বাবার জুতা

বাবার জুতা

ক্ষুধার্ত পেট আর খালি পকেট মানুষকে যে শিক্ষা দেয়,হয়তো পৃথিবীর কোনো বই সেই শিক্ষা দিতে পারে না……!!!তবে আজ খালি পকেটা না। পকেটে ১২২০ টাকা আছে।টিউশনের টাকা দিয়ে সংসার চালিয়ে যে টাকাটা অবশিষ্ট থাকতো সেই টাকাটা মাটির একটা ব্যাংকে রেখে দিতাম। আর ৫ দিন পর কোরবানির ঈদ। অভাব আর অনাটনের মধ্যে দিয়ে বড় হয়েছি।তিন বেলা পেট পুরে খাবার না পাওয়া এটা আমার জীবনে বিরল নয়।বাবা শ্বাস কষ্টের রোগী। কিছু করতে পারেনা।তাও মাঝে মাঝে এই অসুস্থ শরীর নিয়ে রিকশা চালাতে বের হয়।পা প্যাডেল একটা রিকসা আছে।দিন শেষে যখন ঘামযুক্ত আর ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসায় ফিরে তখন বাবার মুখটা দেখে বুকের বাম পাশে কেমন যেনো নড়ে চরে উঠে।কেনো যানি চিৎকার করে খুব কাঁদতে ইচ্ছা করে।বাবাকে অনেক বার বলেছি, বাবা তোমার এই অসুস্থ শরীর নিয়ে কাজে যেও না।কিন্তু কে শুনে কার কথা।

পকেট থেকে টাকাটা বের করে যত্ন সহকারে একটু নেড়ে চেড়ে আবার রেখে দিলাম।বাবাকে একটা জুতা কিনে দিবো।দুই বছর আগে আম্মুর জোগানো টাকা দিয়ে জুতা টা কিনে দিয়েছিলো।এখন জুতাটার আর কোনো জায়গাতে সেলাই করার বাকি নাই।হয়তো মুচিও এই নাজেহাল জুতাটা মেরামত করতে বিরক্ত অনুভব করে।বাবাকে কতো বার বলেছি একটা নতুন জুতা কিনে নাও।হয়তো ঢের সময় চলে যাবে বাবার নতুন জুতা কিনতে।

ছোট্ট একটা বোন আছে।বিনা নাম,৫ম শ্রেনীতে পড়ে।আমার বোনটা পরীর মতো সুন্দর। পাগলীটা সারা দিন কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করে।ভাইয়া এটা কিনে দে,ভাইয়া ওটা কিনে দে।চকলেট ডে তে টিউশনের ছাত্র টা কিছু চকলেট দিয়ে ছিলো, সেটা না খেয়ে পাগলীটাকে এনে দিয়েছিলাম।তারপর থেকে বাসায় ফিরলেই পাগলীটা বলে ভাইয়া আমার চকলেট কই??ভাবছি খোলা বাজার থেকে ওকে একটা ড্রেস কিনে দিবো।কি হবে এতো দামি ড্রেস দিয়ে,,,আমার পাগলী বোনটাকে যা পরাবো তাতেই পরীর মতো লাগবে।দিন শেষে যত বড়ই কষ্ট নিয়ে বাড়ি ফিরি না কেনো,পাগলীটার হাসি দেখলেই কলিজা টা জুড়ে যায়।

ও ভাই সুখী হতে আর কি চাই??শুধু টাকা পয়সা থাকলেই সুখী হওয়া যায় না।সুখ,,সেতো ভালবাসার আর এক নাম সারা দিন যেই ভাবেই যাক না কেনো দিন শেষে খাবারের সময় এক সাথে হই।আর চারজন একসাথে খাবারের সময় মা যখন একটা সিদ্ধ ডিম বাবার প্লেটে তুলে দেয় তখন বাবা বলে,,আহ!ডিমা টা আমাকে দিচ্ছো কেনো??বাবু সারা দিন খাটা খাটনি করে,এই বলে যখন ডিমটা আমার প্লেটে তুলে দেয় তখন লক্ষ করি ছোট বোন নিচু হয়ে মনযোগ দিয়ে খাবার খাচ্ছে।কিছু না ভেবেই ডিমটা ওর প্লেটে দেই,,,,,,পাগলীটা কিছুক্ষণ কি যেনো ভাবে,তারপর ডিমটা চারটা সমান ভাগ করে চারজনের প্লেটে তুলে দেয়।তখন কিছুক্ষন নিরবে কেটে সবার চোখে একটু সুখের অশ্রু আর মুখে একফোঁটা তৃপ্তির হাসি ফোটে।ভাই এটাই ভালবাসা,,, এটাই সুখ। আর কি চাই??মানুষ সুখী হবার জন্য বেশি কিছুর দরকার নেই।শুধু মাথার উপর একটা ছাউনি, দু বেলা দু মুটো খারার আর বুক ভরা ভালবাসা ব্যস।এবার দেখুন life শুধু চলবে না,,,এখন দৌড়াবে!!

ভাবনার রাজ্যে বিভোর। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম কেউ পিছন থেকে আলতো করে ধাক্কা মারলো।পিছিনে ফিরে দেখলাম একটা অপরিচিত লোক।পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে।আমি আর কিছু বলিনি।মার্কেটে গিয়ে দামাদামি করে ৩৯০ টাকায় বাবার জন্য একটা জুতা নিলাম।কিন্তু টাকা দিতে গিয়ে দেখি আমার টাকা !!বুঝতে আর বাকি নেই।জানি টাকাটা আর পাবোনা।তারপরও পাগলের মতো টাকাটা খুঁজতে লাগলাম।কিন্তু না,,আমার চেষ্টা বৃথা।হাউ মাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।একটু চিৎকার করে কাঁদতে পারলে মনে হয় শান্তি পেতাম।নিজের উপরে অনেক রাগ হচ্ছে।কপালে আর সইলো না।ভাইরে তোর এই গরিবের টাকাই মারতে হলো???

অনেক রাত করে বাড়ি ফিরলাম।সবাই ঘুমিয়ে পরেছে।কিছু না খেয়ে আমিও ঘুমিয়ে পরলাম।সকালে খুব ক্ষুদা পাইছে,খেতে গিয়ে শুনলাম খাবার নেই।রাগে দুংখে জ্বলে পুড়ে গেলাম।এমন সময় বিনা এসে বায়না ধরেছে,কয়েক বার যাবার কথা বলেও যখন গেলোনা,,নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারিনি।কষে একটা চড় মেরে দিলাম।বিনা চল ধরে মাটিতে বসে পরলো।গাল বেয়ে টপ টপ করে পানি পরছে।ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে।নিজের চোখ দিয়েও এক ফোঁটা পানি গরিয়ে পরলো।মা এসে বিনাকে নিয়ে গেলো,, আমিও চলে গেলাম টিউশনে। খুব খারাপ লাগছে।পাগলীটার অনেক জোরেই লেগেছে।আমি কখনো ওর গায়ে হাত তুলিনি।এক অপরিচিত কষ্ট যেনো কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।হঠাৎ ভাবনার জগৎ থেকে বাইরে আসলাম ছত্রের ডাকে!!!!

–স্যার??
–হুম বলো??
–স্যার আপনার নীল রঙ কি খুব পছন্দ??
–পড়া বাদ দিয়ে এ প্রশ্ন?
–আপনি সব সময় এই নীল শার্টটা পরে আমাকে পড়াতে আসেন তো তাই বললাম।
–ছাত্রের এমন প্রশ্নে আর কিছু বলতে পারিনি।
–স্যার আপনি একটু বসেন আমি আসছি।

একটু পর ছাত্র আসলো।হাত বারিয়ে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিলো।সাথে একটা লালা খাম।প্যাকেট খুলে দেখলাম সুন্দর একটা নীল শার্ট। ছাত্রের মা দাঁড়িয়ে আছে।নিতে চাইলাম না।কিন্তু ছাত্রের মা এসে জোড় করলো।বললো এটা আমাদের তরফ থেকে আপনার ঈদ বোনাস। খাম টা খুলে দেখি ১৫০০ টাকা।

আজ অনেক অনন্দ লাগছে।কিছু শপিং করে বাসায় ফিরলাম।বাবার জন্য দামাদামি করা সেই ৩৯০ টাকার জুতাটা কিনেছি।মায়ের জন্য একটা শাড়ি আর পাগলীটার জন্য একটা সুন্দর ড্রেস,নীল চুড়ি আর কিছু চকলেট। বাবাকে জুতাটা দিয়ে লক্ষ করলাম বাবা নিরবে বাচ্ছা ছেলের মতো কান্না করছে।কাছে গিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম বাবাকে।কেনো জানি আমার চোখ দিয়েও ঝর ঝর করে পানি পরছে।জানিনা না এ পানি কিসের।তবে হয়তো এই পানি আনন্দের।এই ভাবেই চলছে আমাদের ভালবাসার চার চাকার গাড়ি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত