ঝরা ফুল

ঝরা ফুল

“কথাটা যেন আর কেউ না জানে। ” ঘর থেকে বের হতে হতে ইফতি সাহেব কথাটা বললো। নাজমা মুখে কোনো কথা না বলে শুধু মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলো। নাজমার সারা শরীর ভয়ে কাঁপছে। একটু আগেই এই মানুষটার দানবীয় শক্তির কাছে হেরে গেছে সে।

নাজমা সবে মাত্র ১৪ তে পা দিলো। বাবা মারা গেছে বছর দুই হলো। বাবা মারা যাওয়ার পর খালুই পুরো পরিবারের ভার বহন করছে।ইফতি সাহেব সম্পর্কে নাজমার খালু। জেসমিন আক্তার মানে নাজমার খালা হঠাৎ করেই মারা যাওয়ার পর ইফতি সাহেব বেশ একা হয়ে পড়ে। বয়স খুব বেশি না ৪০-৪৫ হবে। এই বয়সে অনেকেই বিয়ের সিঁড়িতে বসে। কিন্তু ইফতি সাহেবের মৃত স্ত্রীর প্রতি অগাত ভালোবাসা থাকার কারণে দ্বিতীয় বার বিয়ের সিঁড়িতে বসতে নারাজ। এত বড় বাসায় একা থাকায় নাজমার বাবা মারা যাওয়ার পর রহিমা বেগমকে তার বাসাতে থাকার কথাটা বলতেই তিনি রাজি হয়ে যান। কারণ, স্বামীর অঢেল ঋণের বোঝা বইতে রহিমা বেগমের তখন প্রায় পথে বসার অবস্থা। আর ঠিক সেই সময়ই ইফতি সাহেব প্রকাণ্ড রোদের মাঝে যখন বটোবৃক্ষের মত ছায়া দিলো তখন আর কোনো কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে যান। তখন থেকে নাজমার পুরো লেখাপড়ার ভার থেকে শুরু করে সবটাই ইফতি সাহেব বহন করে।

রাতের খাবার তৈরি হয়ে গেছে। রহিমা বেগম আজ মেয়ের জন্য চিংড়ি মাছের ভাজি করেছে। মেয়েটার খুব পছন্দ এই চিংড়ি মাছ। মাকে প্রায় বলতো চিংড়ি মাছের কথা কিন্তু সাহস করে ইফতি সাহেবকে বলতে পারেনি। সংকোচ বলতেও তো একটা কথা আছে। এমনিতেই ইফতি সাহেব যেভাবে মা মেয়ের মাথার উপর ছাতা ধরে আছে এই অবস্থায় মেয়ের জন্য আলাদা আবদার করতে তার বিবেকে বাঁধে। কিন্তু আজ যখন ইফতি সাহেব নিজে বাজার থেকে চিংড়ি আনলো তখন রহিমা বেগমের মুখের হাসি দেখে কে। মেয়েটা এখনও ঘরে আছে। সামনেই পরীক্ষা তাই হয়তো পড়ছে। রহিমা বেগম এমনটাই ভেবে মেয়েকে খেতে ডাকার জন্য ঘরে যেতেই মাকে দেখে বেশ ভয় পেয়ে গেল নাজমা। চোখে মুখে আতঙ্ক। বার বার নিজেকে আড়াল করতে চাচ্ছে মায়ের থেকে।

– চল মা, আজকে তোর জন্য চিংড়ি মাছ রান্না করছি। তোর তো খুব পছন্দের। আজকে চল মন ভরে খাবি।

মেয়ের এমন অস্বাভাবিক আচরণ দেখে মা মেয়ের কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো কথাটা। কিন্তু আজকে নাজমার চেহারায় কোনো আনন্দ নেই। কিন্তু অন্যদিন তো চিংড়ি মাছের কথা শুনতেই নাজমা লাফাতে লাফাতে খেতে যেত।

– কি রে তোর শরীর খারাপ নাকি? জ্বর আসছে?

মেয়ের কপালে একটা হাত দিয়ে তাপ দেখতে দেখতে কথাটা বললো রহিমা বেগম। নাহ্ শরীর তো গরম না, বরং অন্য দিনের মতই স্বাভাবিক। পর পর দুইবার প্রশ্ন করার পরও কোনো জবাব আসলো না মেয়ের কাছ থেকে। ছোট মানুষ তাই বেশি জোরও করলো না। মন খারাপ করেই রুম থেকে বেরিয়ে গেল রহিমা বেগম। হাস্যউজ্জ্বল মেয়েটার মুখে আজ হাসির ছিটাফোটাও নেই।

রহিমা বেগমও আজ খেলেন না। ইফতি সাহেব খাওয়ার সময় একবার প্রশ্ন করছিলেন, ” বুবু আপনি খাবেন না?”
উত্তরে বলেছিলো, ” নাহ্, মেয়েটার কি যেন হইছে। কথা বলছে না। ” রহিমা বেগমের কথাটা শুনেই ইফতি সাহেবের মুখটা কালো হয়ে গেছিলো, তারপর আমতা আমতা করে বলেছিলো,  “শরীর খারাপ নাকি? ডাক্তার ডাকতে হবে? ”  “নাহ্,দেখলাম জ্বর আসেনি । কিন্তু কেমন জানি চুপ চাপ করে বসে আছে। আমি ঘরে যেতেই ভয়ে আতঙ্কে উঠলো। নিজেকে আড়াল করতে চাইছিলো বার বার। আমি যখন ওর শরীরের হাত দিলাম কেমন যেন ভয় ভয় করছিলো। কি যে হলো মেয়েটার, বুঝতে পারছি না।”

ইফতি সাহেব আর কোনো কথা বলেননি। অর্ধেক ভাত প্লেটে রেখেই উঠে পড়লো। তখন অবশ্য রহিমা বেগম প্রশ্ন করেছিলো, “পুরোটা না শেষ করেই উঠে পড়লেন যে?রান্না ভালো হয়নি ? “”না তা নয়, বাইরে একটু খেয়েছি তাই আর খেতে ইচ্ছে করছে না। ” কথাটা বলেই সোজা উপরের সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমে চলে গেল ইফতি সাহেব। গিয়ে রুমের দরজা বন্ধ করে খাটে বসেই ঘামতে আরম্ভ করছে। এই তাপ নিয়ন্ত্রণ ঘরেই কুল কুল করে ঘামছে সারা শরীর। বার বার কপাল ঘেমে উঠছে। দুইদিন আগের কথা। নাজমার জন্য একটা খুব সুন্দর জামা এনেছে ইফতি সাহেব। জামাটা ওর হাতে দিতেই আনন্দে লাফাতে লাগলো নাজমা। পাশেই দাড়িয়ে মেয়ের আনন্দ উল্লাস দেখছে রহিমা বেগম। মেয়েকে এমন খুশি দেখলে সব মায়েরই ভালো লাগে।

– মা জামাটা গায়ে দে তো, দেখি কেমন মানিয়েছে। মায়ের কথা শুনেই নাজমা পাশের ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই রহিমা বেগম সরল মনে বললো,

-আরে এখানেই গায়ে দে। কিছু হবে না।

নাজমা একটু সংকোচ করলেই মায়ের কথায় জামাটা গায়ে দিলো। উল্টো পাশ ফিরে জামা গায়ে দেওয়ার সময় ইফতি সাহেব একবার আড় চোখে দেখে নিলো। মনে বাসনা জেগেছে, চোখে লালসা। এই তো লালসা কমবার নয়।
নিজের ভেতর দমিয়ে রাখা দানবটা আবার জেগে উঠেছে। আর তারই উসুল উঠলো আজ রাতে।ঝরে পড়লো একটা ফুল বিকাশিত হবার আগেই।

নাজমার ভবিষৎ কি! পারবে কোনো পুরুষকে বিশ্বাস করতে? যে নারী নিজেকে বিকাশিত করার আগেই কোনো পুরুষের নোংরা চাহিদার কারণ হয় সেই নারী কি পারবে কোনো পুরুষকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে? বাচতে হবে ভয় নিয়ে, এই বুঝি আবার কেউ হানা দিলো কমল শরীরে।। এই বুঝি আবারও কেউ। এই “এই বুঝি “ভয়টা নিয়েই বাচতে হবে নাজমার মত আকালেই ঝরে যাওয়া হাজার হাজার ফুলকে। ওরা ফুল, কারও লোভ-লালসার বস্তু নয়।

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত