“তুই এত লাস্যময়ী হয়ে যাচ্ছিস কেন বীথি? তোকে দেখলেই এখন আমার হাত নিশপিশ করে। হাত বাড়িয়ে ছুঁইয়ে দিতে ইচ্ছে করে তোকে।””ফ্লাটারিং করছ?” “হুম।” “কেন করছ? এই জিনিস তো তোমার মধ্যে কখনো ছিল না।”
কথাটা মিথ্যে নয়। লবডঙ্কা চেহারা আর আর্থিক অনিশ্চয়তা আমাকে সারাটা জীবন কষ্ট দিয়েছে। জীবনের আধখানা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে অঙ্গার করে দিয়েছে।এইতো মাত্র বছরখানেক আগে একটা জব হল। ডিকপ-কেন্দ্রের আইটি উপদেষ্টা। ভালো চাকুরী। মাইনেটাও ভালো। জীবনে গ্লানিময় অধ্যায়গুলির কথা ভুলে গিয়ে নিজের মতো করে চারপাশটা সাজিয়ে নিতে চাইছি এখন। সবার আগে দরকার মনের মতো একটা মেয়ে। বীথির মতো নাদুসনুদুস একটা প্রেমিকা। তাইজন্যই ওকে ডেকে এনে খানিকটা ফ্লাটারিং করছি। গোপন সূত্রে খবর পেয়েছি, লাস্ট যে ছেলেটার সাথে বীথির এফেয়ার ছিল, কিছু একটা কারণে ব্রেক-আপ হয়ে গেছে। এইটা হল আমার জন্যে শ্রেষ্ঠতম সুযোগ। শুনেছি, মেয়েরা প্রেম করে মজা পায় বাকের ভাই টাইপ ছেলেদের সঙ্গে। কিন্তু যখন বিয়ের কথা ভাবে, এটিএন বাংলার মাহফুজুর রহমান টাইপ পুরুষের কথাই সবার আগে ভাবে। নিঃসন্দেহে আমি এই দ্বিতীয় শ্রেণির লোক।
“বীথি?” “হু।” “চুপ মেরে আছিস কেন? মন খারাপ জানি, তাই বলে সেইটা অষ্টপ্রহর ধরে রাখতে হবে? রিলেশন করলে ব্রেক-আপ হতেই পারে। এত আপসেট হওয়ার তো কিছু নাই, তাই না?” “হু।” “তুই বরং মাহফুজুর রহমান স্যারের মতো একটু বয়স্ক দেখে, পয়সাওয়াল কোন ছেলের সাথে প্রেম কর। তখন আর ব্রেক-আপ টেকাপ হবে না। যখন ইচ্ছে বিয়ে করে ফেলতে পারবি। কেন পারবি জানিস?” “উহু।” আমি সরু চোখে মেয়েটার দিকে তাকালাম আরেকবার। নিজেকে খুব হ্যাংলা মনে হল। অল্প বয়সী চণ্ডালের মত আমি একাই বকবক করছি। বেহুদা উমেদারি করছি। অথচ বীথি আমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না।
এইসব ছিবলেমির কোন মানে হয় না। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, যাকে বিয়ে করব, বিয়ের আগে তার সাথে কিছুকাল প্রেম করব। কিন্তু আমার মত ঘাটের মারার সঙ্গে প্রেম করবে কে? শুধু পয়সা হলেই জগতের সব আশা পূরণ হয় না। হাল ছেড়ে দিলাম। টেবিলের ওপার থেকে খামাখাই একটা কমেন্টারি ফাইল টেনে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ার ভান করলাম। ইচ্ছে ছিল মেয়েটাকে নিয়ে ভালো কোন রেস্তেরায় খেতে যাব। ইচ্ছেগুলি নির্বাসনে চলে যাক। ব্যস্ততার ভান করতে করতে যখন প্রায় বিরক্ত হয়ে উঠছি তখনই আমি একটা অস্ফুট কান্নার আওয়াজ পেলাম এবং বীথির দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে গেলাম। বীথি কাঁদছে!আঁৎকে উঠে জানতে চাইলাম,”এই মেয়ে, তুই কাঁদছিস কেন? এই বীথি, এই-।”
বীথি কাতর গলায় বলে,”আমাকে কিছু টাকা দেবেন? আমার খুব টাকার দরকার..” “টাকা দিয়ে কি করবি?” “এবরশন করাব। আমার পেটে একটা বাচ্চা এসে গেছে। বাচ্চাটা সরাতে হবে।”হা হয়ে তাকিয়ে রইলাম। স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। কী বলব ভেবে পাচ্ছি না। “ছেলেরা এত খারাপ হয় কেন, স্যার? একসাথে থেকেছি, খেয়েছি, শুয়েছি- সেই কথা ভেবে অনুশোচনা করছি না। ভয়ও পাচ্ছি না। ভয় হচ্ছে ভিডিও ক্লিপসগুলার কথা ভেবে। এইগুলা যদি নেটে ছেড়ে দেয়, আত্মহনন ছাড়া আমার মুক্তি নেই!” বীথি ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ওর দুই চোখ থেকেই গলগলিয়ে জলধারা নামছে। সে কথা বলছে খুব ম্লান গলায়। খুব উদাস দেখাচ্ছে ওকে। যেন একটা নির্বাক বৃক্ষের সামনে বসে আছে সে, এমনই অবলীলায় ভয়াবহ সব কথা বলে যাচ্ছে মেয়েটা।
আমি দিশেহারা বোধ করছি। বিত্তবান ঘরের কিছু কিছু মেয়ে ইদানীং রাত করে বাড়ি ফেরা, বন্ধুদের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরতে যাওয়াকে খুব স্বাভাবিক অধিকার বলেই মনে করে। এই অধিকার বলেই সে প্রায়শ রাত করে বাড়ি ফেরে, ইতিউতি ঘুরতে যায়- এইসব কথা আমি জানতাম। সহজভাবেই মেনেও নিতাম। জুভান নামের একটা ছেলে ওর বেস্ট ফ্রেন্ড। জুভানের সঙ্গে কিছু অন্তরঙ্গ ছবি ফেসবুকে দেখেছি। মনে মনে ভেবেছি, ওটা শুধুই বন্ধুত্ব। ওর মধ্যে কোন ক্লেদ নেই। সম্পর্কটা নির্মল বলেই এইসব ছবি পাব্লিক করে পোস্ট করে ওরা। ভেতরে গলদ কিছু থাকলে, রাখডাকের একটা ব্যাপার চলে আসত। বীথি আমার দিকে তাকিয়ে ম্লান গলায় বলল,”সবচে কষ্টের কথা কি জানেন, আমি ধর্ষিত হয়েছি আমার সবচাইতে ভালো মনের দুইটা বন্ধুর দ্বারা। সবচাইতে বিশ্বস্ত দুইটা ছেলে..”
“ধর্ষিত হয়েছিস?”
“হ্যা।”
“দুইজন মিলে?”
“হ্যা, না, মানে, ওরা ছিল তিনজন।”
“কখন? কোথায়? কীভাবে?”
“জলির বাসায়। জলিকে চেনেন না? ঐযে কালো করে লম্বাচওড়া মেয়েটা। সে অনেক আগেই নষ্ট হয়ে গেছে। জুভান, ইমন আর জলির মধ্যে আগে থেকেই এইগুলা চলে। আমি জানতাম না। সেদিন জলির বাসা খালি ছিল। নিজ হাতে নুডলসের তেহারি রান্না করে খাওয়াবে বলে আমাদের দাওয়াত করল। আমি সরল মনে ওর বাসায় গিয়ে ফেঁসে গেছি।” “তুই প্রতিবাদ করিস নাই?”
“আমি আসলেই দিশেহারা হয়ে গিয়ে পড়েছিলাম। ওরা একটা ফাঁদ পেতে রেখেছিল। জলির রান্না খুব ভালো হয়েছে, এই বলে জলিকে হাগ দিতে গিয়ে ইমন ওকে বুকে চেপে ধরে প্রপোজ করে বসে। ছোট্ট করে একটা চুমো খায়। দৃশ্যটা এত সুন্দর ছিল, আমি অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল, কেউ যদি আমাকে এইভাবে প্রপোজ করত!”
“ঠিক তখনই জুভান তোকে প্রপোজ করে?”
“হু।”
“তারপর?”
“তারপর জলি আর ইমন অন্যরুমে চলে যায়, আমরা এইদিকে-।”
“তাহলে তো সবকিছু আপোষেই হয়েছে। জোরাজুরির কিছু দেখছি না।”
“নাহ, শরীরী জোরাজুরির কিছু ছিল না। পুরোটাই ছিল ওদের বুদ্ধির ফাঁদ আর আমার বোকামির ফসল। আমি শেষ-।” “জুভান ছেলেটা এখন কি বলে, রিলেশন রাখবে না তোর সাথে? বিয়ে করবে না তোকে?” “উহু। সে বলে আমি নাকি নষ্ট টাইপের মেয়ে। যে মেয়ে বিয়ের আগেই অন্য ছেলের সাথে-।”
বীথি ওর কথা শেষ করতে পারে না। হ্যাচকি দিয়ে কেঁদে উঠে। আমি বিরস গলায় জানতে চাইলাম,”তারমানে বিয়ে সে করবে না তোকে?” বীথি দিশেহারা কণ্ঠে বলে,”নাহ। তাছাড়া, জোরাজুরি করে বিয়ে করে লাভ কি? প্রেম করে বিয়ে করেই টেকানো যায় না, সেখানে খামাখা একটা বিয়ের নাটকে অভিনয় করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আমি বরং এমরশন করাব-” আমি ছোট্ট করে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করলাম। সেই পুরনো কথা, পুরনো ছাড়াছাড়ি। কিন্তু মেয়েটা শুধু নতুন। ওর যন্ত্রণাগুলি শুধু ওর কাছে নতুন। “চল আমার সাথে।” “কোথায়?” আমি ক্লান্ত গলায় বললাম,”নাহ, কোন ক্লিনিকে নয়। কাজী অফিসে। তোকে বিয়ে করতে চাই আমি। তোর অনাগত সন্তানের পিতা-।” আমার কথা শেষ হবার আগেই বীথি বিক্ষুব্ধ গলায় জানতে চাইল,”দয়া দেখাচ্ছেন আমাকে? অবলা মেয়েমানুষ ভেবে করুণা করছেন? আমি কিন্তু এতটা অবলা নই। পেটে বাচ্চা এসে গেছে বলে খুব ঠেকে গেছি ভাববেন না। আমিও একবাপের বেটি, ঐ শুয়ারের বাচ্চাদের আমি দেখে নেব!”
মেয়েটার কথা শুনে হাসব নাকি কাঁদব ভেবে পাচ্ছি না। নরম গলায় বললাম,”ঠেকে যাসনি জানি, কিন্তু ঠকে তো ঠিকই গেছিস। পাপ যদি কিছু করে থাকিস দুজনে সমান করেছিস। মজা যদি লুটে থাকিস, সমান তালে লুটেছিস। অথচ তোর জুভান গায়ে হাওয়া দিয়ে বেড়াচ্ছে, আর তুই? তুই এখন খুনিদের খাতায় নাম লেখাবার পায়তারা করছিস। যে শিশুটি অনেক আশা নিয়ে আরশ মহল থেকে তোর গর্ভের বৃন্তে এসে বাসা বেঁধেছে তার সমস্ত ভার কিন্তু প্রকৃতি তোর উপরেই ছেড়ে দিয়েছে। এইজন্যেই তুই ঠেকে গেছিস। এইভাবেই প্রতিটা মেয়ে ঠেকে যায়, ঠেকে যেতে হয়!” বীথি অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। তারপর সেই একই রকম উদ্ধত কণ্ঠে জানতে চাইল,”আমি ঠেকে গেছি?” “হ্যা।” “আপনি একটা মহামুর্খ!” “হয়ত।” “করব না বিয়ে আমি আপনাকে। আপনিও তো সেই জুভান শুয়ারটার মতোই একটা পুরুষ। পুরুষ মানুষের উপর থেকে আস্থা উঠে গেছে আমার!”
বীথি আমাকে একটাও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ঘটঘটিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। খুব জোর চেষ্টা করলে ওকে ফেরাতে পারতাম। কিন্তু লাভ কি? একজন মহামুর্খর মতো চুপচাপ বসে রইলাম আমি এবং মধ্য রাত অবধি জেগে রইলাম ছোট্ট একটা খবর শুনবার প্রতীক্ষায়। প্রতিক্ষা বিফলে যায় নি। রাত দুইটার দিকে বীথির বাবার নাম্বার থেকে একটা ফোন কল আসল। আমাকে জানানো হল, বীথি আত্মহত্যা করেছে। ওর লাশ এখনও সিলিং ফ্যানের সঙ্গের দড়িতে ঝুলছে। লোকজন বলছে, পুলিশ আসার আগে লাশ নামানো উচিত হবে না। উল্টাপাল্টা মামলা বসিয়ে দিতে পারে। সমূহ বিপদ।
বীথিদের নতুন বাসা আমি চিনি না। চিনলেও যাব না। আজ সারারাত আমি রাস্তায় রাস্তায় হাঁটব আর আঁধিয়ার শ্বাপদের মতো বিষাদমাখা কণ্ঠে তোমাদের পাথুরে সভ্যতায়- হৃদয়ে- দরজায়- কড়া নেড়ে জানতে চাইব, “বীথিকে চেনেন? ঐ যে, খুব হাসিখুশি, সুন্দরমতো মেয়েটা! জগতের প্রতিটা মানুষকে একদা সে মাদার তেরেসার মতো ভালোবাসত। তারপর আচমকাই ঠকে গিয়ে, ঠেকে গিয়ে… মানুষের প্রেম আর শুভবোধের উপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলল! আহা, বড় ভালো মেয়ে ছিল, আজ রাতে ওর মৃত্যু হয়েছে নিথর দেহ, এই শহরেই কোন এক বিপন্ন পিতার চোখের সামনে, হয়ত এখনও ঝুলছে… এখনও আদরের বীথি, প্রিয়তম বীথি সোনা রে…”