একটি মৃত্যু

একটি মৃত্যু

বুকে সাহস জমিয়ে নাজিফা তার বাবার কাছে বলেই ফেলল, ‘বাবা! আমি রাফাতকে ভালোবাসি৷ ওকে বিয়ে করতে চাই!’ এদিকে রাফাতও তার বাবাকে বলে দিয়েছে, সে নাজিফাকে বিয়ে করতে চায়৷ রাফাতের বাবার কোনো আপত্তি নেই৷ থাকার কথাও না। ছেলে বড় হয়ে যখন নিজে ইনকাম করতে শুরু করে তখন কাজটা খারাপ না হলে বাবা বা তার পরিবারের কেউ তার ঐ কাজে বাধা দেয় না৷ রাফাতের বাবাও দেয়নি৷ তার সোজা-সাপ্টা কথা, ‘নাজিফাকে বিয়ে করতে চাও ঠিক আছে৷ তোমার পছন্দ-ই আমাদের পছন্দ। আর নাজিফাকে তো আমরা চিনি। মেয়ে হিসেবেও সে খুব ভালো।’

রাফাত ভালো চাকরী করে৷ তার ইনকামে দুই-তিন জনের একটা পরিবার সুন্দরভাবে চলার জন্য যথেষ্ট৷ আর ছেলে হিসেবে সে মন্দ নয়। চরিত্রের বিচারে সে যেকোনো মেয়ের বাবার পছন্দের প্রথম কাতারে থাকবে। এছাড়া তার পরিবারিক অবস্থাও খুব ভালো। তাদের আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় বিয়ের বাজারে মেয়ের বাবার পছন্দের পাঁচ-ছ’টা কাতারের প্রথম কাতারে না থাকলেও দ্বিতীয় কাতারে অনয়াসেই ঢুকে যাবে। তাই বলা যায়, যেকোনো মেয়ের জন্য প্রস্তাব নিয়ে গেলে মেয়ের বাবা রাজি হয়ে যাবে৷

মেয়ে রাজি হবে কি না বলা মুশকিল। তবে তার পরিবার চোখ বুঝে রাজি হয়ে যাবে৷ এমন পাত্র কেউ হাত ছাড়া করতে চাইবে না। এসব দিক ভেবেই নাজিফাকে তার বাবার কাছে সব কিছু বলার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলাম৷ এছাড়া রাফাতকে নাজিফার বাবাসহ তার পরিবার অনেক আগে থেকেই চিনে। বিপদে-আপদে রাফাতকে তারা ডাকে। পারিবারিক অনেক পরামর্শও রাফাতের সাথে করে৷ অবশ্য রাফাতকে নাজিফার বন্ধু হিসেবেই চিনতো। তাই আমরা আশা করেছিলাম, আংকেল সহজেই রাজি হয়ে যাবেন৷ কিন্তু আমাদের সবার ভাবনায় জল ঢেলে দিয়ে নাজিফার আব্বা একশত আশি ডিগ্রি এঙ্গেলে বেঁকে বসলেন।

সে খবর আমরা সে রাতেই নাজিফার কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম। নাজিফার বাবা রাজি না হলে নাজিফা সবার অমতেও রাফাতকে বিয়ে করতে রাজি আছে৷ কিন্তু আমরা নাজিফাকে বুঝিয়ে বললাম, ‘রাফাতের বাবাকে দিয়ে প্রস্তাব পাঠিয়ে দেখি। তোর বাবা রাজি হয় কি না!’ সপ্তাহ খানেক পর রাফাতের বাবা প্রস্তাব নিয়ে গেলেন। কিন্তু নাজিফার বাবা রাজি হোননি। আমরা অনেকভাবে বুঝানোর চেষ্টা করলাম৷ তারপরও তিনি রাজি হোননি। বরং আমাদেরকে বলে দিলেন যে নাজিফার বিয়ে সে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে৷

পরদিন নাজিফা ঘর থেকে বের হয়ে গেলো৷ রাফাতের বাসায় এসে উঠেছে৷ নাজিফার একটা-ই কথা, সে রাফাতকেই বিয়ে করবে। রাফাতও এতে রাজি। তার কোনো সমস্যায় নেই। কিন্তু রাফাতের বাবা তা মানতে নারাজ৷ সে একজন বাবা। আরেকজন বাবার কষ্ট বুঝেই এমন বিয়েতে তার অমত। তার কথা হলো, নাজিফাকে বিয়ে করতে হলে তার পরিবারকে রাজি করিয়ে তারপর-ই করতে হবে৷ কিন্তু নাজিফা কোনোভাবেই ফিরে যাবে না। সে রাফাতকে বিয়ে করে এখানেই থেকে যাবে৷ তাকে আমরা অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তার বাসায় ফিরিয়ে দিয়ে আসলাম। নাজিফার বাবাকে অনেকভাবে বুঝিয়ে আবার প্রস্তাব দেয়া হলো। আমাদের কাছ থেকে ভাবার জন্য দু-দিন সময় চেয়ে নিলেন।

দু-দিন পর আমরা যখন নাজিফার বাবাকে ফোন দিলাম৷ তখন তিনি জানালেন যে নাজিফার বিয়ে হয়ে গেছে৷ রাফাত সেটা মানতে না পারলেও সে কিছু বলল না। কিছু দিন একা একা উদাস হয়ে ঘুরে বেড়াতো। অফিসে যেতো না৷ তারপর ধীরে ধীরে তার জীবন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। তবে নাজিফার জন্য যে ক্ষতটা তৈরি হয়েছিলো তা রয়ে গেছে। মাঝে মাঝে প্রকাশ পেতো। পরবর্তীতে শুনেছিলাম নাজিফার বাবা নাজিফাকে খুব ভালো এবং ধনি পরিবারেই বিয়ে দিয়েছে। ভেবেছিলাম নাজিফা খুশি-ই থাকবে।

নাজিফার বাবা নাজিফাকে রাফাতের সাথে বিয়ে দিতে কেনো রাজি হয়নি, জানি না। আর কেনোই বা দু-দিনের সময় নিয়ে তাকে অন্যথায় বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। তাও জানি না। অনেক ভেবে-চিন্তেও আমি যুক্তিসংগত কোনো কারণ বের কর‍তে পারেনি৷ দুইটা কারণ হতে পারে। এক, বাঙ্গালি বাবার মন। ছেলে বা মেয়েকে দরকার হলে পেত্নির মতো মেয়ে বা মাতাল গাঁজাখোর ছেলের সাথে বিয়ে দিবো। তারপরও প্রেমিকা বা প্রেমিকের সাথে বিয়ে দিবো না।  দুই, নাজিফাকে রাফাতের চেয়েও অবস্থাসম্পন্ম পরিবারের ছেলের সাথে বিয়ে দিবে৷ যেটা তিনি দিয়েছেনও। বছর তিনেক পর রাফাতও বিয়ে করে নিয়েছে৷ নাজিফাকে হারানোর ক্ষতটাও ততদিনে মুছে গেছে। আর শুনেছিলাম বছর খানেক আগে নাজিফার একটা ছেলে হয়েছে। ছেলের নামটাও রেখেছে তার প্রাক্তন প্রেমিকের নামে রাফাত।

বাচ্চাটা এখন আমার কোলে বসে আছে। আর রাফাতসহ আমরা সবাই নাজিফার বাড়িতে আছি৷ বাড়ির সবাই শোকে আচ্ছন্ন। তাই বাচ্চা রাফাতের দিকে কারো মনোযোগ দেয়ার সময় নেই। নাজিফা আত্নহত্যা করেছে। যতটুকু শুনেছি বা বুঝেছি তার আত্নহত্যার কারণ হলো তার বরসহ শশুর বাড়ির সবার আত্যাচার। তার বর নাকি প্রায় বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ঘরে বসেই নেশা করতো। নাজিফা তা নিয়ে প্রতিবাদ করলে নাজিফাকে মারধরও করতো। নেশা করে এমনিতেই মারধর করতো৷ প্রতিবাদ করুক আর না করুক। নাজিফার লাশের মুখে-কাধেও মারের দাগ লেগে ছিলো। তার বর নাকি অবৈধ ব্যবসার সাথেও জড়িত ছিলো। যার জন্য বছরের তিন-চার মাস নাকি তার জেলেই কাটাতে হতো।

তার শশুড়-শাশুড়ির কোনো কিছুর অভাব ছিলো না। তবুও নাজিফার বাবার বাড়ি থেকে এটা-সেটা নেয়ার জন্য বিভিন্ন কটু কথা বলতো। এ কথাগুলো আগেই শুনেছিলাম। তখন ভাবতাম মানুষ তো কত গুজব-ই ছড়ায়। এগুলাও হয়তো গুজব। কিন্তু এখন বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছি৷ এগুলো কোনো গুজব নয়। সব সত্য৷ মেয়েটা তিনটা বছর এগুলো সহ্য করেছে। সহ্যের শেষ সীমায় পৌছে নিজের এক বছরের শিশু সন্তানের কথা চিন্তা না করেই অথবা চিন্তা করেই এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে।

নাজিফার মরার কথা শুনে আমরা এখানে দৌড়ে এসে যখন নাজিফার বাবার মুখামুখি হয়েছিলাম। তখন তিনি হাত জোর করে ‘বাবা! আমাকে ক্ষমা করে দিও! সব কিছু আমার জন্য হয়েছে।’ বলে রাফাতের বুকে মাথা ছুয়ে বাচ্চাদের মতো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না শুরু করে দিয়েছিলেন।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত