বৃষ্টিস্নাতো দিনে তোমাকে যদি এনে দেই ভেজা কৃষ্ণচূড়া, তবে কি তুমি বৃষ্টিভেজা কদমকে ভুলে যাবে? এটা কি ভুলে যাবে যে কদমের শুভ্রতা বৃষ্টির কাছে সবচেয়ে মহনীয়? ভুলে যাবে কি এই কৃষ্ণচূড়া সবসময় হয়তো পাবে না তবে কদম তোমায় আমি এনে দেবই। জানিনা এসবের উত্তর, কিন্তু আমি এটাই ভাবছি যে তোমাদের বাড়ির পুকুরঘাটের কদমের গাছটা থেকে আজকাল কদম পাওয়া যাচ্ছে না। এখন তুমি কদম পাবে কোথায়? মিস করবে কি যখন কেউ আর কদম দিতে চুপি চুপি আসবে না? হাহাহা, ভয় পেও না। সুখের শ্বাসটা নিতে একটু ধৈর্য ধরো। কেউ আমার জন্য দুটি কদমের অপেক্ষায় থাকবে এটা ভাবতেই মনটা জুড়িয়ে যায় আর পাওয়ার আকাঙ্খাটা বেরে যায়।
তোমার সাথে অনেক ছোট থেকে বড় হয়েছি আমি। মনে আছে তোমার, একদিন তুমি স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিলে আর হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। রাস্তায় তুমি তখন একা আর আমিও দৌড়িয়ে বাড়ি ফিরছিলাম৷ বিদ্যুৎ চমকালেই তুমি কেঁপে উঠছিলে। তোমার গা বারবার কাটা দিয়ে উঠছিলো৷ তোমার জন্য আর আমারও শেষ রক্ষা হয় নি। একা ফেলে যেতে পারবো না তাই তোমাকে সঙ্গে নিয়েই আশ্রয় নিয়েছিলাম রাস্তার পাশে বটগাছটির নিচে। আকাশে তখনও অন্ধকার আর ঘনঘন বাজ পরার শব্দ। আরেকটু হলে তুমি হয়তো কেঁদেই দিতে কিন্তু মাঝপথে রাস্তায় ঝরে পড়া কদমগুলো তোমায় এনে দিতেই তুমি কেমন যেনো স্বাভাবিক হয়ে এলে। তোমার ভয়ে চুপসে যাওয়া মুখটা হঠাৎ কেমন যেনো খুশিতে জলে উঠেছিলো। সত্যি বলতে আমার তখন কি হয়েছিল জানিনা তবে হয়তো তখনই তোমার প্রেমে পড়েছিলাম আমি। এখনও যদি কল্পনায় তোমাকে দেখি তবে ছোটবেলার সেই ভরাট মুখটাই ভেসে ওঠে।
সদ্য ওঠা দশম শ্রেনীতে যখন সবার মাঝে পড়াশোনার নবসূচনা শুরু হলো, তখনও তুমি আগের মতোই হাস্যজ্জোল ছিলে। মনে পরে কি আমাদের স্কুলের আয়োজিতো পিকনিকের কথা? বাসা থেকে বেরিয়েছিলে পরীর মতো সেজে। চোখের কাজলটা একেবারে ঠিকভাবে লাগিয়েছিলে। কিন্তু লাভ কি হলো? ছবি তুলতে গিয়ে দেরী হয়ে যায় তোমার, আর যেকারনেই শিহাব স্যারের কাছে বকুনি খেলে। তারপর তো চোখের কাজল আর পানি, নাকের পানির সাথে মিশিয়ে কেঁদেকেটে একাকার অবস্থা করেছিলে। শিহাব স্যারই অবশ্য পরে তোমাকে শান্ত করেছিলো কিন্তু তুমি কি জানো, আমি তখন তোমাকে দেখে নিজের হাসি থামাতে পারছিলাম না। চোখের কাজলটাও ভেস্তে গেছে আর ঠোটের লাল লিপস্টিক, তা তো খেয়েই ফেলেছো। হঠাৎ একসময় দেখি তুমি আমার দিকে তাকিয়েছো। আমর বুকে ধক করে কি যেনো একটা লেগেছিলো। তোমায় তখন কতোটা সুন্দর লাগছিলো তা লিখে বোঝাতে পারবো না। তবে তুমি আমার দিকে মলিন হয়ে তাকিয়ে ছিলে৷ তোমাকে হাসতে ইশারা করতেই তুমি হেসে ফেলেছিলে। আমার কথা শুনেছো দেখে ভালো লেগেছে তবে তখন তোমার হাসিতেই হারিয়ে যাই আমি। আবার আমার দিকে তাকিয়ে মনে হয় লজ্জাও পেয়েছিলে। আমার তো ভালই লাগছিলো সেই মুহুর্তটা অনুভব করতে।
আচ্ছা তোমার কি মনে পরে আসাদ ভাইর কথা। সুমি আপু আর আসাদ ভাই আমাদের সবসময় কতো আদর করতো। সরকারী কলেজে তারা জীববিজ্ঞান নিয়ে যখন অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়তো তখন আমরা ইন্টারমিডিয়েটে দ্বিতীয় বর্ষে। তাদের সাথে আমাদের দেখা হয়েছিল মন্টু মামার ফুচকার দোকানে। তুমি যখন ফুচকা খেয়ে ঝালের কারনে পুরো লাল হয়ে হন্নে হয়ে পানি খুজছো তখন সুমি আপু তোমাকে পানির বোতলটি বারিয়ে দেয়। কিছু না দেখে তুমি পানিটা পুরো শেষ করে ফেলেছিলে। আমি তোমার পাশে থেকে কেবল সুমি আপু আর আসাদ ভাইর মুচকি হাসি দেখছিলাম। তোমার পানি খাওয়া শেষে সুমি আপু বোতলটা নিয়ে বলেছিলো, “পানি এগিয়ে দেওয়ার জন্য কাউকে নিজের করে নিলেই তো পারো”। বলেই সুমি আপু আর আসাদ ভাই দুজন দুজনার হাত ধরে চলে যায়। পরে একদিন আবারও তাদের সাথে দেখা হলে তারা তাদের গল্প বলেছিলো। সেখানে আসাদ ভাই নাকি সুমি আপুকে পানির বোতল এগিয়ে দিয়েছিলো ফুচকা খাওয়ার সময়। টুকটাক দেখা হওয়া, কথা বলা এসব কিছুতে অভ্যস্ত হয়ে যায় তারা। তারপরই তো নিজেদের জিবনকে সাজিয়ে নিয়ে একে অপরের হাত ধরে হাঁটার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন আমার বারবার মনে হয়েছিলো, কেনো সেদিন পানিটা আমিই এনে দিলাম না তোমায়? জিবনের অনেকগুলো আফসোসের মধ্যে এটি অন্যতম হয়ে থাকবে আমার।
কলেজ জীবনের গন্ডি পার করে আমরা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ঘাসে গড়াগড়ি দেওয়ার স্বপ্ন দেখছি। একসাথে কোচিং করা হলো না আমাদের। তুমি তো চলে গিয়েছিলে ব্যস্ত শহরের ব্যস্ততায় নিজেকে প্রস্তুত করতে আর আমিতো নিজের শহরেই থেকে গেলাম। তখনি একবার আমার মনে হয়েছিলো, এই মনে হয় হারিয়ে ফেললাম তোমায়। নিজ শহরে কোচিং করতে এসে দেখলাম পাশে এক মেয়ে বসেছে। মেয়েটাকে ঠিকভাবে দেখলামই না কিন্তু আমার তখনি মনে হলো তোমার পাশেও কি এরকম কোন ছেলে বসেছে? সেই ছেলেটি কি তার আধুনিকতার ছোঁয়া দিয়ে তোমাকে আমার থেকে কেড়ে নিবে একটু একটু করে? সেদিন আর ক্লাস করা হলো না। বাসায় এসে তোমাকে ফোন দিয়ে কথা হলো অনেক। কিন্তু বলা হলো না, এই, তুমি আমার থেকে হারিয়ে যাবে না তো? বন্ধুত্ব নামের এক জটিল বন্ধনে আবদ্ধ ছিলাম আমরা। আমিতো অনেকটা ভালোবেসেছি শুধু তেমাকেই বলা হয় নি সেটা। আমরা একে অপরকে কোন কথাই লুকাতাম না তবে আমি লুকিয়েছিলাম। বলতে পারিনি নিজের মনের মাঝে বাস করা সেই শুভ্র কদমের পবিত্র ভালবাসার কথাটা। কেনো বলিনি জানো, ওই যে ভয়। তোমাকে হারানোর সবচেয়ে বড় ভয়টা।
তুমি তোমার স্বপ্ন পুরন করেছো তবে তা ওই ব্যস্ত শহরে নয়। তুমি টিকে গেলে আমাদের শহরে তোমার পছন্দের বিষয়ে। আর অদ্ভুতভাবে আমি চলে এলাম এই ব্যস্ত শহরে। উপর থেকে হয়তো উনিও চায় নি যে তুমি আমি একসাথে থেকে যাই যে কোন এক শহরে। এবার তো বলতেই হয়, তোমার শহরে আমি এসেছি স্নিগ্ধ ফুলের বিকাশ ঘটাতে কিন্তু তুমি ফিরে এলে কেনো? আমিতো আসছিই তোমার কাছে, নতুন করে ফুলের বাগান গড়বো বলে।
তোমার ব্যস্ত শহরে এসে আমি যেনো পিপড়ের বাসায় একজন উইপোকা। এটা হয়তো বুঝেছিলে তাই পরিচয় করিয়ে দিলে তোমার ব্যস্ত শহরের এক বন্ধুর সাথে। সে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো এই ব্যস্ত শহরের ব্যস্ততার সাথে। পরিচিত হলাম আমি এই শহরের সিটিং আর লোকাল বাসের যুগোপযোগী অভ্যেসের সাথে। মানিয়ে নিলাম নিজেকে এই ব্যস্ততার অঙ্গরাজ্যে একজন প্রজা হিসেবে। তবে তোমার মুখে তখন শুধুই তোমার বন্ধু অনিকের নাম। ওকে নিয়ে যেনো কথার ফুলঝুরি তোমার।
সত্যি বলতে খারাপ লাগতো আমার। কিন্তু বললে কি কিছু পরিবর্তন হতো? হয়তো না। তবে তেমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়টা তখন আমার শিরায় শিরায় অনুভুত হতো। এরপর একদিন অনিক ফোন করে বললো, “বলতো মামুন আমি কোথায়”? একটু হেসে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কোথায়? ওর থেকে ফোনটা নিয়ে তুমি বললে, “তুমি বিশ্বাস করবে না মামুন, অনিক না অনেকটা পাগল। ও আমার সাথে দেখা করতে এতদুর এসেছে”। আমি তখন বিরহ বেদনায় ক্লান্ত। মৃদু হেসে বলেছিলাম, একটু ব্যস্ত আছি পরে কথা বলবো। মিষ্টি হেসে তুমি ঠিক আছে বলেই ফোনটা কেঁটে দিয়েছিলে। সেদিন চাপা এক অভিমান কাজ করেছিলো জানো? কিন্তু এই অভিমান কখনই বোঝনি তুমি। হারিয়ে ফেলেছি তোমায় আমি তোমারই অগোচরে।
এরপর তোমার সাথে আর খুব একটা কথা হচ্ছিলো না। তোমার মনে আছে, আমার জন্মদিনে তুমি এই ব্যস্ত শহরে এসেছিলে। অনিক আর তুমি মিলে একটা সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলে। হয়েছেও তাই। তবে আমার জন্মদিনের জন্য নয়, তোমার সাথে অনিককে দেখে। সেদিন আমাকে অনেক খুশি দেখাচ্ছিলো তাই না? আমাকে নিয়ে একটু ভাবলে বুঝতে পারতে আমি খুশি নই বরং তোমাকে হারানোর বেদনায় আমি জর্জরিত। তুমি মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলেছিলে, “আজকাল তো আমার কোন খোঁজ খবরই রাখো না”। আমি মৃদু হেসে বলেছিলাম, আমি তো ফোনে তোমায় ব্যস্ত পাই। আজকাল হয়তো ফোনে একটু বেশি ব্যস্ত হয়ে পরেছো। তুমি তখন অনিকের দিকে তাকিয়ে হাসলে। বুঝলে না আমার ভেতরে কি হচ্ছিলো তখন।
তোমরা কখনও বললে না তোমাদের মাঝে কি চলছে তবে আমি কি এতোটাই অবুঝ। চারটা বছর পেরিয়ে আমি গ্রাজুয়েশন শেষ করলাম। ব্যস্ত শহরকে একটু চিনতে শিখেছি তাই চাকরির মতো সোনার হরিনকে একটু পরিশ্রমেই পেয়ে যাই। বেসরকারী হলেও চাকরী তো। আর ওদিকে তুমি আর অনিক কেউই পারলেনা শেষ করতে। প্রেমে গা ভাসিয়ে হয়তো একটু পিছলে গিয়েছিলে। কে জানতো, তোমাদের মাঝেও বিচ্ছ্যেদ দেখতে হবে আমাকে। তোমরাও ছেড়ে গিয়েছিলে একে ওপরকে। বিশ্বাস হারিয়েছিলে তুমি নিজেও তবে আমি জানতেই পারলাম এই বিচ্ছেদের কারনটুকু। এদিকে একবার ছেকা খেয়ে বেঁকে বসে তুমি কতকিছুই না করতে যাচ্ছিলে। তখনও পারলাম না আমি তোমায় ছাড়তে। অনেক বুঝালাম কয়েকদিন সময় নিয়ে।
ততোদিনে একটু শান্ত হয়েছো। অনিক এদিকে দেশের বাইরে চলে গিয়েছে। নতুন করে শুরু করলে তুমি জীবনটাকে। আমি আবারও আবার নুইয়ে পড়া স্বপ্নটাকে জাগিয়ে যেই না তোমার সামনে নিয়ে আসবো, সেদিনই তুমি এক সন্ধ্যায় বললে, “তুমি অনেক ভাল একজন মানুষ মামুন। অনেক অনেক ভাল একজন বন্ধুও। তোমায় বিপদের সময় হয়তো আমি ছিলাম না তবে আমি সবসময়ই তোমাকে পাশে পেয়েছি। তুমি আমার সেই একজন যার জায়গা আমি কাউকেই দিতে পারবো না। আমাকে ভুল বুঝোনা মামুন। আজ আমাকে যা দেখছো তা শুধু উপরের একজন আর তোমার জন্য। ভাল থেকো মামুন। হয়তো তোমার মতো একজনকে হারিয়ে আমি জীবনের একটা জায়গা অপুর্ন রেখেই পার করে দিবো”।
বিয়ের কার্ডটা ধরিয়ে দিয়ে যখন একপা দুপা করে চলে গিয়েছিলে তখন খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো একটাবার, অন্ততঃ একটাবার তোমার হাতটা ধরে বলতে, তুমি কি যাবে আমার সাথে? তোমায় নিয়ে নতুন এক রাজ্য বানাবো। দুজনে স্বপ্ন বুনে সেগুলো স্মৃতির করিডোরে সাজিয়ে রাখবো। নিজেদের ভালবাসাগুলো প্রকাশ করবো নিজেদের কাছে। শুধু একটাবার কি বিশ্বাস করে হাতটা ধরবে আমার? কথা দিচ্ছি সবসময় আগলে রাখবো। কিন্তু নাহ, আমি পারিনি। তুমি তোমার জীবনে যে জায়গাটা দিয়েছো সেটা হারাতে চাই নি আমি। এলোমেলো পা ফেলে যখন এগিয়ে যাচ্ছিলে তখন তোমার দুহাতে মুখে চেপে ধরেছিলে। খুব জানতে ইচ্ছে হয়েছিলো জানো, আমাকে তুমি কি শুধুই বন্ধু ভেবেছিলে? কেনো জানি মনে হলো তুমি কাঁদছিলে সেদিন। সত্যিই কি তুমি কাঁদছিলে?
তোমার সাথে আমার যোগাযোগ বন্ধ প্রায় সাত বছর হতে চললো। আজ যখন এই চিঠিটা তুমি পড়ছো তখন তুমি হয়তো কাঁদবে? কাঁদবে কি? আমার আরও একটা জিনিস মনে হয়েছে জানো? মনে হয়েছে তোমার স্বামী প্রথমে এই পার্সেলটা পাবে। তারপরে তুমি। আগে অভিমান হতো কিন্তু এখন কেনো যেনো রাগ হয় তোমার প্রতি আমার। তোমার কোন অধিকার নেই তোমার স্বামীকে তার প্রাপ্য অধিকার না দেওয়ার। আচ্ছা বলতো, এই মানুষটার দোষ কি? প্রতিটা মুহুর্ত শুধু তোমার একটুখানি ভালবাসাই চেয়েছে। সেদিন রাতুল সাহেবকে আমি কাটাবনে দেখেছি। এক কাপ চা নিয়ে এক মনে বসে ছিলো। পথিমধ্যে এক বাচ্চা এসে তাকে ফুল কিনতে বললে, উনি কি করেছেন জানো? ফুলটা নিয়ে টাকা দিয়ে আবারও ফুলটা তাকেই দিলো। বললো, “আমার ফুল নেওয়ার মানুষটা কেনো যেনো অন্যের ফুলের আশায় থাকে। সেই অন্যজন যে কে, তা আমি জানিনা। জানলে যেভাবেই হোক তাকে নিয়ে আসতাম”। আরও একটু হেসে বললো, “বাবু এটা তুমিই রাখো অথবা আর কাউকে দাও। অন্ততঃ তাদের মনের মানুষগুলো যেনো ভালবাসা থেকে বঞ্চিত না হয়”।
অনেক তো হলো অহনা। আর কতো বলো? জীবনটা কি গুছিয়ে নেয়া যায় না? একবার নাহয় ভালবাসা ধোকা দিয়েছে তবে সত্যিকারের ভালবাসার মানুষটাকে পেয়ে কেনো অবহেলা করছো বলতো? আমার একটা কথা রাখবে? কথা দেবে আমায়, যেই হোক কাউকে কখনও অবহেলা করবে না? অবহেলার কষ্ট তুমি কি বুঝবে আমার মতো? হয়তো বুঝবে। তবে অনুরোধ করছি তোমায়, রাতুল সাহেবকে আগলে রেখো। এরকম মানুষ খুব কম মানুষই জীবনে পায়। তুমি মরিচিকার পেছনে ছুটে শুন্য হাতে ফিরেছো, তাই বলে কি খাঁটি সোনা পেয়েও ফিরে আসবে। আগলে রেখো অহনা। তোমার বন্ধু হিসেবে বলছি।
শেষ করবো কিন্তু তার আগে কিছু কথা জানাতে চাই। অনেক দুঃখের কথা বললাম এবার কিছু ভাল কথা শোনো, আসাদ ভাই আর সুমি আপুর সাথে দেখা হয়েছিলো জানো? তারা বিয়ে করেছে এবং উনাদের ফুটফুটে একটা বাচ্চাও আছে। তোমার কথা বলতেই ওদের বলি, ত্বোয়ামনির মা এখন আমাদের অহনা। স্বামী সংসার নিয়ে সুখেই আছে। আমার বলা এই মিথ্যেটাকে সত্যি করো কেমন। হয়তো এখন ভাবছো আমার সমন্ধে কিছু বললাম না। হাহাহা, আমি ভালই আছি। এই শহরের স্কুলের এক শিক্ষিকার সাথে একটু বেশি খাতির জমে গেছে। বিয়ে করিনি তবে তুমি সবকিছু ঠিক করে নিলে তোমার সাথে দেখা করিয়ে পাকাপাকি করে ফেলবো। আসাদ ভাই আর সুমি আপুর সাথেও দেখা করা যায়৷ আচ্ছা কেমন হয় বলতো, যদি রাতুল সাহেব আমাদের সবাইকে একদিন লাঞ্চ করান। হাহাহা, আশা করি সবই হবে। তবে তার আগে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিও কেমন।
আমাদের কথাতো শেষ হওয়ার নয়। তবে তোমাকে যা বললাম তা দোয়া করে করো। দেখবে জিবনটা বদলে গেছে। রাতুল সাহেব জানে তুমি কৃষ্ণচূড়া পেয়ে কদম ফুল ভুলে যাওয়ার মতো মেয়ে নও। তাই তার হাত থেকে একবার কদম ফুলটা নিয়েই দেখো না। জিবনটা ভালবাসায় ভরপুর হয়ে যাবে। এক বিছানায় থেকে কাউকে নিজের ভাবা টা ভুল তবে যে এতোদিন অপেক্ষা করেছে সেতো আর ভুলের মধ্যে নেই। সে অপেক্ষায় আছে কবে তার হাতের কদমটা কেউ নিজের করে নেবে। ত্বোয়ামনির প্রতি ভালবাসা আর তোমাদের জন্য শুভকামনা নিয়ে এখানেই শেষ করতে হচ্ছে আজ। ভালো থেকো অহনা।
চিঠিটা পড়তে পড়তেই অনেকবার কেঁদেছে অহনা। কিন্তু পড়া শেষে নিস্তব্ধ মুখে বারান্দায় এসে দাড়ালো সে। ভাবছে, নাহ, অনেক হয়েছে। মনের মাঝের অদৃশ্য দেয়ালটাকে আজ উন্মুক্ত করে দিতে চায় রাতুলের জন্য। রান্নাঘরে এসে রাতুলের পছন্দমতো সবই রান্না হলো। একটু পরে রাতুল সাহেব ঘরে ফিরলে সবকিছুই কেমন যেনো অন্যরকম লাগে উনার। টেবিলে এক প্লেটে খাবার দিয়ে পাশে বসে আছে অহনা। রাতুল সাহেব এক প্লেটে খাবার দেখে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি খাবে না? শরীর খারাপ করলো না তো”? অহনা অনেকটা কান্না আটকিয়ে বললো, “আজ না হয় খাইয়ে দিলেন আমায়”।
রাতুল সাহেব অবাক হয়েছেন কিছুটা। এক লোকমা ভাত যখন অহনার মুখে তুলে দিলো তখন অহনা কান্নায় ভেঙ্গে পরে। রাতুল সাহেবের চোখেও একটু কি পানি দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ ত্বোয়ামনি দৌড়ে এসে বললো, “বাবাই বাবাই, মা কাঁদছে কেনো? তোমার চোখেও পানি কেনো বাবাই”? রাতুল সাহেব খাবার ছেড়ে মেয়েকে কলে নিয়ে বললো, “তোর বাবাই আজ পুর্ন হতে চলেছে রে”। কথাটা শুনতেই অহনা মেয়ে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। রাতুল সাহেব অহনার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, “এতো কষ্ট করে রান্না করে কি খেতে দেবেনা? কান্না করেই শেষ করবে কি”? অহনা তবুও ছাড়লো না। রাতুল সাহেব মা মেয়েকে চেয়ারে বসিয়ে এক প্লেট থেকেই সবাইকে খাইয়ে দিচ্ছেন। সুন্দর দৃশ্যটা রাতুল সাহেব স্বপ্নেও ভাবেন নি। শুধু ভাবছেন যে বিকেলে যে পার্সেলটা অহনার নামে এসেছিলো সেটাতে কি এমন ছিলো? কিন্তু বেশিক্ষন ভাবলেন না। যাই থাক, সব তো ভালই হয়েছে।
খাওয়া শেষ করে ত্বোয়ামনিকে ঘুমিয়ে দিয়ে রাতুল সাহেব আর অহনা ছাদে আসলো। একটু রোমান্টিকতার ছোয়া লেগেছে তাদের। রাতুল সাহেবের হাত জড়িয়ে পাশে বসে অহনা বললো, “আপনি কি রেগে আছেন? অবশ্যই ভাবছেন, আজ হঠাৎ কি এমন হলো”? রাতুল সাহেব হেসে বললেন, “না এসব ভাবছি না। শুধু ভাবছি যাই হোক, ভাল হয়েছে। এখন সামনে তোমায় নিয়ে এভাবে জিবনটা কাটাতে চাই। সঙ্গে থাকবে না আমার”? অহনা কিছু না বলে তার কাঁধে মাথা রাখলো। হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে বললো, “আমি ক্লান্ত নিজেকে খুঁজতে খুঁজতে। তাই আপনার কাছে নিজেকে জিম্মি করতে চাই”। রাতুল সাহেবও অহনার মাথায় আলতো চুমুর স্পর্শ দিয়ে দিগন্তে তাকিয়ে জিবনে ছক খুঁজতে লাগলেন।
পরেরদিন বিকেলে ত্বোয়ামনি ঘুম থেকে উঠেই মাকে ডাকতে লাগলো। অহনা এক কাপ কফি নিয়ে একমনে কি যেনো ভাবছিলো। হঠাৎ মেয়ের ডাকে ভাবনায় ছেদ ঘটে তার। চোখের পানিটা মুছে মুখে একটু হাসি এনে বললো, “আমি ভালবেসেছিলাম তোমায় মামুন। বলতে পারিনি আমিও, যেমনটা তুমিও পারোনি। আর হ্যা, সেদিন রাতে কেঁদেছিলাম আমি। ভাবছিলাম তুমি একবার যদি বলতে ভালবাসি, সব ছেড়ে তোমার কাছে চলে আসতাম আমি। কিন্তু তুমি আমি আমাদেরই গড়া একটা দেয়ালের মধ্যে বাধা পড়েছি। হয়তো আমি তোমার বাম পাজরের হাড় দিয়ে গড়া নই তাই। তবে যা পেয়েছি তাও কিন্তু খারাপ না।
দেখেছো তো, আমরা এখনও আগের মতোই আছি। শুধু একটু বেশি কষ্ট দিয়েছি তোমায় নিজের অজান্তে। এটার জন্য আফসোস নয়, মনে হয় এটা আমার জন্য তোমার প্রাপ্তি ছিলো। তা নাহলে কি এভাবে ভাবতাম নিজেদের। আমি অনেকদিন পর আজ ভাল আছি মামুন। আমি এখন সাজাতে পারি নিজের ছোট সংসার টাকে। দেখা হবে মামুন ততেদিনে ভালো থেকো”। এটুকু শুন্য বাতাসে বলেই অহনা ছুটে গেলো মেয়ের কাছে। কোলে নিয়ে আদর করতে লাগলো আর দেখতে লাগলো নিজের গোছানো সংসারটাকে এই ব্যস্ত শহরে কিভাবে রাঙ্গিয়ে তোলা যায়?