ফুটপাত ধরে হাটতে থাকা ক্রাশের হাতে একটি কাগজ আর কলম ধরিয়ে দিয়ে বললাম- ‘চুপচাপ এতে আপনার নাম, বাসার ঠিকানা আর মোবাইল নম্বর লিখে দিন! আমি আমার সন্তানদেরকে এমন একজন ভালো শিক্ষিকা থেকে বঞ্চিত করতে চাইনা।’ আমি জানতাম ও প্রতিদিন বের হয় টিউশনির খুঁজে। ওর বাবা অসুস্থ। মা নেই। হুট করে দুটি টিউশনি ছুটে যাওয়ায় নতুন টিউশনির খুঁজ করতে বের হয় ও। আমার কথাগুলো শুনে প্রথমে অবাক হলেও পরে বললো,
-আপনি কি করে জানেন আমি টিউশনি করি?
-জানি। আপনি আগে যে বাসায় পড়াতেন সেই বাসার বুয়া আমার বাসাতেও কাজ করতো। তার কাছ থেকেই আপনার গুণকীর্তন শুনেছি।
-আমি এতটাও ভালো পড়াইনা। মোটামুটি। তাতে হবে?
-জ্বী। মোটামুটি হলেই হবে। এখন তাহলে বাসায় চলে যান। কাল আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিব আপনি চলে আসবেন।
-গাড়ি লাগবেনা। আমি হেঁটেই আসতে পারবো। আপনার বাসার ঠিকানা দিন!
আমার উদ্দেশ্য ছিল ওকে যেভাবেই হোক বাসায় আনা। তাই ঠিকানা দিয়ে আমি ফিরে এলাম। কাজ থেকে আমার বাসায় ফিরতে বিকাল প্রায় পাঁচটা বেজে যায় তাই রিধিকাকে কল দিয়ে বলে দিলাম চারটার দিকে আসতে। মাকে সবকিছু বুজিয়ে বলে রাখলাম যেন আমি ফিরে আসা পর্যন্ত ওকে ম্যানেজ করে রাখে। বিকালে ফিরেই দেখি গেস্ট রুমে মুখটাকে বাংলার পাঁচের মতো করে বসে আছে রিধিকা। বুজতে আর বাকি রইলোনা যে, আরেকটু দেরি হলেই হয়তো ট্রেনটা মিস করতাম আমি আই মিন, ও চলে যেত। ওকে দেখেও না দেখার ভান করে ভেতরের দিকে যাচ্ছি অমনি ও বলে উঠলো,
-কেন আমার সাথে এতবড় মিথ্যা কথা বললেন আপনি? আমাদের কষ্ট নিয়ে মজা করে কি আনন্দ পান আপনারা? কি দরকার ছিল আমার সাথে এমন মজা করার? আপনি বিয়েই করেননি অথচ সন্তানের কথা বললেন আমায়! এসব কেন করলেন?
-প্লিজ শান্ত হোন! আমি তো আপনাকে বলিনি যে আমি বিবাহিত আর আমার সন্তান আছে। আমি বলেছি, ‘আমি আমার সন্তানদেরকে এমন একজন ভালো শিক্ষিকা থেকে বঞ্চিত করতে চাইনা।’ এর পেছনে রহস্য ছিল, আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই। আমার সন্তানের জননী বানাতে চাই। দয়া করে আমাকে ভুল বুজবেননা। আপনি বসুন আমি চেঞ্জ করে মাকে নিয়ে আসছি।
কথাগুলো শুনে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো ও। আর কিছু বললোনা আমায়। চেঞ্জ করে মায়ের রুমের দরজায় নক করলাম। মাকে ডাকলাম। ভেতর থেকে মা বললেন, ‘তুই রান্না ঘর থেকে নাস্তা নিয়ে রিধিকাকে দে, আমি আসছি।’ গেলাম রান্না ঘরে। নাস্তা নিয়ে ওকে দিলাম। আমিও নিলাম। কিছুক্ষণ পর মা আসলেন। রিধিকাকে মা বললেন,
-দেখো মা, তোমার আঙ্কেল মারা গেছেন ২০১০ সালে একটি সড়ক দুর্ঘটনায়। এরপর থেকে ব্যবসার কাজ আমার রাহুল ‘ই সামাল দিচ্ছে। বুয়ার মুখ থেকে শুনেছে তুমি খুব ভালো মেয়ে আর তোমার মনটাও নাকি খুব ভালো। পাশাপাশি তুমি এডুকেটেট। এসব জানার পর আমি রাহুলকে বলি খুজ নিতে। এজন্যই ও তোমাকে কৌশলে বাসা পর্যন্ত নিয়ে আসে। আমি জানি এটা করা ঠিক হয়নি। তোমারও নিজস্ব স্বপ্ন থাকতে পারে। নিজের ইচ্ছা আর পছন্দ থাকতে পারে। তুমি যদি চাও তাহলে আমি কালই তোমার বাসায় গিয়ে তোমার বাবার সাথে কথা বলব। বাকিটা তোমার ইচ্ছা। কথাগুলো বলে মা উঠে চলে গেলেন। রিধিকা কেঁদেই দিল এবার। আমি ওর দিকে টিস্যু পেপার এগিয়ে দিই। কিন্ত ও রাগে আর সেটা নেয়নি। উঠে চলে যায়।
এরপর দেখতে দেখতে পনেরো দিন কেটে গেল অথচ রিধিকার কোন খবর নেই। অবশেষে ঠিক করলাম ওর বাসায় যাব। এবং তাই গেলাম। গিয়ে দেখি দরজায় তালা ঝুলছে। তারপর এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে যা জানতে পারলাম তাতে আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো! ও বিবাহিতা তবে ডিভোর্সি। আগের স্বামীটা মাদকাসক্ত ছিল। কারণে অকারণে ওকে প্রচুর মারধর করতো। ডিভোর্সের পরও একদিন ওর ঐ স্বামী এসে ওকে নিয়ে যেতে চায়। তখন ওর মা বাধা দিতে গেলে ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে দেয়ালের সাথে ধাক্কা লেগে মাথায় আঘাত পান উনি। পরে উনাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেও আর বাঁচানো যায়নি। অধিক রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয় উনার। এখন রিধিকা কোথায় আছে জানতে চাইলে প্রতিবেশী লোকটি বললো, ‘ও ওর বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে গেছে।’
গাড়িতে উঠে বসি আমি। স্টিয়ারিং চেপে ধরলেও আমার মনটাকে গাড়ি চালনায় স্থির করতে পারছিলামনা। সাইড নিয়ে এক জায়গায় দাড় করাই গাড়িটা। ফোন করি মায়ের কাছে। সবকিছু খুলে বলি মাকে। মা সব শুনে বললেন, ‘ঠিক আছে। তুই বাসায় আয় আমি কাল যাব ওদের বাসায়।’ আমি কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি আমার মা এসব জেনেও রিধিকাকে নিজের ঘরের বউ করে তুলার জন্য রাজি হবেন। এটা নিয়ে আমি দুশ্চিন্তায় ছিলাম। কিন্ত আমি ভুল ছিলাম। সবকিছু ম্যানেজ করে আমার মা ডিভোর্সি রিধিকাকে তার ছেলের বউ করে ঘরে তুলে প্রমাণ করলেন একজন মা যদি চান তাহলে তিনি অনেককিছুই করতে পারেন। রিধিকা ডিভোর্সি ছিল তাতে আমার কোন আপত্তি ছিলনা। আমার মনে ছিল, আমার মা আমার পাশে আছেন। তাঁর সাপোর্ট আছে আমার সাথে। আমার বিশ্বাস ছিল রিধিকাকে নিয়ে সুখের সংসার করতে পারবো। কারণ, রিধিকা খুব ভালো মেয়ে ছিল। খুব ভালো।