মানুষ

মানুষ

বয়সটা সতেরো পেরিয়ে আঠারোতে এসে পড়েছে আতিকুলের। বাবা নেই। মারা গেছে অনেক বছর আগেই। বসবাসের জন্য মাটির একটা ছোট্ট ঘর। ঘরে অসুস্থ মা। আতিকুল সারাদিন কাজের সন্ধানে থাকলেও তিনবেলার মধ্যে দুইবেলা ভালো করে খাবার জুটাতে পারে না। কেউ তাকে কাজে নেয় না। কারণ একটাই আতিকুল চোরের সন্তান। গ্রামের সবাই তাকে চোরের ছেলে বলেই  ডাকে।

আতিকুলের বুঝ হবার পর কখনো সে তার বাবাকে দেখেনি। বাবা মারা যাবার পর মায়ের কাছেই বড় হয়েছে। মা সারাদিন অন্যর বাড়িতে কাজ করেছে। আর কাজ করে সামান্য যা ডাল ভাত পেয়েছে তা দিয়েই মা আর ছেলের কোনরকম দিন কেটেছে। যখন থেকে আতিকুল একটু বড় হতে শুরু করে তখন থেকেই গ্রামের মানুষ তাকে চোরের ছেলে চোরের ছেলে বলে ডাকতে শুরু করে। এইসব শুনে আতিকুল মাঝেমধ্যে তার মাকে জিজ্ঞেস করে, “মা গ্রামের সব মানুষ আমারে চোরের ছেলে কয় কেন? আমার বাপ কি চোর আছিল?”

আতিকুলের মা রাহেলা বেগম তখন আর কোনো জবাব দেয় না। শুধু চুপ করে বসে নীরবে চোখের জল ফেলে। কারণ তার মুখে জবাব দেওয়ার মতো তখন আর কোনো ভাষা থাকে না।  উনার এখনো মনে পড়ে উনার স্বামী মতিন মিয়াকে সেই বিয়ের পরেরদিন থেকে চুরি না করে অন্যকিছু করতে বলা কথাগুলো। কিন্তু মতিন মিয়া মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার একটা কথাও কোনোদিন শোনে নাই। যদিও কোনদিন ভুলক্রমে শোনেছে তো এক কান দিয়ে শোনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিছে। তিনি কিছু বললেই ধমক দিয়ে বলত চুপ থাক। এত কথা কইস না। বউ বউ হয়ে থাকবি। আমি কী করলাম তা জানার দরকার নাই। আগে সব জাইনা বিয়া করতে পারলি না? এসব কথা শোনার পর রাহেলা বেগম একদম চুপ হয়ে যেতো।

তারপর থেকে ভয়ে আর সে মতিন মিয়াকে কোনো কিছু বলত না। এভাবে দেখতে দেখতে বিয়ের দুই বছর কেটে যায় তাদের। দুই বছরের মাথায় রাহেলা বেগমের পেটে আসে আতিকুল। রাহেলা বেগম তখনও তার পেটের বাচ্চার কথা ভেবে মতিন মিয়াকে কসম কাটাতে চায়। চুরি ছাড়তে বলে। কিন্তু মতিন মিয়া চুরি ছাড়তে রাজি না। তার কথা একটাই সে চুরি ছাড়তে পারবে না। এইটা তার পেশা। রাহেলা বেগম তখন রাগের মাথায় মতিন মিয়ার মুখের উপর চিৎকার দিয়ে বলে,  “আমারে তো গ্রামের মানুষে চোরের বউ কইয়া ডাকেই। তোমার পোলাপানগুলারেও কইবনে নে যে চোরের পোলাপান।

এই কথা শোনার পর মতিন মিয়া একদম চুপ হয়ে যায়। কিন্তু এত বড় কঠিন কথা বলার পরেও সে চুরি ছাড়েনি। চুরি করেই গেছে। শেষ পর্যন্ত বউয়ের কথা না শোনে একদিন রাতে চুরি করতে গিয়ে ধরা খেয়ে জনগণের হাতেই মারা যায়।  যার ধরুন সবাই মতিন মিয়ার ছেলে আতিকুলকে আজ চোরের ছেলে বলে ডাকতে দ্বিধাবোধ করে না। কোনো জায়গায় আতিকুল কাজ করতে গেলেও তারা নিজেদের মধ্যে কানাকানি শুরু করে, চোরের ছেলেকে কাজ দেওয়াটা ঠিক হইব না।  এইরকম কথা শোনার পর আতিকুল আর সেখানে থাকতে পারে না। গ্রামের সবাই মনে করে চোরের ছেলে চোরেই হবে।

এইরকম অপবাদ আতিকুলের একদম সহ্য হয় না। রাতের আঁধারে গ্রামে কিছু চুরি হলে সবাই সন্দেহ করে সকালে উঠে আতিকুলের বাড়িতে চলে আসে। কোনোকিছু না পেয়ে প্রায় সময় তাকে মারও দেয়। মনে করে সে চুরির জিনিস অন্যকোথাও লুকিয়ে ফেলেছে। কিন্তু আতিকুল তার বাবার মতো না। সে জানে বুঝে, চুরি করা মহাপাপ। আর তার বাবার চেরের শাস্তির কথাও সে জানে। তাই বাড়িতে মাকে একা রেখে দূরদূরান্তে চলে যায় কাজ করতে। টাকা উপার্জন করতে। কিন্তু গ্রামের মানুষ তা বুঝে না। বুঝতে চায় না। এভাবেই চলছিল আতিকুল আর তার অসুস্থ মায়ের দিন যাপন। আতিকুল তার মায়ের খুব সেবা করত। মাকে খুব ভালোবাসত। চার পাঁচদিন বাহিরে কাজ করে আবার চলে আসত মায়ের ওষুধ নিয়ে।

একদিন রাত্রিবেলা আতিকুল মায়ের পাশে ঘুমাচ্ছিল। হঠাৎ তার মায়ের চিল্লানি শুনে উঠে দেখে তার মা মাথার ব্যথায় মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি করছে। সে বুঝতে পারে তার মাকে এখনি গ্রামের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু এত রাতে কে ওকে সাহায্য করবে? আর কীভাবে এতদূরের পথ একা একা নিয়ে যাবে? পরক্ষণে মনে পড়ল তার তাদের গ্রামের মেম্বার সাহেবের বাড়িতে একটা ভ্যানগাড়ি রয়েছে। যেটা আনতে পারলে তার মাকে হাসপাতালে দ্রুত নেওয়া সম্ভব, এবং সহজে নেওয়া যাবে। ছুটে গেলো আতিকুল মেম্বারের বাড়িতে ভ্যানগাড়ি জন্য।

বাড়ির ভেতরে ঢুকে যেইনা মেম্বার সাব বলে ডাকতে যাবে ওমনি চোখ পড়ে আতিকুলের উঠনে থাকা ভ্যানগাড়িতে। মেম্বারকে ডেকে সময় নষ্ট না করে আতিকুল ভ্যানগাড়ি নিয়ে বাড়ির ভেতর থেকে সোজা বের হতে থাকে। বাড়ির সীমানা পেরিয়ে যেইনা আতিকুল ভ্যানগাড়িতে উঠে প্যাডেলে পা দিলো, সাথে সাথে পিছন থেকে মাথায় জোরে লাঠি দিয়ে আঘাত করে চোর চোর বলে চিল্লাতে থাকল মেম্বারের বাড়িতে থাকা কুদরত গোমেস্তা।

কুদরত গোমোস্তার চিল্লানিতে কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্রামের সব মানুষ এসে জড়ো হয়ে গেল। আতিকুল তখন অজ্ঞান। মেম্বারের হুকুমে আতিকুলকে বাঁধা হয় বড় একটা গাছের সাথে। বেঁধে রাখার অনেকক্ষণ পর আতিকুলের জ্ঞান ফিরে। জ্ঞান ফিরার পর মা মা বলে চেঁচিয়ে উঠে। কিন্তু মা তো এখানে নেই। হঠাৎ চারপাশে এত এত লোকজন দেখে আতিকুল অনেকটা ভয় পেয়ে যায়। হা করে সবার দিকে তাকিয়ে বলে, “আমাকে বাঁধছেন কেন? আমি কী করছি? আমাকে ছাড়েন দয়া কইরা। আমার মা অসুস্থ। আমার মারে হাসপাতালে না নিলে আমার মা মইরা যাইব।”
কুদরত গোমোস্তা তখন বলে উঠে, “চুপ কর চোরের ঘরের চোর। আইছস চুরি করতে এহন আবার মায়ের কথা কস। বাপটা যেমন চোর আছিল পুলাডাও এমন চোর হইছে। দেখছেন মিয়ারে? কইছিলাম না মতিনের ছেলেডা বড় হোউক দেখবেন আস্তমারা একটা চোর হইব। হইছে তো? আইজ প্রমাণ পাইলেন তো?

সেদিন কেউ বিশ্বাস করেনি আতিকুলের কথা। কেউ শুনতে পায়নি আতিকুলের নিরপরাধ আর্তনাত। গ্রামের কিছু মানুষদের ছিল অনেকদিনের ক্ষোভ। মতিন চুরের ছেলে চোরেই হবে। গ্রামে আর চোর রাখব না। শেষে তাই হলো। আতিকুলকে চোর হিসেবে আখ্যায়িত করে জনগণের মার মারতে মারতে একদম তার বাবার মতো চোররূপেই মেরে ফেলে। গ্রামের একটা মানুষও তাকে বাঁচাতে সেদিন এগিয়ে আসেনি। মাকে বাঁচানোর জন্য ভ্যানগাড়ি নিতে আসা আতিকুল মারা যায় চোর হয়ে। আর ঐ দিকে আতিকুলের অসুস্থ মা মারা যায় ব্যথার যন্ত্রনায়।

দিনের বেলায় দুটো লাশ যখন একত্রে রাখা হয় তখন গ্রামের মানুষের কান্নার ঢল নামে। কেউ কেউ বলছিল ছেলেটা মনে হয় আসলেই চুরি করতে যায়নি। মাকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য ভ্যান আনতেই গেছিল। আবার কেউ কেউ বলছিল আজ পর্যন্ত আতিকুলকে কোনকিছু চুরি করতে দেখিনাই। সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন সেই গ্রামেরই উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আহমেদ সাহেব। আহমেদ সাহেব সেদিন গ্রামের মানুষের সামনে গলা উচু করে বলেছিলেন, আমরা মানুষ প্রতিশোধ নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করি না। একটা নিরপরাধ মানুষকে আঘাত করার আগে ভাবিনা যে তার কী অপরাধ! সত্যিই কী সে এটা করেছে? বা করেছিল?

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত