মা, তুমি কিন্তু বলেছিলে ভালো রেজাল্ট করলে এবার সাগর দেখাতে নিয়ে যাবে । আমার মনে আছে বাবা । তুমি ভালো করে পড়ালেখা করো । আমি তো বলেছি , এবার আমরা যাবোই । দেখো মা, প্রতিবারের মতো এবারো কিন্তু কথা ঘুরিয়ে দিও না । আগের ঈদে বলেছিলে নতুন কেডস কিনে দেবে । তাহলে আমি পুরোনোটা দিয়ে প্রাক্টিস করতে পারতাম । আর তুমি কিনা ঈদের দিন সেই পুরোনা কেডসটাই ধুয়েমুছে আমাকে পরতে দিলে ! স্যান্ডাল পায়ে দৌড়ানো যায় না তো মা । স্যান্ডাল পায়ে থাকলে ওরা আমাকে খেলতেও নেয় না । ঠিকমতো রান নিতে পারি না তো । দৌড়োনোর মাঝখানে স্যান্ডেলের ফিতে খুলে যায় ।তোমাকে কেডসও কিনে দেবো সোনা । মা’র হাতে টাকা এলেই কিনে দেবো ।মা’র আশ্বাস পেয়ে ক্লাস ফাইভে পড়ুয়া ছোট্ট তূর্য খেলতে চলে যায় ।
ছেলের সাথে কথোপকথনের পর মিত্রা’র মনটা খারাপ হয়ে যায় । বাচ্চাটার ছোট ছোট চাওয়াগুলো পূরণ করতেও তাদের এতো হিমসিম খেতে হয় ! মাঝেমধ্যে কান্না পায় ভীষণ । কখনো হতাশা গ্রাস করে বসে তাকে । সে জানে সাদিত খুব চেষ্টা করছে যাতে তারা আরেকটু ভালো থাকতে পারে কিন্তু এই নির্দয় শহরে ভালো থাকা মুখের কথা নয় ।
সাদিতের চাকরীটা খুব একটা খারাপও না । তবে এক চাকরীর টাকায় দু’সংসার চালাতে হলে হিমসিম তো খাবেই বেচারা । গ্রামের বাড়িতে মা-বাবা আছেন, ছোট বোনটা কলেজে পড়ছে । অন্য ভাই-বোনেরা সবাই হাত তুলে নিয়েছে । সাদিত ঢাকায় থাকে, ভালো চাকরী করে । তাই সব দায় যেন সাদিতের’ই । এটা নিয়ে সাদিতের অবশ্য কোনো অভিযোগ নেই । বাবা-মাকে দেখা, তাদের টাকা পাঠানো এটাকে সে কোনো বাড়তি বোঝা মনে করে না , বরঞ্চ সাদিত খুব অবাক হয় মিত্রা’র কান্ড দেখে । বেতনের টাকাটা হাতে পাওয়া মাত্রই মিত্রা অস্থির হয়ে ওঠে কখন বাবা-মাকে টাকা পাঠাবে । বাবা-মা কতো আশা নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন । সময় মতো টাকা না পাঠালে বাবা’র ওষুধ কিনতে হয়তো দেরি হয়ে যেতে পারে । তাই মিত্রা টাকা হাতে পেলে কক্ষণো দেরি করে না ।
বাড়িতে টাকা পাঠানোর পর বাকি টাকা থেকে আধা তো চলে যায় বাড়ি ভাড়ার পেছনে আর বাকী আধায় মাস চালাতে হয় মিত্রাকে । মাসের শুরুতেই তাই বাজেট করে নেয় মিত্রা । ছেলেকে সে নিজেই পড়ায় তাই টিউটরের পয়সাটা বেঁচে যায় । শুধু স্কুলের বেতনটা লাগে । যাতায়াত খরচ যেন না লাগে তাই বাড়ির কাছের স্কুলেই পড়াচ্ছে ছেলেকে । মীম এখনো ছোট, স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি ওর । অবশ্য ওর বয়সের বাচ্চাদের জন্য কী এক ঢঙের প্রি-স্কুল চালু হয়েছে । শুনেই মেজাজটা খারাপ হয়েছিলো তার । দু’বছর না পেরোতেই স্কুল ! এ তো রীতিমতো অত্যাচার বাচ্চাগুলোর ওপর । পাশের ফ্ল্যাটের জারিফের মা’র সাথে দেখা হলেই বলবেন – কী যে মিস করলেন ভাবি ! পরে কী আর কোনো ভালো স্কুলে ঢুকাতে পারবেন? বয়স হয়ে যাচ্ছে না?
মিত্রা মিষ্টি করে হাসি দিয়ে বলেছিলো – সময়মতো স্কুলে পাঠাবো আপা । স্কুল মানেই তো কষ্টের জীবন শুরু । আরো কিছুদিন আনন্দ নিয়ে বাঁচুক তারপর স্কুলের চিন্তা । দু’বছরের বাচ্চাকে তো আমি কিছুতেই স্কুলে পাঠাবো না । অল্প অল্প করে টাকা জমাচ্ছে মিত্রা । ব্যাংকে পাঁচশো টাকার একটা ডিপিএস একাউন্ট খুলেছে আর বাড়িতে তার একটা গোপন ব্যাংক আছে । হাতে কখনো চকচকে নোট এলেই সেটা ওখানে চালান করে দেয় সে । ঐ জমানো টাকা দিয়ে একটা করে জিনিস কিনে সে । এরপর টাকা জমলে প্রথমে কিনবে তূর্য’র পড়ার টেবিল-চেয়ার । সাদিত অফিস থেকে ফিরলে মিত্রা আবারো মনে করিয়ে দিলো – এবার ছুটিতে কিন্তু কক্সবাজার যাবো আমরা । মনে আছে তো তোমার? হুম, মনে আছে তো । তূর্য খুব আশা করে আছে । বাচ্চাটার খুব সমুদ্র দেখার শখ ।
হুম, হবে তো । আমি তো ঠিক করে রেখেছি, এবার বোনাসের টাকা তোমাদের মা – ব্যাটার । যা খুশি করো । যা খুশি না, সমুদ্র । আচ্ছা বাবা সমুদ্র । তূর্য’র যেন আর তর সয় না । দু’দিন পরপরই দিন গুনবে – মা ঈদের ছুটিতেই তো আমরা যাবো, তাই না মা? হুম । মা আমরা কয়দিন থাকবো? দুইদিন থাকলেই তো হয়ে যাবে বাবা । এত্তো বড় সমুদ্রটা মাত্র দু’দিনে কেমন করে দেখবো মা । কেন মাত্র দু’দিন থাকবো ? ঈদের ছুটি তো অনেকদিন । আরেকটু থাকি না মা , প্লিজ । আচ্ছা দেখা যাবে । সময় আসুক তো আগে । মা আমাকে একটা সানগ্লাস কিনে দিও । আমি সানগ্লাস পরে বালুতে শুয়ে থাকবো । মানে কী! হুম, আমি সিনেমায় দেখেছি তো । মা মীমকেও একটা কিনে দিও । আচ্ছা দেবো । মা আমরা ব্যাগ গুছাবো কবে? আরে বাবা, দেরী আছে তো এখনো ।
কয়দিন ধরে সাদিতের ফিরতে রাত হয়ে যাচ্ছে । কাজের ভীষণ চাপ অফিসে , তার ওপরে পরপর দু’টো শিপমেন্ট বাতিল হয়ে যাওয়াতে এমডির মাথা নষ্ট । এখন যে কাজটা চলছে এটা সময়মতো দিতে না পারলে বোনাস তো বোনাস, বেতন নিয়েই টানাটানি পড়ে যাবে । এতো সতর্ক হয়ে কাজ করে সবাই কিন্তু তারপরও যে কীভাবে কী হয়ে যায় ! একটু উনিশ-বিশ হলো তো সব শেষ । এবার তাই সবাই আরো বেশি সাবধান হয়ে কাজ করছে । সাদিত মিত্রাকে কথা দিয়েছে, এবার তারা কক্সবাজার যাবে । মিত্রা কখনো মুখ ফুটে কোনোকিছু চায় না তার কাছে । যদিও তূর্য’র কারণেই তাদের যাওয়ার প্ল্যান কিন্তু সাদিত জানে মিত্রা’র মনেও এই ইচ্ছেটা অনেকদিনের । সংসারের টানাপোড়েনে ইচ্ছেগুলো সব চাপা পড়ে গেছে বেচারির । সাদিত মনে মনে ভীষনভাবে প্রার্থনা করতে থাকে, কোনোভাবেই যেন এবারের কাজটা আটকে না যায় । তাহলে তার মতো আরো অনেকের স্বপ্ন থেমে যাবে, ঈদে বাড়ি যাওয়া আটকে যাবে ।
গতকাল সাদিত বাড়ি ফিরেছিলো খুব হাসিখুশি মেজাজে । এবারের চালানটা ঠিকঠাক মতো করা গেছে কোনোরকম জটিলতা ছাড়া । সবাই খুশি । বেতন, বেনাস তাহলে আর আটকাচ্ছে না তাদের । অথচ আজ খাবার টেবিলে সাদিতের কালো মেঘের মতো চেহারা দেখে একটু ঘাবড়ে গেলো মিত্রা । জিজ্ঞেস করলো – কী হলো তোমার? তখন থেকে শুধু নাড়াচাড়া করে যাচ্ছো, একটুও খাবার মুখে দাওনি তুমি । সাদিত তাও কোনো কথা বলে না । আচ্ছা কিছু না বললে বুঝবো কেমন করে? কী হয়েছে বলো । মাছ খাবে না? ডিম ভেজে দেবো ? আচ্ছা তোমাকে তো বলাই হয়নি। তূর্য তো একটা কান্ড ই করে ফেলেছে । কী করেছে তূর্য? ওকে বলেছিলাম ভালো রেজাল্ট করলে সমুদ্রে নিয়ে যাবো । ও তো থার্ড পজিশনে চলে এসেছে মিড টার্মের রেজাল্টে । কী যে ভালো লাগছে জানো । মনে হচ্ছে আমার সমুদ্র দেখা হয়ে গেছে ।
সাদিত ধরা গলায় বলে – বেতন, বোনাস কিছু হবে না এবার । স্যার বলে দিয়েছেন । মানে কী! কালই তো বললে, সব ঠিকঠাক তো আজ আবার কী হলো ? তোমাদের নিতে পারলাম না মিত্রা সমুদ্র দেখাতে । বাচ্চাটা ঠিকই তার কথা রাখলো কিন্তু আমি তোমাদের এই ছোট্ট ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারলাম না । সাদিত কথাগুলো বলে মিত্রার দিকে তাকাতেই মিত্রা দেখলো সাদিতের চোখ ছলছল করছে । মিত্রার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো । জানো মিত্রা, আজ সবাই খুব খুশি ছিলাম বেতন, বোনাস সব একসাথে পাবো বলে । লাঞ্চের পর স্যার বলে পাঠালেন, শুধুমাত্র শ্রমিকদের বেতন আর হাফ বোনাস হচ্ছে এবার । আমাদের এবার হাফ বেতন হচ্ছে, বাকিটা পরে সমন্বয় করে দেবে । আমার নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে মিত্রা । আমি একটা যাচ্ছেতাই ধরনের খারাপ মানুষ।
মনটা ভীষন খারাপ হয়ে গেলেও মিত্রা সাথে সাথে সামলে নেয় নিজেকে – আরে তুমি এতো মন খারাপ করছো কেন বলো তো? সমুদ্র কী পালাচ্ছে নাকি? অন্য এক সময় যাবো আমরা । এতো গরমে আমারও খুব একটা ইচ্ছে করছে না ওখানে যেতে । শুধু তো পানি আর পানি । আর এখন গেলে সবকিছুর দাম বেশি হবে । হোটেল রুমের ভাড়াও বেশি । বাদ দাও । তূর্য খুব আশা করে আছে মিত্রা । মিত্রা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে হাসিমুখে বললো – তূর্যকে আমি বুঝিয়ে বলবো । তুমি মন খারাপ করো না, খেয়ে নাও প্লিজ । সাদিত ভেবেছিলো মিত্রা হয়তো দু’কথা শুনিয়ে দেবে তাকে । মিত্রা বিষয়টা এতো সহজ ভাবে দেখাতে খুব নির্ভার লাগলো অনেকক্ষণ পর ।
জমানো টাকা থেকে তূর্য’র জন্য সুন্দর দেখে একজোড়া কেডস নিলো মিত্রা । দাম একটু বেশিই ছিলো কিন্তু ওটাই ওর মনে ধরেছে সবচেয়ে বেশি । মীমের জন্য একটা স্কুল ব্যাগ নিয়ে নিলো । যদিও তার স্কুলে যেতে ঢের বাকি এখনো কিন্তু মীম ছড়ার বইগুলো হাতে নিয়ে মা’র কাছে এসে একটা স্কুল ব্যাগের আবদার করেছে কয়েকবার । মিত্রা ভাবে, মাঝে মাঝে মনের চাওয়াটাকেও গুরুত্ব দিতে হয় , তা না হলে মনটা কেমন যেন মনমরা হয়ে যায় । স্কুল থেকে ফিরে তূর্য খুশিতে চিৎকার দিয়ে উঠলো – মা আমাদের ঈদের ছুটি হয়ে গেছে । কী মজা ! এখন ব্যাগ গুছিয়ে ফেলি মা? মা আমরা কবে যাবো ? মিত্রা জুতোর ব্যাগটা এনে তূর্য’র দিকে বাড়িয়ে দেয় ।
তূর্য যেন খুশিতে পাগল হয়ে যায় কেডস পেয়ে । ছুটে এসে মা’র গলা জড়িয়ে ধরে বলে – মা এত্তো সুন্দর ! আমি তো এমনটাই চেয়েছিলাম মা । থ্যাংকইউ মা, তুমি অনেক ভালো মা, অনেক ভালো । মা আমার কাপড় কিন্তু আমার স্কুল ব্যাগে নেবো, ঠিক আছে মা । মা আমরা কী ট্রেনে চড়ে যাবো? বাবা শোনো, এবার না একটু ঝামেলা হয়েছে । তুমি তো আমার অনেক ভালো ছেলে । মা’র কথাটা একটু মন দিয়ে শোনো । মা’র কাছে এখন এতো টাকা নেই বাবা । আমাদের এই ঈদে কক্সবাজার যাওয়া হবে না । আর এটা নিয়ে তুমি বাবাকে কিচ্ছু জিজ্ঞেস করবে না, ঠিক আছে বাবা? মা তোমাকে কথা দিচ্ছি, ডিসেম্বরের ছুটিতে আমরা কক্সবাজার যাবো ইনশাআল্লাহ । তূর্য হঠাৎ যেন চুপসে যায় । আমরা যাবো না মা? আমি যে বন্ধুদের বললাম, এই ছুটিতে আমরা কক্সবাজার যাচ্ছি । ওদের জন্য গিফ্ট নিয়ে আসবো ।
মিত্রা কোনো কথা বলতে পারে না । আটকে রাখার চেষ্টা করেও পারে না, টলমলে জলটুকু চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে । বুকের ভেতরটা উথাল-পাথাল করে ওঠে । মা’র চোখে জল দেখে অস্থির হয়ে ওঠে তূর্য । ছোট্ট হাতটা দিয়ে চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলে – মা সমুদ্রে তো শুধু পানি আর পানি । থাক ওখানে আমরা যাবো না । নানা বাড়ির পাশেই তো কত্তো বড় নদী আছে । আমরা ওখানে যেয়েই বেড়াবো, ঠিক আছে মা ? কথাগুলো বলেই তূর্য জুতোর ব্যাগটা নিয়ে রুমে চলে যায় । মিত্রা অবাক হয়ে যায় ছেলের কথা শুনে । বাচ্চাটা কত সহজে বুঝতে পারলো তাকে । ছোট্ট একটা মানুষ অথচ কী সুন্দর করে নিজের মন খারাপটা চেপে গেলো ।
নিজের লুকোনো ব্যাংক থেকে টাকাগুলো বের করে গুনলো মিত্রা । মাত্র ছয় হাজার তিনশো টাকা ! ডিসেম্বর আসতে আসতে সে ঠিক বাকি টাকা জমিয়ে ফেলবে কক্সবাজার যাওয়ার জন্য । মনে মনে বললো – আমি ডিসেম্বরের ছুটিতে তোমাকে সাগর দেখাতে নিয়ে যাবোই তূর্য । নিয়ে যাবোই । তোমার স্বপ্নগুলো ঐ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখবো আমি । ঐ ছুটিটা আর কিছুতেই নষ্ট হতে দেবো না আমি ।