শূন্য খাঁচা

শূন্য খাঁচা

মা বললেন, নতুন বউকে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। সে নতুন মানুষ। একা একা সংসার পাতবে আবার সেই সংসার সামলাবে এই দক্ষতা ওর এখনও হয় নি। আমি বললাম, মা, পৃথিবীতে কেউই সবকিছু শিখে আসে না। ধীরে ধীরে শিখে ফেলবে। ও নিয়ে তুমি চিন্তা করো না।

মা আরো যেন কি বলতে চাইলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু না বলেই রান্না ঘরের দিকে চলে গেলেন। আমি আড় চোখে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। মায়ের উজ্জ্বল চোখ জোড়া কেন যেন মলিন হয়ে গেল হঠাত। আমি বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে বের হলাম। তিন দিন আগে বিয়ে করেছি। প্রেম টেম না। এরেঞ্জ ম্যারেজ। মা পছন্দ করে হঠাত আমাকে ফোন করে ডাকলেন। বললেন খুব জরুরী। এলাম, এসেই দেখি বিয়ের আয়োজন। আমার যেহেতু পারশোনাল কোন পছন্দ ছিল না সেহেতু অগত্যা বিয়েটা সেরেই ফেললাম।

ওর নাম নীতু। খুব শান্ত শিষ্ট। ওর চুলগুলো মেঘে ঢাকা আকাশের মতো। গভীর। আমি ওর চোখের প্রেমে পড়েছি। কি শান্ত অথচ তীক্ষ্ণ সেই দৃষ্টি ; বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে নির্ঘাত প্রেমে পড়ে যাবেন। তবে আমাদের বয়সের ব্যবধানটা বেশি। আমি ম্যাট্রিক পাশ করেছি আটে আর ও আঠারোতে। এ বিষয়টা মাকে বলেছিলাম, বয়সের তারতম্য বেশি হয়ে যাচ্ছে না তো? মা হেসে বললেন, পুরুষ মানুষের বয়সে কিচ্ছু আসে যায় না। মেয়ে মানুষের বয়স লাগে, আর পুরুষের মানুষের লাগে হিম্মত।

আমি মায়ের কথা কিছুই বুঝলাম না। এটুকু বুঝলাম মা চাচ্ছেন এই মেয়েকেই আমি বিয়ে করি। তাই আর কোন কিছুতে বাধে নি। বিয়েটা ভালোবেই সম্পন্ন হল। আমি চাচ্ছি নীতু আমার সাথে ঢাকায় যাক। অনেক তো হাত পুড়িয়ে খেলাম। এবার একটু আরাম করে বউয়ের হাতের রান্না খাই। কিন্তু মা চাচ্ছেন না। মা গতরাতেও বলেছেন, নীতু অনেক ছোট। ও ঢাকায় গিয়ে একা একা থাকতে পারবে না। কিছুদিন আমার কাছে থাকুক। তারপর সময় সুযোগ বুঝে নিয়ে যাস। আমি নীতুকে রাতে বললাম, তুমি কোনটা চাও? সে মুচকি হেসে বলল, আম্মা যা বলবেন আমি তাই করবো।

আমি একটু মজা করার ছলে বললাম, আমি তোমার স্বামী। তোমার কাছে কে বড়? স্বামী নাকি শাশুড়ি? ও আমার খোলা বুকে মাথা রেখে বলল, আপনি পাগল! কি সব বলেন! আপনি আর আম্মার মধ্যে পার্থক্য চলে! আপনি আমার ভালোবাসার জায়গা দখল করেছেন। আর আম্মা দখল করেছেন সম্মানের। আমার কাছে দুটোই পরম পূজোনীয়। আমি কিছুই বুঝতেছি না। আম্মার সাথে সাথে দুই দিনে নীতুও কি সব ফিলসফিক্যাল কথাবার্তা বলা শুরু করলো! আগামাথা বোঝা মুশকিল।

অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম নীতু মায়ের কাছেই থাক। মা তো চায় তার সন্তান একটু সুখে থাকুক। আরামে থাকুক। তার সন্তানের কোনটা প্রিয় কোনটা অপ্রিয় সেসব সহ আরো কত কথা উনি বউয়ের কাছে বলবেন। বউকে হয়তো বলবেন, পাগলটাকে দেখে রেখো। বড্ড পাজি ছেলে আমার! মায়েরা কেন যে এমন হয়! নিঃস্বার্থে সন্তানের জন্য জীবন উজাড় করে দেয়।

আরো তিন দিন থাকলাম। ছুটি ছিল আর দুই দিন। নীতুর বায়নায় একদিন বাড়িয়েছি। আগামীকাল সকালের বাসে রওনা দিবো। সন্ধ্যা থেকে আমার মিষ্টি বউটার মুখচ্ছবি পালটে গেছে। এক আকাশ কালো মেঘ নেমে এসেছে ওর চোখে মুখে। আমি ওকে কাছে ডেকে পাশে বসালাম। তারপর হাত দুটো ধরে বললাম, আমার মিষ্টি বউটা এত মন খারাপ করলে আমি যে ঢাকা গিয়ে শান্তি পাবো না!

নীতুর মা নেই। ছোটবেলায় মারা যান। মায়ের আদর ভালোবাসা কিছুই ওর ভাগ্যে জোটে নি। তাই ও খুব ভালোবাসার কাঙাল। নীতুর চোখে থেকে এক ফোঁটা উষ্ণ জল আমার হাতে এসে পড়লো। কিছুক্ষণ পর বলল, আমাকে কবে নিয়ে যাবেন? আমি ওকে বুকে টেনে নিলাম। তারপর বললান, খুব শিঘ্রই। দুই মাস পরেই নিয়ে যাবো। ও আমার বুকে মুখ লুকিয়ে বলল, মনে থাকে যেন! নারীর মন বোঝা বড্ড মুশকিলের কাজ। এই উত্তপ্ত লেলিহান তো এই শিতল হাওয়া! সকালে সবার কাছে বিদায় নিয়ে ঢাকা আসলাম। এসেই অফিসে জয়েন করলাম। জমে থাকা কাজ গুলো নিয়ে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। নেক্সট উইকে জোনাল মিটিং। অনেক গুলো ফাইল ড্রপ করতে হবে।

গত তিন দিনে কাজ অনেকটাই গুছিয়ে ফেলেছি। এত ব্যস্ততার ভিড়েও নীতুর সাথে আমার কথা হচ্ছেই। আমি ব্যস্ত থাকি তখন ও মেসেজ করে। কি করেন? খেয়েছি কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। সত্যি বলতে কি ওকে ছাড়া আমারো ভালো লাগছে না। হুট করেই কীভাবে যেন আমি বদলে গেলাম। জীবিনের এত গুলো দিন দিব্যি একাই কাটিয়ে দিলাম। কিন্তু আজ কয়দিনের ব্যবধানে সবকিছু শূন্য শূন্য লাগছে। বেশ গভীর রাত পর্যন্ত আমরা কথা বলি। ওর কথা ফুরোয় না। রাজ্যের কথা নিয়ে আমার সামনে হাজির হয়। আমারও ভালো লাগে ওর নিজেকে সপে দাওয়া দেখে।

এক সপ্তাহ পর আজ অফিসের জোনাল মিটিং শুরু হল। টানা এক সপ্তাহ মিটিং চলবে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। আমি আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। গতকাল থেকে নীতুর প্রচণ্ড জ্বর। থেকে থেকে একশ দুই তিন ডিগ্রী ওঠে। মনটা ভীষণ খারাপ। ডাক্তার এসে দেখে গেছেন। প্রাথমিক ওষুধ খেয়ে না সারলে ব্লাড টেস্ট করতে হবে। এখনই মিটিং শুরু হবে। এমডি স্যার আসলেন।

মিটিং অফিসের চাপে আরো দুইটা দিন কীভাবে যেন হুট করে পার হয়ে গেল। সকালে মা ফোন করে বললেন, বউমার জ্বর তো কমছে না। শরীরে ব্যথা। আবার বমিও করছে। আমি আঁতকে উঠলাম। এই ম্যারাথন মিটিং না থাকলে আজই চলে যেতাম বাড়ি। বললাম, নীতাই দা’কে সাথে নিয়ে নীতুকে মেডিকেলে নিয়ে যেতে। ডাক্তার টেস্ট করে দেখে বলেছে ডেঙ্গু জ্বর। ব্লাডের প্লাটিলেট কমে গেছে অনেক। ব্লাড লাগবে। নিতাই দা ব্লাড ব্যবস্থা করেছেন। ব্লাড দেওয়া হয়েছে। নীতাই দা একটা কেবিনও ম্যানেজ করে ফেলেছেন। এবার তুলনামূলক ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি। বেড পাওয়াই মুশকিল সেখানে কেবিন ম্যানেজ করাটা স্বপ্নের মতো। মা আমাকে ফোনে কথা গুলো বললেন।

আরো দুই দিন পর আমি ছুটি নিয়ে আসলাম। ওরা মেডিকেলেই আছে। নীতু এখনও সুস্থ হয় নি। আমি ওকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার সকল বন্দবস্ত করে এসেছি। নীতু আগের মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতে পারে না। চোখ জোড়া কালো বর্ণ ধারণ করেছে। আমাকে দেখে ওর চোখের কোল গড়িয়ে অশ্রু ঝরে পড়ল। ওর অবস্থা ভাল না। শুকিয়ে গেছে অনেক। কিছুই খেতে পারে না। কিছু পেটে পড়লেই বমি। আমি ওকে মানসিক ভাবে শক্ত থাকার জন্য বললাম, কিছুই হবে না। কালই তোমাকে ঢাকায় নিয়ে যাবো।

ও মলিন হেসে মাথা নাড়ালো। আমি বাইরে একটু আড়ালে গিয়ে কাঁদলাম। চোখের জল বেরিয়ে আসলে মনটা হালকা হয়। নীতুর অবস্থা দেখে আমি আর নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারি নি। কিন্তু ওর সামনে অশ্রু ফেললে নীতু আরো ভেঙে পড়বে। আজ ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। পরদিনই আমরা এসেছিলাম। স্কয়ার হসপিটালে ছিলামও সাত দিন। আজ নীতুকে নিয়ে যাচ্ছি। কত রকমের চিকিৎসা হল নীতুর। উন্নত ট্রিটমেন্ট। শেষ দুইদিন আইসিইউতে রাখা হল। কিন্তু ডাক্তাররা বলল দেরী হয়ে গেছে। আরো আগেই নিয়ে আসা উচিৎ ছিল। মরণঘাতী ডেঙ্গু নিমেষেই আমার প্রাণের চাইতে প্রিয় হয়ে ওঠা মানু্ষটিকে আজীবনের জন্য কেড়ে নিলো।

নীতু আমাকে একা রেখে পরপারে পাড়ি জমালো। অন্ধকার ভেদ করে চলছে আমাদের লাশবাহী এম্বুলেন্স। আমি বসে আছি নীতুর পাশে। ওর নিথর শিতল হাত আমার হাতে। বুকের ভেতর এক সমুদ্র নোনা জল দলা পাকিয়ে উঠে আসছে গলা অব্দি। তবুও কেন জানি কাঁদতে পারছি না। বুকের ছোট্ট খাচায় আশ্রয় নেওয়া হলুদ পাখিটা হঠাত খাচা শূন্য করে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেল! আমায় ক্ষমা করো নীতু।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত