– গীটার বাজাতে পারেন ?
আচমকা কথাটি শুনে পিছনে তাকালাম।তাকিয়ে দেখি নীল ড্রেসে একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে । আমি আবারো সামনে তাকালাম ।প্রকৃতির ভেলা ভাসানো অপার দৃশ্য মনমুগ্ধকর।আর সেটা দেখার জন্য নির্জন কোনো ওপর ব্রীজ অথবা কোনো ছায়াওয়ালা বড় গাছ ই যথেষ্ট ।
– বোবা নাকিই কথা বলেন না কেন ?
আমি আবারো পিছনে ফিরে মুচকি হেসে চলে আসলাম। মেয়েটা ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকালো ।চোখে মুখে রাগের স্পষ্ট ছাপ অনুমান করা যায়। প্রায় ই আসি এই যায়গাটায় আর বড় গাছটার নীচে বসে প্রকৃতির সাথে কথা বলি । মেয়েটা রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেলো। পরদিন আবারো মেয়েটা তার বেলকনি থেকে তাকিয়ে দেখলো আজ ও ছেলেটা গীটার নিয়ে বসে আছে । গুটি গুটি পায়ে ছেলেটার পিছনে দাড়ালো ।
– এই যে হ্যালো অপনার নাম টা কি বলেন তো । আচমকা এরকম প্রশ্ন শুনে পিছনে তাকিয়ে দেখি সেদিনের মেয়েটা । মুখে সামান্য হাসির রেখা টেনে বললাম
– কেন বলুন তো ?
– শুনতে চাইলাম তাই ?
– নীল ।
– তা কি গীটার বাজাতে পারেন নাকি এমনি সাথে নিয়ে ঘুরেন মেয়ে পটানোর জন্য হুম ।
মেয়েটার কথায় কোনো উত্তর না দিয়ে মুচকি হেসে চলে আসলাম। মেয়েটা অবাক হলো সাথে কিছু রাগ । কথাটি জিঙ্গেস করলে আসলে হয় টা কি ওনার যে সাথে সাথেই চলে যান। ছেলেটার প্রতি আগ্রহ টা যেন আরও দ্বিগুন বেড়ে গেলো । অদ্ভুত ছেলে প্রতিদিন দেখি গীটার হাতে এই জায়গায় বসে থাকে । নাহ কাল জানতেই হবে আসলে কে এই ছেলে আর কেনই বা এখানে এসে বসে থাকে প্রতিদিন। পরদিন নীল ও যায়গায় আসার আগেই মেয়েটা গিয়ে বসলোওর যায়গায়। নীল এসে দেখলো যে ওর যায়খায় কোনো এক মেয়ে বসে আছে । তাই পিছন ফিরে চলে যেতে লাগলো। শুকনো পাতার ওপর পা ফেলানোর মড়মড় শব্দে মেয়েটি আড় চোখে পিছনে তাকিয়ে দেখে নীল চলে যাচ্ছে । মেয়েটি দৌড়ে নীলের সামনে গিয়ে দাড়ালো ।
– কি ব্যাপার চলে যাচ্ছেন যে । বসবেন না ওখানে ? আমি ভ্রু কুচকে তাকালাম মেয়েটার দিকে । মেয়েটাও একই দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে উত্তরের অপেক্ষায়।
– কি হলো কথা বলছেন না যে ।আচ্ছা আপনি এরকম গোমরামুখো কেনো বলুন তো। কথা বলতে চান না নাকি ভদ্র হওয়ার চেষ্টা করেন।
– আসলে আজ তো আপনি ওখানে বসছিলেন তাই চলে যাচ্ছি আর কি ।
– কেনো আমার সাথে বসতে আপনার প্রবলেম আছে ?
– নাহ ঠিক তা না ।
– তাহলে চলুন বসে গল্প করা যাক।
মেয়েটা আমার হাত ধরতেই পুরো শরীর শিউরে উঠলো। আমি থমকে দাড়ালাম। আমি থমকে দাড়াতেই মেয়েটার হাতে টান পড়ে গেল । সে পিছনে দেখলো আমি তার হাতের দিকে তাকিয়ে আছি। সাথে সাথেই আমার হাত ছেড়ে দিলো ।
– ওহ আসলে সরি চলুন (মাথা নিচু করে ) মেয়েটা আগে আগে আর আমি পিছে পিছে যাচ্ছি। গিয়ে সেই যায়গাটায় বসলাম। বসেই মেয়েটা আমার দিকে জিঙ্গাসু দৃষ্টিতে তাকালো ।
– কিছু বলবেন ?
– হুম আমি অদ্রিতা ।কাল নামটা বলা হয় নি তার আগেই তো অপনি চলে গেলেন।
– হুম।
– কি হুম ? আচ্ছা এটা বলুন যে প্রতিদিন গীটার হাতে আপনি এখানে বসে থাকেন কেন ?
– যায়গাটা বেশ ভালো লাগে তাই।
– ওহ আচ্ছা গীটার বাজাতে পারেন ?
– হুম পারি ।
– তাহলে বাজান না কেন ?
– গীটারের সুর যে হাড়িয়ে গেছে ?
– আমায় একটু বাজিয়ে শুনাবেন প্লিজ ।
– নাহ ।
– কেন ? আর জানেন প্রতিদিন ঐ বেলকনি থেকে আপনাকে লক্ষ করতাম।
ওটাই আমাকে বাসা । প্রতিদিন দেখতাম যে আপনি শুধু গীটার হাতে এখানে বসে থাকেন। একদিন ও বাজাতে দেখি নি ।তাই আপনার প্রতি আগ্রহ টা বেড়ে যায়। আর গীটার বাজিয়ে শুনাবেন না কেন ?
– শুনবেন ?
– হুম ।
– তাহলে শুনুন।
এই যে আমার হাতের গীটার টা দেখছেন এই গীটার টা আমার বন্ধু মেঘলার দেয়া ।আমাদের বন্ধুত্ব হয় ছোটবেলা থেকেই । আমাদের পাশের বাসাটাই ওদের বন্ধুত্বের শিকলটা অনেক বড় মাপের ছিলো আমাদের । যেখানে যেতাম একসাথেই ছায়া যেমন মানুষের পাশে সব সময় থাকে ঠিক সেরকম।
যেদিন আমার বার্থডে ছিলো সেদিন সকাল থেকেই মেঘলা কি যেন একটা সারপ্রাইজের কথা বলছিলো। অবশেষে লুকোচুরি খেলায় সন্ধ্যার আকাশে ছাদের একপাশে টুংটুং গিটারের শব্দ হচ্ছিলো।আমি শব্দের উৎস খুজতে খুজতে ছাদের কোনায় চলে যাই যেতেই গীটারের গায়ের হেপি বার্থডে টু ইউ লেখা ভেষে উঠে । গীটার টা মেঘলার হাতে ছিলো। সেদিনি এই নীল গীটার টা মেঘলা আমায় গিফট করে । তারপর প্রায় ই আসতাম এই জায়গাটায়। এসে গীটার বাজাতাম ।সন্ধ্যা হলেই ফিরে যেতাম দুজন। একদিন সন্ধ্যায় এখান থেকে ফেরার পথে রোড এক্সিডেন্ট হয়ে যায় দুজনার । দুজনকেই হসপিটালে ভর্তি করানো হয়। ভাগ্যক্রমে আমি বেচে যাই আর মেঘলার মৃত্যু হয় সেখানে । কিন্তু মেঘলা মারা যাবার আগে ছলছল দৃষ্টিতে আমায় একটা কথা বলে যায় । ঠিক এই জায়গাটায় নাকি কেউ একজনের দেখা পাবো আমি ।যার মাঝে আমি মেঘলাকে খুজে পাবো। সেদিন থেকেই এই নীল গীটার আমার সাথে । কখনও এটা বাজাই নি । আর প্রায় মাঝেই মাঝেই এখানে আসি মেঘলার বলা মেয়েটির খোঁজে। কথাগুলো বলে আমি দাড়িয়ে গেলাম । গীটার টা হাতে নিয়ে
– ভাল থাকবেন আজ তাহলে আসি । কথাটি বলে পা বাড়াতে যাবো অমনি
– চলে যাবেন ?
– হুম ।
– আমাকে কি একটা সুযোগ দেয়া যায় ? পিছনে ফিরে ভ্রু কুচকে তাকালাম অদ্রিতার দিকে । কিসের সুযোগ চাচ্ছে ও ।
– সুযোগ ।কিসের সুযোগ ?
– আপনার জীবনে মেঘলা হয়ে থাকার । আমার মাঝে খুঁজে দেখো মেঘলাকে পেয়ে যাবেন মেঘলাকে ।
আপনার কথাগুলো শুনে খুব ইচ্ছে হচ্ছে আপনার কাধে মাথা রেখে প্রকৃতির এই অপার দৃশ্য আর গীটারের সুর শুনি। পেতে পারি কি সুযোগ টা ? অদ্রিতার বলা কথা গুলো শুনে এক মুহুর্তের জন্য যেনো জমে গেলাম। মনে হলো যেনো মেঘলাই কথা গুলো বললো। হতে পারে মেঘলা যার কথা বলেছিলো এই সেই মেয়ে অদ্রিতা। যার মাঝে আমি খুঁজে পেতে পারি মেঘলাকে।
– কি হলো কথা বলছেন না যে আমি কি ফিরে যাবো ?
কথাটি বলেই অদ্রিতা চলে যেতে লাগলো ।কানের কাছে যেনো বাতাসের ধ্বনি ঘুর্নিঝরের মত বইতে লাগলো। সেই ধ্বনির সাথে যেনো ভেষে আসছে মেঘলার কন্ঠ। কানের যেনো মেঘলা ফিসফিসিয়ে বলছে নীল এটাই সেই মেয়ে অদ্রিতা যার কথা তোকে বলেছিলাম। আমি চিৎকার দিলাম অদ্রিতা । অদ্রিতা পিছনে ফিরে দৌড়ে এসে আমায় জাপটে ধরলো। বসে আছি সেই জায়গায়। অদ্রিতার মাথা আমার কাধে ।আর নীল গীটারে টুংটুং সুর উঠছে। ফিরে পাওয়ার সুর।