বৃক্ষ সমাচার

বৃক্ষ সমাচার

রুগ্ন দেহের এক যুবক ফুটপাতের ভিড় থেকে একটু দূরে রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে সস্তা সিগারেট টানছে। হঠাৎ করেই মটকা টাইপ এক আন্টি পেছন থেকে ওকে ধাক্কা দিয়ে বিরক্ত কণ্ঠে বলল,”এই ছেলে, ওদিকে যা..!” আন্টির চোখেমুখে রাজ্যের তাচ্ছিল্য। ওর ধাক্কা খেয়ে যুবকের মেজাজ গেল খিচড়ে। সে লাল চোখে জানতে চাইল,”সমস্যা কি? what the fuck are you going to do there?” খাঁটি ব্রিটিশীয় একসেন্টে যুবকের গালি খেয়ে আন্টি গোলগাল মুখ চেপ্টা হয়ে গেল।

নিজেকে সামলে নিয়ে খুব হিম্মত দেখিয়ে বললেন,”রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছ কেন? দেখছ না একজন মহিলা আছে পেছনে!” যুবক তাকে আগে দেখে নাই। মহিলা মাত্র এসেছে। একা আসে নাই। সঙ্গে করে পিংক কালারের একখানা গাড়িও নিয়ে এসেছে। গাড়িওয়ালা নারী এবং কুত্তাওয়ালা যুবতীদের প্রতি যুবকের একটা চাপা ক্ষোভ আছে। সুতরাং সে ক্ষুব্ধ কণ্ঠেই বলল,”একটা ছেলে এখানে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে, টের পান নাই? চোখ দুইটা কি বাসায় রেখে আসছেন?”

যুবকের রাগারাগি এবং আন্টির চেচামেচিতে অল্পক্ষণেই ভিড় জমে গেল। ভিড়ের মানুষ আন্ধা হয়। ভেতরের ঘটনা তলিয়ে দেখে না। হুদাই আওয়াজ করে। আওয়াজগুলি সব গাড়িওয়ালী আন্টির পক্ষে চলে গেল। প্রথম উনি একজন নারী। তার উপরে গাড়ি। তার উপরে যুবকের আঙুলের ফাকে রাখা জ্বলন্ত সিগারেট এবং বুকের উপর থেকে দুইটা বোতাম খোলে রাখা শার্ট। ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ একজন বলল,”ছেলে তুমি ভুল করেছ। ক্ষমা চাও।” আরেকজন দুই দাগ বাড়িয়ে বলে,”শুধু ক্ষমা চাইলে হবে না। দুই গালে দুইটা থাবড়া লাগাও ঠিক হয়ে যাবে!”

ওপাশ থেকে আরও কয়েকজন হু হা বলে সম্মতি দিল। ওদের থেকে একটু দূরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছিলাম। ভেবে দেখলাম, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে যুবকের সিগারেট টানাকেই সবচাইতে বড় অপরাধ বলে গণ্য করা হচ্ছে। এইটা সিগারেট খাওয়ার জায়গা না। যত্রতত্র সিগারেট টেনে পরিবেশ দূষণ করছে। দূষণের কথাটা কানে যেতেই চোখেমুখে আমার একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল। সিগারেট অবশ্যই দূষণীয়। তারচেয়েও দূষণীয় গাড়ি সমূহের কালো ধোঁয়া। তাছাড়া, রাস্তায় পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট টেনে যুবক যেমন অপরাধ করেছে, আন্টিও অপরাধ করেছেন রাস্তার পাশে এত্তবড় একটা গাড়ি পার্ক করে। এইটা গাড়ি পার্কের জায়গা না। আমার দৃষ্টিতে দুজনেই অপরাধী। ছেলেটা ছোট অপরাধী।  আন্টিটা বড় অপরাধী।

শাস্তি যদি পেতে হয় দুজনেরই পাওয়া উচিত। কিন্তু শান্তি দিবে কে? নকশা হবে কেমন? এলাকায় এক ভাই আছে, বৃক্ষছক নামে একটা গাছের পেইজ চালায়। অনলাইনে অর্ডার নিয়ে ঢাকা শহরের প্রতিটা অলিতে-গলিতে বিভিন্ন সব ফুল ফল ঔষুধি গাছ পৌঁছে দেয়। ওর স্বপ্ন হচ্ছে সবুজের অভিযান। পাথুরে এক নগরীকে সবুজের সমারোহে ভরে দিবে। ব্যাবীলনের শূন্য উদ্যানের মতো প্রতিটা বাসা-বাড়ির ছাদে, বারান্দায়, সান-শেড থেকে শুরু করে জানালার শার্সিতে সবুজের আস্ফালন দেখতে চায় সে। ভয়ের কথা হচ্ছে, মানুষ বিড়ি চায় বেশি বেশি বৃক্ষ চায় কম। পকেটে দুইটা পয়সা আসলে প্রথমেই একটা গাড়ি কেনার স্বপ্ন দেখে। বাগান করার বিলাসিতা ওর মাথায় আসে না।

অনেকটা দুষ্টামি করেই ভাবছিলাম, এই গাড়িওয়ালা আন্টি এবং বিড়িখোর যুবকের শান্তি হওয়া উচিত একটু অন্য রকম। এরা দুজনেই পরিবেশের ক্ষতি করছে। এর ক্ষতিপূরণ হিসেবে বেশি বেশি গাছ লাগাতে হবে। যুবকের শাস্তি হল, একশটা কদম গাছ… আন্টির শাস্তি এক হাজার এইটুকু ভাবার সঙ্গে সঙ্গেই মাথায় আমার অটো-সাজেশন চলে আসল। এই শহরে গাড়ি কেনার শর্ত কি? কেন দিচ্ছে এত এত লাইসেন্স? অনেক অনেক টেকা-পয়াসা? মিল ইন্ডাস্ট্রি? মোটা বেতনের চাকুরী? আমি ঠিক জানি না কিন্তু এমন যদি হত, তবে কেমন হত?

চাইলেই যে কেউ সিগারেট টেনে পরিবেশ দূষিত করতে পারবে না। তারজন্যে লাইসেন্স নিতে হবে। কড়াগন্ডায় হিসেব করে লাইসেন্স দেওয়া হবে একজন মানুষ বছরে কী পরিমাণ সিগারেট খায়, তার থেকে কতটা দূষণ ছড়ায়, সেই দূষণ থেকে মুক্তির জন্য সমপরিমাণ গাছ ওকে রোপণ করতে হবে গাড়ি কিংবা ইটের ভাঁটার মালিকদের জন্যেও একই বিধান ভেবে ভেবে নিজের ভেতর ডুবে গিয়েছিলাম। হঠাৎ করেই ঘোর কাটে। তাকিয়ে দেখিয়ে এদিকের ঝামেলা মিটে গেছে কিন্তু ওদিকে নতুন একটা জটলা লেগেছে।  ভিড়ের সুযোগে এক ছেলে কোন একটা মেয়ের গায়ে হাত দিয়ে ধরা খেয়েছে। ছেলেটাকে ইচ্ছে মত থাবড়ানো হচ্ছে। এই দৃশ্যটা দেখে আরাম হল, কষ্টও লাগলো। জননী জন্মভূমি বাংলা আমার এমনই এক অবলা রমণী। আঠারো কোটি মানুষের ভিড়ের সুযোগ কাজে লাগিয়ে কিছু মানুষ তাকে নিরন্তর ধর্ষণ করছে। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে আঁচড়ে কামড়ে চিড়েচ্যাপটা করে দিচ্ছে। আমরা শালা আন্ধা বলেই দেখতে পাই না!

সেদিন এক ভাই বলছিল,”আপনার মধ্যে একটুকুও দেশ প্রেম নাই। দেশ নিয়ে কখনো কিছু লিখতে দেখি নাই!” আমি বললাম,”আম্মাকে কিংবা আব্বাকে নিয়েও আমি কখনো কিছু লিখি নাই। ভালো যাদের খুব বেশি বাসি তাদের নিয়ে লিখতে পারি না। এর গাঢ় সেই অনুভূতি, লেখা যায় না!” পাঠক আমার কথা শুনে তুষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু হল সর্বনাশ। আব্বা আম্মার কষ্ট হলে, আলহামদুলিল্লাহ- আমি আছি- আমার দুইটা ভাই আছে- তিনটা বোন আছে- বুক পেতে আগলে রাখবে- কিন্তু জননী জন্মভূমির বাংলার কষ্ট সারাবে কে? কোথাও কেউ আছে? নাকি নাই?  পকেটে যখন দুইটা পয়সা হবে, কি করবে প্রথমে? মটকা টাইপ আন্টি কিংবা বেয়াদব যুবকের মতো প্রথমেই তোর বুকের ভেতর কালো ধোঁয়ার ফ্যাক্টরি বসাবে? নাকি দুইটা বৃক্ষ রোপণেও চেষ্টা থাকবে?

কিছু কষ্ট একেবারেই নিরাময়ের অযোগ্য। এইসব জটিলতর বিষয় নিয়ে তাই লিখতে ইচ্ছে করে না। কালো ধোঁয়ার বহনে ওজন স্তর ফেটে যাচ্ছে। বাড়ছে উষ্ণতা। বাড়ছে রোগবালাই। গলছে বরফ। এইটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, বরফগলা জলের ধারায় যদি সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে যায়, সবার আগে ডুবে যাবে আধ-খানা বাংলাদেশ বাকি আধখানায় আঠারো কোটি মানুষের গা ঘেষাঘেষির কথা ভাবতে গেলেই আমার কান্না আসে… ঘেন্নাও আসে এইসব কান্না থেকে উত্তরণের রাস্তা খুব সম্ভবত একটাই। নিজের কথা নয়। এই পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠতম দার্শনিকের একটা উদ্ধৃতি দিয়ে আজকের লেখাটা শেষ করতে চাই।

শ্রেষ্ঠতম সেই মানবের নাম মুহাম্মদ। হযরত মুহাম্মদ (সঃ)৷ আজ থেকে পনের শত বছর আগে আরবের মরু তল্লাটে জন্ম হয়েছিল তাঁর। সেই সময় এত এত কল-কারখানা ছিল না। মিল-ফ্যাক্টরি ছিল না। ভুসভুসিয়ে ধোঁয়া ছড়ানো ইটের ভাঁটা কিংবা ইঞ্জিনের গাড়ি ছিল না সেই পনের শত বছর আগেই তিনি বলতেন,  তিনি বলেছিলেন, যদি তুমি খবর পাও, আগামীকাল কেয়ামত, আর তোমার কাছে একটা বীজ থাকে কিংবা একটা কাছে চারা থাকে, তবে তুমি সেই চারাটাকে মাটিতে রোপণ করে দিবে এমন কি আগামীকাল কেয়ামত এসে সব ধ্বংস করে দিবে জানার পরেও তিনি এই কথা কেন বলেছেন? কখনো কি ভেবে দেখেছি?

বাঁচার রাস্তা যুগে যুগে মহামানবেরা দেখিয়ে গিয়েছেন। বাঁচতে হলে ভাবতে হবে। এইগুলা জানতে হবে। নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হবে। এই দেশ, এই পৃথিবীকে আমাদের সন্তানদের জন্য বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে অযোগ্যরা ভুলে যাবে, বিনিময়ে মারা খাবে- এই হল এদের নিয়তি…

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত