“কি রে তুই নাকি টিউশনি শুরু করেছিস?
স্টুডেন্ট নাকি একটা মেয়ে! বল ঘটনা কি সত্যি?”
রাহাত ক্যাম্পাসে ঢুকতে না ঢুকতেই রাহাতের একদম শার্টের কলার টেনে ধরে ঝাড়ি মেরে বলে উঠলো তূর্পা। মেয়েটার চোখ দিয়ে যেন আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে! রাহাতের এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে, একটা ছেলের টিউশনি করানোটা যেন মস্ত বড় কোনো অপরাধ!
“আরে কি করছিস তুই! ছাড় কলার টা ছাড়! গলা আটকে গেলো তো! এ্যাঁ এ্যাঁ…” শার্টের কলার থেকে তূর্পার হাত ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে রাহাত।
“তাইলে বল তুই ছাত্রী টিউশনি নিছিস ক্যান?
তোরে না ১০০ বার বলছি, ভুলেও কোনো মেয়েরে পড়াতে পারবি না!”
তূর্পার কলার চেপে ধরার মাত্রা বেড়েই যাচ্ছে। রাহাত বহু কষ্টে চেপে ধরা গলায় বলল-
“আরে দোস্ত বলিস না, বাড়িওয়ালী আন্টি তার মেয়েটাকে পড়ানোর জন্য এমন ভাবে জেঁকে ধরলো! মুখের উপর আর না করতে পারিনি”
“চুপ একদম ন্যাঁকামি করবি না! বল মেয়েটা দেখতে কেমন? পড়ে কিসে?”
“আরে বাচ্চা একটা মেয়ে! ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। দেখতে সুন্দর। তবে তোর চেয়ে বেশী না”
“ওই কি বললি তুই! ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে? ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়া মেয়ে বাচ্চা হয়? শিখাস আমারে? তুই এই টিউশনি ছেড়ে দিবি কি না বল!”
“আচ্ছা তুই এত সিরিয়াস হচ্ছিস কেন বলতো? আমি কি তোর বয়ফ্রেন্ড নাকি ঘরের জামাই?”
“হুহ তোর মত আবুল মার্কা ছেলেকে বয়ফ্রেন্ড বানাবো আমি? হাউ ফানি! ওই মেয়েটার জন্য একটু আফসোস হচ্ছে। মেয়েটা যদি ভুল করে তোর প্রেমে পড়ে যায়, তাইলে মেয়েটার লাইফ টা ই একদম শেষ! পুরা তেসপাতা হয়ে যাবে!”
“হইসে, অন্য মেয়েকে নিয়ে তোর এত ভাবতে হবে না। আগের নিজের চিন্তা কর। তোর পাল্লায় যে ছেলে পড়বে সে তো একদম শুকনা তেসপাতা হয়ে যাবে! প্যাঁরায় প্যাঁরায় তার জীবন হয়ে যাবে পেলাস্টিক!”
তূর্পা আর কোনো কথা বলে না। হনহন করে করে উঠে চলে যায় রাহাতের সামনে থেকে। রাহাত পিছন থেকে বার বার ডেকেও তূর্পাকে ফেরাতে পারে না। রাহাত অসহায়ের মত তাকিয়ে তাকিয়ে তূর্পার চলে যাওয়া দেখতে থাকে। মেয়েটা এত বেশী বদমেজাজি ক্যান? সবকিছু তো ঠিকই আছে। রাগ টা একটু কম হলে কি এমন ক্ষতি হতো!
বাসায় ফিরে কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারে না তূর্পা। চোখ বন্ধ করলেই সে দেখতে পায়, রাহাত টিউশনিতে গিয়ে পড়ার টেবিলে বসে ওই মেয়েটার সাথে খিলখিল করে হাসছে। অংক বুঝতে বুঝতে মেয়েটা একদম রাহাতের কাছে চলে আসছে। মেয়েটা কেমন ট্যাপ ট্যাপ করে রাহাতের দিকে তাকিয়ে আছে। কখনো বা লিখতে গিয়ে দুজনের হাতের স্পর্শ লেগে যাচ্ছে। মেয়েটি হয়তো কায়দা করে টেবিলের নিচে পা দিয়ে রাহাতের পায়ে ঠুঁয়াও মারছে!
আর কল্পনা করতে পারে না তূর্পা! ঠাস করে হাতের গ্লাস টা আছড়ে ফেলে মেঝেতে। মুহুর্তেই চুড়মাড় হয়ে যাওয়া কাঁচের টুকরো গুলো ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে যায় পুরো মেঝেতে।
অনেক সহ্য করেছে সে। আর নাহ! কিছু একটা করতেই হবে। কি পেয়েছে কি ও! সব কিছু মুখেই বলতে হবে? তূর্পা একটা মেয়ে হয়েও তার পছন্দের কথা ঢ্যাং ঢ্যাং করে বলতে যাবে কেন? এত দিন এক সাথে চলার পরেও গাঁধা টা কেন বুঝবে না তূর্পা ওকে ভালোবাসে?
পরদিন সকাল হতে না হতেই রাহাতের মেসে এসে হাজির হয় তূর্পা! এত সকালে নিজের মেসে তূর্পা কে দেখে রাহাত যেন আঁকাশ থেকে পড়ে!
“আরে তূর্পা তুই এত সকালে আমার মেসে?”
“চুপ কুত্তা, বেশী কথা বলবি না! তোর সেই বাড়িওয়ালার মেয়েকে ডাক! আমি ওর সাথে দেখা করবো!”
“আরে কি হয়েছে বলবি তো! প্লিজ বল না কি হয়েছে তোর?”
“কিচ্ছু জিজ্ঞেস করতে পারবি না, যা বলছি তাই কর!”
তূর্পার চোখ দুটো একদম লাল টকটকে হয়ে আছে। মনে হচ্ছে যেন কোনো এক হিংস্র বাঘিনী শিকারের নেশায় তেঁতে আছে! রাহাত পরিস্থিতি সামাল দিতে কোমল গলায় বলল-
“তূর্পা তুই কি পাগল হয়ে গেছিস? কি শুরু করেছিস এসব? বাড়িওয়ালা শুনতে পেলে কেমন অবস্থা হবে চিন্তা করেছিস? আর একটা শব্দও করতে পারবি না। চুপ! একদম চুপ!”
তূর্পা এবার আর স্থির থাকতে পারে না। রাহাতের টি-শার্টের কলার ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলে।
“ওই বাঁনর তুই বুঝিস না ক্যান আমি তোকে কত্ত ভালোবাসি! ভার্সিটিতে প্রথম যেদিন তোর সাথে আমার পরিচয় হয় সেদিন থেকেই তোকে সবার থেকে আলাদা লাগে আমার। সেদিন থেকেই তোকে সবার কাছ থেকে আগলিয়ে রেখেছি আমি। তোকে কোনো মেয়ের সংস্পর্শে যেতে দেইনি। এত কিছুর পরও তুই কেন বুঝিস না?? আর আজ তুই অন্য একটা মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত, তাই না? তুই ওই বাড়িওয়ালীর ফইন্নি মেয়েকে একটু ডাক। আমি জাস্ট দুই মিনিট কথা বলেই চলে যাবো। প্লিজ আমার এই শেষ অনুরোধ টুকু রাখ!
রাহাত কিছু বলতে পারছে না। স্তব্ধ হয়ে তূর্পার দিকে তাকিয়ে আছে শুধু। ঠিক সেই মুহুর্তেই উপর তলা থেকে রাহাতের রুমে ৮/৯ বছর বয়সের ছোট্ট একটি কিউট মেয়ের আগমন! মেয়েটি ফড়িং এর মত তিড়িং বিড়িং করে নাচতে নাচতে এসে বলছে- “রাহাত ভাইয়া..রাহাত ভাইয়া কি করো? একটু পর আমরা দাদুবাড়ি যাবো। হি হি হি… কি মজা কি মজা!”
রাহাত কিছুটা অপ্রস্তুত হলো। দ্রুত দু হাতে তূর্পার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল-
“এই পাগলী নে, কথা বল পিংকির সাথে। পিংকি এই বাড়িওয়ালীর মেয়ে। ক্লাস থ্রী তে পড়ে। আমার ছাত্রী।”
তূর্পা যেন নির্বাক হয়ে যায় ক্ষণিকের জন্য। চোখ ভরে আবার ও অশ্রু এসে জমা হয় তার। দুঃখের অশ্রু নয়। সুখের অশ্রু। স্বস্তির অশ্রু। কথা বলতে গলা আটকে আসে তূর্পার-
– শয়তান, তুই না বলছিলি মেয়েটা….
– হেহে মিথ্যা বলছি।
– হারামী মিথ্যা বললি ক্যান?
– এই টুকু মিথ্যা না বললে বুঝতাম কি করে, তুই আমাকে এতটা ভালোবাসিস?
– আজাইরা ঢং! বল আর কোনো দিন মিথ্যা বলবি?
– নাহ! হাহা, খ্যাঁক খ্যাঁক।
– একদম হাসবি না! হাসলে তোকে শিয়ালের মত লাগে!
– আর রাগলে তোকে পেঁচীর মত লাগে”
– কোনো দিন ছেড়ে যাবি না তো?
রাহাত এবার আর হাসতে পারে না। এমন মমতা আর ভালোবাসাময় অভিমান নিয়ে কেউ যখন প্রশ্ন করে, সেই প্রশ্নের প্রতিউত্তরে হাসি আসে না। হাসতে ইচ্ছে হয় না। শুধু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে প্রাণ ভরে কাঁদতে ইচ্ছে হয়। মন প্রাণ উজার করে ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়। রাহাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তূর্পাকে। ছোট্ট মেয়ে পিংকী চুপচাপ পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতেছিল সব। সেদিকে খেয়াল ছিল না কারোরি। ঠিক সেই মুহূর্তে পিংকী হঠাৎ বলে উঠলো, “রাহাত ভাইয়া… তোমরা কোলাকুলি করছো কেন? আজ কি ঈদের দিন?”