প্রচুর মেরেছে আজকে আমাকে। মার খেয়ে ফ্লোরে পড়ে আছি। উঠার শক্তিটুকু পাচ্ছি না। শাশুড়ি এখনও গালমন্দ করেই যাচ্ছে অঝোরে। ছোট ননদটাও মুখ বেঁকিয়ে বলে গেল ” হু, ঢং দেখে আর বাঁচি না। এক চড়েই কাত? অভিনয় কাকে বলে তোমার থেকেই শিখতে হবে ভাবি!”
আমি মারিয়া। বাবা মায়ের খুব আদরের মেয়ে আমি। আব্বু খুব শখ করে শিক্ষিত ছেলের কাছে বিয়ে দিয়েছিল। বিয়ের আগে যেদিন দেখতে এসেছিল আমাকে দেখে আমার শাশুড়ী বলেছিল ” মেয়ের গায়ের রং টা কেমন জানি বেশিই চাপা”। মাথা নিচু করে বসে শুধু শুনেছিলাম। ঘটক ছিলেন আমার ফুফা। উনি বারবার বলছিলেন ” আমাদের মেয়ে লাখে একটা। গায়ের রঙ দিয়ে কি গুন বিচার করবেন নাকি আপা?” আমার শাশুড়ী মায়ের কুঁচকানো ভ্রুযুগলই বলে দিচ্ছিল যে আমাকে তার পছন্দ হয় নি।
কিন্তু কেন জানি না তাদের ছেলে আমাকে খুব পছন্দ করেছিল। বিয়ের পরে শুনেছিলাম সে নাকি বাড়ি এসে সাফ জানিয়ে দিয়েছিল, ” বিয়ে করলে একেই করব, না হলে নয়। ” উনার মা অনেক বুঝিয়ে ছিলেন। কিন্তু একমাত্র ছেলের জিদের কারণে তার সিদ্ধান্ত আর ধোপে টেকে নি।
এর কিছু দিন পরে বেশ ধুমধাম করেই আমাদের বিয়ে হয়ে যায়। ও আচ্ছা আপনাদের কে তো বলাই হয় নি। আমার উনার নাম মোর্শেদ আহমেদ। বিয়ের পরে কিছু দিন যেন স্বপ্নের মত ছিল। তার ভালবাসায় আমি ছিলাম সিক্ত। এমন করত যেন আমি হাঁটলেও সে বুকে ব্যাথা পেত। আমাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিত। মাথার চুল আঁচড়ে এলোমেলো বেনু বেঁধে দিত। এমন করেই যাচ্ছিল দিন। শাশুড়ীও আগের মত কথা শোনাতো না। ননদটাও খুব লক্ষী ছিল আমার।
বেশ কিছুদিন যাবত লক্ষ্য করছিলাম সে যেন আর আগের মত নেই। সকালে বাসা থেকে বের হত অনেক রাতে ফিরত বাসায়। প্রশ্ন করেও উওর পেতাম না। এর পরে আস্তে আস্তে খারাপ ব্যবহার শুরু করল। প্রথম যেদিন চড় মেরেছিল আমি নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। বুঝতে পারছিলাম না কি হল। ব্যাথা না যতটুকু পেয়েছি তার বেশি আশ্চর্য হয়েছিলাম যে আমাকে সে মারল???
ভেবেছিলাম মনে হয় মন খুব বেশি খারাপ তাই এমন করেছে৷ মন ঠিক হলে সরি বলবে। কিন্তু সেদিন হয়ত আমার বোঝার ভুল ছিল। কারণ সেটা ছিল সবে শুরু। এর পর প্রতিরাতে কারণে অকারণে মারত। আগে তো নির্দিষ্ট একটা সীমা ছিল। এখন তাও নেই। যখন দেখে আমি মার খেয়ে প্রাণহীনের মত পড়ে আছি তখনই মার থামায়। তাকে অনেক বার জিজ্ঞেস করেছি কি হয়েছে আমাকে একটু খুলে বলো। উওরে শুধু পেয়েছি নিরবতা। একদিন শাশুড়ী আর ননদের কথোপকথন শুনে ফেললাম রান্না ঘর থেকে। আমার স্বামী নাকি যে কোম্পানিতে চাকরি করত ওই কোম্পানিতেই সে আর তার এক বন্ধু বিশাল পুকুরচুরি করেছে। কিন্তু বিধির বাম তার বন্ধু একাই সব টাকা নিয়ে চলে গেছে। এখন সেই কোম্পানির লোক হন্য হয়ে তাদের খুঁজতেছে।
শোনার পরে যেন বরফ হয়ে গিয়েছিলাম। রুমে যেয়ে দরজা বন্ধ করে অঝোরে কেঁদেছিলাম। শুধু ভাবছিলাম কেন এমন হল। আর কিই বা দোষ ছিল আমার। এর কিছু দিন পরেই আমি অনুভব করলাম আমার ভেতরে অন্য আর একটি প্রাণের স্পন্দনের। আম্মু খুব ছোট বেলায় মারা গিয়েছিল। আব্বুই কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। তাই জীবনের একটা শখ নিজের বাচ্চাকে অফুরন্ত আদর করব। যতটুকু আমি পাই নাই তার চেয়ে অজস্র গুন বেশি ভালোবাসা আমি আমার বাবুকে দেবো।
কিন্তু বিধির বাম। আজ এমন সময় তার অস্তিত্ব আমি অনুভব করলাম যখন আমি নিজেও জানি না আমার সামনে কি আছে। শাশুড়ীকে যখন জানালাম তখন সে সাফ মানা করে দিয়ে বলল ” এই বাচ্চার দরকার এখন একদমই নেই। যখন বাচ্চা পালার মুরোদ হবে তখন বাচ্চার চিন্তা করো”। ভেবেছিলাম উনাকে জানালে উনি খুশিতে আটখানা হবেন। কিন্তু ওই যে বিধির বাম। এই খবর শোনার সাথে সাথে যেন অত্যাচারের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিল সবাই। নানা ভাবে নানা প্রকারে শুরু করল আমার উপর অত্যাচার। শেষমেষ না পেরে আব্বুকে খবর দিলাম। সে এসে নিয়ে গেল আমাকে।
আব্বুর কাছে এসে যেন আমি হাঁফ ছাড়লাম। বাবারা মনে হয় মেয়েদের মুখের দিকে তাকালে সব বোঝে। আব্বু শুধু বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল ” তুই তো আমারই ছিলি আজ থেকে যে পৃথিবীতে আসছে সেও আমার। আমার বুড়ো বয়সের খেলার সাথির যেন কোন অযত্ন না হয় বলে দিলাম।” এই বলে আব্বু অনেক অনেক কেঁদেছিল। আমি চলে আসার পরে একটা দিনও আমার শশুরবাড়ির লোকেরা কোন খোঁজ নেয় নি। তখন আমার সাত মাস চলে। বাবু উপরের পেটে ছিল। শরীর খুব ভারি হয়ে গিয়েছিল। চলতে পারতাম না ঠিক মত। দুপুরের আগে আব্বু বাজারে গিয়েছে। হঠাৎই কলিংবেলের শব্দ। ভাবলাম আব্বু এত তাড়াতাড়ি কি করে ফিরল। পরে দরজা খুলে দেখি কুরিয়ার বয়। একটা পার্সেল এসেছে তাও আবার আমার নামে। সই করে পার্সেলটা খুলে দেখি বেশ কিছু কাগজ। পড়া শুরু করতেই আমার হাত পা ঝিমঝিম করতে লাগল। চোখ থেকে অঝোরে পানি ঝরছিল।এর মধ্যেই আব্বু চলে আসল। আমার অবস্থা দেখে আব্বু দৌড়ে আসল আমার কাছে অনেক প্রশ্ন করছিল আমি শুধু হাত বাড়িয়ে কাগজ গুলো আব্বুকে দিয়েছিলাম। আব্বু পড়ে আমার মাথায় হাত দিয়ে বলেছিল ” মা গো আজ থেকে নতুন জীবন শুরু হল তোর”। আমার স্বামী আমাকে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিয়েছিল। আমিও বিনাবাক্য ব্যয়ে সই দিয়ে দিয়েছিলাম।
কিছুদিন পরেই শুনেছিলাম উনি নাকি এক ডিভোর্সি মহিলাকে বিয়ে করেছিল প্রচুর টাকার বিনিময়ে। এর পরে আমি আর কোন খবরই রাখি নাই তার। তার ঠিক দুই মাস তিন দিন পরে এক বিকালে প্রচন্ড ব্যাথায় আমি কাতর। আব্বু বাসায় নেই দিক না পেয়ে পাশের বাসার আন্টিকে নক করি। উনারা ধরাধরি করে আমাকে হসপিটালের নিয়ে যায়। আব্বু খবর পেয়েই ছুটে আসে। আমার কোল জুড়ে আসে ফুটফুটে এক রাজকুমারী। ঠিক যেন চাঁদের একটা ফালি আমার কোলে এসে পড়েছিল। এই মেয়ের নাম দেয় আব্বু তানহা।
দিন যায় মাস যায় বছর যায়। এমন করতে করতে ২৫ বছর চলে যায় আমার জীবন থেকে। আব্বুও আমাকে ছেড়ে চলে গেছে ৪ বছর হলো। আমার সেই পিচ্চি তানহা আজকে দেশের সেরা দশজন মনো চিকিৎসক এর একজন। একদিন রাতে খেতে বসে মা মেয়ে গল্প করছিলাম। হঠাৎ বলল ” মা তুমি জানো হাসপাতালে এক আজব রোগী এসেছে। কতগুলো পুরোনো শাড়ি হাতে করে বসে থাকে আর একটু পর পর ভিষণ জোরে কান্না করে। ভালো ফ্যামিলির লোক মনে হয় দেখলে। কিন্তু সাথে তার বোন ছাড়া আর কেউ নেই। আর হসপিটালের সবাই বলা বলি করছিল যে তার আর আমার চেহারায় নাকি খুব মিল। ” এই বলেই মেয়েটা খেতে লাগল। আমিও কিছুই বলি নাই। পরের দিন মেয়েকে বললাম আমি তোর সাথে বের হব। ড্রাইভারকে বলবি তোকে হসপিটালে নামিয়ে দিয়ে আমাকে যেন মেঝ খালার বাসায় নামিয়ে দেয়।
মা মেয়ে দুইজনে যখন হসপিটালের সামনে নামলাম তখনই দেখলাম কাপড়ের একটা স্তুপ আমার দিকে ছুটে এলো। ওইটার ভিতরে দুইটা চোখ জুলুজুলু করে চেয়ে আছে। আমার ভয়ে দেখি আত্মা শুকিয়ে গিয়েছে। পরে তানহা অনেক কষ্ট করে তাকে শান্ত করে কাপড় গুলো সরায়। একি এ যে দেখি তানহার বাবা। শুধু অপলক চেয়েছিলাম। ওই চোখ ওই নাক ওই ঠোঁট সবই ঠিক আছে শুধু বয়সের ছোঁয়া লেগেছে। নিজেকে যেন আটকাতে পারছিলাম না। শুধু মেয়েটাকে বললাম মা রে আমাকে বাসায় দিয়ে আয়। তানহা সারা রাস্তা বারে বারে প্রশ্ন করেছে কি হয়েছে। আমার উওর দেওয়ার মত কিছুই ছিল না। শুধু বলেছিলাম পারলে ওই হাসপাতালের চাকরিটা ছেড়ে দিস। আমি চাই নি আমার ভয়ংকর অতীতটা আমার মেয়ে জানুক। ও জানে ওর বাবা মৃত।সেটাই থাকুক জানা। অতীত পেছনে ছেড়ে এসেছি। আর চাই না সে নোংরা অতীত আবার বর্তমানে টেনে আনা।