একটি আইলসা প্রতিযোগিতা

একটি আইলসা প্রতিযোগিতা

সকালে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকা হাতে নিয়ে খবর পেয়ে জানতে পারলাম ‘সেরা আইলসা প্রতিযোগিতায় প্রতিযোগীর নিবন্ধন চলছে।’ বাকি নিয়মাবলী পড়া আর হলো না অলসতার জন্যে। ছোট ভাইকে ডাক দিয়ে বাকি নিয়মাবলী পড়ে শুনাতে বললাম। ছোটভাই পড়ে নিয়মাবলী গুলো শুনালো। নিয়মাবলী হচ্ছে, যে সেরা আইলসা প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট হবে সরকার তাকে একটি ফ্ল্যাট দিবেন আর সারাজীবন তার ভরণ পোষণের দায়িত্ব নিবেন। তবে সে যে আইলসা এটা প্রমাণ করতে হবে। ছোট ভাইকে দিয়ে নিবন্ধন ফরম পূরণ করে দরখাস্ত পাঠালাম। দরখাস্ত পাঠানোর চৌদ্দ দিন পর ফিরতি চিঠি দিয়ে আমাকে জানানো হলো, আগামী মাসের চৌদ্দ তারিখ আমার অডিশন।

দেখতে দেখতে সেই কাঙ্ক্ষিত দিনটি এসে গেলো। আজ আমার অডিশন। বাসার সবাই আমাকে কোলে করে নিয়ে গাড়িতে তুলে দিয়ে আসলো অডিশনের যাওয়ার জন্যে। পৌঁছার কথা ছিলো সকাল ৭ টায় অথচ আমি গিয়ে পৌঁছালাম ১০ টায়। এক ঘন্টা বিলম্ব করে পৌঁছালাম। আমি অডিশন রুমে প্রবেশ করে স্যার কে সালাম দিলাম। স্যার আমাকে চেয়ারে বসার কথা বলার আগেই আমি বসে গেলাম। শুরুতে স্যার আমাকে রিলেক্স থাকতে বললেন। তারপর আমার হাতে একটি কলা দিয়ে বললেন, ‘এই নাও কলা। এটা খাওয়ার পরেই তোমার অডিশন শুরু হবে।’

আমি কলাটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ দেখলাম। দেখে বললাম, ‘স্যার যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম?’ স্যার বললেন, ‘আচ্ছা বলো কি কথা বলবে?’ আমি একগাল মুচকি হেসে স্যারকে বললাম, ‘স্যার কাইন্ডলি কলার খোসাটা একটু ছাড়িয়ে দিবেন? না দিলে স্যার কলাটা আমি খাইতে পারবো না! আমার বড্ড অলসতা লাগে’ এই কথা বলতে না বলতেই আশেপাশের সবাই হাততালি দিয়ে উঠলো। স্যার আমার পিঠ ছাপড়িয়ে বললেন, ‘ওয়েলডার্ন বয়। ইয়্যু আর সিলেক্টেড!’ আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। অডিশনই দেইনি আমি, সিলেক্ট হলাম কিভাবে! কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে আছি। তখন একজন মহিলা এসে আমাকে বললেন, ‘আপনি যে খোলার খোসা ছাড়িয়ে খান নি, এটাতেই প্রমাণ হয়েছে আপনিই সত্যিকারের আইলসা। দ্বিতীয় রাউন্ডের জন্যে প্রস্তুতি নেন ’

অডিশনের পর ভাবলাম আর কেউ জিতবে কিনা সন্দেহ। আমার মতো আইলসা আর কেউ নাই আমি এতোদিন এটাই বিশ্বাস করতাম। কিন্তু অডিশনের পর আমার ধারণা পাল্টে গেলো। হাজার হাজার প্রতিযোগী। মনটা খারাপ হয়ে গেলো। বাংলাদেশে এতো অলস লোকের বসবাস! কিচ্ছুক্ষণ পর একজন ভলেন্টিয়ার এসে মাইকে ঘোষণা দেওয়া শুরু করলো, ‘এটেনশন গাইজ! আজ রাতেই শুরু হবে আপনাদের প্রথম রাউন্ড। কারো কোনো অলসতার কমতি পেলে তাকে ডিসকোয়ালিফাই করা হবে। আপনারা তৈরি থাকুন। ধন্যবাদ।’

রাত অনেক হয়েছে, খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমাতে হবে। আশেপাশে কাউকেই পেলাম না আমাকে খাইয়ে দেবার মতো। তাই আমি নিজ হাতে খাবো বলে রাতে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে ঘুম থেকে উঠার কথা ছিলো ভোর ছয়টায়। কিন্তু আমার ঘুম ভাঙ্গলো নয়টায়। আমি কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে আবার বিছানাতেই শুয়ে রইলাম। অলসতার জন্যে বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে হচ্ছিলো না। কিচ্ছুক্ষণ পর একজন এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এতো বেলা হয়েছে আপনি এখনো বিছানা ছাড়ছেন না কেনো? কি হয়েছে আপনার?’ আমি উনাকে উত্তর দিলাম,

‘সারারাত খুব কষ্ট করে ঘুমাইছি তো! তাই এখন একটু বিশ্রাম নিচ্ছি।’ আমার এই কথা শেষ হতে না হতেই আবারো সেই করতালি। আবারো স্যার এসে সেই আগের মতোই আমার পিঠ ছাপড়ে বললেন, ‘কংগ্রেটস! তুমি ফাইনাল রাউন্ডের জন্যে সিলেক্টেড।’ আমি বিছানা ছেড়ে উঠে হাত মুখ ধুইলাম অনেক কষ্টে। এরপর নাস্তার টেবিলে গিয়ে দেখি খোসা ছাড়া অন্নেকগুলো কলা সাথে কিছু পাউরুটি। টেবিলে বসে কলা আর পাউরুটি মুখে তুলে খাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে না। তাই একজন ভলেন্টিয়ার কে ডেকে এনে বললাম, কলা আর পাউরুটি আমার মুখে তুলে দিতে। উনি আমাকে নিজ হাতে এক এক করে সবকয়টি পাউরুটি আর কলা আমার মুখে তুলে দিলেন। আমি কষ্ট করে খেয়ে ফেললাম। এইবার প্রস্তুতি ফাইনাল রাউন্ডের জন্যে।

দেখতে দেখতে ফাইনাল রাউন্ডও চলে এসেছে। আজ ‘সেরা আইলসা প্রতিযোগিতা’র ফাইনাল রাউন্ড। আমরা প্রতিযোগী প্রায় পাঁচশ জন। সেখান থেকে নির্ধারণ করা হবে সেরা তিনজন কে। আমাদের সব প্রতিযোগীকে বিশাল একটি মাঠে নিয়ে আসা হলো। যিনি রেফারির দায়িত্বে আছেন তিনি হ্যান্ড মাইকে আমাদের উদ্দেশ্য বলতেছেন,

– প্রিয়া প্রতিযোগী বৃন্ধ, আমাদের বিজয়ী হিসেবে একজন প্রয়োজন। কিন্তু ফাইনালে পাঁচশ জন প্রতিযোগী লড়বে, ব্যাপারটা আমাদের আশাতীত। এতো প্রতিযোগী থেকে একজন বেছে নেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভবনা। তাই বাধ্য হয়ে আমরা একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। সেটা হলো মাঠের শেষ প্রান্ত থেকে দৌড়ে এসে যে প্রথম চল্লিশজন আগে আমাদের স্ট্যাজের সামনে রাখা চ্যাম্পিয়ন ট্রফি বরাবার পৌঁছাবে সেই হবে আমাদের চ্যাম্পিয়ন। আমরা জানি এটা একটি আইলসা প্রতিযোগিতা হলেও এখানের সবাই প্রকৃত আইলসা না। তাই আমরা আইলসা প্রতিযোগীতা বাদ দিয়ে দৌড় প্রতিযোগীতার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এতে চ্যাম্পিয়ন পেতে আমাদের পথ সহজ হবে।

এছাড়া আমরা আর কোনো বিকল্প উপায় খোঁজে পাচ্ছিনা। সো, একটু পরেই তোমাদের দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু হবে। তোমরা এখনি মাঠের শেষ প্রান্তে চলে যাও। এবং শারীরিক ও মানুষিক ভাবে প্রস্তুতি নিয়ে নাও ততোক্ষণে ম্যাচ রেফারির কথাশুনে অনেক কষ্টে মাঠের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়ালাম। আমি এতোটাই অলস যে এই সামান্য জায়গায় হেঁটে আসতেই হাপিয়ে উঠলাম। এখন এখানে বসে আমার পাক্কা দুই ঘন্টা বিশ্রাম করতে হবে। নাহলে শরীরে এনার্জি পাবোনা। বিশ্রামের জন্যে বসে বসে মাঠের এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত দিকে নজর দিলাম। এতোদূর সবার আগে দৌড়ে যাওয়া সম্ভব না। এই প্রতিযোগীতা বয়কট করতে হবে। নাম দিলো আইলসা প্রতিযোগিতা, অথচ এখানে অলসদের দিয়ে রীতিমতো দৌড় প্রতিযোগিতা করা হচ্ছে। অলসরা দৌড়ে যদি চ্যাম্পিয়নই হয় তাহলে সে আর অলস রইলো কই? এদেশটা রসাতলে গেলো। সব ক্ষেত্রেই দুর্নীতি।

এবার ফাইনাল রাউন্ডের জন্যে আমাদের সবাইকে দাঁড় করিয়ে বাঁশিতে ফু দিয়ে ফাইনাল রাউন্ডের ঘোষণা দেওয়া হলো। বাঁশির আওয়াজ পেয়েই সবাই এলোপাথাড়ি দৌড় শুরু করে দিলো। আমি প্রচন্ড ভীরের মধ্যে আটকা পড়ে আছি। আমার ডান পাশের দু একজনকে দেখলাম মানুষের পায়ের নিচে পড়ে মারা গেছে। এটা দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। কেউ কাওকে সামনে যেতে দিচ্ছেনা। হৈচৈ কান্ড। আমিও দু চারজনের ধাক্কা খেতে মাটিতে পড়ে গেলাম। যে কেউ যেকোনো মুহূর্তেই পা দিয়ে আমাকে পিষে মেরে ফেলতে পারে। আমার উচিত প্রতিযোগিতা রেখে জান নিয়ে পালানো। কিন্তু আলসেমির জন্যে পারছিনা। এখানেই বসে বসে ভাবছি এখন যদি কেউ আমাকে এখান থেকে কোলে করে নিয়ে যেতো। তাহলে আমি বেঁচে যেতাম। আমার জন্যে ব্যাপারটা কতোই না ভালো হতো।

ইতিমধ্যে সবাই দৌড়ে ওপাড়ে চলে গেছে। হয়তো প্রথম চল্লিশজনকে বিজয়ী ঘোষনা করে ফেলেছে। আমি মানুষের ধাক্কায় মাটিতে পড়ে যাওয়ার পর দুচারজন আমার সাথে হোচট খেয়ে আমার উপরই পড়ে যায়। দু একজন পা দিয়ে লাথি মেরে আমায় সরিয়ে সামনের দিকে চলে যায়। যার জন্যে এই মুহূর্তে আমায় আমার অবস্থা শোচনীয়। এখনি আমার ডাক্তার দেখানো উচিত। হাসপাতালে না গেলে উপায় নাই। একমাত্র অলসতার জন্যে যেতে পারছিনা। আসেপাশে খেয়াল করে দেখলাম কেউ আছে কিনা। থাকলে বলতাম আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে। না একমাত্র আমিই বসে আছি। অবশ্য ছয় সাতটা লাশ পড়ে আছে। হঠাৎ লক্ষ্য করে দেখলাম আমার সামনের একজন লম্বা হয়ে শুয়ে থাকা একজিন উঠে বসলো। আমি উনাকে ডাক দিয়ে বললাম, ‘ভাই মানুষের ধাক্কায় তো আপনার অবস্থা শেষ। এখনও ডাক্তারের কাছে যান না কেনো?’ উনি আমাকে বললেন, ‘আমাকে বলছেন ডাক্তারের কাছে যাইতে কিন্তু আপনি যাচ্ছেন না কেনো?’

– আমি খুব ক্লান্ত ভাই তাই যেতে পারছিনা। হাঁটা তো অনেক পরিশ্রমের কাজ। তাই এভাবেই বসে আছি। অলসতার জন্যে যাওয়া সম্ভবনা। বলছিলাম কি, আপনি যদি ডাক্তারের কাছে যান তাহলে আমাকে কোলে করে আপনার সাথে নিয়ে যাবেন প্লিজ! আর না হলে এখানেই পড়ে মরে থাকা ছাড়া আর কোনো গতি নাই!

– আরে ধুর ভাই কি যে কন! অলসতার জন্যে আমার নিজেরই ডাক্তারের কাছে যাইতে ইচ্ছে করছে না আর আপনি কন কিনা আপনাকে কোলে করে নিয়ে যাইতে? হাস্যকর! যাইহোক মরলে এখানেই মরবো। তাও এখান থেকে উঠা আমার পক্ষে সম্ভব না।

এভাবেই আমাদের কথাবার্তা আপন গতিতেই চলছিলো। ওদিকে বিজয়ীরা হয়তো আনন্দ মিছিল করছে। আর এদিকে আমরা ধুকে ধুকে মৃত্যুর দিকে আগাচ্ছি। শরীরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছিনা। শরীর ক্রমশই অবস হয়ে আসছে। সময়ের সাথে চোখের দৃষ্টিও ক্রমশ ঝাপসা হচ্ছে। এবার চোখের দৃষ্টি পুরোটাই ঝাপসা হয়ে গেলো। কিজানি হয়তো মারা গেছি আমি জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে আবিষ্কার করলাম হাসপাতালে। পাশের বেডে সে লোকটা। আমরা দুজনই মোটামুটি সুস্থ হয়ে গেছি। তাই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের ডিসচার্জ করে দেয়। হাসপাতাল থেকে বের হয়েই দেখি হাজার হাজার মানুষের করতালিতে চারপাশ মুখরিত। উৎসব উৎসব আমেজ। আমাদের গলায় ফুলের মালা দিয়ে বরণ করার জন্যে অনেক লোকজন এসেছে। আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। এরমধ্যে একজন লোক এসে আমার হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে বললো, ‘কংগ্রেটস, আপনারাই প্রকৃত চ্যাম্পিয়ন! আগামীকাল সকাল দশটায় আপনারা দুজন অডিটোরিয়ায়ে চলে আসবেন। আপনাদের পুরস্কৃত করা হবে।’

ঘটনার আগামাথা কিছুই বুঝলামনা। পরে উনাকে জিজ্ঞেস করলাম কিসের চ্যাম্প? আর কিসের পুরষ্কার? তখন উনি বললেন, ‘আসলে সেদিন সত্যিকারের সেরা অলস আপনারা দুজনই নির্বাচিত হয়েছেন। বাকিরা লোভে পড়ে অলস সেজেছিলো। আর এইজন্যে উনাদের মিথ্যা দৌড় প্রতিযোগীতার কথা বলা হয়েছে। তারা যদি প্রকৃত আইলসাই হতো তাহলে তারা অন্তত আইলসেমির জন্যে এভাবে দৌড়াতো না। একমাত্র আপনি আর আপনার পাশের লোকটাই ছিলো সত্যিকারে আইলসা, কারণ আপনার মৃত্যু সঙ্কটেও অলসতার জন্যে মাঠ ত্যাগ করেন নি। আপনারাই চ্যাম্পিয়ন ট্রফির পাওয়ার মতো যোগ্য লোক।

উনার কথা শুনে খুশিতে আত্মহারা আমরা দুজন। একজন আইলসা হিসেবে গর্বে আমাদের দুজনের বুকটা ভরে গেলো। পরদিন অডিটোরিয়ামে আমাদের পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। স্থানীয় একজন এমপি সাহেব আমাদের দুজনের হাতে চ্যাম্পিয়ন ট্রফি তুলে দিয়ে বললেন, ‘গুড জব বয়েজ। তোমরাই এই প্রতিযোগিতার চ্যাম্পিয়ন। তোমারাই আমাদের গর্ব। কি ইট আপ।’তারপর পুরষ্কার বিতরণ করা শেষ হলে, কুচকাওয়াজ এর মধ্যদিয়ে পুরষ্কার বিতরনী অনুষ্ঠান সমাপ্ত ঘোষণা করা হলো।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত