকছি আমারে দেহার পর থেইকা।
-আরে না।তেমন কিছুই না।
-সাব এই লাইনে নতুন না।বেশ্যার চোখ ভুল করে না।
-নুসাইবা জানো আমরা জীবনকে ঠিক যেভাবে নিতে চাই জীবন আমাদের হাতে সেভাবে ধরা দেয় না।জীবনে অনেক স্বপ্ন থাকে,অনেক হাহাকার থাকে,জীবনকে নিয়ে অনেক প্রত্যাশা থাকে।কিন্তু জীবনের নির্মম খেলায় তা পাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না।
-এতো কঠিন কথা বুজি না সাব।
-এই যমুনার পাড়ে আমারও অনেক স্মৃতি আছে।আমারও একটি ছোট্ট পরিবার ছিলো তোমার মতো।সেখানে দরিদ্রতা থাকলেও সুখের কোনো কমতি ছিলো না।কলেরার মহামারী তে বাবা-মা দুজনেই মারা যান।ছোট বোনকে নিয়ে আমি রাস্তায় নেমে পড়ি।তখন বস্তিতে থাকতাম আর একটা হোটেলে কাজ করতাম।একদিন বাড়িতে এসে দেখি আমার কলিজাটা আর নাই।তন্ন তন্ন করে সব জায়গায় খুজেও পাই নি তাকে।এই জীবনের সাথে লড়াই করেছি অনেক।আজ আমার টাকা আছে,পয়সা আছে তবুও আমার কেউ নেই কিচ্ছু নেই………….
-থাক সাব কাইন্দেন না। দোয়া করি আপনি যেন আপনার বইন রে খুইজা পান।
-আমার সেই ছোট্টো বোনের চোখদুটো ঠিক তোমার মতোই ছিলো।ঠিক একই রকম চোখ।
-……………………….
-একটা কথা বলবো নুসাইবা?
-একটা ক্যান হাজারডা কন সাব।
-তোমাকে যদি নতুন জীবন দেই নিবে সেই জীবন?
-বুজলাম না সাব।
-তুমি যাবে আমার সাথে? আমার বোন হয়ে।এই সবকিছু থেকে দূরে সরে।যাবে?
-এমন কতা কইয়েন না সাব। লোভ লাগে অনেক। জীবনে আর স্বপ্ন দেখবার চাই না। এই জীবনে আর কিছুই নাই।
-আচ্ছা আমার কার্ডটা রাখো। কখনো প্রয়োজন হলে আমাকে জানাবে। আর পারলে এই পথ থেকে দূরে সরে আসো।
তারপর আর কিছু মনে নেই। চোখ মেলে দেখি আমি একটা জরাজীর্ণ ঘরে শোয়া। মাথার উপর জলপটি দেয়া। আশেপাশে তাকিয়ে দেখি কয়েকটা নোংরা পোস্টার লাগানো। কোথায় আছি সেটা পরিষ্কার বুঝতে পারলাম। একটু পর দেখি নুসাইবা একটা বালতি তে পানি নিয়ে এসে বলে, “জ্বরে আমনের গা তো পুইড়া যাইতাছিলো। মাথা গুরাইয়া পইড়া গেছিলেন। তাই আমনেরে এই জায়গায় লইয়া আইছি।ঘ রডা অনেক নোংরা। তয় নোংরা কাম হইলে তো নোংরা থাকবই। আর আমনের টাকা পয়সা দেইখা লন। আমি কিন্তু কিচ্ছু নেই নাই আবার।” আমি নুসাইবার দিকে তাকিয়ে হাসি দিয়ে বললাম, “নুসাইবা বোন,এক গ্লাস পানি খাওয়াবে?” নুসাইবার চোখে জল নিয়ে প্রথমবার বললো, “আনতাছি ভাইজান”