কোরবানী ঈদের ১ মাস আগে এ বাড়িতে বউ হয়ে এসেছি আমি। এর মধ্যে প্রায় ৭ দিনের মত ছিলাম বাবার বাড়িতে। তাই বলা যায়,এ বাড়িতে আমার ২৩ দিনের সংসার চলছে। নিজের পরিবার ছেড়ে এসে সম্পূর্ণ নতুন একটা পরিবারের পারিবারিক কাঠামো বোঝার জন্য,সেই পরিবারের মানুষদের মন বুঝে চলার জন্য মাত্র ২৩ দিন নিশ্চয়ই যথেষ্ট নয়। তবে এটা সত্যি যে,আমি আমার স্বামী কে না যতটা চেনাজানার সুযোগ পেয়েছি,তার চেয়ে অনেক বেশি সুযোগ পেয়েছি আমার শ্বশুরবাড়ির লোকদের চেনাজানার। কারণ পেশাগত কারণে আমার স্বামী কে থাকতে হয় ঢাকায় আর আমি বগুড়ায় আমার শ্বশুরবাড়ি তে। মাস তিনেকের মধ্যে অবশ্য আমাকে তার কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা আছে।
আমার বিয়েটা অনেকটা হুট করেই হয়েছিলো কোনোরকম পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া। কথা ছিল শুধু দেখতে আসার কিন্তু দেখতে এসে বিয়ে হয়ে গেল। এমনকি এই দেখতে আসার সিদ্ধান্ত টা ও হুট করেই নেয়া। বিয়ের দিন বিকাল পর্যন্ত আমি জানতাম না আজ আমাকে দেখতে আসবে। দুপুরে ভার্সিটি থেকে এসে গোসল করে খেয়েদেয়ে ভাতঘুম দিই। বিকেলে মা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে জানালেন,সন্ধ্যের পর আমাকে নাকি দেখতে আসবে। তখন ওতটা পাত্তা দিই নি আমি। ভেবেছি,গত দু’একবারের মত এবারও শুধু দেখে চলে যাবে। ফাইনালি আর ব্যাটে বলে মিলবে না বলে বিয়ে অব্দি ব্যাপার টা গড়াবে না। কিন্তু এবার তা হল না। পাত্রপক্ষের আমাকে পছন্দ হয়ে যাওয়ায় আলোচনা সাপেক্ষে দু’পরিবারের সম্মতি তে সেদিন রাতেই আমার বিয়ে হয়ে যায়। সেই মুহূর্তে আমি ছিলাম অনুভূতিশূন্য। চারপাশে কি হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই যেন আমার মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না। বিয়ে পড়ানোর আগমুহূর্তে আমাকে দশ মিনিটের জন্য হিমেলের সাথে মানে আমার হবু জামাইয়ের সাথে কথা বলার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। এই দশ মিনিটেই আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম,এই মানুষ টা কে আমি চোখ বন্ধ করে ভরসা করতে পারি। মাত্র সাতদিনের মাথায় আনুষ্ঠানিকভাবে আমাকে উঠিয়ে নেয়া হয়।
হিমেলের ছুটির কোনো নিশ্চয়তা ছিল না বলে এত তাড়াহুড়ো করে আমাকে উঠিয়ে নেয়ার আয়োজন করা। আমার ধারনা ছিল,জীবন সংগী হিসেবে ডাক্তাররা হয়তো খুব খিটখিটে মেজাজের হয়। কিন্তু তার সাথে সংসার শুরু করার পর দিনের পর দিন আমার এই ধারনা ভুল প্রমাণ হতে লাগলো। মানুষ হিসেবে সত্যিই তিনি অসাধারণ। কিন্তু কথায় বলে না,বর আর ঘর-দুটো কখনো একসাথে মনের মত পাওয়া যায় না? আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। বর মনের মত পেয়েছি ঠিকই,তবে তার পরিবারের সাথে আমি এখনো মানিয়ে নিতে পারছি না। এ বাড়ির পরিবেশ টা সম্পূর্ণ আলাদা। এ ধরনের পরিবেশের সাথে আমি কখনোই পরিচিত ছিলাম না। অন্যান্য সদস্যরা যেমনতেমন হলেও,আমার শাশুড়ি টা একটু কেমন যেন। ভদ্রমহিলা কে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। হুটহাট রেগে যান আবার মুহূর্তেই বুকে টেনে নেন। এই ভালো,এই খারাপ।
এ বাড়িতে আমরা তিন বউ। আমি ছোট,মেজো ভাবী খানিকটা জেদি আর একটু ঠোঁটকাটা স্বভাবের। কিছুটা আত্নকেন্দ্রিক হলেও মন খুব ভালো,কোনো ভণিতা নেই তার মধ্যে। আর বড় ভাবী হচ্ছে সহজ সরল,সদা হাস্যোজ্জল এক রমণী। বড় বউ হিসেবে নিজের স্বার্থকতা তিনি তার প্রতিটি কাজকর্মে ফুটিয়ে তোলেন। সংসারের প্রত্যেক সদস্যের প্রতি তার সমান মনোযোগ। এ বাড়িতে আসার পর থেকে একমাত্র বড় ভাবীর সাথেই আমি নির্দ্বিধায় মন খুলে কথা বলতে পারি। কোনো সংকোচ কাজ করে না। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে,আমার শাশুড়ির মন রক্ষা করে চলতে এই মানুষ টা পদে পদে আমাকে সাহায্য করেন। আমার শ্বশুরসহ বাকি সদস্যরা মানে আমার দুই ভাসুর,তারা যে যার মত থাকতে পছন্দ করেন। শ্বশুর আর বড় ভাসুর মিলে ব্যবসা সামলাচ্ছেন। আর মেজো ভাসুর একটা প্রাইভেট কোম্পানি তে জব করছেন। সংসারের কোনো ব্যাপারে তারা কখনোই নাক গলান না। এ সংসারে আমার শাশুড়ির কথাই শেষ কথা।
আগামীকাল ঈদ। সকাল থেকেই আমার টেনশন শুরু হয়ে গিয়েছে কিভাবে আমি কালকের দিন টা সামলে নিবো-এ নিয়ে। বড় ভাবীর কাছে শুনেছি,এ বাড়িতে কোরবানী ঈদে কাজকর্মের ঝামেলা থাকে অনেক। তিন চার পদের মিষ্টান্ন থেকে শুরু করে সব রান্না বউরা নিজের হাতে করে। এদিকে আমি কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা। বাবার ঘরে আদরের দুলালী ছিলাম আমি। বিয়ের আগে চা কফি ছাড়া কোনো কিছু রান্না করেছি বলে মনে পড়ে না। দু একবার শখের বসে রান্নাঘরে মা’র পাশে দাঁড়িয়ে থেকে টুকটাক রান্না শিখেছি ঠিকই কিন্তু তা বাস্তবে প্রয়োগ করা হয়ে উঠে নি কখনো। তার উপর হিমেলের এবার ছুটিও নেই। অনেক চেষ্টার পর ঈদের পরদিন বিকেলে একদিনের ছুটি ম্যানেজ করতে পেরেছেন। তিনি পাশে থাকলে কিছুটা হলেও স্বস্তি পেতাম। একে তো বিয়ের পর প্রথম ঈদ স্বামী কে ছাড়া করতে হচ্ছে,তার সাথে যোগ হয়েছে দায়িত্ব-কর্তব্য। সব মিলিয়ে মন মেজাজ একেবারেই ভাল নেই। দুপুরে খাবার টেবিলে শাশুড়ি-মা বলে দিয়েছেন,
– মিলি,এই বাড়িতে তোমার প্রথম ঈদ। তাই এইবার তোমারে খুব বেশি দায়িত্ব দেওয়া হবে না। তুমি শুধু মিষ্টান্ন পদগুলা রান্না কইরো আর বড় বউ রে হাতে হাতে সাহায্য কইরা দিও। আজকে রাত্রেই এই কাজগুলা গুছাইয়া রাখবা। তাছাড়া কালকের ধাক্কাটাও তো সামলাইতে হবে।
শাশুড়ি-মা’র কথা শুনে আমার যেন মাথায় আসমান ভেঙে পড়েছে। বড় ভাবী যদিও আমাকে টেনশন করতে না করেছেন। বলেছেন,তিনি সব দেখিয়ে দিবেন,আমার কোনো সমস্যা হবে না। তারপরও আমার খুব অস্থির লাগছে। মেজো ভাবী প্রেগন্যান্ট,ডাক্তার তাকে বিশ্রামে থাকতে বলেছেন। তাই তিনি কোনো কাজ করতে পারবেন না। কাজের মহিলাটা ছেলে অসুস্থ বলে ৭ দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি গিয়েছে। আর আমার শাশুড়ি কোমরে ব্যথা নিয়ে কিছু করতে পারেন না। তিনি শুধু নির্দেশনা দিয়ে যান। সুতরাং রান্নাঘরের সব দায়িত্ব আমাদের দুই বউ-কেই সামলাতে হবে। বড় ভাবীর সাহায্য নিয়ে চার পদের মিষ্টান্ন রান্না করে সব কাজ গুছাতে গুছাতে অনেক রাত হয়ে যায়। সবার শেষে আমি আর বড় ভাবী ঘুমোতে গিয়েছি। আম্মা অবশ্য বলেছিলেন,কাজের মহিলা টা যেহেতু নেই তিনি দু’একটা আইটেম রান্না করে দিবেন। কিন্তু আমরাই দিই নি। পরে যদি আবার কিছু উনিশবিশ হয়ে যায়! ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ক্লান্তি তে চোখ লেগে গিয়েছিলো। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হওয়ার আগমুহূর্তে মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠলো। ঘুম ঘুম চোখে ফোন টা হাতে নিয়ে কল রিসিভ করলাম,
– হ্যালো।
– ঘুমিয়ে পড়েছিলে?
ওপাশের মানুষটার কণ্ঠস্বর শুনে আমার সারাদিনের সব ক্লান্তি যেন নিমিষেই মুছে গেল। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো আমার,
– না,একটু চোখ লেগে গিয়েছিলো। আপনার ডিউটি শেষ?
– শেষ হতে হতে দেরী আছে। আধঘণ্টার বিরতি তে আছি। তা কি কি রান্না করলে?
– অনেক কিছু। কাল সকালে ভিডিও কলে দেখতে পারবেন।
– আচ্ছা তা না হয় দেখলাম,কিন্তু খেতে তো আর পারবো না।
সাথে সাথেই আমার বুকের ভেতর টা মোচড় দিয়ে উঠলো,
– এভাবে কেন বলছেন! আপনাকে রেখে নিশ্চয়ই সব খেয়ে শেষ করে ফেলবো না আমরা। আম্মা আপনার জন্য আলাদা করে তুলে রাখবেন বলেছেন।
– জানি তো! আমি তো জাস্ট একটু মজা করছিলাম। আচ্ছা শুনো,সকালে গোসল করে কিন্তু আমার পাঠানো নতুন শাড়ি টা পরবে। আর চোখে গাঁঢ় করে কাজল টেনে নিবে।
– ইশ্,একদম না। এত সেজেগুঁজে লাভ কি! আপনি তো আর দেখতে পারবেন না।
– কে বলেছে দেখতে পারবো না! ভিডিও কলে দেখবো।
– ভিডিও কলে দেখা আর সামনাসামনি দেখার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। আপনি যেদিন আসবেন,সেদিন আমি ওই শাড়ি টা পরে আপনার মনের মত করে সাজবো।
– আচ্ছা বাবা,যেমন তোমার ইচ্ছা।
রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে আমার দীর্ঘশ্বাসগুলোও ভারী হচ্ছে। আপনজনদের ছাড়া ঈদ করার কষ্ট টা এই প্রথম অনুভব করতে পারছি আমি। ভালোবাসার মানুষের অনুপস্থিতি একটা উৎসবের দিন কে অনায়াসেই শোক দিবসে রুপান্তর করতে পারে এটা আগে কখনো বুঝতে পারি নি আমি। সকালে ঘুম থেকে উঠে গোসল করে বড় ভাবীর জোরাজুরি তে আমার শাশুড়ির দেয়া নতুন শাড়ি টা পরলাম। ঈদের নামাজ পরে আসার পর বড় ভাইয়া আর মেজো ভাইয়া ভাবীদের সালামি দিচ্ছেন দেখে হিমেলের কথা খুব মনে পড়ে গেল আমার। কেমন যেন খালি খালি লাগছিলো। একটু পর পর ভাইয়া ভাবীদের খুনসুটি আড়াল থেকে চোখে পড়ে গেলে,বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাসগুলো কোনোমতে দমিয়ে রাখছিলাম। সকাল থেকেই দেখছি আমার শাশুড়ি-মা’র মন মেজাজ ভাল নেই। খুব বেশি দরকার ছাড়া কারো সাথেই তেমন কথা বলছেন না। একটু আগে হিমেলের সাথে ভিডিও কলে কথা বলার সময় তিনি বারবার চোখের পানি মুছছিলেন আর বলছিলেন,
– প্রতিবার তো তুই পছন্দ কইরা গরু কিনোছ। অথচ এইবারের গরু টা দেখতেই পারলি না। হিমেল তার স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে উত্তর দিলেন,
– দেখেছি তো আম্মা,বড় ভাইজান ছবি পাঠিয়েছেন।
– ও। কিন্তু তবুও….। ছবিতে তো আর গরুর গায়ে হাত বুলাইয়া দেয়া যায় না। নামাজ পইড়া কিছু খাইতে পারছোস?
– হ্যাঁ আম্মা,সেমাই খেয়েছি। তুমি অযথা টেনশন নিও না। হাসপাতালে ডাক্তার নার্সদের জন্য স্পেশাল রান্নাবান্নার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আম্মার চেহারা টা মলিন হয়ে গেল,
– তুই আসোছ নাই দেইখা আমি কিছু রান্না করি নাই। কালকে করবো,তোর পছন্দের ফিরনি রান্না করবো কালকে।
– তুমি কোমরে ব্যথা নিয়ে রান্নাঘরে যেও না আম্মা।
– ওইটা আমি বুইঝা নিবো নে। ওহ্ তোরে তো বলাই হয় নাই। জানোছ ঈদের মিষ্টান্ন সব ছোট বউমা রান্না করছে। খাইতে ভাল হইছে,আমি তো ভাবছিলাম সে রানতে পারবে না। কিন্তু প্রথম রান্না হিসেবে খারাপ হয় নাই। তুই খাইলে বুঝতে পারতি। এর মধ্যে নার্স এসে হিমেল কে কিছু জানালো,তিনি তাড়াহুড়ো করে চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে আম্মা কে বললেন,
– আম্মা,এখন রাখি। ইমার্জেন্সী তে যেতে হবে। আম্মা অভিমানের সুরে বললেন,
– কি চাকরী রে বাপ! ঈদের দিন ছেলেরে কাছে পাইতেছি না,এখন কি একটু শান্তিমত ফোনেও কথা বলতে পারবো না! আমারও তো মন বইলা….
আম্মা পুরো কথা শেষ করার আগেই লাইন ডিসকানেক্টেড হয়ে গেল। সেই সময় আম্মার পাশে আমি আর মেজো ভাবী ছিলাম। আম্মার অশ্রুসিক্ত নয়নজোড়া আমাদের দৃষ্টি এড়ালো না। ১১ টার পর মাংস চলে এলে বড় ভাবী প্রথম তরকারি টা চুলায় বসিয়ে দিলেন। আম্মা কে ডেকেছিলেন পাশে বসে দেখার জন্য কিন্তু আম্মা আসেন নি। শুধু বলেছিলেন,
– এইবার কিছু দেখতে ইচ্ছা করতেছে না বড় বউমা। তুমি তোমার মত রান্না বসাইয়া দাও।
দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর আত্নীয়-স্বজনদের ভাগের মাংস বাটোয়ারা করার সময় আমি বারবার ভুল করছিলাম। এতে করে হিসেবে গড়মিল হচ্ছিলো। আম্মা তাই ক্ষেপে গিয়ে আমাকে মাংস কুটার কাজে লাগিয়ে দিলেন। কিন্তু আমি যে আগে কখনো মাংস কুটি নি,এ কথা টা সাহস করে বলতে পারি নি আম্মা কে। ফলাফলস্বরূপ এ কাজটাও ঠিকঠাক হচ্ছিলো না। আম্মা এক পর্যায়ে রেগে গিয়ে সবার সামনে ঝাড়ি দিলেন,
– বাপের বাড়িতে শিখছো টা কি? সারাজীবন তো আর বড় ভাবী রে পাশে পাইবা না। খালি রূপ দেইখা কি আর সংসার চলবো? সংসার চালাইতে হইলে কিছু গুণও থাকন লাগবো। যাও এখন এইখান থাইকা,তুমি আমার সামনে থাকলে আমি কাজ করতে পারবো না। মনের অজান্তেই চোখ দিয়ে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। সাথে ভর করলো সারাদিনের সকল বিষণ্ণতা। শাশুড়ির সামনে থেকে এসে সোজা বারান্দায় চলে গিয়ে স্থির হয়ে বারান্দার একপাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। এই প্রথম বাবা-মা’কে ছাড়া ঈদ করছি,যদিও সকালে বেশ কিছুক্ষণ বাবা-মা’র সাথে ফোনে কথা হয়েছে তবুও… ভালবাসার মানুষটাও নেই পাশে। আমার মনের মধ্য দিয়ে যে কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে,তা কেউ বুঝতে পারছে না। খানিক বাদে কাঁধের উপর কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে পিছন ফিরে মেজো ভাবী কে দেখতে পেলাম। মেজো ভাবী কাছে এগিয়ে এসে আমার ভেজা চোখ দুটো পরম স্নেহে মুছে দিতে দিতে বললেন,
– আসলে এইবারের ঈদ টা হিমেল কে ছাড়া আমাদের ভালো কাটছে না। দেখছো না,আব্বাও কেমন চুপচাপ হয়ে আছেন? খেয়াল করেছো,খাবার টেবিলে বড় ভাইজান আর তোমার মেজো ভাই মনমরা হয়ে ছিলেন? হিমেল থাকলে খাবার টেবিলে কখনো এমন শুনশান নীরবতা থাকে না। ও-ই সবাই কে মাতিয়ে রাখে। ওকে ছাড়া কোনো আনন্দ উৎসব আমাদের জমেই না। তাই বলছি,আমাদের সবার মনের অবস্থা একই। তাছাড়া আম্মার মন খারাপ থাকলে মুখে কোনো লাগাম থাকে না। কাল দেখো,এই নিরিবিলি পরিবেশ টা-ই কেমন জমজমাট হয়ে উঠবে। সব কাজ শেষ করতে করতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেল। সবকিছু গুছিয়ে আমি আর বড় ভাবী গোসল করতে চলে গেলাম। গোসল করে এসে রান্নাঘরে চা বানাতে গিয়ে দেখি,আম্মা চুলায় চায়ের পানি বসিয়ে দিয়েছেন। আমাকে দেখে বললেন,
– ঘরে গিয়া বিশ্রাম নাও। আমি চা নিয়া আসতেছি। আমি এগিয়ে গেলাম,
– না না আম্মা। আপনি ঘরে যান,আমি করতে পারবো। আম্মা এবার হুংকারের সুরে আদেশ দিলেন,
– যা বলতেছি তাই করো। সারাদিন তো তোমরা খাটা-খাটনি করলা। এখন এইটুকু কাজ আমি কইরা নিলে মহাভারত অশুদ্ধ হইয়া যাবে না। বড় বউরেও বইলা দিও,সে যেন আজকে আর রান্নাঘরের দিকে পা না বাড়ায়। আমি আর কথা বাড়ালাম না। চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গেলাম। আর মনে মনে ভাবতে লাগলাম, মানুষ টা কে আমরা যতটা কঠোর ভাবি,ততটা কঠোর তিনি না। বাইরে থেকে শক্ত দেখালেও,ভেতর টা খুব নরম।
রাতে হিমেল কল করে জানালেন,কাল দুপুরের মধ্যেই তিনি রওনা হয়ে যেতে পারবেন। সেই খুশি তে আমার সারারাত ঘুম-ই আসলো না। ভোরবেলার দিকে ঘুমিয়েছি বলে সকালে ঘুম ভাঙতে ভাঙতে ৯ টা বেজে গেল। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে- এত বেলা হয়ে গেল অথচ এখনো কেউ ডাকতে আসে নি। হুড়মুড় করে বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এসে ঘর থেকে বের হয়ে দেখি,চারদিকে ছুটোছুটি শুরু হয়ে গিয়েছে প্রায়। মেজো ভাবী ফ্রিজ থেকে মাছ নামাচ্ছেন আর বড় ভাবী রান্নার আয়োজন করছেন। বড় ভাইজান একটু পরপর কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছেন। আব্বা আর মেজো ভাইয়া কে দেখতে পেলাম না কোথাও। হয়তো বাড়িতে নেই। বড় ভাবী আমাকে দেখে মুচকি হাসলেন,
– কি,ঘুম কেমন হল?
– খুব ভাল। কিন্তু আমাকে ডাকো নি কেন বড় ভাবী?
– আম্মা না করেছিলেন। রান্নাঘর থেকে আম্মার গলার আওয়াজ পাওয়া গেল,
– ছোট বউ ঘুম থাইকা উঠছো নাকি? বড় ভাবীর ইশারায় আমি রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। আম্মা চুলার কাছে চেয়ারে বসে ফিরনি রান্না করছেন। আমি আম্মার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম,
– জ্বী আম্মা,আজকে উঠতে একটু দেরী হয়ে গিয়েছে।
– তা হোক,ঘুম ভাল হইলেই হইলো। আম্মা আজ বেশ খোশমেজাজে আছেন বলে মনে হচ্ছে। আমার দিকে একবার তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিলেন আম্মা,
– শুনো,তাড়াতাড়ি নাস্তা পানি খাইয়া গোসল দিয়া আসো। তারপর একটা সুন্দর শাড়ি পইরা ভালমতো সাজগোজ করো। বাড়িতে মেহমান আসতেছে।
– কে আসবেন আম্মা?
– আমার দুই ভাগ্নি মিরপুরে থাকে। হিমেল আজকে আসতেছে শুইনা তারাও পাগল হইয়া গেছে আসার জন্য।
জামাই আর বাচ্চাকাচ্চা নিয়া এতক্ষণে মনে হয় রওনা হইয়া গেছে। তোমার বড় ভাইজান তো একটু আগে ওদের সাথেই ফোনে কথা বলতেছিলো। তুমি আর দেরী কইরো না। গোসল সেরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির কুচি ঠিক করছিলাম,এর মধ্যেই আমার ননদরা হুমড়ি খেয়ে ঘরে ঢুকে পড়লো। আমি প্রথমে চিনতে পারি নি। বিয়ের দিন একবার দেখেছিলাম শুধু। ওদের মুখ থেকে আহ্লাদী গলায় ভাবী ডাক শুনে আমার চিনে নিতে সুবিধে হল। ননদদের জামাইদের সাথে কুশল বিনিময় শেষে সবাই মিলে আড্ডা দিতে বসে গেলাম। পুরো বাড়ি জুড়ে আজ রমরমা পরিবেশ বিরাজ করছে। বড় ননদের দুই ছেলেমেয়ে আর ছোট ননদের এক ছেলে মিলে খেলাধুলায় মেতে উঠেছে। চারিদিকে এত কোলাহল আর হৈ-হুল্লোড়, মনে হচ্ছে যেন আজ-ই ঈদের দিন। ঈদের আমেজ আজ সবার চোখেমুখেই ফুটে উঠেছে। হিমেলের সাথে সকালের পর আর কথা হয় নি। এখন একবার ফোন দিয়ে খোঁজ নেয়া দরকার। মোবাইল হাতে নিয়ে হিমেল কে কল করলাম আমি। বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পর কল রিসিভ করলেন হিমেল,
– হ্যালো,রওনা হয়ে গিয়েছেন? হিমেল আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন,
– আম্মার কাছে দাও তো ফোনটা। আমি ইমো তে ভিডিও কল দিচ্ছি।
আম্মা সবার সাথে ড্রয়িংরুমে বসে ছিলেন। আমি গিয়ে আম্মার পাশে বসে ইমো তে কল রিসিভ করে আম্মার সামনে রাখলাম মোবাইল টা। ফোনের স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে,হিমেল হসপিটালের একটা ওয়ার্ড ঘুরেঘুরে দেখাচ্ছেন আম্মা কে। পুরো ওয়ার্ড জুড়ে রোগীদের ভীড়। তিল পরিমাণ জায়গা খালি নেই। সাথে আহাজারি হট্টগোল তো আছেই। খানিকবাদে ওয়ার্ডের বাইরে এসে হিমেল বললেন,
– আম্মা,ডেঙ্গুর প্রকোপ ক্রমশ বাড়ছে। আজ সকাল থেকে এ পর্যন্ত মোট ৬৫ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। বেশিরভাগের অবস্থা সংকটাপন্ন। নিজের চোখেই তো দেখলে সব। কিন্তু রোগীর তুলনায় ডাক্তার সীমিত। এখন এদের এই অবস্থায় ফেলে রেখে তোমাদের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগ করতে চলে আসতে আমার বিবেকে বাঁধা দিচ্ছে। তারপরও তুমি যদি বলো,আমি তোমার কথা ফেলতে পারবো না। এখন সিদ্ধান্ত তোমার,তুমিই বলো আম্মা, কি করা উচিৎ আমার? এর মধ্যে পাশের ঘর থেকে আব্বা,বড় ভাইয়া আর মেজো ভাইয়া ছুটে এসেছেন। একটু আগের রমরমা পরিবেশ টা মুহূর্তেই যেন মিইয়ে গেছে। যে যার জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কারো মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। সবার দৃষ্টি এখন আম্মার দিকে,অধীর আগ্রহ নিয়ে সবাই অপেক্ষা করছে তার উত্তর শোনার জন্য। আম্মা আমার ডান হাত টা শক্ত করে চেপে ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,
– আল্লাহ্ বাঁচাইয়া রাখলে সামনের ঈদ টা আমরা সবাই মিইলা একসাথে করবো,ইনশাআল্লাহ্। তুই মন দিয়া তোর দায়িত্ব পালন কর্ বাবা। আমি তোর আর তোর রোগীদের জন্যে দু’আ করতেছি,আল্লাহ্ ভরসা। ছলছল চোখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে হিমেল আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
– মিলি,তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে আজ।
আমি আর কান্না সংবরণ করতে পারলাম না। আম্মা আমাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। উপস্থিত সবাই নীরবে চোখ মুছতে লাগলো। আজ প্রথমবারের মত হিমেল কে নিয়ে ভীষণ গর্ব হচ্ছে আমার। নিশ্চয়ই আম্মারও তাই হচ্ছে। তবে চোখের পানির আড়ালে আমাদের ভেতরের তৃপ্তির ঢেকুর টা সবার অদেখাই রয়ে গেল।