বিয়ে

বিয়ে

আমার বান্ধবী সীমার বিয়ে হয়েছে এস.এস.সি পরীক্ষার পর পর। আমি যখন ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে উঠলাম তখন তাঁর প্রথম ছেলের জন্ম, ছেলের নাম রাখা হয়েছে সিয়াম। অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের মাঝামাঝি সময়, সীমার দ্বিতীয় ছেলে সেতু জন্ম নিলো। আমি তখন ফাইনাল ইয়ারে পড়ি। ফাইনাল পরীক্ষার সময়, দুলাভাই একদিন ফোন করে বললেন, “ভাই সীমার তো রাতে সিজার, রক্ত লাগবে! দিতে পারবা?” সীমা আর আমার রক্তের গ্রুপ এক, “ও+ (পজেটিভ)।” তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে গিয়ে রক্ত দিলাম। সেবার সীমা মেয়ে সন্তানের জন্ম দিলো। তাঁর নাম রাখা হলো কথা।

অনার্স জীবন শেষ করে, মাস্টার্সে ভর্তি হলাম। মাঝে মধ্যে সীমার সাথে ফোনে কথা হয়। সে এখন বাচ্চাদের নিয়ে মহা ব্যস্ত। তিন বেটা-বেটি সারাদিন হৈচৈ করে। সে সারাদিন তাদের পিছু পিছু দৌড়-ঝাঁপ করে। ফোন করলে, সিয়াম কি করল, সেতুর শরীর ভাল নাই, কথা রাগ করেছে, এইসব শুনতে শুনতে আমার আর বলার মতো কিছুই থাকে না। সাংসারিক জীবনের পাশাপাশি সীমা অনার্স জীবন শেষ করেছে। কথা আরেকটু বড় হলে তাঁর কিছু একটা করার ইচ্ছা। যদিও দুলাভাইদের টাকা-পয়সার অভাব নাই। গার্মেন্টস ব্যবসা। উত্তরায় নিজেদের বিল্ডিং বাড়ি।

সীমাদের বাড়ি থেকে আমদের বাড়ি দশমিনিটের পায়ে হাঁটা পথ। কয়দিন হলো সীমা বাড়িতে এসেছে। আমরা প্রতিদিন বিকেলের দিকে বাইরে বের হই। আমাদের সাথে থাকে সীমার তিন বাচ্চা সন্তান। রাস্তায় এর-ওর সাথে সীমার দেখা হয়। তাঁরা সীমার বাচ্চাগুলোকে আদর করে, আমার দিকে তাকিয়ে সীমাকে জিজ্ঞাসা করে,

“এইটা কি তোমার ছোটভাই? চেহারায় অনেক মিল আছে তো!” কি লজ্জার কথা! সীমা আমার চেয়ে একবছর তিনমাস তেরদিনের ছোট, এরপরেও মানুষ আমাকে ভাবছে সীমার ছোটভাই। অবশ্য সীমা বিয়ের পর থেকে যেই হারে মুটু হয়েছে, তাতে আমাকে পাঁচ-ছয় বছরের ছোট লাগা কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার না। কিন্তু বয়স তো আমার থেমে নাই। কবে বিয়ে করব? কবে বাচ্চা-কাচ্চা হবে? তাদেরকে লালন-পালন করে প্রতিষ্ঠিত দেখে যেতে পারব তো? মনে বহু শংকা, মনে হচ্ছে বিয়ের যোগ্যতা অর্জন করতে করতে বিয়ের আগেই মরে যাব।

মাস্টার্স শেষ করে, বেকার জীবন-যাপন করছি। রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াই, চাকরির চেষ্টা করি, গল্পের বই পড়ি, ফেসবুকিং-নাটক এইসব নিয়েই পড়ে থাকি৷ কিছুদিন হলো সীমা বাড়িতে এসেছে। তাঁর বড় ছেলের মাথায় নতুন এক চিন্তা ঢুকেছে। আমি তাঁর মামা তাহলে মামী কোথায়?

বিকেল থেকে সিয়ামকে নিয়ে ঘুরছি। সীমার তিন ছেলে-মেয়ের মধ্যে সিয়ামের সাথেই আমার যা সম্পর্ক, সে পড়ে ক্লাস টুতে। সেতু আমাকে বিশেষ পছন্দ করে না। কথা আমার চেহারা দেখলেই কেন যেন হাত-পা ছুড়ে করে কাঁদতে শুরু করে দেয়। সিয়ামকে নিয়ে লেকপাড় দিয়ে হাঁটছি এমন সময় সিয়াম বলল, “মামা, মামী কোথায়?” কি যন্ত্রণা! বিয়াই করলাম না, মামি আসবে কোত্থেকে? সিয়ামের হাতে আলতো চাপ দিয়ে বললাম, “বেটা, বিয়েই তো করিনি, মামি আসবে কোত্থেকে?”

–“এখনো বিয়ে করনি কেন মামা?”
–“বুঝবি আরেকটু বড় হ, সব বুঝে যাবি।”
–“মামা আমিতো বড় হয়ে গেছি।”
–“তাহলে তো তোকে বিয়ে দিতে হয়।”
–“তুমি তো আমার থেকেও বড় তাহলে তুমি বিয়ে কর না কেন?”
–“বেটা, আমার বিয়ে করার যোগ্যতা হয় নাই। চাকরি-ব্যবসা না থাকলে মেয়ের বাপ-মারা মেয়ে দিবে না।”
–“আমি তো বুঝতে পারছি না মামা।”
–“বেটা এই দেশে মেয়েদের পড়াশোনা করতে করতে বিয়ে হয়ে যায়।

পড়াশোনা করলেও বিয়ে হয়, না করলেও  বিয়ে হয়। পড়াশোনা শেষ হবার জন্য অপেক্ষা করা লাগে না, চাকরি-বাকরিও লাগে না কিন্তু ছেলেদের পড়াশোনা শেষ হলেও বিয়ে হয় না, চাকরি-ব্যবসা থাকতে হয়। বুঝলি? আমাকে দেখছিস, চুল সব সাদা হয়ে যাচ্ছে। চাকরি পাচ্ছি না এইজন্যে বিয়াও করতে পাচ্ছি না।” সিয়াম কি বুঝল বোঝা গেল না। সে আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, “মামা আমি বিয়ে করব।” আমি সিয়ামকে কোলে তুলে নিয়ে বললাম, “কাকে বিয়ে করবিরে?” সিয়াম চিন্তায় পড়ে গেল। কার কথা বলবে বুঝতে পারছে না। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “কর বাবা, যত তাড়াতাড়ি বিয়ে করবি ততই ভাল। আমাকে তো দেখছিস-ই। এখনই বিয়ে করতে না পারলে তোরও আমার মতো অবস্থা হবে।” সিয়ামকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আমি বাড়ি ফিরলাম। রাতে সীমা ফোন করে বলল, “সিয়ামকে কি বলছিসরে?”

–“আমি আবার কি বলব। কিছু বলিনি তো।”
–“সেতো বিয়ে বিয়ে করে কান্নাকাটি করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলছে।”
–“সর্বনাশ।”

সিয়ামের গলার স্বর স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। সে কাঁন্নামিশ্রিত কন্ঠে বলছে- “আম্মু আমাকে একটা বিয়ে এনে দাও। বিয়ে এনে দাও।”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত