একাকীত্ব

একাকীত্ব

সকালে দাঁত ব্রাশ করার সময় থুথুর সাথে এক দলা রক্ত বের হলো।দাঁত ব্রাশ করা থামিয়ে,নিশা অনেকক্ষণ বেসিনের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। পরমুহূর্তে মনে পড়ে যায় ৮.০০ টা বেজে যাচ্ছে,তাকে তার অফিসের জন্য বের হতে হবে।নিশার মা সুলতানা সে কখন থেকে হাকঁডাক দিচ্ছে রেডি হয়ে খেতে আসার জন্য। একটা প্রাইভেট কোম্পানিরে একাউন্ট ম্যানেজারের সহকারী হিসেবে কাজ করে নিশা।যেমন তেমন একটা বেতন পায় নিশা।তা দিয়ে নিশার একেবারে চলেই না বলতে গেলে।পুরো সংসারের ভার একা নিশার উপরে।

নিশারা ২ ভাই ৪ বোন।বড় ভাই প্রণয় ব্যাংকে চাকরীরত আছে বউ সন্তান নিয়ে সে আলাদা থাকে।ঈদে উৎসবে সে তার পরিবারের খোঁজ নিতে আসে,এসেই তার বউ তার এই বাড়ি থেকে কিছু না পাওয়া হিসেবের খাতা নিয়ে বসে।সাপের মত হিসহিস করতে করতে খোঁচা দেয় সে। নিশার দ্বিতীয় ভাই জিশান।সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে আছে।বিয়ে শাদী কিছুই করেনি কিন্তু তারপর ও সে পরিবারের কোনো খোঁজ রাখেনা।বছরেও দেখতে আসে না বাবা মাকে।শেষ এসেছিলো বছর তিনেক আগে।ফোন করে খবর নেয় মাস দুয়েক এ একবার।অনেকেই বলে ওখানে বিয়ে করেছে পরিবারকে না জানিয়ে।

নিশার বড় এক বোন রাশি।বিয়ে হয়েছে বছর পাঁচেক হলো।বিয়েতে অনেক বড় আবদার ছিলো বর পক্ষের।তাতেও রাজি হয়ে যায় নিশার বাবা।এক মেয়েকে আর কত বসিয়ে রাখবে,তার তো আর তিনটে মেয়ে আছে।বিয়ে দেওয়ার জন্য নিশার বাবার গ্রামের বাড়ির কাঠা দুয়েক জমি বিক্রি করতে হয়েছে।তারপর ও রাশিকে তার শ্বশুর বাড়ি থেকে মাসে কম হলেও পাচঁ বার পাঠানো হয় টাকা আনতে।যেনো ছেলের বউ ঘরে তুলেনি,তুলেছে টাকা আমদানি করা মেশিন।

রাশির পর নিশা,নিশার পর আরো জমজ দুই বোন।একজন রিপা আরেকজন নিপা।দুইজন এইবার ইন্টার ১ম বর্ষে পড়ে।তাদের চাওয়া পাওয়ার যেনো শেষ নেই।নিত্য নতুন জামা,সাজ গোজের জিনিস চাই তাদের। সুলতানা তাদের দুইবোন কে প্রায়শই বলেন দুইটা টিউশনি কর,টিউশনি করলে তো একটু সাহায্য হয় সংসারে।তাদের এই কথা কানেই যাই না। নিশা এস.সি.সি পরিক্ষা দেওয়ার পর থেকে টিউশনি করতো,তারপর তো বি.এ পরার মাঝেই চাকরি টা পেলো।বড্ড কষ্ট হয় নিশার কাজ করতে ওখানে।নিশার সিনিয়র মাসুম স্যার প্রায়শই নোংরা কথা বলেন।নোংরা ভাবে স্পর্শ করার চেষ্টা করে নিশাকে,ফাইল নেওয়ার ফাঁকেফাঁকে,টেবিলের নিচে পা দিয়ে আরো বিভিন্ন ছলে।নিশা নীরবে কাদেঁ কিছুই করতে পারেনা।কারণ চাকরি টা চলে গেলে নিশার পরিবারের কোনো কূল কিনারা পাবেনা,অথৈ সাগরে তলিয়ে যাবে তারা।তাই আর চাকরি টা ছাড়া হয়নি।

ইদানীংকাল নিপা আর রিপা বায়না ধরেছে ফোনের জন্য,দুইজনকে দামি টাচ ফোন কিনে দিতে হবে।নিশা বলেছে কিনে দিবে পরের মাসের বেতন পেলে।তারপর ও তারা নাছোড়বান্দা কিনে তাদের এর আগেই দিতে হবে।তাদের ফোনের কথা শুনে নিশা তার হাতের ফোনের দিকে তাকায়,কভার ভাঙ্গা ফোন যা নিশা একটা রাবার দিয়ে বেধে চালায়।নিশা কখনো নিজের জন্য কোনো টাকা খরচ করে না,যতটুকু পারে পরিবারকে দেয়।

নিশার পরিবারের বাইরেও আরো একজনকে সাহায্য করতে হয়।আর সে হলো কাব্য।কাব্যর সাথে নিশার সম্পর্ক টা সেই কলেজ জীবন থেকে,আসলে সম্পর্ক বললে ভুল হবে।যখন কাব্যর টাকা প্রয়োজন হয় তখনি নিশার কথা মনে হয়।ফোন দিয়ে দেখা করতে বলবে,দেখার করার পর ইনিয়েবিনিয়ে আদুরে কথা বলবে আদরের ছলে শরীরে নোংরা ভাবে স্পর্শ করবে।নিশা ছিটকে সরে গেলে আবার কাব্য তার গা ঘেষে বসবে।তারপর এই কথা ওই কথা বলে টাকা নিবে।নিশাও বিনা দ্বিধাবোধে টাকা দিয়ে দেয়।এটা জেনেও যে নিশা যে কাব্য কে তাকে প্রয়োজনে ব্যবহার করছে,হয়ত ভালোবাসে কাব্যকে তাই এই ব্যাপার গুলো নিশাকে কাবু করতে পারেনা।

নিশার বাবা কিছুই করেনা সারাদিন শুয়ে বসে কাটিয়ে দেয়।কাজের কথা বললে বলবে,এক কালে কাজ করেছি না।কাজ করে তোদের ভরণ পোষণ দিয়েছি না এখন আর পারব না কিছুই করতে।এখন আমি আরাম করবো।নিশা ভাবে কথা তো ঠিকি বলেছে বাবা,দুই ছেলেকে অনেক বড় করেছে তাদের উচিৎ বাবাকে আরাম আয়েশে রাখা কিন্তু তারা তা করেনি তা করতে হচ্ছে নিশাকে।গায়ের রক্ত হিম হয়ে যায় কথা গুলো ভেবে।

নিশার জন্য বিয়ের সম্বন্ধ প্রায়শই আসে,ভালো ভালো পরিবার থেকে আসে।নিশার গায়ের রং উজ্জীবিত শ্যামলা।লম্বা ও বেশ,গায়ের গঠিত গঠন ও আঁকশি আকর্ষিত।মুখের গড়ন টাও কিছুটা দুর্গা দেবীর প্রতিমার মত।শিক্ষিত ও বি.এ কমপ্লিট। কিন্তু নিশার বাবা মা বিভিন্ন ছলে বিয়ে ভেঙ্গে দেয় তারা ভাবে নিশাকে বিয়ে দিয়ে দিলে তাদের সংসার চলবে কি করে।নিজেদের স্বার্থে এতটুকু স্বার্থপর তো তারা হতেই পারে।কত আর বয়স হয়েছে নিশার ২৮ ছুঁই ছুঁই করছে।তারা নিশাকে বিয়ে দেওয়ার আগে রিপা আর নিপা কে বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছে তাই নিশার বিয়ে কথা বলতে এলে রিপা আর নিপা কে আগে দাঁড় করিয়ে দেয়।ওদের বিয়ে দিতে পারলে কিছুটা নিশ্চিত হওয়া যাবে ভাবে সুলতানা।লুকিয়ে নিশার থেকে সে একটা পলিসি ও করেছে গত কয়েক বছরে বেশ কয়েক টাকা জমা হয়েছে।দোতালা টা কমপ্লিট করতে পারলে ভাড়া দিয়ে বেশ কিছু টাকা মাসে আসতো তখন না হয় নিশার বিয়ের কথার চিন্তা করা যাবে।মা হয়েও সুলতানা পারছে নিশাকে দিয়ে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করতে।মশার মত বিনা সংকোচে নিশার রক্ত চুষে খেতে।

নিশা রাত করে বাসায় ফিরে আজকাল।অফিস শেষ হয়ে যায় রাত ৯টায়।তারপর আজকাল বাইরে একটা গানের টিউশনি করে ২ ঘন্টা।মাস শেষে বেশ কিছু টাকা দিবে বলেছে।গান টা নিজে নিজেই শিখেছিললো নিশা,বেশ সুরালয় কন্ঠ নিশার।যেকোন গানের সুর খুব সহজেই ধরতে পারে নিশা।ইচ্ছে ছিলো গান নিয়ে কিছু করার কিন্তু সংসারের চাপাচাপিতে নিজের ইচ্ছেকে খুন করতে হয়েছে নিশার।

নিশা সকালে অফিস যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে দেখলো তার জামা টা কয়েক জায়গা দিয়ে ফুটোঁ হয়ে গিয়েছে।সেলাই করার জন্য সুইঁ সুতো খোজাঁর জন্য মায়ের আলমারি খুলতেই পলিসির কাগজ গুলো নিচে পড়ে যায়।নিশা খোলে দেখে বুঝতে পারে,তার মা তাকে না জানিয়ে এইগুলো করেছে।সেখানে নমনিতে নিশার নাম নেই আছে নিপা আর রিপার নাম।আচ্ছা নিশাকে জানালে কি খুব বেশি ক্ষতি হত।নিশা বাসায় আসলেই তো তার মা তার কাছে সংসারের সব খবর নিয়ে বসে।কি দরকার কি নেই পাশের বাড়ির ওর মা কিনেছে তার ছেলে মেয়ে তার মাকে কি দিয়েছে।এত কথা বলতে পারলো মা কিন্তু একবার ও নিশাকে এই ব্যাপারে কিছু বললো না।নিশা কাগজ গুলো ভিতরে গুছিয়ে রেখে সুইঁ সুতো বের করে।জামা সেলাই করে বের হয়ে যায় অফিসের জন্য মাকে কিছুই জানায় না এই ব্যাপারে।

কাজ শেষ করে বাসায় ফিরবে যখন তখন অফিসের ভিতরের রুম থেকে মাসুম স্যার নিশাকে ডেকে পাঠায়।মাসুম স্যার নিশার কাছে এগিয়ে এসে নিশাকে বলতে থাকে,আগামীকাল যেনো তার বাসায় একবার যেনো নিশা যায়।অফিস থেকে ছুটির ব্যবস্থা সে করে দিবে।কিছু অফিসের প্রাইভেট কাজ আছে তাই। নিশার অনেকটা কাছে মাসুম দাড়িঁয়ে ছিলো,লোকটার মুখ থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছিলো।নিশার দম আটকে আসছিলো,দৌড়ে নিশা বের হয়ে আসে।মাসুমের ঘৃণিত কুনিয়তের কল্পনা নিশার বুঝতে বাকি রইলো না।

নিশা টিউশনির জন্য রওনা হয় পাচঁ তালা বাড়ির তিন তালায় থাকে রাতুলেরা।বাবা মায়ের ৮ বছরের একমাত্র সন্তান রাতুল।দরজার কলিং বেল বাজাতেই রাতুলের বাবা দরজা খুলে।দরজা খুলে ভিতরে আসতে বলে নিশাকে।সচারচর রাতুলের বাবা বাসায় থাকে না আজকে তাকে দেখে নিশা কিছুটা ঘাবড়ে যায়,আমতাআমতা করে জিজ্ঞেস করে নিশা রাতুল আর তার মা কোথায়?রাতুলের বাবা উত্তর দেয় তারা দাওয়াতে গিয়েছে বাসায় কেউ নেই।তারা আজ আর আসবে না।এই বলে পৈচিশিক হাসি দেয় রাতুলের বাবা।নিশা বের হতে চাইলে নিশাকে যেতে মানা করে রাতুলের বাবা।বলে খাবার খেয়ে যেতে,রাতুলে বাবা ভিতরে যায় খাবার আনতে।নিশা দৌড়ে দরজা খুলে বের হয়ে যায়।হয়ত রাতুলের বাবা সহজ ভাবেই কথা গুলো বলেছিলো কিন্তু নিশার কাছে তা অন্যেরকম শুনিয়েছে অল্পতেই সে ভয় পেয়ে গিয়েছিলো।

আজ তার বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না।নিশা ভালো করেই বুঝতে পারছে কাব্যর মত নিশার পরিবার ও নিশাকে ব্যবহার করছে।কিছুদিন আগে নিপার ব্যাগ থেকে রেস্টুরেন্টের একটা বিল পায় নিশা।যেখানে বিল ছিলো প্রায় ২২০০ টাকা।খুব দামি রেস্টুরেন্ট ছিলো তাতে কোনো সন্দেহ নেই।নিশা এই ২২০০ টাকা রোজগার করার জন্য কত কষ্ট করে একটা বাড়তি টিউশন করছে অফিসের পর।নিশার মা ও নিশাকে ব্যবহার করছে সকালে তার প্রমাণ পেলো নিশা।

সারারাত আজ হাটঁবে নিশা,বাসায় যাবে না নিশা।আসলে নিশা বাসা গেলেই কি আর না গেলেই কি নিশাকে নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যাথা নেই।সবাই মাস শেষে টাকার দরকার নিশাকে দরকার নেই কারো।সবাই নিশার থেকে যে যতটা পারছে ততটাই আদায় করে নিচ্ছে।কেউ নিশার পরোয়া করছেনা।দুনিয়ায় সবাই কি স্বার্থপর।

শহরে রাত বেশি হলেও কোনো সম্যসা নেই সারারাত দোকান গুলোতে আলো ঝলমল করে।নিশা একা একা শপিং মল গুলোতে ঘুরে। পরের দিন ভোরের সূর্য দেখে নিশা বেঞ্চিতে বসে।ফুটপাত থেকে চা কিনে খায়,বিস্কুট দিয়ে ভিজিয়ে।রিক্সা করে অনেকদূর পযন্ত না চেনা অনেক জায়গায় ঘুরে।নদীর পাড়ে যেয়ে বসে রইলো নিশা,তারপর খাবার কিনে নৌকায় করে অনেকক্ষণ নদীতে ঘুরে।অফিস ও যায় না নিশা। সন্ধ্যা বেলা বাসায় ফিরে নিশা।নিশার বাবা মা নিশাকে অনেক বকাবকি করে চড় থাপ্পড় ও দেয়।জিজ্ঞেস করে কোথায় ছিলো সে এতক্ষন,ফোন কেনো ধরেনি?বিভিন্ন প্রশ্ন করে তারা।নিশা প্রতিউত্তরে নিশব্দে চুপ করে থাকে।

নিশার মত ছেলেমেয়েরা পরিবারের কাছ হাজারো কষ্ট পেয়েও চুপচাপ তার পরিবারের কাছেই চলে আসে।তারা তাদের ইচ্ছে গুলো কে খুন করে পরিবারের ইচ্ছেগুলোকে পূরণ করার শত চেষ্টা করে।পরিবারও স্বার্থপরের মত একজনকে যাতাঁ কলে পিষতে থাকে।

পরিবারের কাছ থেকে কষ্ট পাওয়া নির্বিকার ভাবে বেঁচে থাকা ছেলেমেয়ে গুলো অনেকটা একাকীত্ব জীবন পার করে।বেঁচে থাকে পরিবারের খুশির জন্য কিন্তু নিজেরা কতটুকু খুশি থাকে তা তারা নিজেরাও জানেনা।ভালো থাকুক এমন হাজারো নিশার মত ছেলেমেয়েরা।

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত