বরফের পাহাড়

বরফের পাহাড়

বহুক্ষণ ধরে শব্দটি শুনছিলাম। করাতকলে কাঠ চেরাইয়ের শব্দ। খুব পরিচিত আর প্রিয়। আমাদের বাড়ির ওপাশে রবিনস স’মিল। সেখান থেকে ভেসে আসছে হয়ত। কখনো ইস্পাতের পাতে নির্দিষ্ট রিদমে ঘষঘষ, ঘষঘষ, কখনোবা একটানা যান্ত্রিক। অসংখ্য ঝিঝি পোকা একসাথে ডাকলে যেমনটি হয়। কিন্তু ঘুম থেকে জেগে বুঝলাম আমি বাড়িতে নই। হলে। রুম নম্বর ২০৫ এ। জেবা পাটায় চন্দনকাঠ ঘষছে। ঘুমঘোরে সেই আওয়াজই শুনেছি বোধ হয়। পাটার পাশে আরো কিছু লতাপাতা পড়ে আছে। এগুলো বাটাঘষা শেষ হলে মুখে লাগিয়ে ঘন্টা খানেক গান শুনবে বা ইন্টারনেট ব্রাউজ করবে জেবা। তারপর গোসল সেরে ঘুম। লুনা আর রাশা রুবার খাটে বসে হিহি হাহা করছে। দুজনের চোখই মোবাইলে। সম্ভবত ফেসবুকের কোন পোস্ট বা ছবি দেখছে। শিলা তার নিজের বিছানায়। দুই কানে ইয়ার ফোনের দুই তার। বাম হাত মুখের কাছে। মুখ নড়ছে কিন্তু কথা শোনা যাচ্ছেনা। এভাবে পুটপুট করে সারারাত প্রেমিকের সাথে কথা বলবে। দেওয়ালে ঘড়িতে রাত প্রায় একটা বাজে। তার মানে মাত্র মিনিট বিশেক ঘুমিয়েছি। রুমমেটদের সময়ের সাথে আমার সময় বা কাজে তেমন মিল নেই। ওদের রাত কেবল শুরু। কিন্তু আমাকে বারোটার মধ্যে ঘুমুতে হয়। ভোর সাতটায় মোহাম্মদপুরে টিউশনি। ফিরে এসে ক্লাস। পাশ ফিরে আবার ঘুমুবার চেষ্টা করছিলাম তখন ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রীনে ভাসছে ‘মা’। তড়াক করে উঠে বসলাম। মা এত রাতে? কোন অঘটন নয়তো? দ্রুত রিসিভ করতে মা বললেন, ‘ঘুমুচ্ছিলে?’

‘হ্যাঁ। কি হয়েছে মা?’

‘সকালে একবার বাড়িতে আসতে পারবে?’

একটু অবাক হলাম । মা কখনো অনুরোধ করেন না, অর্ডার করেন। বললাম, ‘আজ আর কাল তিনটে টিউশনি আছে। নেক্সট উইকে আসি?’

‘না। আজই এসো। তোমার সাথে কিছু জরুরি কথা আছে।’

‘ফোনে বলা যাবে না?’

‘ফোনে বলতে পারলে আসতে বলতাম না ঝুমা।’

মা ফোন কেটে দিলেন। পরশু শাফির ম্যাথ পরীক্ষা। আজ যদি পড়াতে না যাই ওর মা মুখ হাঁড়ি করে রাখবে। কিন্তু মায়ের গলার স্বর শুনে মনে হচ্ছে বাড়িতে যাওয়াটা খুব জরুরী। গত দুবছরে কোনদিনই মা এত রাতে ফোন করেননি। কোন বিষয়ে আমার পরামর্শ নেওয়া দূরে থাকুক ফোনে কথাই হয় কালেভদ্রে। তাহলে আজ এমন কি ঘটেছে যে মা আমাকে পরামর্শের জন্য ডাকছেন। বাড়ির সব খবর পাই সাজিদ আর সোহেলীর কাছে। দুমাস হলো বাড়ি থেকে এসেছি। এরমধ্যে ওদের সাথে কয়েকবার কথা হয়েছে। গতানুগতিক অভাব অভিযোগ আহ্লাদ আবদার ছাড়া নতুন কিছু বলেনি। মাজিদ কোন অকাজ করেনি তো? কদিন আগে মারপিট করেছিল। সেটার কোন রেশ? নাহ, সেটা হলে মা বলতেন। বহুদিন হয় ঘুমের জন্য আমাকে পিল খেতে হচ্ছে। আজ আর ঘুম আসবে না। সকালের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। সোহাগের প্রথম বাস ধরতে পারলে এগারোটার মধ্যে বাড়িতে পৌঁছে যেতে পারবো। শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে না। উঠে বারান্দায় গেলাম। বারান্দা থেকে এক চিলতে আকাশ দেখা যায়। আজ আকাশে মেঘ করেছে। কে জানে বৃষ্টি হবে কিনা! বৃষ্টির কথা মনে হতে বাড়ির কথা মনে পড়ে। রুমানার কথা, বাবার কথা, আরো কতকত কথা!

মায়ের মত মহাসুন্দরীর পেট থেকে আমার মত অসুন্দরী কিভাবে জন্ম নিল সেটা একটা মহাবিস্ময়! গড়পরতা হারে বাঙ্গালী মেয়েদের যে উচ্চতা সে তুলনায় আমি বেশ খাটো। গায়ের রঙ মিশমিশে কালো নয় তবে লোকে কালোই বলে। আমি যে অসুন্দর সেটি আমি বুঝতে শেখার আগে চারপাশের পরিবেশ আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল। খুব ছোট বেলায় একবার মায়ের মামার বাড়িতে গিয়েছিলাম। মায়ের খালা আমাকে দেখে বললেন, ‘আরে রত্না, তোর মেয়ে দেখি ফিঙ্গে পাখির মত হয়েছে। গায়ে দুধ সর লাগাস না?’ মা কেঁদে কেটে একাকার। বাড়িতে ফিরে আমাকে দমাদম মারলেন। যেন আমারই সব দোষ। ক্লাসের অনিমাকে আমার খুব ভাল লাগতো, চাইতাম ও আমার বন্ধু হোক। ক্লাস টুয়ে যখন অনিমার পাশে বসতে চেয়েছিলাম অনিমা বলেছিল, গায়ের সাথে গা লাগাস না, আমিও কালো হয়ে যাব। বাড়িতে এসে কাঁদতে কাঁদতে মাকে নালিশ করলাম। মা বললেন, ‘যাস কেন সুন্দর মেয়েদের কাছে বসতে। লজ্জা করেনা?’ একটু বড় হতে পাশ কেটে যাওয়া ছেলেদের অনেক টিজই আমার মন খারাপের কারণ ছিল। মা-কালী শব্দটি যে কতবার শুনেছি! তবে ধীরে ধীরে সবকিছু সয়ে এসেছে। কয়লার ড্রাম শুনেও এখন আর উনিশ বিশ কিছু মনে হয় না।মায়ের জন্য মাঝে মাঝে আমার খুব খারাপ লাগে। ছোটবেলা থেকেই বুঝতে পারতাম নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে ফিঙ্গের মত মেয়েকে নিয়ে মা বিব্রত বোধ করতেন। মেয়ের কালো চামড়া সাদা করতে কি প্রাণান্ত চেষ্টাই না তিনি করেছেন! হ্যানো গাছ গাছড়া পাতালতা নেই যা আমার ওপর মা এপ্লাই করেননি। বরোলিন, ফেয়ার এন্ড লাভলী, আর্চি থেকে শুরু করে বহু নাম না জানা ব্রান্ডের প্রসাধনী, নানা জাতের মাটি আমার গাল গলা এবং দুই হাতে ঘষে ঘষে লাগিয়েছেন। কিন্তু কয়লা ধুলে কি আর ময়লা যায়! শুধু কি তাই? আমার মুখের সামনের উঁচু দাঁত দুটো নিচু করতেও কি মা কম শ্রম দিয়েছেন? মাঝে মধ্যে এমন চাপ দিতেন যে মাড়ি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসত। আমার বয়স যখন দশ বারো বছর তখন থেকে আমার বিয়ে নিয়ে মায়ের গভীর চিন্তা শুরু হয়েছিল। বলতেন, ‘এই কালনি মেয়েকে কে বিয়ে করবে?’ বাবা রেগে যেতেন, ‘খবরদার আমার মেয়েকে কালনিমে বলবে না।’ মা ঝাঁঝিয়ে উঠতেন, ‘হুহ, তোমার সর্বস্ব বিক্রি করেও মেয়েকে বিয়ে দিতে পারবে না। দেখে নিও।’ বাবা বলতেন, ‘বিয়ে ছাড়া তুমি কি অন্যকিছু ভাবতে পারোনা? ঝুমুকে নিতে পঙ্খীরাজে চড়ে রাজকুমার আসবে। আর না এলেই বা কি? আমাদের ঝুমু বড় অফিসার হবে । তুমিও দেখে নিও।’

আমার নাম ঝুমা। একমাত্র বাবার কাছেই আমি ঝুমু। বাবার সেসব কথা ছিল, কথার কথা। মানে গুরুত্বহীন কথা। তবুও আমি বিশ্বাস করতাম। ঘোড়ায় চড়ে হয়ত সত্যি কোন রাজকুমার আসবে। আরো বড় হয়ে বুঝেছি, যেসময় আমরা পার হয়ে আসি শুধুমাত্র সেই সময়টির চরিত্রই বাস্তবিক রূপে বর্ণনা করা যায়। আগামীদিন নিছকই কল্পনায় আঁকা ছবি। অস্থির, পরিবর্তনশীল। আমার আঁকা সেসব ছবি পরিবর্তন হবারই ছিল। রাজপুত্র দূরে থাকুক, প্রেম বার্তার ইশারা পর্যন্ত কেউ কখনো আমাকে দেয়নি। অথচ মনে মনে কত লক্ষ প্রেমপত্রই না আমি নানা ঠিকানায় লিখেছিলাম! ভার্সিটিতে আসার পর নোটের প্রয়োজনে কিছু কাছের বন্ধু জুটেছে সত্য কিন্তু মনের প্রয়োজনে কোন প্রেমিক জোটেনি। মায়ের সাথে বাবার বিয়ে স্বাভাবিক ভাবে হয়নি। শুনেছি বিএল কলেজে পড়ার সময় একজন হিন্দু ছেলের সাথে মা পালিয়ে গিয়েছিলেন। আমার নানা পুলিশ নিয়ে মাকে উদ্ধার করে আনেন এবং রাতারাতি বাবার সাথে বিয়ে দেন। মা ছিলেন ভীষণ সুন্দরী। দুর্দান্ত সুন্দরী যাকে বলে। শিক্ষিতা স্মার্ট। বাবা শিক্ষিত কিন্তু অতি সাধারণ ছাপোশা টাইপ। কোটচাঁদপুরের অখ্যাত একটি বেসরকারী কলেজে দর্শনের শিক্ষক। পরীক্ষার ফরম ফিলআপের সময় ছাড়া যে কলেজ থেকে বাবা কখনো বেতন পেতেন না। বাবার পরিবারে একমাত্র বাবাই শিক্ষিত ছিলেন। আমার দাদা চাচা সকলে ক অক্ষর গো মাংস। অন্যদিকে মা প্রায়ই গর্ব করে বলেন, তিনি আরাফপুরের জমিদার পরিবারের মেয়ে। তাঁর চাচা ব্যারিস্টার অমুক, মামা অমুক দলের নেতা। যদিও সেসব চাচা মামাকে দেখার সৌভাগ্য আমাদের কখনো হয়নি। বাবা মাঝে মধ্যে মুচকি হেসে বলতেন, ‘না দেখা নদী সমুদ্রের মত বিশালই হয়।’ আরাফপুরের জমিদার বংশের নানা বাড়িতে আমি গিয়েছি। নানা বেঁচে নেই। জমিদারীর ঠাঁটবাটের মধ্যে নানার ভাগের দেড়তলা ইটের ভাংগা দালান ছাড়া তেমন কিছু অবশিষ্ট ছিলনা। দালানটিতে আমার দুই মামা বাস করেন। একজন জজ কোর্টের পেশকার অন্যজন ডিসি অফিসের নাজির। মামাদের চাল চলনে অবশ্য জমিদারীর সব চিহ্নই প্রকট।যাইহোক, সুন্দর বা অসুন্দরের পরিমাপক যে চামড়া, নাক, কান, দাঁত সেটা আমি খুব ছোট বেলাতেই জেনে গিয়েছিলাম। শৈশব থেকেই আমাকে বুঝানো হয়েছিল সৌন্দর্য মেয়েদের সবথেকে বড় সম্পদ। লেখাপড়ায় বরাবরই ভাল। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি কোথাও মেধা তালিকার বাইরে কখনো যাইনি। কিন্তু আমি সুন্দর নই। আর সে জন্যই হয়ত নিরীহ, শান্ত, গোবেচারা। দাবা কোটের বোড়ের মত। অস্ত্র ছাড়া ক্ষমতাহীন, সৌষ্ঠব বিহীন। বড় দ্বিধাভরে একপা একপা করে এগোচ্ছি বা ঠাই দাঁড়িয়ে আছি নিজের ঘরে। আমাকে দিয়ে পৃথিবীতে কারো কোন কাজ নেই। লাভ নেই, ক্ষতি নেই। কখনো প্রতিবাদ করতে শিখিনি। যা পেয়েছি হাত পেতে নিয়েছি যা পাইনি তার জন্য আফসোস করিনি। ভেবে নিয়েছি সেটা আমার কখনো ছিলইনা। বাবা আমাকে খুব বুঝতেন। বলতেন, ‘মা রে এই পৃথিবীতে কেউ কাউকে অধিকার দেয়না অধিকার আদায় করে নিতে হয়।’ কিন্তু আমার কিসে অধিকার আছে কিসে নেই সেটাই তো বুঝতে পারি না। আমার পর দুইভাই। সাজিদ মাজিদ। এরপর রুমানা। সব শেষে সোহেলী। রুমানাকে দেখে মনে হয়েছিল আমাদের ঘরে পরী কন্যা নেমে এসেছে। ওর ছোট্ট গায়ে যখন আমি হাত রাখতাম ফর্সা শরীরের ওপর আমার হাতটিকে আরো অনেক বেশি কালো দেখাতো। আমি চট করে হাতটি সরিয়ে নিতাম। মায়ের কোলে ওকে কি যে সুন্দর মানাত! আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। মা ওকে রঙ বেরঙের লেস পুঁতি লাগানো সুন্দর সুন্দর ফ্রক পরিয়ে পুতুলের মত সাজাতেন। বাবার একটা ইয়াসিকা ক্যামেরা ছিল সেটি দিয়ে প্রচুর ছবি তুলে ওয়াশ করেছেন। এখনো ঘরের দেওয়ালে সেগুলো ঝুলছে। রুমানার মত না হলেও সোহেলীও অনেক সুন্দর। ওর ছবিও আছে কিছু। কিন্তু আমার এমন সুন্দর ফ্রক পরা ছেলেবেলার কোন ছবি নেই। না এলব্যামে, না দেওয়ালে। তাই বলে এসব নিয়ে আমার মনে ঈর্ষা অভিমান তৈরী হয়েছিল? না কক্ষনো হয়নি। বরং এই ভেবে খুব গর্ব হয় যে ওরা আমার বোন! ধীরে ধীরে রুমানা বড় হয়। মায়ের কার্বন কপি। কিন্তু শিশু বয়স থেকেই বড় জেদি ছিল রুমানা। কারো কোন কথাই শুনতো না। রেগে গেলে হাতের কাছে যা পেতো ছুঁড়ে ফেলতো। বড় হবার সাথে সাথে রুমানার জিদ বেড়ে যায়। বিশেষ করে মায়ের সাথে তার দন্দ্ব বাড়তে থাকে। মা ডানে যেতে বললে বামে যায়, বামে যেতে বললে ডানে। শুধু মা নয়, আমি আর বাবা বাদে বাড়ির বা বাইরের আর কারো সাথেই ওর ভাব ছিলনা। ও যেন অন্য জগতের কেউ। প্রচন্ড একরোখা, স্বাধীনচেতা। বয়সের তুলনায় অনেক বেশি বুঝতো এবং সেটা ভেতরে না রেখে বলে দিত। ওর বন্ধুরা বলত রূপের দেমাগে মাটিতে পা পড়েনা। আসলে সেটা নয়। ও সত্যিকে সত্যি বলতে শিখেছিল আর মিথ্যাকে মিথ্যা। যেটা আমি কখনো পারিনি। ন্যায্য যাকিছু ওর পাওনা সেটা ওর চাই তো চাইই। কোটচাঁদপুর শহরের এক প্রান্তে প্রাইমারী স্কুলঘরের মত লম্বা শেপের চারচালা টিনের বাড়ি আমাদের। চওড়া বারান্দার সাথে পরপর তিনটে ঘর। প্রতি ঘরে দুটো দরজা একটা জানালা। একটা দরজা বাইরে যাবার আর অন্যটি ছিল ভেতর দেওয়ালে। যাতে একঘর থেকে অন্য ঘরে যাওয়া যায় । জানালাগুলোয় লম্বালম্বি শিক লাগানো। রঙহীন। কপাটগুলো কাঁঠালী রঙের। প্রথম ঘরে বাবা মা, মাঝের ঘরে পাশাপাশি লাগানো দুটো খাটের একটিতে আমি আর সোহেলী অন্যটিতে রুমানা ঘুমাতো। সবশেষে রাস্তার পাশের ঘরটিতে দুই ভাই সাজিদ আর মাজিদ। পাঁচ ভাই বোনের সংসারে অভাব ছিলনা কিন্তু অতটা সচ্ছলও নয়। কলেজ থেকে বাবা নিয়মিত বেতন পেতেন না। সরকারী অংশের যা পেতেন সেটা সাতজনের সংসারের জন্য অপ্রতুল। তার ওপর মায়ের খরচের হাত ছিল জমিদার বংশের মেয়ের মতই। আজ এটা বদলাতে হবে, তো কাল ওটা কিনতে হবে। এমন বাহানা নিয়ে বাবার সাথে নিত্য খিটিমিটি। নতুনবাজারে আমাদের একটা কাপড়ের দোকান ছিল। মায়ের কথা অনুযায়ী ওটা বিয়ের যৌতুক হিসেবে নানা বাবাকে দিয়েছিলেন। কলেজ থেকে ফিরে গিয়ে বাবা দোকানে বসতেন। ফিরতেন রাত দশটার পর। মূলতঃ এই দোকানই ছিল আমাদের সংসারের চালিকা শক্তি। সে যাক। রুমানার কথা বলি। ফুলকি নামের দশ-বারো বছরের একটা মেয়ে আমাদের বাসায় কাজ করত। কাজ বলতে মা আর আমার দুই ভাইয়ের হুকুম তামিল করা। আমাদের তিনবোনের কোন কাজ করা তার জন্য নিষেধ ছিল। এ নিয়ে রুমানার মনে প্রচন্ড ক্ষোভ ছিল। ওর ধারণা হয়েছিল মা ছেলেদেরকে বেশি ভালোবাসেন। এজন্য সবকিছুতে ওদের প্রায়োরিটি বেশি। রুমানা প্রায়ই অভিযোগ করত, ‘আমরা যদি আমাদের কাজ করতে পারি সাজিদ মাজিদ ভাইয়া কেন নিজেদের কাজ নিজেরা করতে পারবে না?’ আমার অবশ্য কখনো এমন মনে হয়নি। বরং সাজিদ মাজিদের ঘর টেবিল এগুলো সব আমিই গুছিয়ে দিতাম। স্কুল ড্রেস ধুয়ে দিতাম। তাতেও রুমানা গজগজ করত, ‘দ্যাটস নট ফেয়ার বড়াপা। সিস্টার নিবেদিতা হয়ে ওদেরকে অলস বানিয়ে ফেলছো।’ আমি হেসে ফেলতাম, ‘দে তোর কাপড়গুলোও ধুয়ে দেই।’ রুমানা গম্ভীর, ‘লাগবে না। রানীমা গোস্বা করবেন।’ আড়ালে মাকে ও ‘রানীমা’ বলত। তো, ফুলকি আমাদের ঘরের মেঝেতে ঘুমাত। এক শীতের রাতে দেখলাম সে রুমানার পাশে ঘুমুচ্ছে। মা দেখে তো ফায়ার। হ্যাচকা টানে ওকে নীচে নামিয়ে আনলেন, ‘আমার মেয়ের বিছানায় ঘুমানোর সাহস তোকে কে দিল?’ রুমানা ঠান্ডা গলায় বলল, ‘ওকে আমি আমার সাথে ঘুমাতে বলেছি। মেঝেতে পা দিয়ে দেখেছ কেমন ঠান্ডা? এখন থেকে ফুলকি আমার সাথে ঘুমাবে। আর ওকে তুমি ‘তুই’ বলোনা তো মা। শুনতে বাজে লাগে।’ মা যেন অধিক শোকে পাথর হয়ে গেলেন। আর কথা বললেন না। আমি অবাক হয়ে রুমানার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ভাবছিলাম আমি হাজার চেষ্টা করলেও রুমানার মত হতে পারবো না। ও এমনই ছিল আমার থেকে একদম আলাদা। আমার জীবনের প্রধান লক্ষ্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব। ভর্তি পরীক্ষার আগের তিনমাস দিনরাত এক করে পড়ালেখা করেছিলাম। মেধা তালিকায় জায়গা করে ফার্মেসিতে ভর্তি হলাম। বাবা প্রায় আধা মণ মিষ্টি বিতরণ করলেন। মাও খুব খুশি হয়েছিলেন তবে সাথে এটাও বলেছিলেন, ‘তোমার কখনো বিয়ে হবে সে আশা আমি করিনা। চাকরী করেই যখন তোমাকে জীবন চালাতে হবে পড়ালেখা ভাল করে কর।’ চোখের পানি লুকোতে আমি নিজের ঘরে পালিয়ে গিয়েছিলাম। রুমানা বলেছিল, ‘বড়াপা আমার ধারণা তুমি মায়ের আপন মেয়ে নও। খোঁজ নাও, বাবা আগে বিয়ে করেছিল কিনা।’ ওর বলার ভঙ্গীতে কষ্টের মধ্যে হেসে ফেলেছিলাম, ‘আমি মায়ের আপন কিন্তু সুন্দর মেয়ে নই রুমা। আমাকে নিয়ে মায়ের কত লজ্জা। বেঁটে কালো কাকের মত কুৎসিত।’ রুমানা গলা জড়িয়ে ধরে চুমুতে চুমুতে আমার মুখ ভিজিয়ে দিল। বলল, ‘নেভার। ইউ আর মাই সুইটেস্ট সিস্টার এভার।’

এর কিছুদিন পরের ঘটনা। তখনো আমি হলে সিট পাইনি। বাবার কলিগের মেয়ে রিয়া আপুর সিটে গেস্ট হিসেবে উঠেছি। সামনেই সামার ভ্যাকেশন। বাবা ঢাকা এসেছেন আমাকে নিতে। বাবা বললেন, ‘সাজিদ মাজিদ অনেকদিন থেকে সাইকেল কেনার জন্য আবদার করছে কিন্তু ঝিনেদায় দাম অনেক বেশি রাখে। চল, এখান থেকেই কম দামে পেলে কিনে নেই।’ অনেক ঘুরে ঘুরে বংশাল থেকে বাবা আর আমি দুটো সাইকেল কিনলাম। সাজিদ তখন ক্লাস টেনে, মাজিদ নাইনে। মাজিদের সাইকেলের রঙ ছিল লাল আর সাজিদের নীল। বাসের ছাদে তুলে সেই সাইকেল বাড়িতে নেওয়া হলো। আচমকা সাইকেল দেখে দুই ভাই বিস্মিত, আনন্দে আত্মহারা। কিন্তু রুমানার মুখ ভার। রুমানা তখন হাজী মহসীন গার্লস স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ে। কোটচাঁদপুর শহরের তখন অনেক মেয়ে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাওয়া আসা করছে। রুমানা লাল সাইকেলটা নিয়ে প্যাডেল ঘুরাতে থাকে আর বাবার কাছে আবদার করতে থাকে, ‘বাবা আমার এমন একটা সাইকেল কিনে দাও প্লিজ। আমার তিন বান্ধবী সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসে, আমিও যাব।’ সে শুধু বায়না ধরেই ক্ষান্ত ছিলনা কান্নাকাটি, চিৎকার চেচামেচি শুরু করল। বাবা অনেক বুঝালেন, ‘ভদ্র ঘরের মেয়েরা সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যায়না। লোকে খারাপ বলে।।‘ রুমানা ঘাড় বাঁকা করে জবাব দিল, ‘তোমার ছেলেরা ভদ্র ঘরের না? ওরা কেন সাইকেল চালিয়ে যাবে? তাহলে ওরাও যাবেনা।’ বাবা হেসে বললেন ‘ছি! মা, ভাইদের সাথে এমন হিংসে করতে নেই।’রুমানার বাড়াবাড়িতে মাজিদ সাজিদ খুব রেগে গিয়েছিল। আমারো বিরক্ত লাগছিল ভীষণ। ছেলেরা সাইকেল চালিয়ে যাবে, মেয়েরা রিকশায়- এটাই তো হয়ে এসেছে এতকাল। তাতে সমস্যা কোথায়? কিন্তু রুমানাকে কে বুঝাবে? সাজিদ শান্ত স্বভাবের ছেলে, কিছু বলল না। কিন্তু কথায় কথায় মাজিদ আর রুমানার মধ্যে তুমুল লড়াই হলো। মাজিদ রুমানার চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলল। রুমানা মাজিদকে আঁচড়ে কামড়ে রক্তাক্ত করলো। মা দুজনকেই পিটিয়ে যার যার ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সন্ধ্যায় মাজিদ দেখলো লাল সাইকেলের টায়ার ফালাফালা করে কেটে ফেলেছে কেউ। আমরা সকলে বুঝেছিলাম কে করেছে। কিন্তু কেউ কিছু বললাম না। বাবা সেদিন কোন কারণে সে সময়টাতে দোকান থেকে বাড়ি ফিরেছিলেন। রুমানাকে সবথেকে বেশি ভালবাসতেন বাবা। এত জিদ করার পরেও কখনো ধমকটি পর্যন্ত দেননি। এই নিয়ে মায়ের খুব অভিযোগ ছিল, বাবার জন্যই রুমানা বখে যাচ্ছে। সে রাতে কি যে হলো বাবার! কাটা টায়ার দেখে কোন কথা বললেন না। রুমানার হাত ধরে হিড়হিড় করে আমাদের ঘরে নিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলেন। বাবার হাতে মোটা বেত। কদিন আগে মাজিদ মেলা থেকে কালো ডোরাকাটা বেতটি কিনে এনেছিল। এরপর কিছু সময় আমরা কেবল শপাং শপাং শব্দ শুনলাম। মা নির্বিকার। রান্নাঘরে যে কাজ করছিলেন সেটাই করতে থাকলেন। এসবের কোন কিছুর সাথে যেন তার কোন সম্পর্ক নেই। আমি একবার মায়ের কাছে দৌঁড়ে যাই, ‘মা, প্লিজ বাবাকে মারতে নিষেধ কর। ও মরে যাবে।’ আরেকবার বন্ধ দরজায় ধাক্কা দেই, ‘বাবা ওকে মেরো না। প্লিজ বাবা, দরজা খোল।’ কিন্তু বাবার কানে বোধকরি আমার আওয়াজ পৌঁছেনি। রুমানার কান্নার শব্দ আমরা কেউ পাইনি। দরজা খোলার পর দেখলাম রুমানা মেঝের ওপর বসে আছে। হাতে গলায় লালচে মোটা মোটা বেতের দাগ। রক্তবর্ণ চোখে এক ফোঁটা পানি নেই। মা একবার উঁকি দিয়ে দেখে বললেন, ‘বেশ করেছে, মেরেছে। তোমার সাহস খুব বেড়ে গিয়েছিল মেয়ে। ভাইদের সাথে পাল্লা দাও। এবার শিক্ষা হয়েছে তো?’ রুমানা মায়ের দিকে তাকালো না। সারারাত সেভাবেই চুপচাপ বসে রইল। রুমানা বা বাবা কেউ সে রাতে খায়নি। খাবার জন্য তাদেরকে কেউ জোরাজোরিও করেনি। আমার খুব চিন্তা হচ্ছিল। রুমানাকে ওভাবে রেখে কিছুতেই ঘুম আসছিল না। বারবার ওর হাত ধরে টেনে শোয়াতে চাইলাম। কালশিটে জায়গাগুলোতে স্যাভলন ক্রিম লাগিয়ে দিতে গেলাম, কিন্তু ও হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিল। কথা বলল না। আর কোনদিনই বলেনি। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভোরে পাশের বাড়ির জব্বার দাদীর চিৎকারে বাইরে এসে বাবাই প্রথম দেখলেন। রুমানা বারান্দায় টিনের চালের বরগায় ঝুলছে। ওর গলায় পেঁচানো লাল রংয়ের জরির উড়না। ওর খুব প্রিয় ছিল ওড়নাটা।

রুমানার মৃত্যুর পর আমাদের বাড়িটা শোকের চাদরে আচ্ছাদিত হলো। বহুদিন পর্যন্ত কারো মুখে হাসি দেখা যায়নি। তবে বাবা আমুল বদলে গেলেন। সংসারের জন্য তিনি সবই করেন তবুও মনে হয়, পৃথিবীর সবকিছুর সাথে যেন তার সম্পর্ক শেষ হয়ে গিয়েছে। হিসেব ক্লোজ। উদাসীন, একা। সারাক্ষণ বিড়বিড় করতেন। কখনো নিজের মনে হাসতেন, কখনো কাঁদতেন। মাঝে মধ্যে চিৎকার করতেন, ‘পাপ করেছি, ঘোর পাপ।নিজের মেয়েকে খুন করেছি। মাফ করে দিস মা, মাফ করে দিস।’ আর আমি? সেই শিশু বয়স থেকেই মানুষে মানুষে, নারীতে পুরুষে, ধনীতে দরিদ্রে, সাদা কালোয়, সুন্দরে অসুন্দরে যে ডিস্ক্রিমিনেশন তা অল্প বিস্তর বুঝতে শিখেছিলাম। সময়ের সাথে সাথে নানা উপসর্গ অনুসর্গের মধ্য দিয়ে সেসব ব্যবধান বৈষম্য আমার ভেতরে বরফের ছোট ছোট পাহাড় গড়ে তুলেছিল। রুমানার মৃত্যুতে সেগুলো বাড়তে বাড়তে হিমালয়ের সমান বড় হলো। কিন্তু বাইরে বাষ্পের একটা কণা পর্যন্ত জমতে দিলাম না। রুমানা যাবার বেলায় সাথে করে আমার ঘুমও নিয়ে গেল। বাবার মানসিক অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছিল। কলেজে ক্লাস নেবার ক্ষমতা পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছিলেন। কোন চিকিৎসাই তাঁকে ভালো করতে পারেনি। রুমানা মারা যাবার বছর না ঘুরতেই এক রাতে আমার বাবা বুকের ব্যথায় মারা গেলেন। দুবছর খুব কি বেশি সময়? বাবা মারা যাবার পর প্রায় দুবছর পেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিভাবে পার হচ্ছে সেটা আমরা সকলেই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। যেন হাজার বছর পেরিয়ে এসেছি। বাবার কোন ব্যাংক ব্যালান্স নেই। তার ওপর শেষ এক বছরে সংসার চালাতে গিয়ে অনেক ঋন করে ফেলেছেন। বাবা মারা যাবার পর দুদিন যেতে না যেতেই পাওনাদারেরা হাজির হল। এক দোকান ছাড়া বিক্রি করার মত কিছু নেই। মা সেই চেষ্টাই করলেন। কিন্তু দেখা গেল দোকান ব্যাংকের কাছে মর্টগেজ দেওয়া। বাবা কবে এটা করেছেন আমরা কেউ জানিনা। মা অবশ্য এসব সম্পর্কে কখনো খোঁজ খবর রাখতেনও না। প্রয়োজনই পড়েনি কখনো। মায়ের গয়না কেনার নেশা ছিল। ডানো দুধের কৌটায় টিস্যুতে পেঁচিয়ে রাখা মায়ের অনেক গয়না আমি বহুবার দেখেছি। বললাম, মা কিছু গয়না বিক্রি করে দেন। ছেলেমেয়েদের মধ্যে একমাত্র আমি বাবা মাকে আপনি সম্বোধন করি। কেন করি, কে শিখিয়েছে জানিনা। মা সাফ বললেন, ‘গয়নার প্রসঙ্গে একটা কথাও বলবেনা। কি করতে হবে আমি দেখব। তোমাকে ভাবতে হবেনা। অনেক ক্লাস মিস করেছ তুমি। ভার্সিটি চলে যাও।’ এক প্রকার জোর করে মা আমাকে ঢাকা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আমার পড়ার খরচ টিউশনি করে চালাচ্ছি কিন্তু বাকী তিন ভাই বোনের পড়ালেখা, খাওয়া দাওয়া, সংসার খরচ কিভাবে জোগাড় হচ্ছে জানি না। প্রশ্ন করলে মায়ের একটাই জবাব, ‘এসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।’ কিন্তু আসলে কিছুই ঠিকমত চলছে না। যতবার বাড়িতে যাই ততবার মনে হয় আবার পালিয়ে ঢাকা ফিরে আসি। আমার সেই দুর্দান্ত সুন্দর ঝকঝকে মা বিষন্নতার মূর্ত প্রতীক। যে বাঁকা গ্রীবায় অহংকারের রোদ খেলা করত সেখানে রাজ্যের অবসাদ আর শ্রান্তি বাসা গেড়ে আছে। বাবার ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল ছিলেন মা। একটা ডিম কখনো কিনেছেন বলে মনে পড়ে না। সম্ভবত সেই কারণে নিজের শিক্ষা কাজে লাগাতে পারছেন না। বাড়ির প্রতি বিন্দুতে অভাব আর অশান্তি দাঁত বের করে হাসছে। সাজিদের সামনে এইচএসসি পরীক্ষা অথচ প্রাইভেট পড়ার টাকা নেই। সোহেলী সারা সময় নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকে। যেন আপন থেকে বহুদূরে একা আর নিসংগ। কখনো বলে, ‘বড়াপা আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাবে?’ মাজিদ পড়া বাদ দিয়ে ইয়ার দোস্তদের সাথে রকে বসে বিড়ি ফুঁকে। এসব দেখে শুনে আমার কান্না পায়। টিউশনি আরো একটা বাড়িয়ে দিয়েছি। প্রতিটি পয়সা হিসেব করে চলি। সাজিদের জন্য এ মাস থেকে প্রাইভেটের টাকা পাঠাচ্ছি। যাতে ব্যাচে গিয়ে অন্তত ম্যাথ আর ক্যামেস্ট্রিটা পড়তে পারে। কিন্তু তাতে কি সব সমস্যার সমাধান হবে?

কি এত ভাবছিস ঝুমা? ঘুমালি না, টিউশনি নেই?

মুখ থেকে প্যাক তুলে ফেলেছে জেবা। খুব ফ্রেশ লাগছে ওকে। সামনের আকাশে ভোরের আলো। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বলি,

‘না রে ঘুম হলো না। বাড়ি যাব।’

‘হঠাৎ বাড়ি কেন?’

‘জানিনা। মায়ের জরুরি তলব।’

‘গিয়ে দ্যাখ আন্টি তোর জন্য হয়ত বর ঠিক করেছে।’

আমি জবাব দেইনা। ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ি।

আজ ফেরীতে জট ছিলনা। সকাল সাড়ে এগারোটার মধ্যে বাড়ি পৌঁছে গেলাম। সাজিদ মাজিদ সোহেলী কেউ বাড়িতে নেই। আমি আর মা যেন অনন্তকাল সামনা সামনি বসে আছি। মায়ের কথা শেষ হয়েছে কিন্তু আমার জবাব নেই।

বহুক্ষণ পর আমি ক্ষীণ স্বরে বললাম, ‘কবে যাবেন?’

‘আজই।’

‘এখন?’

‘না, রাতে। সবাই ঘুমালে।’

‘একটা প্রশ্ন করতে পারি মা?’

‘কর।’

‘কাউকে বিয়ে করছেন?’

‘সেটা জানতে চেও না।’

‘এই শহরেই থাকবেন?’

‘সেটাও জানিনা।’

‘কেন যাচ্ছেন?’

‘প্রেসার নিতে পারছিনা। এই সংসারে থাকলে আমি পাগল হয়ে যাব বা সুইসাইড করব।’

‘আমি যদি সব প্রেসার নেই, তবে কি থাকবেন?’

‘না।’

‘দুটো বছর সময় দিতে পারেন না? আমি পাশ করা অবধি?’

‘একটা দিনও নয়।’

‘ও।’ মায়ের চোখে আমি অন্যকিছু দেখতে পাচ্ছি। সন্তানের মায়া, সমাজ, ধর্ম কোন বাধাই মাকে আমাদের কাছে আটকে রাখতে পারবে না। আমিও আর জোর করলাম না। দুপুরে সাজিদ মাজিদ সোহেলী সকলে বাড়ি ফিরলো। আমাকে দেখে ওরা তিনজনেই অবাক। খুব খুশিও হয়েছে। সবথেকে বেশি খুশী সোহেলী। বাবা মারা যাবার পর সম্ভবত আজই প্রথমবার আগের মত করে সবাই মিলে হইহল্লা করে কাটালাম। কিন্তু সারাদিনে ওদেরকে কিচ্ছু বুঝতে দিলাম না।

আজ বোধ হয় রাশ পূর্ণিমা। রূপালী আলোয় বাড়ি ঘর ভাসিয়ে নিচ্ছে। আমি শুয়ে রুমানার বিছানার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। বাঁশ পাতা আর জানালার শিক গলে চাঁদের আলো সেখানে কিছু জ্যামিতিক রেখা তৈরী করেছে। রুমানার শরীরেও আগে এভাবে নিশ্চয়ই আলোর রেখা তৈরী হতো, কিন্তু কখনো খেয়াল করিনি।

সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি একটি শব্দের অপেক্ষায় জেগে আছি। অবশেষে মায়ের ঘর থেকে সেই শব্দটি ভেসে এলো এর কিছু সময় পর আমাদের ঘরে মায়ের ছায়া পড়ল। লঘু পায়ে ঘরময় হাঁটছেন। কিছুক্ষণ পর আমাদের খাটের পাশে এসে দাঁড়ালেন। আমি দেওয়ালের পাশে অন্ধকারের দিকে সরে গেলাম। মা ঝুঁকে খুব সন্তপর্ণে সোহেলীর কপালে চুমু খেলেন। আমার মুখে হাত বুলিয়ে দিলেন। এরপর রুমানার বিছানায় মাথা রেখে মেঝেতে বসে পড়লেন। মা কাঁদছেন। কান্নার দমকে তাঁর শরীর কাঁপছে।এরও দীর্ঘক্ষণ পর মা যখন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন, সেই মুহূর্তে আমার ভেতরে জমে থাকা বরফের পাহাড়টি হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়লো। সেটি নদী হয়ে তীব্র স্রোত নিয়ে দুচোখ বয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ইচ্ছে হচ্ছে মাকে জড়িয়ে ধরে বলি ‘প্লিজ যেওনা মা।’ কিন্তু আমি স্রোতের মুখে বাঁধ তুলে দিলাম। মাকে আটকাবো সে সাহস কোথায় আমার? এখন রাতের শেষ প্রহর নাকি মধ্য প্রহর জানিনা। কিন্তু সকল শব্দ ছাপিয়ে আমি আমার মায়ের পায়ের মৃদু ধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। প্রথমে ঘর, তারপর বারান্দা, সেখান থেকে উঠোন। উঠোন পেরিয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে কোথাও…।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত