খুব আলগোছে বিছানা থেকে উঠল শ্রাবন্তী। বাইরে চাঁদের আলোতে বন্যা বয়ে যাচ্ছে। জানালা দিয়ে আলো ঢুকে পড়ে ঘর ভাসিয়ে নিয়ে যাবে যেন! ঘন্টা খানেক ধরে ঘুমের সাথে এপাশ ওপাশ যুদ্ধ করে আর শুয়ে থাকতে ইচ্ছে হল না। এখন বিছানায় যুদ্ধ শুধু বিছানার সাথেই হয়! ভাবতে বেশ অবাক লাগে শ্রাবন্তীর। পা টিপে টিপে বারান্দার দরজাটা খুলে টুক করে বাইরে চলে আসল। জোছনার একটা ঘ্রাণ আছে। এমন পূর্ণিমার রাতগুলোতে মাঝরাতের পর চাঁদের আলোতে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে খুব গভীর করে শ্বাস নিলে পায় ও। অদ্ভুত ভাল লাগায় মন ভরে যায়। যদিও শ্রাবন্তীর মনে এখন ঝড় বইছে … আসলে মনে নয়। শরীরে। নাকি ঝড় শুধু মনেই বয়। কি জানি! আগে বড়রা বলত পূর্ণিমা রাতে নাকি নেকড়ে আর মেয়েদের শরীর জেগে উঠে। শ্রাবন্তীর দাদী এগুলা বলত আর ফিক ফিক করে হাসত। দাদী নেকড়ের কথা কেমন করে জানে এখনো সেটা শ্রাবন্তী ভেবে পায় না। নেকড়ের শরীর জাগে কিনা শ্রাবন্তী না জানলেও ওর নিজের শরীর যে জেগে উঠে সেটা ও জানে!
আজ পূর্ণিমা। ভরা পূর্ণিমা। পাশের কারো বাড়িতে হাসনাহেনা গাছ লাগিয়েছে। মাতাল করা ঘ্রাণ ভেসে আসছে। শ্রাবন্তীর মনে হল ওই ঘ্রাণে ওর শরীরের জ্বালা পোড়া আরো বেড়েছে। নাহ,এখানেও থাকা যাবে না। রুমে ফিরে এসে টেবিলের উপর রাখা এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে খেয়ে ফেলল। গলা একেবারেই শুকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ জেগে থাকায়।
আধো আলোতে ভাল করে ওদের খাটের দিকে দেখল। কাওসার ঘুমাচ্ছে। মোটামুটি সুর করেই নাক ডাকছে। আর ওদের মেয়েটাও ঘুমাচ্ছে বাবার পেটের কাছে। কি দারুণ মায়াময় এক দৃশ্য! কাওসার এর শরীর এখনো পেটানো। চওড়া বুক। পেট অল্প ফুলেছে। কিন্ত কুমড়া শেইপ ধরেনি এখনো। শ্রাবন্তী ঘরের দুইটা লাইটের একটা জ্বালাল। এটা ওদের মাথার দিকের দেয়ালটায় লাগানো। কাওসার এর চোখে সরাসরি আলো পড়বে না। আর ওরা বাবা মেয়ে যেমন আরাম করে ঘুমাচ্ছে, ওদের চোখে টর্চের আলো ফেললেও জাগবে কিনা শ্রাবন্তীর সন্দেহ আছে। কাজেই সাহস করে লাইটটা জ্বালিয়েই ফেলল। টেবিলে রাখা ল্যাপটপটার দিকে এগুতে গিয়েই পাশের ড্রেসিং টেবিলটার দিকে নজর গেল। নিজের দিকে তাকিয়ে আরেকটা মুচকি হাসি আসল ঠোঁটের কোণায়। প্রায় বিধ্বস্ত একজন নারী। আটত্রিশে পা দিবে আর কয় মাস পরে। অথচ এখনি কেমন বুড়িয়ে গেছে। কি মনে করে ড্রেসিং টেবিলটার সামনে এসে দাঁড়াল শ্রাবন্তী। নিজের সাথে কথা বলতে চায় যেন। খুব ভাল করে নিজের মুখটা দেখতে থাকল। মুখের চামড়ায় নানান জায়গায় ভাঁজ এই অল্প আলোতেও দেখা যায়। ঘাড়ের কাছে আগের সেই রেশমী চুলের গোছা নেই এখন আর। চুল কমে গিয়ে এখন খোঁপা করতেই কষ্ট হয়। চুল সরিয়ে ঘাড়ের কাছটায় আলতো করে হাত বুলালো। কাওসার বাইরে থেকে ফিরেই আগে এখানে একটা চুমু খেত। নাক ডুবিয়ে রাখতো অনেক ক্ষণ! বলতো,তোমার ঘাড়ের কাছটায় কাঠগোলাপের নরম ঘ্রাণ পাই আমি! আর এখন শ্রাবন্তীর ঘাড়ে দুইটা কালো কালো বৃত্ত জন্মেছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় ময়লা লেগে আছে। অথচ বহু কসরত করেও এই দাগগুলো উঠাতে পারেনি। বডি সাইজ আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকল শ্রাবন্তী। কেমন যেন নেশা ধরে যাচ্ছে। কেমন যেন রাগ হচ্ছে। রাগের নেশা। কেমন করে কিছু বুঝে উঠার আগেই বুড়িয়ে যেতে শুরু করল ওর শরীর!?
একটানে শাড়ী খুলে ফেলতে থাকল শ্রাবন্তী। এক এক করে শরীরের সব কাপড় খুলে ফেলল। নেশা পেয়ে গেছে। খুনে নেশা। আড়চোখে একবার ঘুমন্ত বাবা মেয়েকে দেখে নিল। ওদের বড় মেয়েটা পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছে। একবার দেখে এসেছিল শু’তে যাওয়ার আগে। বড় মেয়েটা এবার সাত পেরিয়ে আটে পা দেবে। বড় মেয়ের জন্মের আগেই গাইনীর ডাক্তার ফারহানা হক জানতে চেয়েছিলেন ওরা কেমন ডেলিভারী চায়। নর্মাল নাকি সিজারিয়ান। শ্রাবন্তী ওদের পাড়ার দুইজন আন্টির ডেলিভারীর সময় উনাদের সাথে ছিলেন। আগে ঘরে দাইমা ডেকে ডেলিভারী করানো হত। শ্রাবন্তী দেখেছে কেমন কষ্ট হয়। ওর মনে ভয় ঢুকে গিয়েছিল। সেজন্য ও নিজেই সিজারিয়ান বেছে নেয়। অনেকদিন পর এর কুফলটা টের পায়। ওর তলপেটের নীচে সেই কাটা দাগটা স্থায়ী হয়ে লেগে গেছে। সাথে তলপেটে এক তাল চর্বি আটকে গেছে যেন। অনেক চেষ্টা করেও এর হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। আস্তে আস্তে নিজের তলপেটে হাত বুলায় শ্রাবন্তী। ওর বুক ফেটে কান্না আসছে যেন। বড় মেয়ের জন্মের আগে এই জায়গাটা কত সুন্দর ছিল কাওসার কেমন করে পাগল হয়ে যেত!! এরপর ছোট মেয়ের জন্মের সময় শ্রাবন্তীর শরীর আরো ভাঙ্গে। নিজের বুকের দিকে তাকানোর সাহসই পেল না শ্রাবন্তী! ও জানে সেদিকে তাকালে ও কি দেখতে পাবে! গায়ে কাপড় পরেনা ও তাকিয়ে থাকে।তিন মাস হয়ে গেল কাওসার ওর গায়ে একবারের জন্যেও ভালোবাসার স্পর্শ করেনি। ছুঁয়েও দেখেনি। অথচ আগে একটা দিনও শ্রাবন্তীকে কাছে না পেয়ে থাকতে পারত না ও। আরো বিধ্বস্ত মনে গায়ে কোন রকমে কাপড় জড়িয়ে আবার বারান্দায় আসে শ্রাবন্তী। এখন এই বারান্দাটা-ই ওর না-ঘুম রাতের আশ্রয়।
ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘগুলাতে চাঁদের আলো পড়ে কেমন রুপালী তুলার দলের মত দেখাচ্ছে। অদ্ভুত সুন্দর। একদম দূরের দিকে খানিক নীলচে আঁধার। শ্রাবন্তী এর আগেও খেয়াল করেছে চাঁদনী রাতগুলোর আঁধারটা পুরোপুরি কালো হতে পারে না। কেমন যেন নীলচে নীলচে একটা আবহ থাকে। বারান্দার গ্রিলটা ধরে ভাবতে থাকে। অগোছালো ভাবনা। আচ্ছা, ও আর কাওসার তো প্রায় একই বয়সী। ক্লাসমেট ছিল ওরা কলেজে। সেখান থেকেই প্রেম। পরে সত্যিকারের জন্মদিন হিসেব করে দেখেছে কাওসার ওর চেয়ে আট মাস ষোল দিনের বড়। তবু কাওসার এর শরীর এখনো কেমন পোক্ত। কোন দাওয়াতে গেলে অনেকেই ওদের নিয়ে আড়ালে কানাকানি করে। শ্রাবন্তীকে নাকি কাওসার এর খালা মনে হয়। শ্রাবন্তী জানে। কিছু বলে না। ইদানিং কাওসার শ্রাবন্তীর সাথে আর ছবিও তুলতে চায় না। এটাও শ্রাবন্তী বোঝে। সব বুঝেও সহ্য করে নিতে হয়।হঠাৎ শ্রাবন্তীর মনে হল এই মা হওয়ার দায় কেন ওকে একাই মেটাতে হচ্ছে? কেন সব দায় মেয়েদেরই মেটাতে হয়? শরীরে, মনে। কেন ভাটার টান শুধু নদীর এক পাড়েই ভাঙন ধরায়!?