জুলুম

জুলুম

নারীরা পুরুষের চোখের ভাষা পড়তে পারে। এটা তাদের এক অদ্ভুত ক্ষমতা! কিন্তু সব পুরুষই নারীদের চোখের ভাষা পড়তে পারে না।তাই নারীর ভালোবাসা মিশ্রিত মায়াবী চাহনির মাঝেও পুরুষ কপটতার গন্ধ পায়!

বিড়ি টানতে টানতে কখন যে হাশেম আলীর দৃষ্টি তার স্ত্রী রূপাবতীর উপর পড়েছে–সে খেয়ালই করে নি!  এই রমণীকে সে প্রতিদিনই দেখে। একসাথে খায়। একসাথে ঘুমায়৷ কোনোদিন তাকে এতো সুন্দর লাগেনি! আজকে ভীষণ সুন্দর লাগছে! তার স্ত্রী রূপাবতী এতক্ষণ বসে বসে সবজি কাটছিলো। স্বামী হাশেম আলীর তাকিয়ে থাকার ব্যাপারটা সে বুঝতে পেরেছে। ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলো–

_ কীগো! কী দেহো এমন কইরা চাইয়া?

_ তোমার মাছ কাটা দেখি!

রূপাবতী ফিক করে হেসে দিলো। কারণ এতক্ষণ সে বসে বসে সবজি কাটছিলো। তার আশেপাশে আদৌ কোনো মাছ ছিলো না। স্বামী হাসেম আলী রুপাবতীর মুখের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকার কারণে রূপাবতী মাছ কাটছে নাকি সবজি কাটছি এটা সে বুঝতেই পারে নি! রূপাবতী জিজ্ঞেস করলো

_ কই দেখলা মাছ?

_ আসলে চোহে সমস্যা হইয়া গেছে তো। তাই দেহি নাই তুমি কি কাটতাছো!

একটা মিথ্যাকে ঢাকার জন্য মানুষ আরেকটা মিথ্যা বলে! এটা মানুষের এক অদ্ভুত স্বভাব! হাসেম আলীর চোখে সমস্যা হয়েছে–ব্যাপারটা এরকম না! বরং এতক্ষণ ধরে সে স্ত্রীর মাছ কাটা কিংবা সবজি কাটা কোনোটাই দেখেনি। তাকিয়েছিলো স্ত্রীর অপরূপ চেহারার দিকে! এটা ঢাকার জন্যই সে মিথ্যে বলেছে!

রূপাবতীর ঠোঁটের কোণে তখনও চন্দ্রাবতী হাসি লেগেছিলো! হাসির অপরূপ উজ্জ্বলতায় রূপাবতীর চেহারা চাঁদের মতো ঝলমল ঝলমল করছিলো! এ হাসির আরেকটা মানে আছে! সে মানেটার নাম হলো ভালোবাসা! এই হাসির পিছনে পাগল হয়েই মজিদ মেম্বার রুপাবতীর বাবাকে বেঁধে রেখেছিল! যে করেই হোক রূপবতীকে আমার কাছে বিয়ে দিতেই হবে। রূপাবতীর বাবা রাজি হননি! খারাপ মানুষগুলোর মধ্যেও মাঝেমধ্যে অসাধারণ গুণ থাকে!

মজিদ মেম্বার মানুষ খারাপ হলেও তার মাঝে অসাধারণ একটা ভালো গুণ আছে! সে নারী জাতিকে সম্মান দিতে জানে! রূপাবতী যখন বলে দিলো–বাবা যখন রাজী না! তখন আমিও রাজী না। মজিদ মেম্বার তখন আর জোরাজুরি করে নি! রূপাবতীর চেহারায় যে জৌলুস, যে কমনীয়তা ভালো ঘরে তার বিয়ে হতে পারতো! কিন্তু হলো এই হাশেম আলীর সাথে! এতক্ষণ পিনপতন নীরবতা ছিলো! হঠাৎ ঘরের উপরে থাকা সজনে গাছে ডানা ঝাপটে এসে বসল একটা বসন্তের কালো কোকিল। ডানা ঝাপটানোর শব্দে হুঁশ ফিরলো রূপাবতীর! কথার মোড় পাল্টে জিজ্ঞেস করলো–

_ কিগো, চেয়ারম্যান সাব কয়দিন আগে কী কইয়া গেলো? জমিন নাকি এইডা ছাইড়া দিতে অইবো! আমরা যামু কনে?! হাশেম আলি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো —

_ আশেপাশের বেবাকতেই তো জমিন ছাইড়া চইলা গেলো। এহন খালি আমরাই বাকি! আমাগো জন্যেই নাকি চেয়ারম্যান সাব এহানে কারখানা খুলবার পারতাছে না! কী যে করি–হেওডাও বুঝতে পারতাছি না!

স্ত্রীর রূপাবতী আবারো সবজি কাটায় মনোযোগী হলো। হয়তো হাশেম আলীর কথা সে কিছুই বুঝতে পারে নি! কিংবা বুঝেও তার কোনো উত্তর দেয় নি! একসপ্তাহ পরের কথা । এক রাতে হঠাৎ দরজায় কারো খটখটানি আওয়াজ শুনা গেলো!  হাশেম আলী ভড়কে যায়! এতো রাতে কে আসবে? রূপাবতী দুধের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে শুয়ে আছে। পাশে শুয়ে আছে ছয় বছর বয়সী ছেলে খায়রুল। হাশেম আলী তড়িঘড়ি করে দরজা খুলতেই হড়বড় করে ভেতরে ঢুকলো কয়েকজন!

_ তোরে কইছিলাম জমিটা ছাইড়া দিতে। মানছ নাই। এহন বুঝবি মজা। তোর বউ কই?!

_ কেন ভাই? ওরে দিয়া কী কাম?

_ কাম তো ওর লগেই!

এই কথাটা বলেই হিংস্র প্রাণীর মতো রূপাবতীর কোমল দেহের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো মানুষরূপী হায়েনাগুলো! এতক্ষণ আকাশে ফকফকা চাঁদ ছিলো!মনে হচ্ছিলো চাঁদের গা বেয়ে চুইয়ে পড়ছে তার অপরূপ সৌন্দর্য্য! হঠাৎ করেই মস্ত বড় চাঁদটা মেঘের আবরণে হারিয়ে গেলো।

এই নিশুতি রাতে হাশেম আলীর বাড়িতে যেই কলঙ্ক হচ্ছে তার প্রভাব কি নিষ্কলঙ্ক চাঁদের গায়েও লেগেছে নাকি! হয়তো লেগেছে! লেগেছে বলেই মেঘের আড়ালে লজ্জায় মুখ লুকিয়েছে! রূপাবতী গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। খায়রুল মা মা বলে এগিয়ে আসতেই ওকে একটা লাথি মেরে বাইরে বের করে দেয় এক নরপশু! হাশেম আলী বাঁধা দিতে এগিয়ে আসলে জবাইয়ের ছুড়ির মতো লম্বা ছুড়ি দিয়ে তার পেট এফোঁড়ওফোঁড় করে দেওয়া হয়!

কলকল করে তার দেহ থেকে রক্ত বেরুচ্ছে! রাতের অস্বাভাবিক অন্ধকারে মনে হচ্ছে হাশেম আলীর রক্তের রঙ কালো! কুচুকুচে কালো! হয়তো গরীবের রক্ত কালোই হয়! মানুষের মনে লাল রঙা রক্তের জন্য মায়া আছে। কালো রক্তের জন্য মায়া নেই।অনেকেই মনে করে গরীবরা অস্পৃশ্য, সমাজের অভিশাপ। তাদের জীর্ণশীর্ণ নোংরা কদাকার শরীর কারো পছন্দ না! হাশেম আলী মারা যায়!  আহা! বেঁচে থাকার কী আকুতি ছিলো তার মুখে! কেও শুনে নি! ওর মুখের ভাষা কেও বুঝে না! বুঝতে চেষ্টাও করে না! রাত শেষে ভোর হয়েছে খানিক আগেই! এখন কুয়াশার মতো নিবিড় হয়ে নামছে মেঘ। গাছের পাতালতায় সেই মেঘের কোনো শব্দ হয় না।

বৃষ্টির সময়টাতে তীব্র গরমেও শীতের আমেজ পাওয়া যায়। কিন্তু আজকে বাতাসে ভ্যাপসা গরম ভাব! বিছানায় শুয়ে গলাকাটা কই মাছের মতো ছটফট ছটফট করছে রূপাবতী! পাশে পড়ে আছে হাশেম আলীর নিথর দেহ! ফ্যালফ্যাল চোখে খায়রুল একবার বাবার দিকে তাকায়! একবার মায়ের দিকে তাকায়! সেই হতাশ চোখের চাহনি বুঝার ক্ষমতা পৃথিবীতে কারো আছে!  নাহ! কারো নেই।সেই হতাশার ভার বইবার শক্তি কেও রাখে! রাখে না! হঠাৎ রূপাবতী কুঁকড়ে উঠে বললো–

_ বাবা, তোর নানারে গিয়ে খবর দে! আশেপাশের কেও তো আইলো না চেয়ারম্যান সাবের ডরে!

ছোট্ট খায়রুল নানাকে খবর দেওয়ার জন্য ছুটে যায়! এক গ্রাম পরেই তার নানাবাড়ি। মাঝখানে পড়ে লম্বা একটা বাঁশের পুল। বাঁশের পুলের ওপারেই তার নানার ছোট্ট ঘর! বাতাসের ঝাপটায় পুলটা বুড়ো মানুষের দাঁতের মতো নড়বড় নড়বড় করে! বাতাস যখন থেমে যায়, পুলটাও তখন স্থির হয়!

খায়রুল পুলের উপরে উঠতেই বাতাসের ঝাপটায় পা পিছলে ঝপাং করে পানিতে পড়লো!খায়রুল কি সাঁতার জানে?! নাহ! খায়রুল সাঁতার জানে না! কুণ্ডলী পাকানো পানির স্রোতে এতক্ষণে খায়রুলের দেহটা হয়তো অনেকদূর চলে গিয়েছে! ওদিকে দুধের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে কাতরাচ্ছে মা! এদিকে পানির তীব্র স্রোতে ভেসে যাচ্ছে ছেলে!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত