লেডিস পার্লারের ভিতর যদিও পুরুষের প্রবেশ নিষেধ কিন্তু আমাকে ঠিকিই ঢুকার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। দেওয়া কারণ হলো আমার স্ত্রী শ্রাবণী।পাশের ফ্ল্যাটে ভাবী না কি শ্রাবণীকে বলেছে, নাকফুল না পড়লে স্বামীর অমঙ্গল হয়। তাই সে নাক ছিদ্র করতে পার্লারে এসেছে। কিন্তু পার্লারের মেয়ে যখন ওর নাক ছিদ্র করতে যায় তখনি সে জোরে চিৎকার করে। তাই আমাকে বাধ্য হয়ে ভিতরে ঢুকতে হয়েছে। ভিতরে ঢুকে দেখি ভয়ে শ্রাবণীর সারামুখ লাল হয়ে গেছে। আমাকে দেখেই কান্না করতে করতে বললো,
– আমি যদি নাক ছিদ্র করতে গিয়ে মারা যায় তাহলে কিন্তু তুমি দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারবে না।যদি করো তাহলে কিন্তু আমি ভূত হয়ে তোমার ঘাড়ে চেপে বসবো শ্রাবণীর এমন ছেলেমানুষী কথা শুনে পাশে বসা ভদ্রমহিলা মুচকি হেসে বললো,
~ প্রেমের বিয়ে না কি? আমিও মাথা চুলকাতে চুলকাতে মুচকি হেসে বললাম,
— জ্বি….
আজ ২ বছর পর আমি শ্রাবণীর হাত ধরে বসে আছি। ওর কপালের নীল রগটা ভেসে উঠছে। চোখের কোণ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে কিন্তু মুখে একটা মিষ্টি হাসি লেগে আছে। ওর এই চেহারার দিকে তাকিয়ে খুব অবাক হচ্ছি। কয়েকদিন আগেও যে মেয়েটা মুখে একটা ব্রুণ হলে সেই ব্যথাটা সহ্য করতে পারতো না। আজ সেই মেয়েটা খুব সহজেই প্রসব ব্যাথাটা হাসি মুখে সহ্য করছে।
মাতৃত্ব খুব অদ্ভুত রকম জিনিস। একটা মেয়ে মা হলে কতটা যে পরিবর্তন হয়ে যায় তা শ্রাবণীকে না দেখলে বুঝতাম না। যে মেয়েটা খুব খুঁতখুঁতে ছিলো, ময়লা কিছু দেখলেই যার গা শিরশির করতো সেই মেয়েটা এখন অনাহাসে সন্তানের পায়খানা পরিষ্কার করতে পারে। যে মেয়েটার গায়ে একটু ময়লা লাগলে সাথে সাথে গোসল করতো সেই মেয়েটার জামা এখন সবসময় অর্ধেকটা ভেজা থাকে সন্তানের প্রস্রাবে…
আমি আমার মেয়ে নাযাহাকে আমার বুকের উপর বসিয়ে খেলছিলাম। হঠাৎ আমার মেয়ে আধো আধো গলায় বললো, বাবা আমি আবারও খেয়াল করে শুনলাম আমার মেয়ে বলছে, বাবা আমি সহজে কাঁদি না। এমন কি খুব বেশি কষ্ট পেলেও আমার চোখ দিয়ে একফোঁটা জল বের হয় না কিন্তু আমার মেয়ের মুখ থেকে প্রথম বাবা ডাকটা শুনার পর আমি আমার মেয়েকে জটিয়ে ধরে কেঁদেছি। টিকা দেওয়ার সময় যখন ডাক্তার আমার মেয়ের শরীরে ইঞ্জেকশন দিচ্ছিলো তখন মনে হচ্ছিলো কেউ আমার হৃৎপিন্ড ছিদ্র করে ফেলছে আমার মেয়ে রাতে ঘুমালে আমি আমার মুখটা আমার মেয়ের কাছে নিয়ে যায়। মেয়ের মুখের গরম নিঃশ্বাসটা যখন আমার মুখে পড়ে তখন নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হয়।
আমার মেয়ের শরীর একটু খারাপ হলে আমি সারারাত ঘুমাতে পারি না। সারা রাত আমি আমার মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে থাকি শ্রাবণী ঘুমাচ্ছে আমি আমার মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে বসে ভাবছি, আচ্ছা শ্রাবণীর বাবাও হয়তো শ্রাবণীকে এমনটাই ভালোবাসতো যেমনটা আমি আমার মেয়েকে ভালোবাসি। আমার মেয়ে যদি কোনদিন একটা অচেনা ছেলেকে নিয়ে এসে বলে, বাবা আমি ওকে ভালোবাসি। আমি তো কখনোই হুট করে মেনে নিবো না। তারপর সেই ছেলেটা যদি আমার মেয়েকে ইমোশনালি কিছু কথা বার্তা বলে আমার মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যায় তখন তো সেই ছেলেটার প্রতি আমার রাগ থাকবে এটাই স্বাভাবিক না আমি আর ভাবতে পারছি না। এই মুহূর্তে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ মনে হচ্ছে। ৪ বছর আগে আমি ঠিক এভাবেই শ্রাবণীর বাবা থেকে শ্রাবণীকে আলাদা করেছিলাম। এখন নিজে মেয়ের বাবা হওয়ার পর বুঝতে পারছি আমি সেদিন শ্রাবণীকে নিয়ে পালিয়ে কত বড় ভুল করেছিলাম আর কতটা কষ্ট দিয়েছিলাম শ্রাবণীর বাবা মাকে সকাল ৫ টা বাজে। আমি শ্রাবণীকে ঘুম থেকে ডেকে বললাম,
— তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও তো। শ্রাবণী ঘুম ঘুম চোখে বললো,
-এত সকালে কোথায় যাবো?
— ময়মনসিংহ যাবো আমার কথা শুনে শ্রাবণী অবাক হয়ে বললো,
– ময়মনসিংহ কার এখানে যাবে? আমি জুতার ফিতা লাগাতে লাগাতে বললাম,
— কোথায় আবার, তোমাদের বাসায় যাবো..
– কিন্তু বাবা…
— তোমার বাবার ১ পায়ে তুমি আরেক পায়ে আমি ধরে বসে থাকবো। আশা করি ৪ মিনিটের মাথায় তোমার বাবা আমাদের ৪ বছরের পাপ মাফ করে দিবেন শ্বশুর বাড়ি যাবার পর শ্রাবণী যখন ওর বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে থাকে তখন শ্রাবণীর বাবা শ্রাবণীকে বললো,
~দিলি তো আমার কুচকে যাওয়া পাঞ্জাবিটাকে আরো কুচকে। তুই মা চলে যাওয়ার পর আমি প্রতিদিন ভেবেছি তুই কোন একদিন আমার কাছে এসে বলবি, বাবা তুমি কেন কুচকে যাওয়া পাঞ্জাবি পড়ো? আমি তখন আগের মত হাসি মুখে বললো, ভুল হয়ে গেছে মা। দে পাঞ্জাবিটা একটু আয়রন করে দে আমি আমার মেয়েকে দিকে তাকিয়ে আছি। এমন সময় শ্বশুর আমার মাথায় হাত রাখলে আমি কান্না ভেজা চোখে আমার শ্বশুরকে বললাম,
— বাবা, আমিও মেয়ের বাবা হয়েছি..