নদীর কথা

নদীর কথা

বড় অাপার অাগেই অামার বিয়ে টা হয়ে গেলো।অামরা চার বোন,অামি মেঝো।স্কুলে যবার পথে অামাকে পছন্দ করেছে পাত্র।অাব্বা পাত্র পক্ষ কে বলেছিলেন বড় মেয়ের অাগে মেঝো মেয়ের বিয়ে দেই কি করে।তাছাড়া মেয়ের বিয়ের বয়স ও হয়নি। অামার চাচা বললেন-

-তোর মেয়ে বেশি একটা বিয়ে দিলি তো ফরজ কাম একটা কমলো।তাছাড়া কোন খারাপ ঘটনার জন্য তো অার বিয়ে দিচ্ছিস না।এটা সবাই জানবে এবং বুঝবে।ইনশাআল্লাহ, বড় মেয়ে বিয়ে দিতে সমস্যা হবে না। সেদিন টা ছিলো বৃহস্পতিবার, হাফ স্কুল শেষ করে বাসায় ফিরলাম। অাব্বা জিজ্ঞেস করলেন –

-রিকশা করে অাস নাই কেন,টাকা ছিলো না?

-পাঁচ টাকা হারিয়ে ফেলেছি অার পাঁচ টাকা দিয়ে বকুল ফুলের মালা কিনেছি। অাব্বা অামার দিকে ভাবলেশহীন তাকিয়ে অাছেন। অামি শুয়ে শুয়ে বকুলের মিষ্টি ঘ্রাণ নিচ্ছি,বড় অাপা বললো-

-অাজ কে বিকেলে তোর বিয়ে,মেহমানরা অাসতে শুরু করেছেন।

– অামার বিয়ে তাহলে তো খুবই মজা হবে তাই না,অাপা।

ক্লাস নাইনে পড়া একটা মেয়ে অাবেগ কে বাস্তবভাবা টা অস্বাভাবিক কিছু না।বিয়ে টা অামার কাছে তখন মনেহচ্ছিলো অন্য কারো বিয়েতে যে অানন্দ করি ঠিক তাই। পাশের বাসা রিনার দাদী, ভাবীরা অামাকে গোসল করানোর জন্য নিয়ে গেলেন।অামি চিৎকার করে বলছিলাম অামি একা একা গোসল করতে পারবো।এত এত মহিলাদের সমনে কি গোসল করা যায়।

রিনার দাদী অামার হাত ধরে টানাটানি করছে অার বলছে- অায় গো নাতিন কোলে অায়, ডাকিতেছে তোর নানায়। নাতিন অামার সুন্দরী, টাইন্না অানো প্রেম করি। পেটে কাতুকুতু দেয়ার চেষ্টা করছে।এইধরনের দুষ্টামি অামার খুবই বিরক্তি লাগে। চারদিকে হাসির বন্যা বয়ে যাচ্ছে।হাসতে অামরা চার বোন খুবই ভালোবাসি,এইসব বাজে বিষয় নিয়ে হাসাহাসি অামরা কখনোই করি না। অাব্বা-অাম্মার ভয়ে মুখে উড়না দিয়ে হাসতে হয়। রাতে হাসলে অাম্মা বলেন “রাতের হাসি গলায় ফাঁসি।” অামাদের যে কোন তুচ্ছ কারনে হাসি পায়।এক কথায় অামাদের বয়সের তখন একটাই ঋতু বসন্ত।এখানে গ্রীষ্ম,বর্ষা,শরৎ, হেমন্ত, শীতের কেন স্থান নেই।

অামাকে খুব সুন্দর লাগছে লাল শাড়ি,লাল লিপস্টিক,কপালে টিপ, চুড়ি,টিকলি,নথ।বড় অাপাও শাড়ি পরেছে কিন্তু অামার মতো সাজেনি। অাপা কে বললাম অামার মতো সাজো অাপা, তোমাকেও অামার মতো খুব সুন্দর লাগবে। অাপা তখন ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্রী বিয়ের মানে টা হয়তো একটু একটু বুঝে।বড় একটা শ্বাস নিয়ে বললো,অাজ তোর বিয়ে। নতুন জামাই মুখে রুমাল দিয়ে বসে অাছে, অামার পাশে।মনেহচ্ছে জামাই লজ্জা পাচ্ছে কিন্তু অামি লজ্জা পাচ্ছিলাম।ভীষণ লজ্জা একজন অপরিচিত পুরুষের গায়ে লেগে বসতে ভীষণ লজ্জা হচ্ছে। এক ভাবী অামার মুখের সামনে অায়না ধরে বললো-

-জামাই কি দেখা যায়,অাসমানের চাঁন না জমিনের পরী।

-অামার বউ দেখা যায়। সবাই হৈ হৈ করে হাসছে,অামার খুবই লজ্জা লাগছে।

-একজন বললো জামাইর তো বুদ্ধি বেশি জুতা লুকানোর সুযোগ দিচ্ছে না।ও জামাই জুতা কি বেশি টাইট জুতা খুলেন না কেনো?

জামাইর হাত ধুয়াতে ধুয়াতে রিনার দাদী বললেন দেখি কত বুদ্ধি একটা শোলক ভাঙ্গাও তো রসের নাগর – “উট্টুইন্না পুলা ডা তাল গাছ বায়, বাজারের সময় হইলে দৌড়াইয়া যায়।” “উট্টুইন্না” শব্দ টা অামার খুবই বিরক্ত লাগলো,বুড়ি অার কোন ধাঁধা খোঁজে পেলো না।অামি হলে অন্য একটা সুন্দর ধাঁধা জিজ্ঞেস করতাম।কোন টা করতাম মনেকরার চেষ্টা করছি,বড় অাপার বিয়ে তে এই বুড়ি কে দিয়ে ধাঁধা জিজ্ঞেস করানো যাবে না। নতুন জামাই পকেটে হাত দিয়ে এক মুঠো টাকা দাদির হাতে দিয়ে বললো-

– উট্টুইন্না পুলা ডা বাজারে যাওয়ার সময় হয়েছে।

নতুন জামাইর সাথে অামাকে চলে যেতে হবে,অামার নতুন কোন জায়গায় বেড়াতে ভালেলাগে। তবে রাতে থাকতে ভালোলাগে না। অামি বললাম সকালে যাবো এখন অামর ঘুম অাসছে। রিনার দাদী অামার ছোট দুই বোন সাথে যাবে,বড় অাপা যেতে চাচ্ছে তবে তাকে এখন যেতে দেওয়া হবে না।অাম্মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন গাড়িতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যেতে পারবি।দুই একদিন পর তো অাবার চলে অাসবি।

ফুলে ফুলে ভরা একটা বিছানা।গোলপ,রজনীগন্ধা,সূর্যমুখীর মতো দেখতে কিছু ফুল অাছে।অামার খুব ভালোলাগছে,তবে রিনার দাদী যা বলে গেছেন তাতে অামার শরীর কাঁপছে। (বার বার রিনার দাদী বলছি কারন এই বুড়ি কে অামার দাদি ডাকতে ইচ্ছে করেনা।অামার দাদি অনেক ভালো মানুষ ছিলেন।) অামার সাথে কি কি হতে যাচ্ছে মনেহতেই অামি কাঁদছি। নতুন জামাই রুমের দরজা বন্ধ করে অামার পাশে না ঠিক একটু দূরে বসে অাছে।

-অামার নাম রাহাত,তোমার নাম টা বলবে?

-নদী, অামার নাম জান্নাতুল নাঈম সবাই নদী বলে ডাকে।(ভয় কাটিয়ে বলার চেষ্টা টা ব্যার্থ হলো কারন অামার গলা কাঁপছিলো)

অাস্তে অাস্তে ভয় কেটে গেলো,বুড়ি যা যা বলেছে তার কিছুই হচ্ছে না অামার সাথে।জামাই টা অামার তিন বোনের নাম জানতে চাইলো। এক শ্বাসে বললাম অামি সহ চার জনের নাম ঝর্ণা, নদী,রবি,শশী। অামার প্রিয় বান্ধবী দের নাম জানতে চাইলো। অাগামিকাল সিনামা দেখাতে নিয়ে যাবে অামাকে বোনেরা ও সাথে যাবে।

অামি বললাম, বড় অাপা সিনামা দেখতে খুব পছন্দে করে। নতুন জামাই বলেছে বড় অাপা কে ও সাথে নেওয়া হবে। দুজনেরই চোখে ঘুম অামি খাটে তার সামনে শুয়ে পরতে খুব ইতস্ততা বোধ করছি তাই বসে অাছি।সে জুতা এতক্ষণে খুললো। এবার তার পা’য়ে চোখ যেতেই অামি ভয়ে কান্নাকাটি, চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলাম।তার সম্পূর্ণ পা ঠিক অাছে শুধু পা’য়ের পাতা দুটি মুচড়ানো।অামার জামাই লেংড়া অামাকে নিয়ে সবাই হাসবে।

অামার মনেপরতে লাগলো, একবার পত্রিকার পাত্রী চাই বিজ্ঞাপনে পাত্রের পা’য়ে সমস্যা অাছে। বিজ্ঞাপন টা বড় অাপা কে দেখিয়ে তার লেংড়া জামাই হবে বলে হাসাহাসি করছিলাম।এখন তো সকাল বেলা অাপা অামাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে।সবাই অামাকে নিয়ে মজা করবে। অামি কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে গেলাম।সকালের অালো ফুটতেই অাব্বা-অাম্মা, বড় অাপা,অামাদের অত্মীয়রা এসে বকাবকি করছিলো। কেন অাপনারা প্রতারণা করলেন,কেন মেয়েটার জীবন নষ্ট করলেন।অামার মেয়ে এক্ষুনি নিয়ে যাবো অাব্বা বললেন। নতুন জামাইয়ের খালু ভীষণ চালাক টাইপের মানুষ তিনি আব্বা কে বুঝাতে লাগলেন-

-এই মনেকরেন বিয়াই মেয়ে কে অন্য জায়গায় বিয়ে দিলেন,জামাই বিয়ের পরে এক্সিডেন্ট করলো,ধরেন এইটা একটা এক্সিডেন্ট। অাব্বা-অাম্মা কাঁদছে তাদের কান্না দেখে অামরা তিন বোন কাঁদছি।তিন নম্বার বোনের নাম রবি,ও ক্লাস থ্রি তে পড়ে।ছোট বোন শশী ওয়ানে পড়ে। রবি বড় অাপা কে বলছে –

-অাপা দেখো অামরা কাঁদছি, শশী কাঁদছে না।

অামরা চার বোন নতুন জামাইয়ের বাড়ি ছাদে বসে অাছি। নতুন জামাই ছাদে এসে অামাদের সাথে গল্প করছে,গান গেয়ে শুনালো।লোক টা কে একটু একটু অামাদের ভালোলাগছে।তাদের বাড়িতে অসংখ্য কাজের লোক একজন এসে নাস্তা দিয়ে গেলো।

সেজো অার ছোট বোন টা নতুন জামাইয়ের অগোচরে লেংড়া টাইপের একটা ছন্দ
বলে, হাসাহাসি করছে।বড় অাপা তাদের চোখ ইশারা দিয়ে ধমক দিচ্ছে বার বার।বড় অাপা কে রগাতে অামাদের বরাবরই ভালোলাগে।তাই অামি ও তাদের পক্ষ নিয়ে লেংড়া বলতে লাগলাম। নতুন জামাইর বাড়িতে অামরা সবাই চারদিন ছিলাম,তারা অাম্মা-অাব্বা কে বিভিন্ন ভাবে বুঝিয়ে রাখলেন।তাদের অান্তরিকতা কে অামরা উপেক্ষা করে অাসতে পারছিলাম না। নতুন জামাই কে অামাদের সাথে নিয়ে ফিরলাম।নতুন জামাইয়ের উপর রাগ টা সবার কেমন যেনো কমে গেলো। বড় অাপা অামাদের কে বললো-

-মনেকরবি অামাদের ভাই,ভাইয়া বলে ডাকবি।নদী,তুই ভাইয়া ডাকার প্রয়োজন নাই,তুই “ওনি” ডাকবি।

ওনা কে অামাদের এখন অাপন মনেহয়।কেউ কিছু তাকে নিয়ে বললে অামাদের গায়ে লাগে। কত টা অাবেগের বয়স ছিলো তখন সবাই যখন ব্যাপার টা প্রতারণা বলছে অামি তখন ভাবছিলাম সবাই অামাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। বিয়ের দেড় বছর পরে অামাদের একটা মেয়ে বেবি হয়,নাম রাখলাম” ছুটি” ।

ছুটি দেখতে দেখতে অনেক টা বড় হয়ে যায়,স্কুলে ভর্তি করানো হয়।ওর বাবার খুঁড়া পা নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে স্কুলে নিয়ে যায়। ছুটি স্কুলে যায় অামি, অামার পড়ার টেবিলে বসে জানালা দিয়ে বাপ-মেয়ের স্কুলে যাবার দৃশ্য দেখি।তারপর নিজের পড়াশোনায় মন দেই।বিয়ের পরে বেশ অনেক দিন পড়াশোনা হয়নি।অাম্মা-অাব্বার সাপোর্টে অাবার নতুন উদ্দ্যামে শুরু করেছিলাম।এখন ডিগ্রি পড়ছি অনার্স করার ইচ্ছে ছিলো চান্স পাইনি। অাম্মা বললেন মনখারাপ করার কারন নেই পড়াশোনা সব সময়ই উন্নত, এখানে অনুন্নতের স্থান নেই।

ছুটির বাবার কষ্ট দেখে অনেক দিন বলেছি মেয়েকে অামি স্কুলে দিয়ে অাসি।সে হেসে বলতো তার খুব ভালোলাগে মেয়ে কে স্কুলে নিয়ে যেতে।অামরা রাতের খাবার খেলাম,তারপর টিভি দেখলাম। খাওয়ার সময় টিভি দেখা অামার পছন্দ না।ছুটি কে, ওর বাবা খাইয়ে দেয় তারপর বাবার বুকের উপর ঘুমিয়ে পরে মেয়ে টা।মেয়ে টা বাপের ভক্ত।

রাত একটার দিকে ওনি অামাকে ডেকে বললো তার শরীর খারাপ লাগছে।প্রচুর ঘামছিলো অামি পানি এনে দিলাম।ছুটি ঘুম থেকে উঠে গেলো,বাবার মাথায় বিলি কেঁটে দিচ্ছে। অামার হাতে শক্ত করে ধরে,নিঃশ্বাস ছেড়ে দিলো। শারীরিক ভাবে অসম্পূর্ণ মানুষ টা যে কতটা অামাদের জন্য সম্পূর্ণ ছিলো তার মৃত্যুর পরে অনুভব করতে পারছি। অার বিয়ে করবো না সিদ্ধান্ত নিলাম।ছুটি তার বাবা কে সারাক্ষণ মিস করে।অাস্তে অাস্তে একজন জীবন সঙ্গীর কতটা প্রয়োজন উপলব্ধি করতে পারছি। স্বামী-স্ত্রীর একটা বিশেষ বৈধ সম্পর্কের জন্য বিয়ে নয়,বিয়ে নামে ছোট্ট শব্দ টা কে অনেক দায়িত্ব

-কর্তব্য,ভালোবাসা,ত্যাগের ভার বহন করতে হয়।

ফেইসবুকে ওবায়দুল নামে একজনের সাথে পরিচয় হয়, সবচেয়ে বড় কথা ছুটি তাকে অনেক পছন্দ করে।পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে করি ওবায়দুল কে। অামি তাকে ওবায়েদ বলে ডাকি।তার সাথে চ্যাটিং করে বুঝলাম সে খুব সুন্দর করে কথা বলে,খুব কর্মঠ মানুষ। বিয়ের পারে সম্পূর্ণ উল্টো হয়ে গেলো।প্রথমত ছুটি ওবায়েদ কে এখন একদমই পছন্দ করে না।ও খুবই অলস এবং হুটহাট কথা বলে কথার কোন গুছানো ভাব নেই।

সারাদিন মাথার নিচে একটা হাতদিয়ে চিত হয়ে শুয়ে সিগারেট খায় অার খুব চিন্তিত ভংগিতে ধোঁয়া ছাড়ে।এককাপ চা সামনে নিয়ে গেলে কম পক্ষে বিশ পঁচিশ বার থেংক কিউ, থেংকিউ বলবে।তার এমন ভংগি দেখে বিয়ের পরে ভাবতাম মনেহয় ব্যাবসা নিয়ে চিন্তা করে। অাসলে ঘটনা তা নয় তার স্বভাব-ই এমন। ছুটির জন্য ওবায়েদ এখানে অাসতে পারেনা বেশি।ছুটি চিৎকার-চেচাঁমেচি করে বের করে দেয়।সে তার দোকানে ঘুমায়। সন্ধ্যায় ওবায়েদ ছোট মাছ এনে বললো –

-ঝাল কম দিয়ে কাঁচামরিচ অার বিলাতী ধনিয়া পাতা দিয়ে মাখাইয়া তরকারি রান্ধ, নদী।

শুয়ে একটা সিগারেট ধরাতেই, ছুটি বললো তুমি অামাদের এখানে সিগারেট খাবে না।বেরিয়ে যাও, এক্ষুনি যেতে হবে,এক্ষুনি যেতে হবে। ছুটি যে কোন কথা দুইবার করে বলে। অামি ইশারা দিয়ে বললাম রান্না হোক অার ছুটি ঘুমিয়ে গেলে তারপর এসো। ওবায়েদ চলে গেলো। রাতে খাওয়ার পরে ওবায়েদ অামাদের সাথে ঘুমিয়ে পরে।সকালে ছুটির কান্নাকাটি তে ওবায়েদের ঘুম ভাংগে। রাগ করে সে চলে যাবার সময় বলে গেলো-

– কি একটা বিয়াদ্দপ মেয়ে তৈয়ার করছ।

অামার রক্ত মাথায় উঠে গেলো,বললাম তুই বেয়াদব।অামার মেয়ে কে বেয়াদব বলিস। অামার ভিষণ জ্বর,অাম্মা এসে সেবা যত্ন করে গেলে ও বাড়ির বিভিন্ন ঝামেলায় থাকতে পারে না। বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে,শশী হোস্টেলে থেকে পড়ালেখা করে। ছুটির স্কুলের সময় কেউ অবসর থাকে না। অাব্বা বাড়ির জায়গা জমির বিভিন্ন ঝামেলায় দৌড়াদৌড়িতে অাছেন। সবচেয়ে বড় কথা অাব্বা সারাক্ষণ অামার সামনে অাসলে নিজেকে অপরাধী মনেকরেন।অামার বুঝ হবার পরে অনেকবার বলেছি,অাব্বা অাপনার কোন দোষ নেই। তাই নিজের সমস্যা গুলো তাদের সামনে তুলে ধরতে খুব একটা অামার ভালোলাগে না।অামি চাইনা মা-বাবা অামার কাছে নিজেকে গুটিয়ে রাখুক। মেয়েটার পরিক্ষা কয়েক দিন পরে।নির্ভর করার মতে কাউকে পাচ্ছি না। ওবায়েদ দু’দিন যাবৎ অাসছে না,তাকে কিছু বলেও লাভ নেই।তারপরেও কল দিলাম-

-অামার অনেক জ্বর,মেয়ে টা কে স্কুলে দিয়ে অাসতে পারবে।একটু তারাতাড়ি এসো প্লিজ।

তার উপর অস্থা রাখা যায় না তবে নির্ভর করে কোন রকম চলা যায়।ছুটির স্কুল টাইমের এক ঘন্টা অাগে কল দিলাম।কিছু খেয়েছি কি না,শরীর কেমন তার কাছ থেকে এসব কথা অাশা করা ছেড়ে দিয়েছি। ওবায়েদ দশ মিনিটের মধ্যে চলে অাসলো।হাতে খাবারের প্যাকেট।অামি বিস্মিত না হয়ে পারলাম না।

-ছুটি নিজে নিজে খেতে গেলে স্কুল ড্রেস নষ্ট করে ফেলবে,একটু খাইয়ে দিতে পারবে ওবায়েদ। ওবায়েদের চেহারায় ফুটে উঠলো অশ্চর্যবোধক চিহ্ন।

-নিজের হাতে খাইতে পারে না এটা কোন কথা,অামি তো লেংটা বয়স থেকে নিজে নিজে খাইতে শিখছি।

বলে ছুটি কে খাইয়ে দেয়ার জন্য রেডি হলো,ছুটি অামার কাছে দৌড়ে এসে মুখগুঁজে রইলো। অামার অবস্থা অনেক খারাপ একা বাসায় বমি-টমি করে একাকার।বমির মধ্যেই পরে অাছি,কখন যে এখান থেকে উদ্ধার পাবো বুঝে উঠতে পারছি না। প্রায় অাধা ঘন্টা পরে ওবায়েদ অাসলো।বমি দেখে হাসতে হাসতে বললো

-ও নদী নতুন মেহমান অসবে না কি?

অামি তার উপর এমনিতেই বিরক্ত থাকি,তার মাঝে এমন রসিকতা।কিচ্ছু বলার মতো শক্তি অামার নাই।একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কেউ করেদিলেই বাঁচি। ওবায়েদ অাবার চলে গেলো,অামাকে পরিষ্কার করতে হবে এটা কি তার মাথায় অাসেনি।অাসলে ভার্চ্যুয়াল লাইফে মানুষ কে মনেহয় এক রিয়েল লাইফে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এবার প্রায় পনেরো মিনিট পরে হাতে বাজারের ব্যাগ,অার এক মহিলা কে নিয়ে অাসলো।

-টুলটুলির মা,পরিষ্কার বাবাদ তোমারে দেওয়া হবে একশো টাকা।দেশি মোরগার পাতলা ঝোল,পুঁতি অালু দিয়া

অার বাসমতী চাইলের ভাত রানবা একশো টাকা। কাজ অারো বাড়লে অারো টাকা দেওয়া হবে। টুলটুলির মা অামার কাপড়-চোপড় পরিষ্কা করে হাত মুখ ধোঁয়ে দিলো,রান্নাবান্না শেষ করলো। ওবায়েদ বললো –

-টুলটুলির মা তোমার অাপারে লোকমা তুলে খাওয়াইতে পারবা,পঞ্চাশ টাকা পাবে।

-ভাই,টাকা লাগবে না এমনিতেই খাওয়াইয়া দিব। অামি একটু ভ্রু কুঁচকে তাকালাম।

-থাক টুলটুলির মা তুমি খাওয়া দাওয়া করে চলে যাও। ওবায়েদ এক টা প্লেটে ভাত নিয়ে মুঠো করে ভাত অামার মুখের সামনে ধরলো-

-বুঝলা নদী, এতিমখানায় বড় হইছি অাদর সোহাগ পাইনাই।তুমিই অাদর কর তাই তোমার কাছে কাছে থাকতে ভালোলাগে।

অামার চোখে জল জমতে শুরু করেছে,অামি তাকে নিজে পছন্দ করে বিয়ে করছি ঠিকই।কিন্ত ভালোবাসতে পারছিনা।বাজার করে অানলে একটু খেয়াল করে খাওয়াই ছুটি কে লুকিয়-চুরিয়ে এতটুকুতেই সে সন্তুষ্ট।তবে তার কথায় বুঝতে পারলাম ছুটির ব্যাবহারে সে রেগে নেই। ছুটি কে বাসায় দিয়ে ওবায়েদ চলে গেলো।ছুটি বাসায় এসেই বলছে অার স্কুলে যাবে না।অামি মহাচিন্তায় পরলাম।
ছুটি কে জিজ্ঞেস করলাম –

-অাংকেল কি তোমাকে বকা দিয়েছে?

-না।

-মেরেছে?

-না,না,না। ছুটি দৌড়ে চলে গেলো। একটুপরে গিয়ে দেখলাম ছুটি খেলছে,তাকে খারাপ স্পর্শ ও ভালো স্পর্শ বুঝালাম-

-তোমার কি এমন কিছু হয়েছে ছুটি?

-হ্যা।

অামার হাত-পা কাঁপছে ঠোঁট ঠান্ডা হয়ে অাসছে,কে এমন করেছে অামি জিজ্ঞেস করতে পারছি না।ওবায়েদের কথা মাথায় এক ন্যানো সেকেন্ডের জন্য অাসলেও অাবার মাথার কাজ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ওবায়েদ কে ফোন দিলাম।

-ছুটি স্কুলে যেতে চাচ্ছে না কেনো?

-ছোট্ট মেয়ে কখনো ভালোলাগে কখনো ভালোলাগে না তাই মনে হয়।

-তুই কি বলেছিস অামার মেয়ে কে?

-অারে অামি কি বলবো,মেয়েটাই তো অামারে দেখতে পারে না।

-তুই কি করেছিস,ছুটির সাথে?(বলতে চাইনি তারপরেও নিজে কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না)

-তুই নিজে বেয়াদ্দপ, তাই মেয়েটা এমন হয়েছে। ওবায়েদ অামাকে এই প্রথম তুই বললো। এক সপ্তাহ পরে ফোন দিয়ে ওবায়েদ বললো –

-ছুটি ইস্কুলে অাসে নাই কেন?ওরে নিয়া ইস্কুলে অাসো।

অনেক হিসাব মিলাতে মিলাতে স্কুলে গেলাম। গিয়ে দেখলাম অফিস রুমে নতুন টিচারের কলারে শক্ত করে ধরে অাছে।সবাই ছাড়তে বলছে ওবায়েদ কথা শুনছে না। অামাদের দেখে দু’চারটা কিল বসিয়ে দিলো পিঠে।এবার যা শুনলাম, ওবায়েদ ছুটির ক্লাসমেটের পকেটে ভিডিও করা যারয় এমন একটা কলম অাকৃতির ক্যামেরা দিয়ে দিয়েছিলো।টিচার অাদরের ছলে বাচ্চাদের যে নির্যাতন করতো তা অাজ ধরা পরেছে।

-প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পাইলেই কি মিয়া শিক্ষক হওয়া যায়।অাগে নিজেকে শিক্ষিত করেন তারপর শিক্ষক হইয়েন।শিক্ষক অনেক সম্মানের বিষয়,এই যে অাপনার কলিগ তারা হচ্ছে শিক্ষক অার অাপনে হইলেন অাগাছা।
জ্ঞান কোথায় থেকে অর্জন করেছেন তা গৌণ,কতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছেন তা মুখ্য। ছুটি অামার কোলে ঘুমিয়ে পরেছে।ওবায়েদ অামার কোল থেকে ছুটিকে নিলো।বাসায় এসে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরলাম।ছুটি ওবায়েদের বুকে পরম নির্ভরতায় ঘুমাচ্ছে। সন্ধ্যায় ঘুম ভাংলো,পাশে ওবায়েদ ও ছুটি নেই।অামার অাগের মতো অার চিন্তা হচ্ছে না কেনো জানিনা।
ওরা রাত অাট’টায় বাসায় অাসলো।

-নদী, অামার অাম্মুর কত বুদ্ধি তুমি জানো? হেসে বললাম-

– কি করলো? ছুটি বলতে লাগলো-

-জানো মামনি, বাপী অনেক বোকা। দোকানে গিয়ে বলে, একটা ঠোঁট পালিশ একটা গালপালিশ দেও। ছুটি এই প্রথম ওবায়েদ কে বাপী ডাকছে।শুনে অামার কেমন জেনো গায়ে একটা কাঁটা দিয়ে শিহরণ খেলে গেলো।

-কও তো নদী,অামি কি তোমাদের মতো লিবিস্টিক বলতে পারি ?

-তুমি তো শিক্ষিত মানুষ, লিপস্টিক বলতে পারবে না কেনো?

-অারে শিক্ষিত হইলেই কি সব পারতে হইব।

ওবায়েদ হাসছে,ছুটি তার চুলে বিলি কেঁটে দিচ্ছে। খাওয়া-দাওয়ার শেষ করে টিভি দেখতে বসলাম,ছুটি পাশের রুমে পুতুল নিয়ে একমনে খেলছে। পুতুল খাচ্ছে না তাই মাঝে মাঝে ওবায়েদের কাছে পুতুল কে এনে ধমক দিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। ওবায়েদ ছুটি কোথায় অাছে দেখলো,তারপরে অামাকে জড়িয়ে ধরে বললো-

– ও নদী বমি-টমি করছিলা কেনো? লজ্জায় অামার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।

-মেয়ে টা একা একা খেলে,ওর জন্য অাইজ রাইত থেকে একটা ভাইয়ের ব্যাবস্থা করি চলো।

-ফাজিল, তো কম না তুমি।

বলে ওবায়েদ কে দৌড়ানি দিলাম,ছুটি ও দৌড়াদৌড়ি তে অংশ নিলো। মানুষ ভিন্ন, ভিন্ন তার ভালোবাসার ধরন।সব ধরনের ভালোবাসার রেজাল্ট একটাই অাসে
ভালোবাসা।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত