রাতে মোবাইলে এলার্ম দিয়ে রেখেছিলাম। সকাল ছয়টার দিকে একবার বেজেছিলো বটে। ঘুমের মোহে এতটাই ব্যাকুল ছিলাম যে, এলার্মটা বন্ধ করে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সময় যখন সাতটা ছুঁই ছুঁই তখন রুমমেট নাঈম ডেকে বললো, গুরু তোমার না ভার্সিটিতে কী একটা কাজ আছে? আমি ঘুম জড়ানোর চোখে একবার তাকিয়ে বললাম, কী কাজ? সে আমার শরীর থেকে কাঁথাটা টান দিয়ে বললো, তুমিই তো গতকাল রাতে বলেছিলে “তোমাকে যেন সকাল সকাল ডেকে দেই।” তার কথা শুনে তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে উঠে বললাম, কয়টা বাজে? সে বললো, ছয়টা বেজে সাতান্ন মিনিট।
“আরও আগে ডাকলে না কেন?”
“ঘুমে ব্যাঘাত ঘটতো, তাই আর ডাকিনি।”
“বাহ, এই না হলে আমার রুমমেট।”
ফ্রেস হয়ে এসে শার্টটা গায়ে জড়িয়ে চশমাটা চোখে দিয়ে ঘড়িটা পড়তে পড়তে বাসা থেকে বের হলাম। “গুরু, ঐ গুরু। গুরু পেছনে তাকিয়ে দেখি রাসেল নামে এলাকার এক ছোট ভাই ডাকছে আমাকে। সাথে কয়েকজন পুলিশও রয়েছে। আমি এগিয়ে যেতেই আবির বলে উঠলো, শ্রাবণ তুই? আমি বললাম, এই থানাতে কবে ট্রান্সফার হয়েছিস?
“এইতো দিন দশেক হবে।”
“বলিসনি কেন?”
“আরে আমি কী জানতাম যে…”
“আচ্ছা বাদ দে, এখন কী হয়েছে সেটা বল।”
“এই ছেলেকে চিনিস?”
“হ্যাঁ, চিনি তো। এর নাম রাসেল।”
রাসেল আমাকে বললো, গুরু দেখো না ওরা আমাকে হুদাই ধরে রেখেছে। আবির ধমক দিয়ে বললো, “চুপ, একদম চুপ। কোনো কথা বলবি না।” আমি আবিরকে বললাম, কী করেছে ও?
“মেয়েদের টিজ করছিলো।”
“কিরে? মেয়েদের টিজ করছিলি?”
“না গুরু, বিশ্বাস করো। আমি কোনো টিজ করিনি।”
“তাহলে কী পুলিশ তোকে এমনি এমনি ধরেছে?”
“আরে গুরু এরা তো ঘুসখোর, কিছু টাকার জন্য এরা সবার সাথেই এমন করে।”
শার্টের হাতাটা গুছিয়ে কষে একটা থাপ্পড় দিলাম তাকে। “বেয়াদব, মেয়েদের টিজ করিস। আর পুলিশ ধরলেই পুলিশের দোষ।” ছেলেটি রেগে গিয়ে বললো, “মাহিন ভাইকে চিনিস? তোর খবর আছে। মুক্তবাংলার সামনে দিয়ে যাইস একবার।” “থানা থেকে ছাড়া পেয়ে বাসায় গিয়ে তোর মাহিন ভাইকে বলিস, গুরুর সাথে দেখা করতে।” “আবির তুই ওকে থানায় নিয়ে যা। কিছুদিন রেখে ছেড়ে দিস।” “গুরু তুমি আজ বাইক নিয়ে বের হলে না কেন?” “আসিফ, তুই হঠাৎ?” “তোমাদের কলেজে নাকি আজ প্রোগ্রাম আছে? সেখানেই যাচ্ছি।” “গুড, যা তবে।” “না, আমি তোমার সাথে যাবো।” “আরে আজকে আমি বাসে করে যাবো। যেতে পারবি লোকাল বাসে?” “গুরু যেখানে পারবে, সেখানে আমি কেন পারবো না? নিশ্চয়ই পারবো।
মিরপুর-১ এর বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ফার্মগেটে যাওয়ার মতো কোনো বাসই দেখছি না। হঠাৎই আসিফ বলে উঠলো, গুরু ঐ যে “নিউ ভিসন” চলে এসেছে। চলো উঠে পড়ি। “হুম চল।” দু’জনে উঠে পড়লাম বাসে। অনেকগুলো সিট খালি পড়ে আছে। আমি আসিফকে মাঝখানের দুইটা সিট দেখিয়ে বললাম, ওখানে বসে পড়। আসিফ জানালার পাশে গিয়ে বসলো। আর আমি তার পাশে বসলাম।
“এই শ্যামলী, কল্যাণপুর, ফার্মগেট, সদরঘাট। এই আসেন, আসেন।” পেছন থেকে একটা ছেলে বলে উঠলো, কিরে আর কত লোক লাগবে তোর? সিট তো সব বুকই হয়ে গেছে।” “মামা বাড়তি কিছু লোক উঠাইলে আমাদের এক্সট্রা কিছু ইনকাম হয়।” “সিটিং সার্ভিসকে লোকাল বানাইয়া ফেলছস একেবারে।” কন্ট্রাক্টর লোকটি আর কোনো কথা বললেন না। লোকটির বয়স আনুমানিক চল্লিশের উর্ধ্বে হবে। আর পেছনের ছেলেটি সম্ভবত ইন্টারমিডিয়েটে পড়ে। দু’জনের কথা বলার ধরণ দেখে পেছনের ছেলেটিকে মোটেও শিক্ষিত মনে হলো না। “আপনি এবং তুই” এই সম্বোধন দু’টিই একজন শিক্ষিত আর অশিক্ষিত ব্যক্তির মধ্যেকার পার্থক্য।
বাস লোকজনে পরিপূর্ণ হয়ে গেলে ড্রাইভার বাস ছেড়ে দিলেন। টেকনিক্যালের গোল চত্বরের মাথায় এসে একবার বাস থামলে চেকার বাসে উঠলেন। “মামা আমি স্টুডেন্ট।” “মামা আমিও স্টুডেন্ট।” “যারা যারা স্টুডেন্ট আছো, তারা তারা হাত তুলো। আর কার্ড দেখাইয়ে হাফ ভাড়া দেবে।” অনেকেই হাত তুললো। দেখলাম আসিফও হাত তুলেছে।
শ্যামলিতে কয়েকজন নেমে গেলেন। সাথে নেমে যাওয়া ব্যক্তিদের তুলনায় আরও দু’চারজন অধিক ব্যক্তি বাসে উঠলেন। এর মধ্যে একজন মহিলাও ছিলেন। তার বয়সের কথা বলতে গেলে চেহারার মধ্যে কিছুটা বার্ধক্যের ছাপ পড়েছে। কোনো সিট খালি না থাকায় তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন। বাস আবারও চলতে শুরু করলো। বাসের মধ্যে পা ফেলানোর জায়গা পর্যন্ত নেই। মহিলাটিকে যে নিজের সিট ছেড়ে দিয়ে বসতে বলবো, তারও কোনো উপায় নেই। কেননা তিনি আমার থেকে কিছুটা সামনে রয়েছেন। আমি আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মুরুব্বি গোছের লোকটিকে আমার সিটে বসতে বললাম। তিনি কোনো প্রকার সংকোচ না করে বসে পড়লেন। দেখলাম সামনের সিটের এক বড় ভাইও তার নিজের সিটটা ছেড়ে দিয়ে মহিলাটিকে বসতে দিলেন।
বাস প্রায় আসাদগেটের কাছাকাছি। ঠিক সেই মুহূর্তে মহিলাটির পাশে বসে থাকা একটি মেয়ের উঁচু গলায় কথা বলা শুনতে পেলাম। মেয়েটি তার পাশে বসে থাকা মহিলারটির পাশে দাঁড়ানো, সিট ছেড়ে দেওয়া সেই বড় ভাইকে আচ্ছামতো বকে চলেছে। বাসের অন্য সবার দৃষ্টি তখন ঐ মেয়েটির দিকে। সে বড় ভাইটিকে বলছে, মেয়ে মানুষ দেখলেই গায়ে ধাক্কা দিতে মন চায়, ঘষাঘষি করতে মন চায়, তাইনা? ছেলেটি কথাটার প্রতিবাদ করতে একটি কথা বলতেই মেয়েটি তাকে হাজারটা কথা শুনিয়ে দিচ্ছে। “লুচ্চা, বেহায়া ছেলে কোথাকার?” আমি ভাইটিকে বললাম, কী হয়েছে ভাই?
“এইযে দেখুন না, বাসের মধ্যে এতো ভীড় থাকলে একজনের গায়ের সাথে অারেকজনের গা লাগতেই পারে। তাই বলে কী সে খারাপ হয়ে গেলো?” মেয়েটি ছেলেটির কথা শুনে বললো, আমি নিজের চোখে দেখলাম আপনি ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়েছেন। আবার বেশি বেশি কথা বলছেন। এসব ছেলেরা বাসেই ওঠে এসবের জন্য।” আমি মেয়েটিকে বললাম, এইযে ম্যাডাম। সে আমার কথার কোনো গুরুত্ব না দিয়ে ছেলেটিকে বকেই চলেছে। আমি ছেলেটিকে বললাম, ভাই আপনি চুপ থাকুন। আমি দেখছি বিষয়টা। মেয়েটির অমন উশৃঙ্খল আচরণে বাসের অন্যসব যাত্রীরাও বলছেন, এই ছেলেটির কোনো দোষ নেই। সে কোনো খারাপ কিছু করেনি।
আমি মেয়েটিকে বললাম, এইযে ম্যাডাম। হ্যাঁ আপনাকেই বলছি। চুপচাপ সিটে বসে থাকুন। আর একটা কথা বললে বাস থেকে নামিয়ে দেবো। কী পেয়েছেন আপনি? আপনি ইচ্ছে মতো হাত বানানো ঘটনা তৈরি করে একটা ছেলেকে অপমান করবেন। আর সে তা মেনে নেবে? আর কী যেন বলছিলেন? এই মহিলাটিকে এই ছেলেটি ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়েছেন? আচ্ছা মানলাম, তিনি ইচ্ছে করেই ধাক্কাটা দিয়েছেন। কিন্তু মহিলাটি কি কোনো কিছু বলেছেন?
আমি এবার মহিলাটিকে উদ্দেশ্য করে বললাম, আন্টি এই ছেলেটি কি আপনাকে ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়েছেন?
তিনি বললেন, না।
এবার আমি মেয়েটিকে বললাম, শুনেছেন আপনি আন্টি কি বললেন? আর আপনার একটা বোধগম্য জ্ঞান থাকা উচিত যে, এই ছেলেটি মহিলাটির বসার সুবিধার্থে নিজের সিটটা ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। যদি তার মনে কোনো কু-মতলব থাকতো, তবে তিনি তার সিটটা ছেড়ে দিয়ে এই আন্টিকে বসতে বলতেন না। আবার আপনি এই ছেলেটি আর এই আন্টিটির বয়সের দিকে খেয়াল করে দেখুন। আমি যদি ভুল না করি, তবে বলতে পারি “ছেলেটির বয়সী এই আন্টিরও একটি ছেলে আছে।”
মেয়েটা কিছু একটা বলার জন্য হাতের আঙ্গুল উঁচু করতেই আমি একটা ধমক দিয়ে বললাম, চুপ থাকতে বলছি না? আর আপনি এসব কী পোশাক পড়েছেন হ্যাঁ? এসব পোশাক ছেড়ে বোরকা পড়ে চলাফেরা করুন। নিচের কাপড়টা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে আপনার। মেয়েটি একদম চুপসে গেলো। বাসের সকল যাত্রী মেয়েটির বিপক্ষে। আমি ভাইটিকে বললাম, “বৃদ্ধ, সে নারী হোক বা পুরুষ, অসুস্থ ব্যক্তি এবং পর্দাশীল নারীর জন্য নিজের সিটটা ছেড়ে দিবেন। কিন্তু কখনও মানবতা দেখাতে গিয়ে এরকম মেয়েদের জন্য নিজের সিটটা ছেড়ে দেবেন না। এসব মেয়েরা আড়ালে মারা দিয়ে জনসম্মুখে নৈতিকতা দেখায়।”
“এই ফার্মগেট, ফার্মগেট। নামেন নামেন। ফার্মগেটের যাত্রীরা নামেন।” আমি আর আসিফ নেমে পড়লাম বাস থেকে।
“গুরু ফাটিয়ে দিয়েছো একদম।”
“হুম, চল। অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গিয়েছে বোধ হয়।”
“কেবল সাড়ে আটটা বাজে।”
“বাজুক। তার আগে চল নাস্তা করে আসি।”
“হুম, চলো।”
আসিফকে সাথে নিয়ে জামাল মামার চায়ের দোকানের দিকে রওনা দিলাম। দু’জনে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছি। ঠিক সেসময় অনুরাধা এসে বললো, কী গুরু? চা কি একাই খাবে? নাকি আমরাও কিছু পাবো? তার পেছনে তাকিয়ে দেখি সে তার বান্ধবীদেরও সাথে করে নিয়ে এসেছে। এর মাঝে শিহাব কল করে বললো, শ্রাবণ দ্রুত অডিটোরিয়ামে চলে আয়। আমি বললাম, কেন? কী হয়েছে?
“আরে বেটা অডিটোরিয়াম এখন আমাদের দখলে। সবার সামনে আমি এখন সুহানাকে প্রপোজ করবো। তুই এলে একটু বেশি সাহস পেতাম।”
“ঠিক আছে। একটু অপেক্ষা কর, আসছি আমি।”
“অনুরাধা অডিটোরিয়ামে যাবি?”
“কেনরে? কী হয়েছে?”
“শিহাবের ছেলেমানুষি দেখবি চল।”
“হুম, চল।” চা’য়ের বিল মিটিয়ে শিহাবের প্রপোজ দেখতে আমরা অডিটোরিয়ামের দিকে রওনা দিলাম।