গভীর রাত। চারদিকে কুয়াশার মতন নিবিড় হয়ে নামছে গাঢ় অন্ধকার। মেঘলা আকাশ। আকাশে কোনো তারা নেই। নেই চাঁদের জোছনা। এমন অমাবস্যা রাতে একটা মেয়ে পথ ভুলে ক্রমশ জনবসতি থেকে চলে এসেছে দূরে বহুদূরে! মেয়েটা অনিন্দ্য সুন্দরি। আয়ত নয়না। কৃষ্ণ কুন্তলা। হাঁটতে হাঁটতে মেয়েটা হঠাৎ প্রবেশ করলো বিরাট বনে, গহীন অরণ্যে। মেয়েটার ভয় বাড়ছে। বাড়ছে শঙ্কাও! চারদিকে ওঁৎ পেতে থাকতে পারে দস্যুদল। অতর্কিত আক্রমণে তারা যদি কেড়ে নেয় তার কুমারীত্ব, তার সতীত্ব! তার কোমল মোহনীয় সৌন্দর্যের উপর যদি হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে হায়েনার দল! তখন?!
হাঁটতে হাঁটতে মেয়েটা বনের গভীরে চলে গেলো। চারদিকে সুনসান নীরবতা। মাঝেমধ্যে আবার সশব্দে চেঁচিয়ে উঠছে ঝিঁঝিঁ পোকার দল । বাতাসে ভেসে আসছে বাহারি ফুলের গন্ধ। আগামীকাল যে কুঁড়িগুলো ফুটবে তারা ফোটার প্রস্তুতি নিচ্ছে। যারা ফুটবে পরশু, তারা বড় হচ্ছে। আর যারা আজকে ফুটেছিলো তাদের মোহনীয় ঘ্রাণ এখনো রয়ে গেছে বনের বাতাসে, খোলা আকাশে! কিন্তু মেয়েটার ওসবে কোনো খেয়াল নেই। তার ভিতরে মারাত্মক ভয় কাজ করছে। কী করবে এখন?! কোথায় যাবে? ঈষৎ দূরে হঠাৎ চোখে পড়লো একটা মসজিদ! ভেতরে মোমবাতির আলো জ্বলছে। বাতাসের তীব্র ঝাপটায় আলোটা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়। বাতাস যখন থেমে যায় আলোর গতি তখন বাড়ে। ভয় এবং আশা দুটো একসাথে করে মেয়েটা মসজিদের দিকে এগুলো। উঁকি দিলো মসজিদের ভেতরে। ”মানুষজন কাউকেই তো দেখা যাচ্ছে না! এ আমি কোথায় চলে আসলাম! ”— মনে মনে বললো মেয়েটি।
সহসা তাকিয়ে দেখে ঐ তো মসজিদের কোণায় একজনকে দেখা যাচ্ছে। সুদর্শন যুবক। উন্নত দেহসৌষ্ঠব। গায়ে পাঞ্জাবি। মুখে ভদ্রতার একফালি চাঁদ। যুবক একধ্যানে কিতাব অধ্যয়নে নিমগ্ন। মেয়েটা ধীরে ধীরে মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করে সোজা গিয়ে দাঁড়ালো পাঠে নিমগ্ন যুবকের পেছনে। যুবকের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য মেয়েটা সুন্দর করে সালাম দিলো। পেছন ফিরে তাকালো যুবক। একি! এরকম গহীন অরণ্যে এতো আশ্চর্য সুন্দরী মেয়ে আসলো কোত্থেকে?! প্রশ্ন করার আগেই মেয়েটা খুলে বললো সব। “ পথ ভুলে এসেছি৷ আজকের রাতটা আপনার সাথে কাটাতে চাই! আপনার যদি মর্জি হয়”— করুণ কণ্ঠে মেয়েটার সকাতর আকুতি। যুবকের দয়া হলো। নরম গলায় বললেন, ঠিকাছে। থাকুন। মসজিদের ঐ কোণায় গিয়ে বসে থাকুন৷ এখানে আপনার কোনো ভয় নেই। সকাল হলে আপনাকে আমি পৌঁছে দিবো ইনশাআল্লাহ।
তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে মেয়েটা কোণায় চলে গেলো। যুবক নিমগ্ন হলো আগের মতো কিতাব অধ্যয়নে। যুবকের প্রতি মেয়েটার শ্রদ্ধা বাড়ছে, বাড়ছে ভরসা। সে একধ্যানে তাকিয়ে আছে সুদর্শন যুবকের দিকে। তাকে দেখছে, দেখছে তার পাঠের নিমগ্নতা। এদিকে যুবক ভাবলেশহীন। এরকম আশ্চর্য সুন্দরী একটা মেয়ে গহীন অরণ্যে, জনমানবহীন প্রান্তরে, নিশুতিরাতে তার পাশে বসে আছে, এদিকে তার কোনো খেয়াল নেই! হঠাৎ যুবক অদ্ভুত এক কাণ্ড করতে শুরু করলো। মেয়েটা বিচলিত হয়ে গেলো। এটা কী করছে সে! পাগল হয়ে গেলো নাকি! মেয়েটা ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে চুপ করে বসে থাকলো। হারিয়ে ফেললো কথা বলার সাহস।
এদিকে যুবক তার কাজ করেই যাচ্ছে। বারবার মোমবাতির আগুনে তার আঙুল পোড়াচ্ছ। আগুনে আঙুল পোড়ানোর মানে কী— মেয়েটা বুঝতে অপারগ! দেখতে দেখতে সকাল হলো। সবুজ গাছের কচি পাতার আবরণ ভেদ করে আছড়ে পড়তে লাগলো সোনালি সূর্যের আলো। পাখিরা সশব্দে জেগে উঠলো। আলো বাড়ার সাথে সাথে মেয়েটার সাহস বাড়লো। এখন ফিরে যাওয়ার পালা। যুবক নিজেই তাকে নিয়ে যাবে মেয়েটার ব্যক্তিগত গ্রামে, তার বাড়িতে।জড়তা ভেঙে মেয়েটা জিজ্ঞেস করলো— গতরাতের একটা বিষয় বুঝতে পারছি না। বারবার আপনি আগুনে আপনার আঙুল পোড়াচ্ছিলেন। এটা কেনো?! যুবক নিরুত্তর। কিন্তু মেয়েটা নাছোড়বান্দা। অবশেষে যুবক বলতে বাধ্য হলো।
“ আসলে গতরাতে আপনি যখন আমার পাশে ছিলেন তখন আমার ভেতরের কুপ্রবৃত্তি বারবার জেগে উঠছিলো। আমাকে ফুঁসলাচ্ছিলো। আপনার মোহনীয় সৌন্দর্য আপনার সামনে বিকশিত করে তুলছিলো দারুণভাবে। আমাকে অবৈধ সম্পর্কের জন্য প্ররোচিত করছিলো। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার ভয়ে আমি মৃত্যুর কথা স্মরণ করতে লাগলাম। স্মরণ করতে লাগলাম পরকালের করুণ পরিণতির কথা। জাহান্নামের সুতীব্র শাস্তির কথা। ভয়ানক আগুনের কথা।মোমবাতির আগুনে আঙুল পুড়িয়ে নিজেকে বলছিলাম, দ্যাখ, দুনিয়ার সামান্য আগুনের কী ভীষণ যন্ত্রণা। কী তার ব্যথা! তুই যদি আজকে পাপ করিস তাহলে পরকালে তোর প্রভুর সামনে কীভাবে দাঁড়াবি?! তোর লজ্জা করবে না”! আল্লাহ আমার সঙ্গে ছিলেন। ব্যভিচার থেকে আমি বিরত থাকতে পেরেছি।
যুবকের কথা শুনে মেয়েটা মুগ্ধ হলো।আপ্লুত হলো। বাড়িতে ফিরে তার বাবাকে সবিস্তারে সব খুলে বললো। এবং এটাও বললো, বিয়ে করলে আমি ঐ যুবককেই করবো। জীবনসঙ্গী হিসেবে তাকেই আমার পছন্দ। মেয়ের পিতা ছিলেন বিরাট ধনী। বিত্তশালী। ছিলেন ধার্মীকও। তাই মেয়ের আবদার তিনি মেনে নিলেন। আদরের দুলালীকে তুলে দিলেন নীতিবান যুবকের হাতে। শুরু হলো ভালোবাসার পবিত্রতম অধ্যায়। অকৃত্রিম প্রেমের সুগভীর সম্পর্ক!
বন্ধু! তুমি কি ভেবে দেখেছো, যুবক যদি সেই রাতে লাস্যময়ী অনিন্দ্য সুন্দরি মেয়েটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তো, গহীন অরণ্যে, এমন জনমানবহীন প্রান্তরে যদি অবৈধ প্রণয়ে লিপ্ত হতো, সুন্দরীর সুমিষ্ট মদিরা প্রাণ করতে যদি বেছে নিতো নীতিবিরোধী অবৈধ পথ, মিলনের অতল উচ্ছল আনন্দে অভিভূত হয়ে যদি ভুলে যেতো ধর্ম ও পরকাল, তাহলে সে দুনিয়াতেও হতো লাঞ্ছিত বঞ্চিত, পরকালে পেতো কঠিন শাস্তি। কিন্তু যুবক তা করে নি। তাই পুরস্কার হিসেবে পেয়েছে ধনী পিতার অনিন্দ্য সুন্দরি মেয়ে, একজন অতুলনীয়া স্ত্রী। প্রিয়তমা জীবনসঙ্গিনী। হ্যাঁ, সততা আর পবিত্রতার পুরস্কার এমনই হয়।