মিসন ইমপসিবল

মিসন ইমপসিবল

: কি, খাচ্ছো না যে? সেমাইটা মজা হয়নি?

: জী আন্টি মজা হয়েছে তো..

: সরি, তোমাকে ঠিক মতো আপ্যায়ন করতে পারলাম না, আসলে বাইরে যাব আগে থেকেই ঠিক করা ছিল তো, আর তুমিও একটা ফোন করে আসতে পারলে না …

: জী আন্টি, ভুল টা আসলে আমারই হয়েছে, আগে থেকে জানিয়ে আসাই উচিত ছিল, অ্যা ইয়ে আপনারা কি রেডি আন্টি তাইলে এক সাথে বেরোই?

: এই তো জাস্ট পাঁচটা মিনিট বস, আসতেছি ..

সকাল সকাল বেশ একটা সাজুগুজু দিয়ে বের হয়েছিলাম। উদ্দেশ্য যথেষ্ট মহৎ, বাড়ি বাড়ি গিয়ে কোরবানীর গোশত টোকানির বদলে গোশত খাওয়া।

ঈদের ছুটি পাইনি বলে বাড়ি যাওয়া হয় নাই আর এজন্য কোরবানীর গোশত খাওয়াও হয় নাই। অবশ্য চাইলে হয়তো ঘ্যানঘ্যান করে চার পাঁচ দিনের ছুটি পাওয়া যেতো কিন্তু তাতে তেমন কোন লাভ হতো বলে মনে হয়না। চট্টগ্রাম থেকে বগুড়া যাওয়া আসা করতে পাঁচ দিনের বেশি জ্যামেই বসে থাকা লাগতো। কাজেই ছুটি না গিয়ে সরকারি দায়িত্ব পালনের মহান ব্রত নিয়ে থেকেই গেলাম।

থেকে তো গেলাম কিন্তু তাই বলে কি কোরবানীর গোশত খাব না! এমনেই আমি পেটুক শ্রেণীর, তারওপর গরুর মাংস আমার ফেভারিট, না খেয়ে থাকা যায়!

কাজেই কার কার বাসায় হানা দেয়া যায় ভাবতে ভাবতে তার একটা লিস্ট তৈরি করে ফেললাম মনে মনে। এখানে খুব কাছের কোন আত্মীয় স্বজন আমার নেই তবু হালকার উপরে ঝাপসা তিনজন মানুষ পাওয়া গেল, যাদের বাসায় গেলে এটলিস্ট ভদ্রতা করে হলেও গোশত খেতে দেবে।

তো সেই মিশন নিয়ে ঈদের পরদিন বের হলাম। ঈদের দিন নরমালি মানুষজন নানান কাজ কর্মে ব্যস্ত থাকে, ঠিকঠাক মতো রান্না করতে পারে না সেজন্য ঈদের দ্বিতীয় দিনই মিশন এক্সিকিউসনের উপযুক্ত সময়।

সেই প্ল্যান মাফিক প্রথমেই দূর সম্পর্কের এক আন্টির বাসায় এসে হাজির হলাম। উনি আমার এতোই লতায় পাতায় আত্মীয় যে গোড়া খুঁজতে গেলে আমারই হারায় যাবার সমূহ সম্ভাবনা। তবুও কোরবানীর গোশত খাবার লোভে লাজ লজ্জা ভুলে উনার বাসাতেই ল্যান্ড করলাম এবং করেই ভদ্রমহিলা কে যথেষ্ট অস্বস্তিতে ফেলে দিলাম। উনারা পরিবারসহ কোথাও যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন।

তবুও আমাকে দেখে খুশি খুশি ভাব ধরে ফ্রিজ থেকে কিছু ঠান্ডা সেমাই, পায়েস এনে হাজির করলেন। ঈদের পরদিন বলে কথা, খালি মুখে তো আর ফেরানো যায়না। আমি কাঁচুমাচু করে কোনমতে সেটাই একটুখানি মুখে দিয়ে পালিয়ে বাঁচলাম, বাবারে বাবা, আগের দিনের বাসি জিনিস, খাওয়া যায়!

ওখান থেকে বের হতেই ফোন দিলাম শিল্পী আপুকে, এবার আর ভুল করা যাবেনা। শিল্পী আপু আমার এক বান্ধবীর বড় বোন, বিয়ে করে এখানে থাকেন। বেশ ভালো, মাঝে মাঝেই বাসায় যেতে বলেন কিন্তু যাওয়া হয়না। আজকে এই সুযোগে যদি যাওয়া যায়।

আপুকে বাসাতেই পাওয়া গেল। দুপুরে খাব একথা বলতেই খুব খুশি হলেন। ঠিকানা দিলেন তারাতারি পৌঁছে যাবার জন্য। আমিও উচ্ছ্বসিত হয়ে পরিমরি করে ছুটলাম শিল্পী আপুর বাসায়।

সেখানে পৌঁছে নানান গল্প গুজব শেষে খাবার টেবিলে ডাকলেন। অবশ্য গল্প করতে করতেও সেমাই, চটপটি হাবিজাবি খেতে দিয়েছিলেন কিন্তু পেটে জায়গা রাখার জন্য সেসব ছুঁয়েও দেখিনি, মনে মনে শুধু দুপুরের খাবারের অপেক্ষা।

অবশেষে সেই কাঙ্খিত দুপুরের খাবারের ডাক এলো। উত্তেজনায় হাত পা কাঁপতে লাগলো আমার, এইতো আর একটু। আর একটু পরেই গরুর গোশতের উপ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ব, চিন্তা করতেই মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। খেতে বসে একটা একটা করে আইটেম আপু তুলে দিতে লাগলেন। ইলিশ ভাজা, বেগুন ভাজা, ডিম ভুনা, কাবাব, মুরগীর রোস্ট, হাসের মাংস আরও হাবিজাবি কি কি সব। আমি একটু অবাক হতেই শিল্পী আপু উত্তর দিলেন …

: গরুর মাংস খেতে খেতে সবাই বিরক্ত হয়ে যায় বুঝলি, এজন্য আর গরু রান্না করিনি তোর জন্য, ভালো করিনি বল?

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা ঝাঁকালাম, ভালো করেছেন। বেচারী! সে তো আর জানে না যে গরুর গোশতের জন্যই আমার এখানে আসা। কি আর করা, কপালে নাই ভেবে এসব হাবিজাবি দিয়েই একটু খেয়ে নিলাম।

: হ্যালো রুবিনা আপা, বাসায় আছেন?

: হ্যা আছিতো, কেন?

: না মানে একা একা ভালো লাগছে না তাই ভাবলাম আপনাদের ওখানে বেড়ায় আসি।

: হ্যা হ্যা অবশ্যই, চলে আয়, বাসা চিনবি তো?

: হ্যা তা চিনব তবে আপা আমার জন্য কোন কষ্ট করার দরকার নাই।

: কি কষ্ট!

: না মানে আমি আসব এটার জন্য নানান রান্না বান্না করবেন তার কোন প্রয়োজন নাই।

: কি বলিস! তাই বলে কোরবানীর ঈদে কিছু খাবি না?

: হ্যা তা খাব, শুধু কোরবানীর মাংস রান্না করলেই হবে, এক্সট্রা কিছু করার দরকার নাই।

: আচ্ছা সেটা দেখা যাবে, তুই চলে আয় কেমন…

রুবিনা আপা আমার মেডিকেল কলেজের সিনিয়র। কিছুদিন আমার রুমমেটও ছিলেন। কাজেই উনার কাছে একটু তো আবদার করাই যায়। তাই বিকেল গড়াতে না গড়াতেই শিল্পী আপুর বাসা থেকে বিদায় নিয়ে রুবিনা আপার বাসায় দাখিল হলাম এবং দাখিল হয়েই সরাসরি টেবিলে ..

: আপা খেতে দেন, সারাদিন তেমন কিছু খাই নাই।

: কি বলিস!

খাইনি শুনে রুবিনা আপা অস্হির হয়ে খাবার দাবার হাজির করলেন সামনে। আদর করে পাতে উঠিয়েও দিতে লাগলেন।

: আপা, এটা তো গরু মনে হচ্ছে না, এটা কিসের মাংস?

: খাসী, কেন, খাসনা?

: অ্যা… খাই কিন্তু ইয়ে মানে …গরু নাই?

: না রে তোর ভাইয়ার গরুতে এলার্জি, এজন্য আমরা খাসি কোরবানী দিয়েছি।

আমার অধিক শোকে পাথর হওয়ার দশা। সামান্য গরুর মাংস তাও আবার কোরবানীর ঈদে, সেটাই পাওয়া যাচ্ছে না! ভগ্ন মনে একটু খেয়েই উঠে এলাম। মনে খুব দুঃখ, ঈদের দ্বিতীয় দিন অথচ কোথাও গরুর মাংসের দেখা পেলাম না। এবারের ঈদ কি তবে পুরোপুরি কোরবানীর গোমাংস ছাড়াই কাটাতে হবে!

: হ্যালো শারমিন, আজকে রাতে কয়েকজন কে খেতে বলেছি বুঝলে, তোমারও দাওয়াত, চলে এসো।

: জী স্যার, অবশ্যই স্যার।

খুশিতে আমার চোখ চকচক করে উঠল। এজন্যই লোকে বলে যার কেউ নাই তার আল্লাহ আছে। আমি যখন আশা একদম ছেড়েই দিচ্ছিলাম ঠিক তখনই সিনিয়র একজন অফিসার ফোন করে দাওয়াত দিলেন।

কাজেই হতাশ মনে আশার আলো জ্বেলে স্যারের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সেখানে পৌঁছে গল্প গুজবের এক ফাঁকে জেনেও নিলাম, উনারা কি কোরবানি দিয়েছেন। গরু, শুনেই মনটা খুশিতে ভরে উঠল। এই না হলে কোরবানী!

আমি যে রুমে বসেছি, সেখানে সব মেয়েরা আর সেটার ঠিক পাশেই রান্নাঘর। গরুর মাংসের গন্ধে যেন মৌ মৌ করছে, একদম জিভে জল আসার দশা। ইচ্ছা করছে নিজেই রান্নাঘরে গিয়ে নিয়ে নিয়ে খাওয়া শুরু করি। কিন্তু ঐযে ভদ্রতা, সেটা থাকারও বিপদ আছে বৈকি, সেটার জন্যই যাওয়া গেলনা। খানিক বাদেই রাতের খাবার পরিবেশন করা হল। প্রথমে ছেলেরা নিয়ে চলে যেতেই আমরা মেয়েরা এগিয়ে গেলাম। আমি লজ্জার মাথা খেয়ে সরাসরি ভাবীর কাছে হাজির।

: ইয়ে ভাবী, গরুর মাংস …

: এইযে বাটিতে আছে, আপনার স্যার বলল মেয়েরা নাকি অনেক ওয়েট কনশাস, এজন্য কম খায়, আর আপনারা তো ইচ্ছে করলে মোটাও থাকতে পারবেন না এ কারনে মেয়ে দের কম করে দিয়েছি, নেন

বলেই দুই পিস হাড্ডি আর এক পিস পাতলা স্লাইস করে কাটা মাংস সহ একটা বাটি এগিয়ে দিলেন। দেখে আবেগে আমার চোখে পানি চলে এলো। ইশ্ সবাই মেয়েদের স্বাস্থ্যের বিষয়ে এতো সচেতন, ভাবা যায়! ভাবী আমার পাশে বসেই পড়লেন খাদিমদারি করতে করতে, কোলে তার আদরের পারসিয়ান বিলাই, কলম্বাস।

: বুঝলেন আপু যত জনকে দাওয়াত দিলাম কোন মেয়ে গরুর মাংসের বাটি ছুঁয়েও দেখেনি। বলে কিনা অনেক ফ্যাট, এখনকার মেয়েরা বেশ সচেতন তাইনা?

নীরবে মাথা ঝাঁকালাম। মনে মনে খুব আফসোস, মেয়ে গুলা ডায়েট করে আর তার জন্য আমার মতো পেটুক গুলার অবস্থাও খারাপ, খেতে পায়না। তবু সেই হাড্ডির মধ্যেই মুখ গুঁজতে যাব সেই সময়েই ভাবীর কলম্বাস কি মনে করে ঝাঁপ দিয়ে আমার গোশতের বাটির মধ্যে পড়ল। আমি শোকে পাথর তো আগেই ছিলাম, এবার যেন সেই পাথর ফেটে পানি পড়ার দশা।

ভাবী পরিমরি করে কলম্বাস কে সরালেন কিন্তু ততক্ষণে নষ্ট যা করার তা করে ফেলেছে। ভাবী বারবার করে দুঃখ প্রকাশ করলেন, কলম্বাস নাকি কখনই এমন করেনা, কলম্বাস গরু খায়না। এরপর অতি দ্রুত রান্নাঘরে গেলেন, ফিরে এলেন মুরগির বিশাল বিশাল ঠ্যাঙ হাতে, গরু শেষ হয়ে গেছে। আমি হতাশ চোখে কলম্বাসের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। খাবি না তো মাখাইলি ক্যান ব্যাটা বল! ইশ, আমার সাধের গরু, কোরবানীর গরু, আহা!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত