রাত ১২:৩০।
সুপ্তির আড়াই বছরের ছেলেটা ঘুমের মধ্যে কেঁদে ওঠায় সদ্য চোখে ঘুম আসা সুপ্তির ঘুমটা ভেঙে গেল। পাশেই স্বামী নিরোদ ভুস ভুস করে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। নিরোদের এই নাক ডাকাটা প্রথম প্রথম সুপ্তির বড্ড অসহ্য লাগতো কিন্তু এ তিন বছরে সে এ বিভৎস নাক ডাকাতে অভ্যস্থ হয়ে গেছে। নারীদের জীবনে কতকিছু যে সয়ে যেতে হয় তার তো কোন ইয়ত্তা নেই, বাকি তো এই সামান্য নাক ডাকা!
মাঝ রাতে ছেলেটা কেঁদেই চলেছে, তো কেঁদেই চলেছে। সূর্যকে কোলে বসিয়ে সুপ্তি নানানভাবে কান্না থামানোর চেষ্টা করে চলেছে তবুও সে থামছেনা। কনকনে শীতের রাতে লেপ কম্বল ছেড়ে বিছানা থেকে নেমে একটু হাঁটাহাঁটি করে সুপ্তি ছেলেকে থামাতে চেষ্টা করছে। ওদিকে নিরোদ হঠাৎ করেই সুপ্তিকে ধমকে ওঠে,”কি করছো তুমি? এখনো ছেলেটার কান্না থামাতে পারছো না! ” নিরোদের ধমকে চমকে উঠে সুপ্তি। সে আপ্রাণ চেষ্টা করেও যখন সূর্যকে থামাতে পারছেনা তখন স্বামীর ঘুমের ডিস্টার্বের কথা ভেবে ছেলেকে গরম কাপড়ে জড়িয়ে বারান্দায় চলে আসে যাতে কান্নার আওয়াজ নিরোদের কান পর্যন্ত না যায়। এ ঠান্ডার মধ্যে আধা ঘন্টা বারান্দায় পায়চারী করে সুপ্তি ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে বিছানায় আসে।
সমস্ত শরীর ঠান্ডায় হিম হয়ে আছে,ফ্লোরে দাঁড়িয়ে পা দুইটা বরফ হয়ে গেছে তার। ছেলেকে পাশে শুইয়ে কম্বলের নিচে গুটিসুটি মেরে শুইয়ে পড়তেই নিরোদ তার একটা হাত সুপ্তির পিঠে রাখে। তার মানে নিরোদ সজাগ! ধীরে ধীরে হাতটা সুপ্তির পিঠ হাতড়ে ঘাড়ের কাছে চলে এসেছে। সুপ্তি নিরোদের এ হাত রাখার মানেটা খুব ভাল করেই বোঝে। অজানা একটা বিরক্তি ছেয়ে যায় তার মনে। হাতটা ঘাড় থেকে সরিয়ে দেয় সে। নিরোদ এবার সুপ্তিকে তার দিকে ঘুরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলে সুপ্তি জোর খাটিয়ে তাকে ফিরিয়ে দেয়। নিরোদের মাথায় রাগ চেপে যায়,”এদিকে ঘোরো বলছি।” আদেশ করে সুপ্তিকে।
সারাদিনের সাংসারিক কাজ, চাকরি, সন্তান সব সামলে স্বামীর আবদার রাখার মত একটুও তার ইচ্ছে নেই আজ। নিরোদকে সে বুঝায় আজকের সারাদিনের কাজের প্রেসারে সে ক্লান্ত, একটু ঘুমের দরকার। নিরোদ কিছুতেই যখন শুনতে রাজিনা তখন বাধ্য হয়ে সুপ্তি বিছানা ছেড়ে পাশের রুমে চলে যায়।
এ রুমটাতে কেউ অনেকদিন থাকেনা,আর খাটটাও ভাঙা। নিরোদের ভাগ্নে আর ভাগ্নি বেড়াতে এসে লাফালাফি করে ভেঙে ফেলেছে। পাতলা একটা কম্বল গায়ে জড়িয়ে ভাঙা খাটের একপাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ে সে। ঠান্ডায় কিছুতেই ঘুম আসছেনা তার। কখন যে ঘুমিয়ে গেছে সে নিজেও জানেনা।
ভোরের আযান কানে ভাসতেই ধরমড় করে উঠে বসে সুপ্তি। এর থেকে একটু দেরি হয়ে গেলেই যে তার সকালের কাজ শেষ হবেনা। অসুস্থ শ্বশুর আর ননাস ঘুম ভেঙেই শুধু খাই খাই করে। অসুস্থ মানুষ কিনা, ক্ষুধা পায় বেশি উনাদের। ভাতের হাঁড়ি বসিয়ে সুপ্তি রাতের খাওয়া সব প্লেট গ্লাস ধুয়ে সকাল দুপুরের খাবার রান্না করে একা হাতে।
সমর্থ শাশুড়ি আজ সাঁঝসকাল থেকেই শরীর ভাল লাগছেনা বলে ঘ্যান ঘ্যান করছে। সুপ্তি জানে তার শাশুড়িমার এ ঘ্যান ঘ্যানের মানে তবুও সে সেদিকে কর্ণপাত করেনা।
তিন তরকারি রান্না করে, ঘরদোড় গুছিয়ে, সবাইকে সকালের খাবার দিয়ে সুপ্তি নিজে রেডি হতে যায়।স্কুলে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে অলরেডি।সকালে সূর্যকে একবার কোলে নেওয়ারও সুযোগ নেই তার।
হঠাৎ নিরোদের চিৎকার গ্লাসে জল নেই। শাড়ির কুচিটা হাতে ধরেই সুপ্তি ছুটে আসে নিরোদকে জল দিতে। কাছেই বসা শাশুড়িমা এখনো কোমরে ব্যথা,পায়ে ব্যথা বলে চেঁচিয়েই যাচ্ছেন। সুপ্তি জানে সূর্যকে যাতে সুপ্তি বাড়িতে রেখে না যায় সেজন্যই শাশুড়িমার এ বাহানা। ছেলেটা আজকাল বড্ড বিরক্ত করে, শাশুড়ি ওকে সহজে সামলাতে পারেন না,ওকে খাওয়ানো তো মহাযুদ্ধ। সে ভয়েই শাশুড়িমা প্রতিদিন অসুস্থতার ভান তুলেন যাতে সুপ্তি ছেলেকে সাথে করে নিয়ে যায়।
স্কুলে নতুন প্রধান শিক্ষক এসেছেন, শিক্ষকের বাচ্চা সাথে নেয়াটা পছন্দ করেন না তিনি । সূর্যকে সেদিন সুপ্তির সামনেই একটা অপ্রয়োজনীয় কাগজ ছেঁড়ার জন্য যাচ্ছেতাই করে ধমক দেয়। চোখে জল চলে আসে মেয়েটার। স্কুলে রুটিন মাফিক ক্লাস করে ছেলেকে সামলানোটা সুপ্তির জন্য কষ্টকর তো বটেই। সকালে নিরোদ তাকে বাইকে করে অর্ধেক পথ পৌঁছে দিলেও বিকেল বেলা নিরোদ ফ্রি থাকলেও তাকে আনতে যায়না। পায়ে হেঁটে আসতে হয় অনেকটা পথ। বাড়ি ফেরে রেস্টের কোন সুযোগ নেই তার, শাড়িটা পাল্টেই আবার রান্নাঘরে ঢুকতে হয়। এত পরিশ্রম শেষে ক্লান্তিতে যখন শরীর নেতিয়ে পড়ে তখনই আসে নিরোধের কামপ্রবৃত্তি। স্বামীর সুখের প্রয়াসে অনিচ্ছা সত্যেও নিজেকে সমর্পণ করতে হয় তাকে।
আজকাল নিরোধের সুপ্তির প্রতি কোন টান নেই, মমত্ববোধ নেই। সুপ্তি সেটা বুঝতে পারে কিন্তু এটা নিয়ে ভাবার মত অবকাশ নেই তার।
স্কুলে তার অন্য কলিগরা যখন নিজেদের স্বামীর ভালবাসা আর কর্তব্যপরায়ণতার গল্পে আহ্লাদে আটখানা হয়, সুপ্তি তখন নিরবে তাদের কথা শুনে নতুবা বসে বসে পরের ক্লাসের পাঠ টীকা লেখায় মনোনিবেশ করে।
বাড়িতে ছেলেটার জন্য চিন্তা হয়, মায়ের আদর যত্ন পায় না বললেই চলে। রাস্তার পাশে বাড়ি তাই ছেলেটা হাঁটা শেখার পর থেকেই সুপ্তি আতঙ্কে থাকে, কখন হাঁটতে হাঁটতে রোডে চলে যায়। একবার তো প্রায় গাড়ির নিচে পড়েই গিয়েছিল।
স্কুল শেষে বাড়ি ফিরে সুপ্তি আজ তার সোনামানিক কে কোলে নিয়ে আদর করছে, হঠাৎ পিঠে হাত পড়তেই ছেলেটা লাফিয়ে উঠে। পিঠে লম্বা ছেড়া দাগ, নিশ্চিত কঞ্চির বাড়ি।
কোমড়ের নিচেও দুটি দাগ দেখায় সূর্য। সুপ্তি সস্নেহে ছেলেকে শুধায়, “তোমার এখানে কি হয়েছে বাবা?”
আধো আধো বুলিতে সূর্য বলে,”তাম্মা মেরেছেে, নাঠি দিয়ে। “
চোখের জল বাঁধ মানেনি সুপ্তির, চিৎকার করে কেঁদে দেয় সে। এ কান্না কোন রাগে নয় এক বিশাল দুঃখ আর যন্ত্রণার কান্না, নিজের নারীছেঁড়া ধনের উপর আঘাত আসার যন্ত্রণার।
সুপ্তির কান্না শুনে শাশুড়ি দৌঁড়ে তেড়ে আসে। উনি বাহির থেকে আড়ি পেতে শুনছিলেন সূর্য তার মাকে মারার কথা বলে দেয় কি না শোনার জন্যে।
— তুমি এমন মরা কান্দন শুরু করছো কেরে? আগে শোনে লও আমি কেরে মারছি?
— আমার কিছু শুনতে হবেনা, মা। আমার ছেলে রেখে যাই, বিরক্ত করে তাই মারতে তো পারেনই।
— তুমি তো হুদাই রাগ দেখাইতাছো।
দুচোখে কান্নার দাগ নিয়ে ছেলেকে কোল থেকে নামিয়ে রান্নাঘরের দিকে ছুটে চলে সুপ্তি। ছেলেকে নুডুলস রান্না করে খাওয়ানোর জন্য মন চাইছে,ওদিকে শাশুড়িমা বক বক করে চৌদ্দগুষ্ঠির পিন্ডি চটকাচ্ছে, শিক্ষিত চাকরিজীবী বউ আনার পাপ ঝাড়ছে।