মায়া

মায়া

জানালাটা বন্ধ কর, মুটি মোটা মেয়েটি খোলা জানালার অর্ধেক আড়াল করে এদিক ফিরে দাঁড়ায়। বাকি অর্ধেক দিয়ে মেয়েটির গায়ের ডানদিক ঘেঁষে হুড়মুড়িয়ে হলুদরঙা রোদ ঢুকে রুমে। আমি চোখের পাতা বন্ধ করে ও স্পষ্ট দেখতে পাই, মোটা মেয়েটির চোখে হাসি। আমার প্রচন্ড রাগ হয়।

আমার ভীষণ ইচ্ছে করে মেয়েটির মাথার চুল ধরে জানালায় গাঁথা লোহার গ্রীলে ‘ঠুকুস’ ‘ঠুকুস’ করে অনেকক্ষণ বাড়ি দিই। মেয়েটি আমার বুজে রাখা চোখের পাতা দেখেই বুঝে যায়, আমি কি ভাবছি। তারপরেও হাসে। হয়তো মেয়েটি জানে, আমার বেশিরভাগ ইচ্ছেগুলোই এখনো অপূর্ণ ই থেকে গিয়েছে। এটাও। আমি চোখ খুলে ভ্রুঁ কুঁচকে হাসৌজ্জ্বল মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হই, কি বিশ্রী করে হাসে মেয়েটি! ডানদিকের দাঁত একটি বাঁকা, ভেতরের দিকে ঢুকানো, হাসলে দেখা যায়। এমতাবস্থায় মেয়েরা পারতপক্ষে হাসেনা। হাসলেও এমন ভাবে হাসবে, দাঁত সবগুলো দেখা যাবে তবে ঐ একটা বাদে। এই মেয়েটি উল্টো। তাছাড়াও মেয়েটির হাসির আওয়াজ খিল খিল না। খিক খিক। কোনো অষ্টাদশী তরুণী এমন বিশ্রী ‘খিক খিক’ করে হাসতে পারে জানা ছিলোনা আমার।

লোকের বদ্ধ ঘরে দম আটকে আসে, আমার বদ্ধ ঘর প্রিয়। জানালা দিয়ে আসমান চলে আসে রুমে, আমার বিরক্তি লাগে। আমার একলা সময়ে আমি কাউকেই আসতে দিইনা। আলোকে ও না। শুধু এই মেয়েটি আসে। প্রতিদিন আসে। একা আসেনা। সাথে করে নিয়ে আসে দখিনা বাতাস, এক তৃতীয়াংশ নীলচে আসমান, একটুকরো রোদ আর বিশ্রী গা জ্বালানো ঐ ‘খিক’ ‘খিক’ হাসি। সকাল বেলা দশটা অবধি ঘুমোনোর এক তীব্র ইচ্ছা প্রতিদিন বিসর্জন দিতে হয় আমায়। কি বিপদ! মোটা মেয়েটির চিকন কন্ঠস্বর শুনি,

— উঠ…

আমায় আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠতে হয়। মোটা মেয়েটি বিছানা গুছিয়ে ফেলে চটপট। তারপর রান্নাঘরে মায়ের সাথে শুরু করে ভুজুর- ভাজুর গল্প।

গল্পের নব্বই শতাংশ জুড়ে থাকে ‘মনি, তোমার ছেলেকে আমি বিয়ে করবোনা। আমি অলস মানুষ ভয়ংকর অপছন্দ করি। তোমার ছেলে অলস। মহা অলস। তোমার একটা ছেলে কেন? তুমি আর বাবু নাও নাই কেন? ইশশ.. আর একটা ছেলে যদি থাকতো তোমার। কি পাপ করেছিলাম আমি? আমার কপালে এটাই কেন জুটলো?’ মা কে ‘মনি’ ডাকে মেয়েটি। আমার মায়ের নাম ‘মনি’ না। রেহানা বেগম। মেয়েটি মনি ডাকছে। অবশ্য এটি একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। বিয়ের পর ‘মনির’ আগে ‘মা’ লাগানো হবে। ‘মামনি।’ গালে হাত রেখে আদুরে গলায় মেয়েটিই এটা বলেছে আমায়। মা মেয়েটির ভুজুর- ভাজুর গল্প শুনে হাসি চেপে রেখে চিন্তিত স্বরে দুঃখ প্রকাশ করে,

— আচ্ছা, ঠিক আছে। করিস না বিয়ে। অলস হলেও একটাই তো ছেলে আমার। আমি কি করবো বল মেয়েটি মায়ের কানের কাছে মুখ এনে নিচু স্বরে পরামর্শ দেয়ার চেষ্টা করে,

— সকাল বিকাল থাপ্পড় দিতে হবে। আমাদের বাসার নিচতলার গোঁয়ার ছেলেটার ও একিই অসুখ ছিলো। মনি, বললে বিশ্বাস করাবানা, দু’সপ্তাহেই সিধে হয়ে গেছে। তুমি তোমার ছেলেটাকে আদর দিয়ে দিয়ে আমি নাস্তার টেবিলে বসে রান্নাঘরের খন্ড খন্ড আলাপ শুনে হাত মুঠো করি আর খুলি। রাগে সমস্ত শরীর জ্বলে আমার। পাশের ফ্ল্যাটের বন্যা- ক্লাসমেট তনিমা, রাখী, ছন্দা- মেশকাতের খালাতো বোন রিয়া সহ পৃথিবীর এতো লক্ষ লক্ষ মেয়ে থাকতে এই মেয়েটিই কেন কপালে জুটলো আমার? মেয়েটি নাস্তার টেবিলে এসে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকা করে বিশ্রী- ক্ষ্যাঁত ভঙ্গিতে পাউরুটি চিবোয়। তার ‘দুর হ’ টাইপের দৃষ্টি এসে আমার সমস্ত শরীরে হুল ফুটিয়ে বিষাক্ত কোনো একটা কিছু শরীরের প্রত্যেকটি কোষে কোষে ছড়িয়ে দেয়। আমি কি কখনো ভেবেছি, মোটা মেয়েটির এই রাগে গায়ে আগুন ধরানো দৃষ্টি একটা সময় তীব্র অসহ্য কষ্টে নীল হয়ে উঠা আমার চোখ দু’টোর দিকে তাকিয়ে অশ্রুজলে ভিজতে ভিজতে কাঁপতে কাঁপতে বলবে আমায়,

— এ্যাই… শুন, আমার চোখের দিকে তাকা। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাক। কষ্ট কম হবে। দেখ আমি কাঁদছিনা। আমি তোকে যতোটুকু চেয়েছি, তারচেয়েও বেশি পেয়েছি। তুই আমায় ছেড়ে কোথাও যাচ্ছিস না। এই যে তুই আছিস আমার সাথে। আমি একা নই। আমি পূর্ণ, বিশ্বাস কর। পূর্ণ মানুষ কখনো একা হয়না।

মেয়েরা চারটে কথা বলতে গেলে দু’টো কথায় কাঁদে, একটা কথায় ফোঁপায়। বাকি একটা হাসি মুখে বলে। ‘কান্না’ করতে মেয়েরা ভালোবাসে। আমার একটা মেয়ে বন্ধুকে আমি টানা পঞ্চম শ্রেণী থেকে একাদশ শ্রেণী পর্যন্ত প্রতিটি পরীক্ষার রেজাল্টের দিন কাঁদতে দেখেছি। প্রত্যেকটা সাবজেক্টে আশি থেকে নব্বই এর মধ্যে থাকতো মার্কস। তারপরেও কাঁদতো। রেজাল্টের দিন টিস্যু হাতে চোখ লাল করে নাকে চোখে জল এনে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলতো, ‘কি পুওর মার্কস!’

আমি আমার উনিশ- বিশ বৎসরের জীবনে মোটা মেয়েটিকে কখনো কাঁদতে দেখিনি। আমরা সহপাঠী। এখনোও। দু’জনই ডিগ্রী পড়ছি, একিই ডিপার্টমেন্ট, একিই সেকশন, একিই বর্ষ। স্কুল জীবনে আমি প্রেম করতে পারিনি, কলেজ জীবনেও না। এখন পড়াশোনার এই লেভেলেও এসে না। কারণ, স্কুল- কলেজের কোনো মেয়েই আমায় প্রেম প্রেম ভাব নিয়ে তাকায়নি। আমি দেখতে খারাপ নই, চরিত্র ও খারাপ নয়। একটা বদঅভ্যাস ছাড়া আর সবকিছুই ঠিকঠাক। বদঅভ্যেসটা হচ্ছে, সিগেরেট। বারো বৎসর বয়েস থেকে খাচ্ছি! যখন আমার বয়সী ছেলেরা চিপস খেতো কুড়মুড়িয়ে, আমি ‘বাবার জন্যে’ বলে দোকান থেকে নিয়ে আসা সিগেরেট হাতে ছাদে চলে যেতাম ধুমসে ধোঁয়া উড়াতে।

সিগেরেট নাহয় মেয়েরা অপছন্দ করে, কিন্তু শুধুমাত্র সিগেরেট খাই বলে মেয়েরা প্রেম প্রেম দৃষ্টিতে তাকাবেনা, এটা বিশ্বাসযোগ্য কথা না। সমস্যাটা অন্য জায়গায়। স্কুল এবং কলেজের সমস্ত ছাত্র- ছাত্রী প্লাস শিক্ষক শিক্ষিকারাও অবগত আছেন, আমাদের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। মোটা মেয়েটি আমার বৌ। আমরা বিবাহপোযুক্ত হলেই আমাদের বিবাহ আনুষ্ঠানিক ভাবে সম্পন্ন হবে। দু’পরিবারের খামখেয়ালি মার্কা সিদ্ধান্তে নাহয় ছেলে একটার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, বিয়ে তো হয়নি এখনো। শুধুমাত্র ‘বিয়ে ঠিক হয়ে আছে’ কারণ দেখিয়ে পৃথিবীর সমস্ত মেয়েরা তাদের প্রেম প্রকাশ না করে সেটা বুকে গুজে রাখবে, এটা ভাবতেই রাগে গায়ে আগুন ধরে যায় আমার! আমার মেয়ে বন্ধুর সংখ্যা সীমিত হলেও মোটা মেয়েটির ছেলে বন্ধুর সংখ্যা কম নয়। আমি বুঝতে পারিনা, ছোটবেলায়ই বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়া একটা মেয়ের সাথে ছেলেদের বন্ধুত্ব করতে এতোটুকু বিবেকে বাঁধেনা কেন! উল্টোদিকে মেয়েরা যেখানে আমার দিকে ফিরে ও চায়না। আমি হিংসেয় জ্বলি। কলেজ মোড়ের টং দোকানের বেঞ্চিতে বসে ঠোঁটে সিগেরেট ধরিয়ে খুক খুক করে কাশতে কাশতে মোটা মেয়েটিকে বলি,

— তুই একদিন সময় করে মরে যাস না কেন? মেয়েটি হাসে। শব্দহীন। তারপর হাই তুলে বলে,
— বাসায় যা। সন্ধ্যেয় আসছি।
— ছিঃ… মামা কি বলবে? রাত বিরাতে একটা পরপুরুষের বাসায় যাস। লজ্জা করেনা তোর? ছিঃ মেয়েটা হাসি চেপে রেখে মোবাইল হাতে নিয়ে কল লিস্ট দেখায়, মায়ের ফোন। বলে,

— মনি ফোন দিয়েছে। তোর বাসায় আমি তোর জন্যে গিয়ে বসে থাকি ভাবছিস? আব্বু টাঙ্গাইল যাচ্ছে। একসপ্তাহ মনির সাথে আছি। তোকে লাথি মেরে বের করবো বাসা থেকে, ওয়েট কর মামা প্রায়শই অফিশিয়াল কাজে এদিক ওদিক যান, মেয়েটি সোজা চলে আসে আমাদের বাসায়। মামী বেঁচে নেই। মামার একমাত্র সন্তান। মেয়েটিকে কখনো মায়ের জন্যে কাঁদতে দেখিনি। এমন অদ্ভুত মেয়ে ও হয়!

মামার বাসা থেকে আমাদের বাসায় আসতে রিকশায় করে পাঁচ মিনিট, হাঁটাপথে দশ মিনিট লাগে। এই দু’টো বাসা আলাদা মনে হলেও আলাদা নয়। এমনও হয়েছে, মুখে সিগেরেটের গন্ধ পেয়ে মা আমায় চড় থাপ্পড় দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে, আমি গিয়ে উঠেছি মামার বাসায়। সারাদিন মেয়েটির সাথে খুনসুটি, রাগারাগি। কলেজ যাচ্ছি, আসছি, থাকছি, পড়ছি, ঘুমোচ্ছি। এক দুই সপ্তাহ কাটে, মায়ের কোনো টেনশন নেই। কলেজ থেকে বাসায় পৌঁছে বুকের বাঁ পাশে এবং পেটের ঠিক মধ্যিখানে একটা অসহ্য ব্যথা টের পেলাম। ট্যাবলেট একটা খেয়ে চুপ করে শুয়ে পড়লাম। সন্ধ্যেয় ঘুম ভাঙ্গলো। পাশে মেয়েটি বসে আছে বন্ধ জানালার দিকে তাকিয়ে। চুপচাপ। আমি একটু নড়ে উঠে জিজ্ঞেস করি,

— মা কই? তুই কখন আসছিস মুটি? মেয়েটি হকচকিয়ে উঠে জবাব দেয়,

— বাইরে গিয়েছে, আসছি বিকেলে। মনি’র এতোক্ষণে চলে আসার কথা। তোর কি হয়েছে? ব্যথা করছে?
আমি ব্যথা লুকোই, মেয়েটি জানে মাঝে মাঝে আমি হালকা পাতলা ব্যথায় ভুগী। এতেই মেয়েটি ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে! ভাগ্যিস জানাইনি, ব্যথা কি তীব্র।

— ডাক্তার দেখাচ্ছিস না কেন? মনি’কে বলবো?
— আরে দুর। তুই মনি মনি করিস না তো কানের কাছে। রুমের লাইট না জ্বালিয়ে বসে আছিস কেন অন্ধকারে?
— লোডশেড়িং

মেয়েটি চুপ করে বসে থাকে, আমি আবছা অন্ধকারে মেয়েটির খোলা চুলে লেগে থাকা এক অপার্থিব মায়ার গন্ধ পাই। শ্যামলা রঙের, অন্য মেয়েদের থেকে একটু আলাদা এই মোটা মেয়েটিকে আমার প্রচন্ডরকমের ভালোবাসতে ইচ্ছে করে হঠাৎ। এ আমার ছোটবেলার খেলার সাথী। একসাথে বড় হয়েছি। কতো মারপিট, রাগারাগি, ঝগড়া- ঝাঁটির সাক্ষী দু’জন। আমাদের এতো ভালোবাসা জন্মালো কখন?

ডাক্তারের চেম্বারে অল্পবয়স্ক তরুণ ডাক্তারটাকে আমার ঠিক ডাক্তার বলে মনে হচ্ছেনা। ইনি কিছুক্ষণ হলো, একটি অপারেশন করে এসেছেন। আমার কেন জানি মনে হলো, এই ছেলেটাকে দেখলে অপারেশনের রোগী হতাশ স্বরে প্রথম কথা বলবে, ‘এই ছেলে পারবে তো?’ আমি এর আগেও এসেছি কয়েকবার, এবার একগাদা টেস্ট- রিপোর্ট নিয়ে এসেছি। তরুণ ডাক্তার ওসবে চোখ বুলাচ্ছেন দ্রুত। তার চোখের ভ্রুঁ বাঁকা হচ্ছে। ডাক্তারের ঝকঝকা কাঁচের টেবিলের ডানদিকের স্বচ্চ কাঁচের জানালার ওপাশের চমৎকার আকাশটার দিকে তাকিয়ে আমি হুট করে টের পেলাম, এই জীবনে মন ভরে আকাশ দেখা হয়নি আমার। সময় বোধহয় ফুরিয়েছে!

চেম্বার থেকে বেরিয়ে কাগজ গুলি ছিঁড়ে উড়িয়ে দিলাম রাস্তার পাশে। বাসায় এসে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ পর্যন্ত নিজেকে দেখলাম। ক্যান্সারে আক্রান্ত একটা মানুষ ‘ক্যান্সার, লাস্ট স্টেজ, সময় তিন অথবা চার মাস’ শুনার পর প্রথমবারের মতো আয়নায় নিজেকে দেখে কি ভাবে? ‘জীবনের শ্রেষ্ঠ কিছু সময় কাটাও…’ টং দোকানে বসে সিগেরেট ধরিয়ে ঠোঁটে চেপে অবাক হলাম সিগেরেটের প্যাকেটের সতর্কবাণীটা দেখে। ‘ধুমপান মৃত্যু ঘটায়।’ মিথ্যে মনে হতো। আমার কখনো বিশ্বাস হয়নি। ডাক্তার যখন বললো, তখন ও না।

— আপনার সাথে আপনার পরিবার কিংবা বয়োজৈষ্ঠ কেউ আছে? আমি শান্ত স্বরে ‘না’ বলে মাথা নাড়ি। তরুণ ডাক্তার অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে কথা বলেন। আমি জিজ্ঞেস করি,

— ক্যান্সারের লক্ষণ কি? পেটে মাঝে মাঝে অসহ্য যে ব্যথা হতো সেটা? কিন্তু ওটা তো আগে ছিলোনা। ইদানিং হয়েছে।

— ক্যান্সারের স্পষ্ট কোনো লক্ষণ নেই। হালকা জ্বর, কাশি কিংবা অন্য যেকোনো উপসর্গ। এজন্যেই দেরী হয়ে যায় মানুষের। এটা কতোটা ভয়ংকর নিরব ঘাতক আন্দাজ করার জন্যে একটা তথ্য দিই, ক্যান্সার একটা মানুষের শরীরে দশ বৎসর পর্যন্ত সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থেকে ইদানিং ভাবতে ভীষণ অবাক লাগে, কয়েকমাস পর মারা যাচ্ছি। ফিরে এসেই মোটা মেয়েটির সাথে ভয়ংকর এক ঝগড়া বাঁধালাম। বিচ্ছিরি কিছু কথা শুনালাম। রাগ করে চার পাঁচদিন ধরে বাসায় আসা বন্ধ তার। আর মায়ের আমার সাথে কথা বলা বন্ধ। বদ্ধ ঘরে শুয়ে থেকে প্রথমবার টের পেলাম, মোটা মেয়েটি আসলে অক্সিজেনের মতো। অক্সিজেন হরদম পেলে অনেকেই বোর হয়, বিরক্ত হয়… একটু অভাব হলেই ছটফটিয়ে বাঁচতে চায়। আমি একলা রুমের বিছানার এক কোনায় বসে ভাবি, বাকি সময়টুকুর জন্যে কি প্রচন্ড স্বার্থপর হবো?

— চল বিয়ে করে ফেলি।

আমি হকচকিয়ে উঠি, এটা আজ আমার বলার ছিলো। প্রস্তুতি ও নিয়ে এসেছি। আমি ভেবেছি, মেয়েটি শুনে ভীষণ চমকে যাবে। উল্টো আমার চমক কাটতেই দেখি সামনে হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মোটা মেয়েটির চোখ দু’টো লাল। সম্ভবত সারা রাত কেঁদেছে। অন্য কোনো মেয়ে হলে স্বাভাবিক একটা ব্যাপার হতো। সমস্যা হলো, মোটা মেয়েটি কখনো কাঁদেনা। আমি আফসোস করলাম, ঝগড়াটা না করলেও হতো। এটা একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছে! একটা ছোটখাটো আয়োজন হলো, মামা ঝিনাইদহ থেকে অফিসের কাজ ফেলে ছুটে এলেন। বাবা ব্যস্ত আর খুশি খুশি চেহারায় সব তদারকি করছেন। মাকে দেখা গেলো কিছুক্ষণ পর পর কাঁদতে। মোটা মেয়েটির চোখে কি প্রচন্ড সুখ। কেউ জানেনা, শুধু আমি ই বাসার এক কোনায় বসে এক চরম অপরাধবোধে ভুগছি।

পৃথিবীর কোনো প্রেমের গল্পে এমন কোনো স্বার্থপর প্রেমিক জন্মেছে কিনা জানা নেই আমার। আমি একটা নিষ্ঠুর সত্য লুকিয়েছি মেয়েটির কাছে। স্বার্থপরের মতোন মেয়েটিকে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত পাওয়ার জন্যে। মেয়েটি কি কখনো ক্ষমা করবে আমায়? আমি ভেবেছি বিয়ের পর অদ্ভুত সব পরিবর্তন চোখে পড়বে আমার। যেসব দেখে আমি প্রচন্ড অবাক হবো, মজা পাবো, আনন্দ পাবো। কিন্তু কিছুই হলোনা। সবকিছু আগের মতোই। মেয়েটির সকাল সকাল উঠে আমায় বিরক্ত করতে রুমের জানালাটা খুলে দেয়া, মায়ের সাথে ভুজুর- ভাজুর গল্প, কলেজ, দু’টো বাসা, সারাদিন রাগারাগি, ঝগড়া- ঝাঁটি… এই তো!

আমরা প্রথমদিকে ‘তুমি’ করে বলার চেষ্টা করেছি খুব। কিন্তু ‘তুই’ কাউকে ‘তুমি’ বলার জন্যে যে কি প্রচন্ড মানসিক প্রস্তুতি লাগে, জানা ছিলোনা। আমাদের ‘তুমি’ করে বলা হয়নি। সব আগের মতোই। একটা যা পাল্টেছে, তা হলো মেয়েটির শাড়ি। মেয়েটি আগে বিশেষ কিছু দিবসে শাড়ি পরতো, এখন প্রতি দিবসেই পরে। ওহ হ্যাঁ, আরো একটা। ‘মনি’র আগে ‘মা’ লাগানো হয়েছে। দু’টো মাস কাটলো। ষাট দিন। আমার মনে হলো, আমি মাত্র ছয় দিন কাটিয়েছি মেয়েটির সাথে। টের পেলাম, প্রথমবার ক্যান্সারের কথা জেনেও অতোটা আফসোস হয়নি, যতোটা এখন হচ্ছে এই ভীষণ ঝগড়ুটে মোটা মেয়েটির সাথে আমার আর মাত্র ত্রিশ দিন বেঁচে থাকা হবে ভেবে।

সময়, তুমি একটু আস্তে চলো প্লিজ….! সকাল দশটা। একটা বদ্ধ রুম, অল্প পাওয়ারের একটা লাইট জ্বলছে রুমে। এই মুহুর্তে পেট সহ শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ- প্রত্যঙ্গের জোড়ায় জোড়ায় ভয়ানক ব্যথা অনুভব করছি আমি। মোটা মেয়েটি আমার মুখের উপর ঝুঁকে আছে। মোটা মেয়েটির চুল আর শাড়ির আঁচল থেকে একটা মিষ্টি মায়া মায়া গন্ধ টের পাচ্ছি। এই মায়া ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছেনা আমার। আমি মেয়েটির ঝুঁকে থাকা মুখের উপর এসে পড়া চুল কানের পাশে গুজে দিতে দিতে কাঁপা অস্পষ্ট স্বরে বলি,

— আমি এটা তোকে… বলিনি। জানাইনি। আমি খু.. খুব স্বার্থপর, না? মোটা মেয়েটি আমার কপালে জমে থাকা ঘাম মুছে দিয়ে ভেজা স্বরে বলে,
— জানি আমি। বিয়ের আগের দিন ই জেনেছি সব। তারপর লুকিয়েছি তোর থেকে, করুণা করছি ভেবে আবার চলে না যাস তাই, স্বার্থপর আমিও। তোর থেকেও বেশি।

আমি চমকাই, পরমুহূর্তে পেটে তীব্র ব্যথায় ঘোঁ ঘোঁ করে উঠি। আমার গায়ের ঘাম মুছে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মেয়েটি। আমার বুকের উপর যে ভারী পাথর চেপে বসেছিলো, আমি টের পাই সেটা এখন আর নেই। মেয়েটি সব জানতো। সবকিছুই। কিভাবে জানলো জানতে ইচ্ছে করেনা আমার। আমি শুধু তাকিয়ে থাকি মেয়েটির চোখের দিকে। একফোঁটা জল নেই এখনো ওতে।

অথচ আমি জানি, কি প্রচন্ড ভালোবাসা বুকে পুষে রাখলে সব জেনেশুনেও ‘চল, আমরা বিয়ে করে ফেলি’ বলা যায়! তিনশত বৎসর পায়নি মেয়েটি আমায়, তিনটে মাস পেয়েছে… ওটাই দু’হাতে আঁকড়ে ধরেছে। শরীর কুঁকড়ে আসে আমার প্রচন্ড ব্যথায়, চোখ নীল হয়ে আসে। মেয়েটি আমার নীল হয়ে উঠা চোখ দু’টোর দিকে তাকিয়ে কাঁপতে কাঁপতে ভেজা স্বরে বলে,

— এ্যাই… শুন, আমার চোখের দিকে তাকা। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাক। কষ্ট কম হবে। দেখ আমি কাঁদছিনা। আমি তোকে যতোটুকু চেয়েছি, তারচেয়েও বেশি পেয়েছি। তুই আমায় ছেড়ে কোথাও যাচ্ছিস না। এই যে তুই আছিস আমার সাথে। আমি একা নই। তুই আমায় আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ তিনটে মাস উপহার দিয়েছিস। বিশ্বাস কর, আমি পূর্ণ। পূর্ণ মানুষ কখনো একা হয়না। আমি মেয়েটির খন্ড খন্ড কথা শুনতে পাই; সবটুকু পাইনা। দমবন্ধ লাগে আমার। আকাশ দেখতে ইচ্ছে করে। ডানহাতে ভর করে ডানপাশে কাত হয়ে শুয়ে বদ্ধ জানালার দিকে আঙ্গুল তুলে মেয়েটিকে বলি,

— জানালাটা খুলে দে মুটি…

মোটা মেয়েটি ধীরপায়ে জানালা খুলে জানালার অর্ধেক আড়াল করে এদিক ফিরে দাঁড়ায়। খোলা জানালার বাকি অর্ধেক দিয়ে মেয়েটির গায়ের ডানদিক ঘেঁষে হুড়মুড়িয়ে হলুদরঙা রোদ ঢুকে রুমে। আমি চোখের পাতা বুজে রেখে ও স্পষ্ট দেখতে পাই, মোটা মেয়েটির চোখে জল। গাল বেয়ে গড়িয়ে জমে আছে নাকের পাশে। অশ্রুজলের উপর একটুকরো রোদ। চকমক করছে। যেন ছোট্ট হীরে দিয়ে তৈরী এক চমৎকার নাকফুল। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি। কি অপুর্ব সেই দৃশ্য। কি অপার্থিব মায়া ঐ জলে…!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত