-পর্দার আড়াল থেকে সরে সামনে আসুন।কে আপনি?বাসায় কিভাবে ঢুকলেন? আড়ালের ছায়াটা দিপেনের কথায় সাড়া দিল না।দাঁড়িয়েই রইল।দিপেন গুটিগুটি পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।৩মিটার দূরের দরজার ওপাশে পর্দার আড়ালে কেউ যে ঠাই দাঁড়িয়ে আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই তার।কিন্তু কি করে সে বাসায় ঢুকলো!ঘুমানোর আগে তোহ সব ঠিকঠাক লাগিয়েই ঘুমিয়েছিল সে।দরজার কাছে এসে পর্দা টা ধরে একটানে সরিয়ে দিল।কিন্তু পর্দাটা ছাড়া সেখানে কিছুই দেখতে পেল না দিপেন।আচমকা কে যেন ঘাড়েচাপা দিয়ে নাক মুখ চেপে ধরল তার।দম বন্ধ হয়ে আসছে।বাঁচার প্রয়াসে হাত পা নাড়িয়ে প্রতিরোধ করতে চাইল সে।কি আশ্চর্য!হাত পা সবকিছুই একেবারে নিথর যেন হাতে পায়ের সব স্নায়ুগুলো মারা গেছে।তবে কি সেও মারা যাবে?
বিছানা থেকে উঠে বসে গেল দিপেন।দ্রুত কয়েকবার শ্বাস নিতে নিতে চারপাশটাই একবার তাকালো।পর্দার ওপাশেও একবার তাকালো।নাহ,কোথাও কেউ নেই।তাহলে স্বপ্ন দেখছিল ভেবে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।বারান্দায় গিয়ে মায়ের(দূর্গা) ছবিতে প্রনাম করে এসে ঘুমানোর চেষ্টা করল।মনে মনে ভাবলো,’নাহ,এভাবে আর থাকা যায় না।কিছু একটা করতে হবে।’
নীলের ধারনা ছিল সে মিষ্টি কম খায়।কিন্তু হাতে থাকা মিষ্টি দই এর হাড়িটার অর্ধেকটা কবে যে সাবাড় করে ফেলছে খেয়াল ই করে নি।বাড়িওয়ালা তকরীমুল্লাহ সাহেব কুমিল্লা সফরের কাহিনী শুনাচ্ছে নীলকে।নীল শুনছে আর খেয়ে চলেছে।ভদ্র লোক নীলকে খুব পছন্দ করেন।নীল ছাদের একপাশে ব্যাচেলর থাকে।আর একপাশটা খালি।তকরীমুল্লাহ সাহেব এখনো পর্যন্ত নীলের বাসা ভাড়া বাড়ান নি। ভ্রমনপ্রিয় রসিক ধাচের মানুষ তিনি।প্রায়ই দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমনে বের হন।আর প্রতিবারই আসার সময় নীলের জন্য কিছু না কিছু নিয়েই আসেন।একা থাকেন,দুই মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে স্ত্রী থাকে ইতালীতে।তিনি যান নি বরং ভালোই হয়েছে উনার মতে বিবাহিত জীবনে এমন স্বাধীনতা কজনই বা পায়!এদিক থেকে তকরীমুল্লাহ সাহেব নিজেকে সুখী মানুষের কাতারে চিন্তা করে বড্ড খুশি হন।
-জানেন নীল সাহেব ময়নামতি জায়গাটা কেমন যেন মায়াবী
-(মৃদু হেসে)তাই নাকি?
-হ্যাঁ।জিজ্ঞেস করুন মায়াবী কেন?
-কেন?
-এই যে দেখুন চলে এলাম তাও বার বার মনে পরছে।একরকম মায়া পরে গেছে।জানেন ময়নামতি নামটা কিভাবে এল?
-আনুমানিক দশম শতাব্দীর চন্দ্র বংশের রাজা মানিকচন্দ্রের স্ত্রী রাণী ময়নামতির নামানুসারে এই এলাকার নাম রাখাহয় ময়নামতি।তবে এটা ইতিহাসবিদ দের ধারনা মাত্র।সত্যতা জানা নেই।
-বাহ।ইতিহাস চর্চাও করেন?
-মাঝে মাঝে সব বিষয় নিয়েই একটু আধটু ঘাটাঘাটি করি।
তকরীমুল্লাহ সাহেব প্রতিবার ভ্রমন থেকে এসে এভাবেই বলেন নীলকে।কিন্তু তার প্রতিবারের একই কথাবার্তায় একটুও বিরক্ত হয় না নীল। শরতের বিকেলে সন্ধ্যে হবে হবে অবস্থা।মেঘে ঢেকে গেছে সারা আকাশ।বারান্দায় চেয়ারে বসে আছে লোকটা। প্যান্টের নিচের দিকে হালকা কাদা মাখানো,কিন্তু পায়ে কোনো কাদা নেই।গতকাল বা তার আগে কাদা লেগেছে নিশ্চয় কিন্তু তিনি পরিষ্কার করেন নি।হয়তো তাড়াহুড়োয় কিংবা অন্য কারনে।সুতি কাপড়ের প্যান্ট,কাপড় কিনে সেলানো হয়েছে।সাথে আকাশী রঙের ফুলহাতা শার্ট পরেছেন।শার্টের মাঝের বোতামটা ঝুলে আছে।এখুনি খুলে পরে যাবে এমন অবস্থা।বাহিরের মৃদু ঠান্ডা হাওয়ায় লেবু পাতার মিষ্টি গন্ধে চারপাশটা মৌ মৌ করছে।নীল লক্ষ করলো প্রায় তিন মিনিটের ও বেশি সময় ধরে লোকটা টেবিলের উপরের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে।আরো খেয়াল করলো লোকটা কিছুক্ষন পরপর চোখের পাতা দুবার করে ফেলছে।নীল বুঝতে পারছে না লোকটা আসলেই অন্যমনষ্ক নাকি অন্যমনষ্কের ভাব ধরে কি বলবে গুছিয়ে নিচ্ছেন! খানিকবাদে নীলের দিকে ফিরতেই সে থামিয়ে দিয়ে দিয়ে বলল-
-তাড়াহুড়ো না থাকলে আস্তে আস্তে চিন্তা করে বলুন যা বলতে চান।এমনিতেই বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে।চা খান।চা খেতে খেতে শুনি।
-ওহ বৃষ্টি পরবে?আজ তাহলে আসি।অন্য একদিন এসে বলবো।
-বাসায় ছাতা আছে।নিতে পারবেন।আপনি কিছুক্ষন বসুন আমি চা বানিয়ে নিয়ে আসছি। লোকটা কিছু বলল না।
-আপনার নাম?
-দিপেন নীল পরিষ্কার বুঝতে পারল দিপেন নামের এই লোকটা সৌজন্য প্রকাশে বলছেন চলে যাবেন। নীল চা বানিয়ে বসার ঘরে এসে দেখলো কেউ নেই ঘরে। নাহ,চলে যায় নি দিপেন।মেইন দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে।নীল দেখেই-
-দিপেন সাহেব,ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
-বৃষ্টি দেখছিলাম। নীল অবাক হল।কারন লোকটা ঘরের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিল।
-ও আচ্ছা।ভেতরে আসুন।এই নিন চা সাথে লেবু পাতা ও হালকা করে দিয়েছি।
-ধন্যবাদ।
চা খেতে খেতে দিপেন বলতে শুরু করলো- “তখন জানুয়ারি মাস চলছে।নতুন বাসা নিয়েছি।সিঙ্গেল ফ্যামিলির ছোট বাসা।সকাল ৯টার দিকে অফিসে যায়।আসতে আসতে বাজে সন্ধ্যে ৬টা।মাঝে সারাদিন বাসা ফাঁকা থাকে।রাত ১০টার দিকে রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার পাঠিয়ে দেন নকিব সাহেব।আমার পরিচিত মানুষ।জানুয়ারীর শেষের দিকের এক রাত।শীত কমে গেছে অনেকটা।তবুও কম্বল জড়িয়ে ঘুমাচ্ছি।গভীর রাতে হঠাতই একটা মিষ্টি গন্ধ পেলাম।ঘুম থেকে উঠে বসে দেখি রুমের পর্দার আড়ালে কে যেন দাঁড়িয়ে আমায় দেখছে।দেহটা নিস্তব্ধ আর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।এগিয়ে গিয়ে দেখলাম কিছুই নেই।পরক্ষনেই টেরপেলাম কিছুএকটা আমার ঘাড়েচাপে দিয়ে বসে নাক মুখ চেপে ধরলো।কিন্তু অদ্ভুদ ভাবে আমার হাত পা আমি নাড়াতে পারছিলাম না।যেন প্যারালাইজড রোগী।মনে হল মারা যাচ্ছি।”
নীল মনোযোগ দিয়ে শুনছে কথাগুলো।
-ভয় পেয়েছেন?
-নাহ।কারন আপনি স্বপ্ন দেখেছেন। দিপেন অবাক হল।
-আপনি কি করে জানলেন?
-যুক্তিগত ভাবে এসব বাস্তবে সম্ভব নয়,তাই।তারপর বলুন। চা টা পুরো শেষ করে আবার বলা শুরু করলো।
-নীল সাহেব চা টা ভালো হয়েছে।
-ধন্যবাদ।আরেক কাপ খাবেন?
-পরে।আমার দিন গুলো আগের দিনের মতই কাটছে।কিন্তু রাতগুলা আর স্বাভাবিক রইল না।মাঝে মাঝেই আমি এই স্বপ্ন দেখতাম।একই স্বপ্ন বারবার দেখাটা নিশ্চয় স্বাভাবিক নয়।
-অতটা অস্বাভাবিক ও নয়।প্রায়ই আপনি স্বপ্নের ব্যাপারে চিন্তা করেন।সেটার কারন খুঁজে বেড়ান বলে এমনটা বারবার ঘটছে। ঠিক তখনই তকরীমুল্লাহ সাহেব দরজায় দাঁড়িয়ে-
-নীল সাহেব।
-জ্বী,ভেতরে আসুন।
-আজ নয়,অন্য একদিন আসবো।এই নিন আরেকটু দই। নীল দরজায় গিয়ে দই নিয়ে-
-(মৃদু হেসে)আপনি বুঝি আমার ডাইবেটিস বাধিয়েই ছাড়বেন!
-আচ্ছা,তাহলে নিয়ে যাই।
-নাহ থাক।একটু খেলে সমস্যা হবে না।
এই বলে দুজনেই খুব হাসলেন।দিপেন একটা বার ও সেদিকে ফিরে তাকালো না।তকরীমুল্লাহ সাহেব ও দিপেনের ব্যাপারে কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না নীল কে।ব্যাপারটাও নীলের দৃষ্টি এড়ায় নি।তবুও সে কিছু বললো না।তকরীমুল্লাহ সাহেব কে বিদায় জানিয়ে দিপেনের কাছে আসতেই-
-নীল সাহেব আজ আসি।
-ঘটনা কি এতটুকুতেই শেষ?
-নাহ,অন্য একদিন বলবো।বৃষ্টি থেমেছে।আবার শুরু হওয়ার আগেই চলে যায়।
-আচ্ছা।
বাহিরের বৃষ্টি থেমে গেছে।তবে এখনো বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ক্ষনে ক্ষনে।নীল ছাদের একপাশটাই দাঁড়িয়ে লেবু পাতার গ্রানযুক্ত হাওয়ায় শ্বাস নিচ্ছে আর ভাবছে।বিবাহিত পুরুষের প্যান্টের নিচে দুদিন ধরে কাদা কিংবা শার্টের মাঝের বোতাম ছেঁড়া হওয়ার সম্ভাবনা কম।যদি বিবাহিত হয়ে থাকেন উনার স্ত্রী হয়তো সাথে থাকে না।স্বপ্নের ব্যপারটা নিয়ে ওইভাবে অস্বাভাবিকভাবে চিন্তা করে না ভাবলেই হয়তো আর দেখতেন না।কিন্তু আসলেই কি তাই?দিপেন সাহেব পুরো ঘটনা তোহ বলে নি।প্রকৃতিতে রহস্য থাকতে পারে,কিন্তু সে রহস্যের ব্যাখ্যাও প্রকৃতিতেই লুকানো থাকে। সপ্তাহ দুয়েক কেটে গেল।মাঝে আর দিপেনের দেখা পেল না নীল।সেদিন শেষ বিকেলে ছাদের গাছগুলোর জন্য সার কিনবে বলে বের হচ্ছে নীল।মেইন দরজা লাগিয়ে বাহিরে আসতেই দেখলো দিপেন বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে।
-আপনি!এত দিন পর!
-কোথাও যাচ্ছেন মনে হয়?আজ তাহলে আসি।অন্য একদিন আসবো।
-হ্যাঁ যাচ্ছিলাম।তবে আপনি যেহেতু ব্যস্ততার ফাঁকে সময় খুঁজে এসেছেন সেহেতু পরে যাবো ভাবছি।আসুন ভেতরে আসুন। আজ পরিবেশটা ঠিক সেদিনকার মত।নীল চা বানিয়ে আনলো।নীল লক্ষ করলো দিপেন আজকেও ঠিক সেই কাদা মাখানো প্যান্ট আর বোতাম ছেঁড়া আকাশী রঙের সেই ফুলহাতা শার্ট পরেছেন।নীলের খুব জানতে ইচ্ছে করলেও দিপেন সাহেব কে লজ্জিত করতে চাইল না,তাই কিছু জিজ্ঞেস করে নি।
-তারপর বলুন।
-বাড়িতে আমার বিয়ের কথাবার্তা চলছিল সেসময়।বিয়ের পর এখানেই স্বামী স্ত্রী দুজন থাকবো বলে আগে থেকেই সিঙ্গেল ফ্যামিলির বাসা নিয়ে রেখেছিলাম।আষাঢ়ের প্রথম দিকে এক প্রচন্ড বৃষ্টির দিনে আমার সাথে অনামিকার বিয়ে হল।ঢাক ঢোল বাজল,সবাই নাচলো গায়লো।শুধু আমি চুপ ছিলাম,স্বপ্নের ব্যাপারটা মাথায় ঘুরতো সারাটাক্ষন।পরদিন গ্রাম থেকে ওকে নিয়ে চলে এলাম শহরে।অদ্ভুদ পরিবর্তন নেমে এল আমার জীবনে।স্বপ্ন দেখা বন্ধ হয়ে গেল।নিত্য রজনীর সেই কঠিন স্বপ্ন চলে যাওয়ার ব্যাপারটা আমার কাছে অস্বাভাবিক হয়ে ঠেকলেও আমি অনামিকা কে কিছুই জানাই নি।স্বপ্নের ব্যাপারেও সে জানতো না।আচমকা স্বপ্ন বন্ধের কারন নিয়ে আর চিন্তা করতে চাইলাম না।
এদিকে আষাঢ় কেটে যাচ্ছে আর আমার প্রেম কাব্যে অনামিকাকে নিয়ে সবে মাত্র কটা লাইন রচিত হয়েছে।সেদিন ছিল শুক্রবার।ছুটির দিনে আমরা রিক্সা ভ্রমনে বের হতাম প্রায়ই।১০ টাকার এক পোটলি বাদাম নিয়ে দিনের শুরুটা করলাম।সারাদিন ঘোরাফেরার পর বাসায় ফিরলাম সন্ধ্যের দিকে।রাতের খাবারের ব্যবস্থা না করেই ক্লান্ততার দরুন দুজনই শুয়ে পরলাম।রাত তখন ৩টা বাজে হয়তো।হঠাতই আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল।পাশ ফিরে দেখি অনামিকা নেয়।আচমকা চোখ পরলো ৩মিটার দূরের সেই পর্দাটাই।আবছা আধাঁরে মনে হল অনামিকা দাঁড়িয়ে আছে।’কিন্তু কেন?’এই চিন্তাই হঠাতই মাথায় আসলো সেই স্বপ্নের কথা।চিমটি কাটলাম গায়ে।নাহ এটা স্বপ্ন নয়।পর্দার কাছে যেতে ভয় আর সংকোচ দুটোই হচ্ছিল।কিন্তু কি এক অদ্ভুদ আকর্ষন মনের বিরুদ্ধে আমাকে সেদিকে নিয়ে গেল।পর্দা সরিয়ে দেখি সেখানে কেউ নেই।অনামিকা দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়।আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আমি তাকে কিছু বলতে যাবো তখনই আমার ঘাড়ে ঠান্ডা আর ভারী কিছু একটার স্পর্শ অনুভব করলাম।বুঝলাম সেটা কারো হাত,ঠান্ডা বরফের হাত।ঘাড় ছেড়ে গলা টিপে ধরল।জোছনার আলোয় স্পষ্ট দেখলাম অনামিকার চোখে জল।নিজেকে বুঝাতে শুরু করলাম এটা স্বপ্ন এখনই ঘুম ভেঙে যাবে।দেখবো অনামিকা আমায় জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। দিপেন চুপ হয়ে গেল।
-তারপর?
-নীল সাহেব চা টা ভালো হয়েছে। ‘এভাবে অতি স্বাভাবিকভাবে কথার বিষয়বস্তু থেকে বেরিয়ে এসে কাহিনীর গাম্ভির্য্য ঢাকতে চাইছেন নাতো দিপেন সাহেব’ মনে মনে ভাবলো নীল।
-ধন্যবাদ।আরেক কাপ খাবেন?
-আরেকদিন খাবো।নীল সাহবে অনামিকাকে এমন করে চা বানানো শিখিয়ে দিবেন?
-অবশ্যই।নিয়ে আসুন একদিন।
-সে একা কোথায় যায় না।
-একা কেন আসবে?আপনি নিয়ে আসবেন।
সে কথার উত্তর না দিয়ে দিপেন বাসার ঠিকানা দিয়ে সেদিনকার মত চলে গেল।যাওয়ার আগে কয়েকবার করে বাসায় যাওয়ার নিমন্ত্রণ দিয়ে গেল। দক্ষিনের জানালাটা দিয়ে শরতের হাওয়া আর জোছনার আলো এসে পরেছে।দেয়ালের টিকটিকিটার দিকে তাকিয়ে আছে নীল।জোছনার আলোই সেটিকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সাথে তার ছোট্ট ছায়াটাও। শহরের উত্তরে একেবারে যেন শেষপ্রান্তে বাসাটা,পাশেই ইউক্যালিপটাস গাছটা ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে আছে।নিচতলার ঘরখানায় বেল টিপে দাঁড়িয়ে আছে নীল।খানিকপর দরজার ওপাশ থেকে এক বৃদ্ধা কর্কশ কণ্ঠে বলল-
-কাকে চাই?
-দিপেন সাহবে কি এখানে থাকেন?
-থাকেন নয় থাকতেন।’এখন না থাকলে পুরনো ঠিকানা কেন দিল দিপেন সাহেব’ মনে মনে ভাবলো নীল
-আচ্ছা এখন কোথায় থাকে বলতে পারেন?
-অদ্ভুদ সব মানুষ দুনিয়াতে থাকে।যান উপরে গিয়ে খোঁজ করুন।
দিপেন যদি এখানে না ই থাকে তবে সে দোতালায় গিয়ে কি করবে ভেবে পেল না নীল।তাও সে একবার গেল।বেল চাপতেই দরজা খুলে বেরিয়ে এল ২৩ কি ২৪বছরের এক সুন্দরী যুবতী।
-ভেতরে আসুন। নীল অবাক হল।অপরিচিত মানুষকে ভেতরে আসতে বলছে কেন?যুবতি কি তাকে চেনে?
-হ্যাঁ আমি আপনাকে চিনি।আমি দিপেন রায়ের স্ত্রী অনামিকা। নীল কিছুটা অবাক হলেও কিছু বলে নি।
-ও আচ্ছা।কিন্তু নিচে যে বলল…
-উনি এমনই।আসুন।
বারান্দায় আসবাবপত্র বলতে সোফা আর একপাশে ছোট্ট টেবিলের উপর ১৫ কি ১৬ ইঞ্চি টিভি বসানো।দেয়ালে মা(দূর্গা) এর ছবি।ছোট্ট বারান্দায় জায়গা সংকটের কারনে হয়তো আর কিছু স্থান পায় নি।দক্ষিনে রান্না ঘরের পাশেই পর্দা টানা একটা রুম।হয়তো বেডরুম।বসার ঘরের জানালা দুটোর পর্দা আর বেডরুমের পর্দার মধ্যে ভিন্নতা লক্ষ্য করল নীল।এমনটা কেন ভেবে পেল না।দিপেন সাহেবের স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করবে বলে ভাবলো নীল।
-চা নিন।
-ধন্যবাদ।
-বলুন আমার উপর কি রিচার্স করতে এলেন?
-আচ্ছা আমি যদি মনে মনে একটা সংখ্যা ধরি সেটা আপনি বলতে পারবেন?
-ধরুন।দেখি পারি কিনা। নীল মনে মনে কটা সংখ্যা ধরে জিজ্ঞেস করলো প্রতি বারই সে সঠিক বলেছে।বুঝতে পারলো মেয়েটির টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা খুব ভালো।
-আপনার কি কখনো এমন হয়েছে যে ঘুমোলেন একজায়গায় ঘুম থেকে উঠে নিজেকে আবিষ্কার করলেন অন্য জায়গায়?
-স্লীপ ওয়াকিং বা স্লীপ এপনিয়ার কথা বলছেন?
-জ্বী।
-নাহ।আমার সেরকম অসুখ নেই।চা টা কেমন হয়েছে?
-ভালো হয়েছে।
চা আসলেই ভালো হয়েছে নীলের আরেক কাপ খেতে ইচ্ছে করছে।সাথে সাথে অনামিকা রান্না ঘরের দিকে উঠে চলে গেল।নীল বুঝতে পারল অনামিকা জেনে গেছে সে আরেক চা খেতে চায়।
-এ নিন আরেক কাপ।
-ধন্যবাদ।
-আপনি অবাক হচ্ছেন তাই না?
-কিছুটা।
-আমি আগে থেকেই বুঝতে পারি।দিপেন মারা যাওয়ার আগেও বুঝতে পেরেছিলাম।
শেষ কথাটা নীলের মাথার উপর দিয়ে গেল।ঠিক তখনই হঠাত প্রচন্ড মাথা ব্যাথা শুরু হল।মস্তিষ্কের প্রতিটা রক্তনালী যেন ফেটে যাচ্ছে।হাতুড়ী দিয়ে মাথাটা ভাঙতে পারলে হয়তো কিছুটা শান্তি পাওয়া যেত। রাত ৩টা বাজে।নীলের ঘুম ভেঙেছে।শোয়া থেকে উঠে বসে বুঝতে পারলো সে দিপেন সাহেবের সোফায় শুয়ে ছিল।উত্তরের জানলা দিয়ে জোছনার আলো ঘরে ঢুকেছে।কাছে কোথাও থেকে বেলী ফুলের মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে।ঘুমন্ত চোখে আবছা আবছা জোছনার আলোয় দেখলো বেডরুমের দরজার সামনে স্থির মুর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে অনামিকা।
-আপনি ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
-আমি চলে যাচ্ছি।
-কোথায়?
-দিপেনের কাছে।
-কিন্তু…
-চিন্তা করবেন না।ভালো হয়ে যাবেন আপনি।সব ভূলে যাবেন,সব।
নীল স্পষ্ট লক্ষ করলো স্থির মুর্তিটা আস্তে আস্তে পর্দার আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে।নীল দৌড়ে গিয়ে পর্দার এপাশ ওপাশ সরিয়ে দেখলো।সেখানে কিছুই নেই।সারা বাসায় কাউকে খুঁজে পেল না নীল।আবার শুরু হল সেই প্রচন্ড রকমের জটিল মাথাব্যথা। সিটি হাসপাতালের পেশেন্ট বেডে শুয়ে আছে নীল।পাশে বসে আছেন তকরীমুল্লাহ সাহেব।
-আমি এখানে কেন?
-আপনি দুসপ্তাহ ধরে হাসপাতালে।
খুব অদ্ভুদভাবে শরীরের কোনো রকমের সমস্যা না থাকা সত্ত্বেও আপনি কোমায় ছিলেন এত দিন। তকরীমুল্লাহ সাহেবের কথায় নীল চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষন। শীতের রাত। কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে নীল।রাত ৩টা বাজে।হঠাতই ঘুম ভেঙে গেল তার।বেলি ফুলের মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে কোথাও থেকে।কিন্তু কোত্থেকে?তার ছাদে তোহ বেলী ফুল নেই।হঠাত দরজায় চোখ পরলো নীলের।জোছনার আলোই পরিষ্কার দেখতে পেল পর্দার আড়ালে কেউ স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।বিছানা থেকে নেমে-
-কে?পর্দার আড়াঁলে কে?