মানবতার জয়

মানবতার জয়

“বাবা, আজ টিউশনে পাওয়া এই চার হাজার টাকা নিন। আড়াই মাস ধরে রহিম চাচার দোকানে দৈনন্দিন বাজার খরচের টাকা বাকি পরে আছে। ঋণটা শোধ করে আসুন।” বাবা কাঁপা কাঁপা হাতে টাকাগুলো মুঠোবন্দি করলেন। ভ্রু কুঁচকে বললেন,” তোমার তো অনার্স ২য় বর্ষের পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপের লাস্ট ডেট আগামীকাল। রহিম তো টাকাটা চাচ্ছে না। বরং আগে তোমার ফর্ম পূরণ করো। পরে না হয় শোধ করে দিবো।” বাবাকে বললাম,” চাচার ছেলে অসুস্থ। আমি একটি টিউশনে ফর্ম ফিলাপের কথা বলে টাকা চেয়েছি। আশা করি, তারা সময়মতো দিয়ে দিবেন।” হয়তোবা বাবা নিশ্চিত হতে পারেন নি। টিউশনির টাকা পাওয়া নিয়ে আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। ছাত্রী ২য় সাময়িক পরীক্ষায় বরাবরের মতো ১ম হলে গড়ে ৯৫ করে নম্বর পায় নি। তাই দুইমাস ধরে সম্মানী আটকে রেখেছে। গত দুইমাসে একদিনও আমি টাকা চাইনি।

রহিম চাচা মাটির মানুষ। কখনোই তিনি আমাদের বকেয়া টাকা আদায়ের জন্য চাপ দেন না। বরং ধার চাইলেও সাহায্য করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কারণে তার ছোটো ছেলে এক সপ্তাহ আগে প্যারালাইজড হয়ে গেছে। তাই আমাদের বকেয়া টাকাটা চেয়েছেন। বিষয়টি বাবাকে না জানানোর জন্য বিশেষ অনুরোধ করেছেন। অবশ্য আমাদের উচিত হবে তার বিপদে পাশে দাঁড়ানো। বাবা আমার হাতেই টাকাগুলো গুজে দিলেন। আগে আমার ফর্ম ফিলাপ করার তাগাদা দিলেন। অনেকদিন ধরেই বাবা শয্যাশায়ী। টিউশনির টাকায় কোনোমতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সংসার চলছে। পাশাপাশি পড়ালেখার খরচ তো আছেই।

সর্বশেষ কবে এককাপ চা খেয়েছিলাম তা মনে নেই। অবশ্য সামীর (ক্লাসের সেকেন্ড বয়, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু) টেস্ট পরীক্ষায় ১ম হওয়াতে কিছুদিন আগে ট্রিট হিসেবে দুটো শিঙারা খাইয়েছিলো। যদিও আমি সর্বদা ক্লাসে ১ম হলেও কাউকে ট্রিট দিতে পারিনি। আক্ষেপ করার কিছু নেই। অসুস্থতার কারণে আমার প্রিয় বিষয় ব্যবসায় গণিত পরীক্ষাটি দিতে পারিনি। ফলে কোনো মেধাক্রমে ছিলাম না! ফযরের নামাজ পড়তে গিয়ে রহিম চাচার হাতে বকেয়া ৪০০০ টাকা তুলে দিলাম। চাচা কিছুটা অপ্রস্তুত ছিলেন। বাবার কুশলাদি জিজ্ঞেস করে বাড়ির উদ্দেশ্য রওয়ানা দিলেন।

আজ আমার ফর্ম ফিলাপের শেষ দিন। টাকাটা জোগাড় করতে পারিনি। পারার কথাও না। দুটো টিউশনে মাস হলেও টাকা দেয়নি। চক্ষুলজ্জা পদদলিত করে দুইবার বিনীতভাবে টাকা চেয়েছি। আমার কাছে মনে হয়েছিল ভিক্ষা চাচ্ছি। তবুও তারা মিথ্যা অযুহাত দেখিয়ে টাকাগুলো দেননি। অনিশ্চিত ভবিষ্যতকে সঙ্গী করে বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। দীর্ঘশ্বাস ও অসহায়ত্ব আমার জীবনকে এই মুহূর্তে জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ডের উপর নিক্ষেপ করেছে। কোনোকিছুই ভালো লাগছিলো না। একঘন্টা ধরে বাবা কলেজে যাওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছেন। কিন্তু আমার কাছে তো টাকা নেই। আমাকে ফিরিয়ে দেওয়া ৪০০০ টাকা তো চাচাকে দিয়েছি। বাবা বিষয়টি জানেন না। তাই তাগাদা দিচ্ছেন।

সকাল নয়টা বাজে। আরেকবার টিউশনি দুটোয় ফোন করে টাকা চেয়েছি। তারা পূর্বের মতোই আচরণ করলেন। অনেক অনুনয় করেও লাভ হয় নি। অটোভ্যানের শব্দে জানালা খুলে বাইরে তাকালাম। সামীর ও তাঁর আব্ব্বু (রহিম চাচা) ভ্যান থেকে নেমে আমাদের ঘরে আসলেন। হাতে ফর্ম ফিলাপের টাকা দিয়ে দ্রুত রেডি হতে বললেন। আমি অবাক হলাম। সামীরের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলাম। আমি আর সামীর একই বিল্ডিংয়ে টিউশনি করাই। পাশাপাশি ফ্লাট। আজ সকালে টিউশনে গেলে আন্টি (ওর ছাত্রীর মা) সামীকে ফর্ম ফিলাপের টাকা দেন। যদিও সামীর টাকা চায়নি। তাছাড়া মাস হতে আরো ১৭ দিন বাকী। সামীর আন্টিকে কারণ জিজ্ঞেস করলে আন্টি বলেন,”

~~~পাশের বাসার ভাবী (আমার ছাত্রীর মা) আমাকে বলেছেন, তার মেয়ের টিউটরের দুমাসের বকেয়া বেতন তিনি আটকে রেখেছেন। মেয়ে খারাপ ফল করেছে। ক্লাসে ১ম হলেও গড়ে ৯৫ করে নম্বর পায়নি। তাই তিনি টিউটরকে শিক্ষা দিচ্ছেন। আমি ভাবলাম তুমিও তো ২য় বর্ষে পড়। মাস হয়নি তাতে কি! সব অভিভাবক তো আর এক নয়। তোমার লাগেনি বা মাস হয়নি বলে হয়তোবা টাকাটা চাও নি। টাকাটা দিলাম নিয়ে যাও। ছেলেটাকে আমি চিনি। তোমার না লাগলেও প্রয়োজনে ওরে (আমাকে) ধার দিও। আমি শুনে কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। আমার নিজ টিউশনির অভিভাবক আমার পাওনা টাকা দেননি। অথচ অন্য টিউশনির আন্টি আমার ফর্ম ফিলাপ নিয়ে ভাবেন। বিচিত্র মন-মানসিকতা সম্পন্ন মানুষের অভাব নেই এই পৃথিবীতে। টিউশনির সকল আন্টির মানবতার জয় হোক।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত