স্কুল থেকে এসে ফুলস্পিডে ফ্যান ছেড়ে ব্যাগটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলেই ক্লান্ত দেহটা এলিয়ে দিলাম বিছানায়। ইশ! কি প্রচণ্ড গরম! তার উপর রোজ রোজ এই স্কুলের ঝামেলা। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। গলার স্বর উঁচু করে চেঁচিয়ে বললাম, “মা, ক্ষুধা লাগছে ভাত দাও।” রান্নাঘর থেকে মা জবাব দিল, “দাঁড়া, বাবা। ভাত হয়ে গেছে, তরকারীটা হয়ে গেলেই ভাত বেড়ে দিব।” মায়ের কথা শুনে মেজাজ আরও তিরিক্ষে উঠে গেল। একে তো সকাল সকাল উঠে কোনোরকমে নাশতা খেয়ে দৌড় দিতে হয় স্কুলে, এক্সট্রা ক্লাস আর প্র্যাকটিকালের যন্ত্রণায় টিফিনটাও ঠিকমতো করতে পারি না।
সবকিছু মিলিয়ে যেন জাহান্নামে আছি। এখন বাসায় এসে শুনি মায়ের রান্নাটাও হয় নি। ঘর থেকে বের হয়ে পুরো রেগেমেগে বলে উঠলাম, “মা, তুমি না” বাকিটুকু বলার আগেই আমার কথা গলায় আটকে গেল। মায়ের দু’চোখ পানিতে টলমল করছে, একনাগাড়ে দ্রুত পেঁয়াজ কুঁচি কুঁচি করে যাচ্ছে, চোখে এতোটাই ঝাঁজ লাগছে যে চোখ মেলে তাকাতেও পারছে না। মা’কে দেখেই আমার বুকটা ধ্বক করে উঠল, মনে হলো পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে এই বুঝি বটিতে নিজের আঙুল কেটে রক্তারক্তি অবস্থা করে ফেলবে। আমি সাথে সাথে একরকম ছুটে গিয়ে মায়ের হাত ধরে ফেললাম। মা চমকে উঠে বলল, “কিরে বাবা? তুই এখানে কেন?”
– মা, তুমি এভাবে পেঁয়াজ কাঁটছো কেন?
-“কিভাবে কাঁটবো?” বলেই মা হেসে ফেললেন। আমি অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকালাম। “তুই ভাত খাবি না? এজন্যই তো তাড়াতাড়ি করছি। খেয়েই তো আবার কোচিংয়ে দৌড়াবি। যাহ, গোসলটা সেরে আয়।” মা আগুনের পাশে বসে কেমন দরদর করে ঘামছে! আমি নিজেই আগুনের উত্তাপ সইতে পারছি না, সেখানে মা এই গরমে এতক্ষণ ধরে বসে বসে রান্না করছে। রান্নাঘরে ছোট একটা ফ্যান আছে, কিন্তু চুলা জ্বলছে বলে সেটাও চলছে না। আর আমি কিনা সামান্য গরমেই হাঁপিয়ে যাই, কেমন অস্থির হয়ে উঠি!
-“মা, তুমি কি কিছু খাওনি?”
-“খাওয়ার সুযোগ পাচ্ছি না রে বাবা। সকালে নাশতা খেয়ে কাজে লেগে পড়লাম। তোর আজকে হলো কিরে?”
আমি মায়ের কথার জবাব দিতে পারলাম না। আমার একটু ক্ষুধা লাগলেই কেমন মেজাজ চড়ে যায়। আর মা কিনা সেই সকালে একটা রুটি খেয়ে ঘরের সমস্ত কাজ করে যাচ্ছে। মা আঁচল গুছিয়ে হাতের উপরে তুলতেই নজরে পড়ল, মায়ের কব্জির উপর দগদগে পোড়া ঘা।
– মা, তোমার হাতে এমন হলো কীভাবে?
-“আরে, ওইটা কিছু না। কাল ভাতের মাড় গালার সময় একটু লেগে গেছিল, তাই ফোস্কা পড়ে গেছে। সেরে যাবে।” মা চূলায় তরকারীর হাঁড়ি চাপিয়ে বলল।
মা খুব সহজেই বলে ফেলল এটা অনেক সামান্য ব্যাপার; কিন্তু মায়ের হাতের ঘা, আর তাতে আঁচলের স্পর্শেই মায়ের আর্তনাদ আমাকে স্পষ্টভাবে জানান দিচ্ছে এটা কোনো সামান্য ব্যাপার নয়। আমি মৃদু স্বরে বললাম, “মা, তুমি আমাকে বলোনি কেন? আমি স্যাভলন লাগিয়ে দিতাম।” মা আগের মতোই ব্যাপারটা উড়িয়ে দিয়ে বললেন, “তুই তো স্কুলে ছিলি। আর এ তো এমন কিছুই না।” আমি বেশ অবাক হলাম। সামান্য একটু ব্যথা পেলে আমি এখনও ঘাবড়ে যাই। সেখানে কিনা মা হাতের এই দগদগে ঘা নিয়ে ঘরের সমস্ত কাজ অবলীলায় করে যাচ্ছে!
-“মা, তোমার ব্যথা লাগে না?” মা তরকারীতে এক চামচ হলুদ দিয়ে বললেন, “নারে বাবা, ব্যথা নিয়ে বসে থাকলে হবে?”
-“আচ্ছা মা, তুমি যে প্রতিদিন ঘরের এত কাজ করো, তোমার একঘেয়েমী লাগে না? বিরক্ত লাগে না? কখনও ইচ্ছা করে না তোমার ছোট্টবেলার বান্ধবীদের দেখতে, তাদের সাথে চড়ুইভাতি খেলতে? তোমাদের গ্রামের সেই ছোট্ট নদীটাতে সাঁতার কাটতে? আমগাছের আম পেড়ে খেতে? তুমি কতোদিন এই বদ্ধঘরের বাইরে বের হয়ে ওই নীল আকাশটা দেখো না, বলো তো? তোমার কি একটুও ইচ্ছা করে না স্বাধীনভাবে নিজের জীবনটাকে একটু উপভোগ করবে? নিজেকে কেন এত কষ্ট দাও মা?”
আমার একনাগাড়ে এতগুলো প্রশ্নের জবাবে কিছুক্ষণ থমকে গেল যেন মা। দেখতে না দেখতেই তার টলমলে চোখ কানায় কানায় ভরে উঠল পানিতে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মা আস্তে আস্তে বলতে লাগল, “আমার তো অনেক কিছুরই ইচ্ছা হয় রে বাবা, আমি নারী হওয়ার আগে একজন মানুষ। আমার ইচ্ছা হয় সেই ছোট্টবেলার বান্ধবী লতার সাথে পুতুল বিয়ে, চড়ুইভাতি খেলি। ঝড় হলেই সকাল-সন্ধ্যা না মেনে বেরিয়ে পড়ি আম কুড়াতে, স্কুল ছুটি হলেই মায়ের হাতের গরম পিঠা খাওয়ার জন্য উনুনের পাশে বসে থাকি। বড় ইচ্ছা ছিল অনেকদূর পড়ালেখা করব, কলেজে পড়ব। কিন্তু স্কুলের গণ্ডি পেরুতে না পেরুতেই বাবা বিয়ে দিয়ে দিল। সেই থেকে এই সংসারই আমার আরেক দুনিয়া হয়ে গেল। তুই কোলে আসার পর তোকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে গেলাম। আমি তো মানুষ, আমারও ব্যথা লাগবে, ক্ষুধা লাগবে, অস্থির লাগবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি ভেঙে পড়লে তোদের কে দেখবে রে বাবা? তাই তো, আমি সবকিছু সয়েই তোদের ভালোর জন্যই পরিশ্রম করে যাই। তোরা যখন খেয়ে তৃপ্তি পাস, তোদেরকে যখন যত্নে রাখতে পারি তখন এসব কষ্ট আর কষ্ট মনে হয় না রে বাবা।
মনে হয় মা হয়ে আমি স্বার্থক। আমার আকাশ দেখতে বড্ড ইচ্ছা হয় রে শহিদ, তাই বলে বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি তো তোর মাঝেই আমার অসীম আকাশে শান্তি খুঁজে পাই। তোরা সবাই খুশি, তো আমি খুশি।” বলেই মা হাসল। মায়ের দু’চোখভর্তি অশ্রু, কিন্তু মুখভর্তি হাসি। মা’কে কেমন অন্যরকম লাগছে, যেনো বহু অচেনা। কত সহজভাবেই না মায়েরা বুকের মাঝে হাজারও কষ্ট, ইচ্ছা আর স্বপ্নকে চাপা দিয়ে, নিজের স্বাধীনতাকে বলি দিয়ে আমাদের মুখে হাসি ফুটানোর জন্য নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে। মায়ের মতো অমূল্য উপহার আর কিছুই হয় না।