মধ্য রাতে পোড়া গন্ধে ঘুম ভাংলে কম্বলের নিচে থেকে মাথা বের করে দেখি আমার খাটের সোজা রাখা সোফার মধ্যে কেউ একজন সিগারেট টানছে!! টানের সাথে সিগারেটের আগুন বাড়ছে কমছে!! সেই আলোতেও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি একজোড়া চোখ খুব স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে!! চিৎকার দিবো নাকি অজ্ঞান হয়ে যাবো ভাবছি!! স্বপ্ন দেখছি নাতো?? মাঝে মাঝে কিছু স্বপ্ন খুব বাস্তব মনে হয়!!
আমার রুমের দরজা ভেতর থেকে লাগানো আর এই তিনতলায় জানালার গ্রিল কেটে চোর ঢোকা কোনভাবেই সম্ভব না!! আর চোর ঢুকলেও আয়েশ করে সোফায় বসে সিগারেট টানবে!! নাহ! কোনভাবেই না!! আর সিগারেট না, এটা বিড়ির গন্ধ!! খুব তীব্র ঝাঁজালো গন্ধ!! বিড়িতো পাশের বাড়ির দারোয়ানটা টানে!! ওই লোক কি চুরি করতে ঢুকেছে?? নাহ!! আমার এই ঘরে বাহির থেকে কোন ভাবেই মানুষ ঢোকা সম্ভব নাহ!! আমি মনে হয় স্বপ্ন দেখছি!! আমি অবশ্যই স্বপ্ন দেখছি!!
রাতে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছি, নাকি ঘুমিয়ে গেছি জানি না!! সকালে ঘুম ভাংলো আম্মার ডাকে আর দরজায় ধাক্কার আওয়াজে!! বিছানা থেকে উঠে আগে জানালার পর্দা সরিয়ে দেখলাম জানালার কোন গ্রিল কাটা কিনা!! না,জানালা ঠিক আছে দরজাও লাগানো ভেতর থেকে!! ব্যাপারটা স্বপ্ন ভাবতাম, কিন্তু সোফার দিকে চোখ পড়তেই দেখি সোফার পাশে ফ্লোরে একটা আধ টানা বিড়ি!!
দুইদিন চলে গেলেও কারো সাথে এই ব্যাপারে কথা বলিনি!! পাশের বাসার দারোয়ান আগে দেখলে সালাম দিতো কিন্তু গত দুইদিন দূরে দূরে থাকছে আমাকে দেখে!! আচ্ছা তাকে জিজ্ঞেস করি, আমি নিশ্চত এই লোক কিছু একটা জানে!!
আপনি কি কিছু লুকাচ্ছেন আমার কাছে?? কিংবা ভয়ে বলছেন না?? দারোয়ান খুব ভয় পেলো আমার কথায়!! মধ্য বয়স্ক একটা লোক গেট পাহারা দেয়ার পাশাপাশি বাজার সদাইও করে দেয় বাড়ির লোকজনের। দেখতে সহজ সরলই মনে হয়!! আমি আবারো বললাম, আপনি কি এমন কিছু আছে যে লুকাচ্ছেন বা ভয়ে বলছেন না?? আপনিতো বিড়ি টানেন, তাই না?? আসেন আপনাকে এক প্যাকেট বিড়ি কিনে দেই!! আপনার নামতো আজিজ তাই না?? আসেন আজিজ সাহেব, আমার সাথে আসেন, চা খাবেন?? চলেন চা খাই!!
আজিজ মিয়াঁ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে!! অবাকের সাথে ভয়ও পাচ্ছে খুব!! আজিজ সাহেব ভয়ের কিছু নাই!! আমি জানি আপনি গত দুইদিন আগে আমার রুমে ছিলেন, কিভাবে ঢুকেছেন তা জানি না!! তবে আমি নিশ্চত আপনি ছিলেন!! আপনি চুরির উদ্দেশ্যে রুমে ঢোকেননি তাও আমি জানি, কারন আমার রুমের কিছুই হারায় নি !! আপনি বলতে না চাইলে আমি আপনাকে জোর করবো না, আবার কাউকে এই ব্যাপারে আমি কিছু বলবো না, আপনি ভয় পাবেন না!!
চায়ের বিল দিয়ে চলে আসার সময় আজিজ মিয়াঁ মুখ খুললো!! ভাইজান আমি অশিক্ষিত মানুষ!! কেমনে মানুষের ঘরে ঢুকতে পারি জানি না!! বাপ, মারে রাইখা চইলা যায় আমি ছোট থাকতেই!! আমার আর কোন ভাইবোন ছিলো না! আমি আর মার সংসার!! একদিন জ্বর উইঠা মা মারা যায়!! সুস্থ একটা মানুষ সামান্য জ্বরে মারা গেলো ভাইজান!! মা মারা গেলে আমি পরি বিপদে!! কতদিন যে ভাইজান না খায়া ছিলাম হিসাব নাই!! টোকাইয়ের কাম শুরু করলাম!! টোকাইয়ের কাম কইরা একবেলা খাবার জুটতো না ঠিকমত!! তাই বিয়া বাড়ির সামনে সামনে ঘুরতাম তারা ঝুটা খাবার ফালায়া রাখলে তা খাইতাম!! তাওতো আপনার রোজ কি আর বিয়া হইতো তাই বেশি সময় না খায়া থাকতে হইতো!!
একদিন ভাইজান দেখলাম এক বাড়িতে বিয়া হইতেছে!! আহ সেকি আপনার পোলাওয়ের গন্ধ!! আমি ভাইজান প্রায় তিনদিন পানির উপরে ছিলাম!! পোলায়ের গন্ধে মাথা খারাপ হইয়া গেলো!! কিন্তু তাগো গেট বন্ধ!! অনেকক্ষণ বাড়ির বাইরে দাড়ায়া ছিলাম যদি গেট খোলে ঢুইকা যাবো না হয় ঝুটা খাবার দিলে খাবো!! কিন্তু তাগো গেট খোলার কোন নাম নাই!! এইদিকে আমার পোলায়ের গন্ধে মাথা খারাপ হইয়া যাইতেছে!! মনে হইতেছে দুই তিন গামলা পোলাও আমি একলা খাইতে পারবো!! পোলায়ের সাথে আর কিছু দরকার নাই!! আমি খালি চোখের সামনে এক টেবিল ভর্তি পোলাও দেখতেছি!! এরপরেই হইলো ভাইজান ঘটনা!! সত্যি সত্যি দেখলাম আমার সামনে টেবিলে সাজানো বাটিতে পোলাও রোষ্ট রেজালা!!!
আমি জানি না আমি ওই বাড়িতে কেমনে ঢুকছি কিন্তু এরপর থেকে ভাইজান আমি এক যায়গা থেকে আরেক যায়গায় যাইতে পারি চোখ বন্ধ কইরা!! কেমনে পারি ভাইজান জানি না!! এক যায়গা থেকে একটা সার্ট প্যান্ট চুরি করছিলাম!! একটু বড় হইতো আমার!! ওইটা পইরা কোন যায়গায় বিয়া বা দাওয়াত হইলে চোখ বন্ধ কইরা ঢুইকা যাইতাম!! তবে ভাইজান আমি খালি খিদা লাগলে মানুষের বাড়িতে ঢুকি এ ছাড়া আর কোন যায়গায় কোনদিন ঢুকি নাই ভাইজান!
দুইদিন আগে রাতের বেলা আপনাগো বাসার তনে পোলায়ের গন্ধ ভাইসা আসতেছিলো ভাইজান!! আহ খালাম্মার হাত মাশাআল্লাহ দুর্দান্ত নাইলে এত সুন্দর গন্ধ পোলায়ে কম হয়!! কিন্তু আমার কপাল খারাপ রাতে আপনাগো ঘরে ঢুইকা দেখি সব পোলাও শেষ!! মনের দুঃখে আপনার রুমের সোফায় বইসা বিড়ি টানতেছিলাম!! আমি অশিক্ষিত মানুষ ভাইজান!! নাইলে আপনের রুমে বিড়ি ধরানের মত ভুল কি আর করি!! বিড়ির গন্ধে আপনের ঘুম ভাইঙ্গা গেলে আমিও ভাইজান ভয় পাইয়া যাই!! বিশ্বাস করেন মনে মনে আল্লাহ্রে বলছি আল্লাহ একটা মুরগি সদকা দিবো ভাইজান যাতে চিৎকার না দেয়!! আল্লাহ আমার কথা শুনছে ভাইজান!! আপনে অজ্ঞান হইয়া গেছিলেন ভয়ে!! আমিও তারাহুরা কইরা বিড়ি ফালায়া চইলা আসছি ভাইজান আপনার রুমে!! ওই যে ভাইজান বলছি না আমি অশিক্ষিত মানুষ!! জ্ঞানবুদ্ধি একটু কম!! বিড়ি ফালায়া আইসাই ধরা খাইলাম!!
আজিজ মিয়াঁর গল্প আমি অবিশ্বাস করিনি !! কারো সাথে এই ব্যাপারের কোন কথাও বলিনি!! কে জানে সবাই আমাকে পাগল বলবে কিংবা আজিজ মিয়াঁকে চোর ভাববে!! থাকুক না কিছু রহস্য রহস্যময় হয়ে!!
কিছুদিন পর আমরা বাসা বদল করে বাড্ডা থেকে আদাবর চলে এলাম আমার অফিসের কাছাকাছি!! চলে আসার সময় আজিজ মিয়াঁর সাথে দেখা হয় আমার!! ভাইজান চইলা যাইতেছেন?? হুম!! ঠিক আছে ভাইজান!! ভালো থাকবেন, কোনদিন আপনারে দেখতে ইচ্ছা করলে চইলা আসবোনে আপনার বাসায়!! দূরত্ব আমার কাছে কোন ব্যাপার না ভাইজান!! চোখ বন্ধ কইরা আমি আজিজ যেকোন যায়গায় যাইতে পারি ভাইজান!!
আজিজ মিয়াঁর সাথে আমার আবার দেখা হয় বছর দুইয়েক পর আমার বিয়ের দিন কমিউনিটি সেন্টারে!! ভাইজান ভালো আছেন?? বিয়ার খাবার মাশাআল্লাহ এক নম্বর হইছে ভাইজান!! পাশে বসা বউ জিজ্ঞেস করলো উনি কে? বললাম, উনি আজিজ মিয়াঁ!! ওনার কাছে দূরত্ব কোন ব্যাপার না!! চোখ বন্ধ করে উনি যেকোন যায়গায় যেতে পারেন!!