– অনু, এবার আমরা একটা মহিষ কিনি?
– না, গরু ই দাও।
– কিন্তু তুমি যে গরু খাও না। তাহলে তোমার জন্য একটা ছাগল কিনব।
– না। এটা অপচয় হবে। আমার জন্য একটা মুরগি হলে হবে।
আমার শশুড় বাড়িতে এটা প্রথম কোরবানির ঈদ। বিয়ের আট মাস হতে চললো। রাফি আমার স্বামী, সকাল থেকে পিছু লেগেছে মহিষ কেনার জন্য। শুধু আমার জন্য মহিষ কোরবানি দিতে চাচ্ছে। এ বাড়ির সবাই গরুর মাংস পছন্দ করে শুধু আমি ছাড়া । আমি চাই না আমার জন্য এত্তগুলো মানুষের ঈদ টা খারাপ যাক। আমি গরুর মাংস খাই না এটা একান্তই ব্যক্তিগত ব্যপার এর জন্য সবার রুচি পরিবর্তন করতে পারি না। এই গরুর মাংস দেখলেই আমি অতীতে ফিরে যাই।
আমি প্রথম গরুর মাংসের স্বাদ পাই চৌদ্দ মাস বয়সে। আমার জীবনের প্রথম কোরবানির ঈদে। আমাদের ঘরে নাকি কোরবানির ঈদে ভালো মতো গরুর মাংস খাওয়া হতো। শবে কদর, শবে বরাত, মহরম এই দুই তিন ফাতেহা বা পবিত্র রাতে আব্বা গরুর মাংস আনত। সারা বছর গরুর মাংস কল্পনাতেও আসত না অভাবের সংসারে। ফাতেহার দিন সকাল থেকে আমরা দুই বোন ঈদের খুশিতে থাকতাম । আম্মার পেছনে ঘুর ঘুর করতাম। আম্মা দুই বাড়ির পরের বাড়িতে যেতেন চাল নিয়ে। ওটা ছিল মেম্বার এর বাড়ি, ওদের ঢেঁকি ছিল। চার চালা ঘরের একপাশের বারান্দায় ছিল ঢেঁকিটা। পৌষ পার্বণে ফাতেহাতে পাড়ার বৌদের লাইন পড়ে যেত এই বারান্দায়। আসলে লাইন না বলে আড্ডা বলা যেতো। সব বৌয়েরা কাজের ফাঁকে আড্ডা দিতেন। আমি আম্মার সাথে প্রতিবার যেতাম। ছোট্ট থাকতে আমাকে ফেলে আসতে পারতেন না তাই আনতেন অবশ্য আমাকে আনলে আম্মার লাভ। ঢেঁকির গোড়ায় চাপ দিতে আম্মার একটু সমস্যা হতো। উনার শরীর হালকা ছিল তাই উনার ভর ঢেঁকির গোড়ায় লাগত কম। আমাকে কোলে নিলে উনার ওজন সামান্য বাড়ত।
ঢেঁকির গোড়ায় ক্রমাগত চাপ দেওয়ার একটা ছন্দ বা তাল ছিল। সেই তাল আমি খুব উপভোগ করতাম। তালে তালে একসময় আমি ঘুমিয়ে যেতাম আম্মার কোলে। আম্মার চাল যে মহিলা মুষলের আঘাতের ফাঁকে ফাঁকে গর্ত থেকে নেড়ে তুলে দিতেন, উনার চাল বা ধান ও আম্মা চাপ দিতেন। এতে করে একটানা লম্বা সময় ছন্দের তালে ঘুমাতে পারতাম। আম্মা আমাকে ঘরে এনে বিছানায় রেখে দিতেন। বিছানা বলতে মাটির উপরে চাটাই তার উপরে কাঁথা বা ছেঁড়া শাড়ি বিছিয়ে রাখা। আমি ঘুমে থাকতেই আম্মা চালের রুটি তৈরি করতেন। আব্বা গরুর মাংস আনতে আনতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতো। আম্মা মাংস চুলায় বসালে আমার ঘুম ভাঙ্গত, হয়তো গোশতের ঘ্রাণে অথবা ক্ষিধে পেয়ে । ধড়পড় করে উঠে দৌড়ে রান্না ঘরে গিয়ে আম্মার গা ঘেঁষে বসতাম। রেনু হওয়ার পর থেকে ও আমার গা ঘেঁষে দাঁড়াতো। আব্বা ঘরের ভেতর থেকে একটু পর পর তাগিদ দিতেন
– কই তোমার হলো?
– মাত্র চুলায় বসালাম। তার উপরে ঘরে লাকড়ী বলতে কিছু নাই, ভিটে থেকে পাতা, ডাল কুড়িয়ে এনে কোনমতে আগুন দিছি।
– হয়ছে, একটু তাড়াতাড়ি করো, লবণ মরিচ ঠিকঠাক দিছ তো?
– খেয়ে তারপর বলো।
আব্বা একটু পরে আবার বলেন কই হলো? আমি আর আম্মা হাসি। আমাদের ঐ হাসি বেশিক্ষণ থাকে না। রান্না শেষ হলেই আব্বা পাশের মসজিদ থেকে এক হুজুর নিয়ে আসতেন। কোরবানির বা ফাতেহার তরকারি নাকি হুজুরকে দিয়ে ফাতেহা বা শুরু করিয়ে নিতে হয়। আম্মা রুটি, ভাতের সাথে দুই বাটি মাংস দিতেন। কখনো দুই বাটি থেকে মাংস ফেরত আসত না। উল্টো রান্না ঘর থেকে নেয়া লাগত। তখন আমার মুখ কালো হয়ে যেতো। মন ভীষণ খারাপ হয়ে যেতো। এতোদিন পর ঘরে গরুর মাংস আসল তাও ভালো করে খেতে পারতাম না। আম্মা বলতেন,
-আমার মেয়েরে কসাই এর ঘরে বিয়ে দেব। তাহলে সারা বছর গরুর মাংস খেতে পারবে। আমি কসাই কি চিনতাম না। আম্মাকে জিজ্ঞেস করলে আম্মা বলতেন
– যারা গরু জবাই করে বিক্রি করে তাদের কসাই বলে। আমার তখন বড় হয়ে কসাই হতে মন চায়তো।
– আম্মা, আমি বড় হয়ে কসাই হব। আম্মা হেসে বুকে টেনে নিয়ে বলতেন
– পাগলী, মেয়েরা কসাই হয় না।
আব্বা খেতে বসলে কখনো মনে হয় আমাদের কথা ভাবতেন না। হুজুরকে বলতেই থাকতেন, হুজুর আরেকটু নেন। আর যদি তরকারিতে লবণ মরিচ একটু কম বেশি হয়, তাহলে হুজুরের সামনেই আম্মাকে বকা দিতেন। আম্মার আর সে তরকারি খাওয়া হতো না। রান্না ঘরে বসে বসে কান্না করতেন। আব্বা সে কান্নার শব্দ কখনো শুনতে পেতেন না, অথবা আব্বাকে স্পর্শ করতো না সে দুঃখ। আমার বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে আম্মার কান্নার সাথী হয়েছিলাম।
তখন আমি সিক্সে পড়ি। রেনুর বয়স পাঁচ । আব্বা একটা ছেলের জন্য আম্মাকে বলে বলে থাকেন। সে বছর আম্মা আবার গর্ভধারন করলেন।
তখন সম্ভবত আম্মার সাত মাস চলছে। একে তো রমজান মাস তার উপরে শবে কদর এর রাত। আম্মা এই শরীর নিয়ে ঢেঁকিতে যেতে পারলেন না। চালের রুটি ও হলো না। আব্বার মন মেজাজ ঠিক নেই। এদিকে গরুর মাংস আনার অনেকক্ষণ পরে ও আম্মার রান্না শেষ হওয়ার নাম নেই। হবে কি করে, এই শরীর নিয়ে মরিচ মসলা বাটা, আলু কাটা, মাংস কেটে ধুয়া, তার উপরে লাকড়ীর চুলায় আগুন ধরানো কি যে কষ্টের কাজ। চুলার ভিতরে কাঠে একটু করে আগুন দিয়ে, বাসের একটা নল ছিল ঐটা দিয়ে মাথা নিচু করে একপ্রকার শরীর উপুড় করে ফু দিতে দিতে আগুনের শিখা বাড়াতে হতো। আম্মা পেটের জন্য ভালো করে ফু দিতে পারতেন না। আমি বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে নাকে মুখে পানি নিয়ে আসলাম। নাকের পানি চোখের পানি মুছে সোজা হয়ে বসতেই আম্মা হেসে খুন। আমি হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছি। আম্মা বললেন
– হয়ছে, তুই হাতে আয়না নিয়ে দেখ। তারপর মুখ ধুয়ে আয়।
আমার কেন জানি আম্মার হাসিটা খুব সুন্দর লাগছিল । আমি আম্মার সামনে দাঁড়িয়ে হাসি দেখছিলাম আর আম্মা আমার চেহারা দেখে আরো জোরে হাসছিলেন। শেষে থাকতে না পেরে ইশারায় সরে যেতে বললেন। আমি আয়না দেখে মনে হলো আয়নার ভিতর কোন ভুত দেখছি। নিজেকে চিনতে সময় লাগলো। আমি মুখ ধুয়ে এসে রান্না ঘরে আসতে আসতে দেখি আম্মার মুখে হাসি নেই। এটাই ছিল আমার মায়ের শেষ হাসি। আম্মা রান্না করতে করতে ইফতারের সময় হয়ে গেল। আব্বা হুজুরকে আনতে পারলেন না। হুজুরের জন্য তরকারি নিয়ে গেলেন মসজিদে। আব্বা খেতে বসলেন খুব আরাম করে। যেহেতু হুজুর নেই আম্মা সহ আমরা ও বসলাম আব্বাকে ঘিরে। আব্বা গরুর মাংসের এক টুকরো মুখে দিয়েই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন।
– কি রান্না করছস এগুলো। ঝালের জন্য মুখে দেয়া যায় না।
– একটু ঝাল ঝাল না হলে মুখে লাগে না।
– কি তর এত্ত বড় সাহস রানতে জানস না আবার মুখে মুখে কথা।
উনি এই বলে একটা লাথি দিলেন আম্মার গায়ে। লাথিটা লাগল গিয়ে আম্মার পেটে। আম্মা একটা ডাক দিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। আমি আর রেনু কান্না জুড়ে দিলাম। পাশের বাড়ি থেকে চাচা চাচিরা চিৎকার শুনে দৌড়ে এলেন। আব্বা গেলেন ডাক্তার আনতে। ডাক্তার আসতে আসতে আম্মার রক্তপাত শুরু হয়ে গেছে। ডাক্তার এসে চোখ আর রক্ত দেখে বললেন তাড়াতাড়ি উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে যেতে। আব্বা আর চাচারা নাকি উপজেলা হাসপাতাল হয়ে জেলা হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। রক্ত বন্ধ করতে না পারার কারণে আম্মা আর আমাদের ভাই দুজনকেই জীবিত নিয়ে আসতে পারলেন না।
আম্মার মৃত্যুর চারদিন আর ঈদের পর অনেক মানুষ এলেন আমাদের ঘরে। অনেক গরুর মাংস রান্না হলো। সবাই কি মজা করে খাচ্ছে। আমাকে একটা থালায় অনেক গুলো গরুর মাংস দিয়ে ভাত দেয়া হলো। আমার ছোট খালা হাতে তুলে খাইয়ে দিতে চাইলেন। আমার গরুর মাংস দেখেই আম্মার কথা মনে পড়ে গেল। আমি থালাটা দূরে পেলে দৌড়ে ঘরের কোনে চলে গেলাম। আমার হাতে, মুখে আর গরুর মাংস উঠে না।