দালাল

দালাল

দালাল-১

মন্তাজ মিয়া ৭/৮ দিন ধরে ফুরফুরে মেজাজে আছেন৷ তার বড় ছেলেটাকে অবশেষে তিনি বাইরে পাঠাতে পেরেছেন৷ ছেলেটার পড়া শোনার মাথা ছিল না৷ কোনরকমে মেট্রিক পাশ করেছে৷ আই এ তে সুবিধা করতে পারেনি৷ দু’বারে না হওয়ায় ছেড়ে দিয়েছে৷ উনার ছেলের নাম শহীদুল৷ শহীদুল মিয়া৷ ছেলেটা বখে যাচ্ছিল প্রায়৷ সিনেমা দেখা ঘুরে বেড়ানো মোবাইল টেপা বিড়ি খাওয়া গঞ্জে চায়ের দোকানে আড্ডা মেরে বেড়াতো৷

মন্তাজ মিয়া একদিন ছেলেকে ডেকে বললেন এসব কি রে শহীদুল? তরে যুব উন্নয়ন থেইকা কম্পুটারের কোর্সও করালাম আর তুই….

শহীদুল মাথা নিচু করে বলেছিল বাজান! এইহানে কিছু হইবো না৷ আমারে বাইরে পাঠিয়ে দেন৷
মন্তাজ বললেন বাইরে যাইয়া কি করবি? কাম কি জানস তুই?

শহীদুল বলল ক্যান বাজান, উত্তর পাড়ার মুরাদ ভাই, কল পাড়ার জাকির, হেরপরে ধরেন এই যে আমাগো পাড়ার সোমার বাপে, হগলেইতো বিদেশ গেছে৷ কাজকাম কইরা সুন্দরই আছে! দালান তুলছে৷ রমরমা!
মন্তাজ মিয়া বললেন যাওনের কোন ব্যবস্থা আছে! কই যাবি কি করবি ঠিক করছোস!

তিনি আসলে চাচ্ছিলেনও ছেলেটাকে বাইরে পাঠিয়ে দিতে৷ ওখানে গিয়ে কোন রকমে যদি কিছু একটা হয়৷ ছেলে যখন নিজ থেকেই বিদেশের কথা বলল তিনি বুকে বল পেলেন৷

শহীদুল বলল ক্যান বাজান ঐ যে মমিনুল চাচায় আছে না! পাইক পাড়ার৷ হে তো মানুষের কারবার করে৷ রাজন রে দুই মাস আগে মালয়েশিয়া পাঠাইল৷

সত্যি বলতে কি আমারেও বলছে একদিন , মমিনুল চাচায়৷ দেহুম নাকি কথা কইয়া!
মন্তাজ মিয়া চিন্তায় পড়েন৷ টাকা পয়সা কেমন লাগবে কি না লাগবে জানেন না৷ তবু বললেন আইচ্চা দেখ যাইয়া৷ জানাইস আমারে৷

শহীদুল উৎসাহে তার বাজানকে কদমবুসি করে বলে আমি বলে দেখতেছি বাজান!
ছেলেটা যাবার সময়ে ওর যাওয়ার পথে তাকিয়ে আল্লাহকে বলেন আল্লাহ পোলাডা এমনে মানুষ খারাপ না৷ বেকার থাইকা সঙ্গদোষে পড়ছে! তুমি দেইখো….
….
দ্রুত পাসপোর্ট হয়ে গেল৷ ভিসার জন্যও দিয়ে দেওয়া হল৷ মমিনুলের সাথে ভিসা’র জন্য চারলাখ টাকায় রফা হল৷ শহীদুলকে সে মালয়েশিয়া পাঠিয়ে দেবে৷

মন্তাজ মিয়া অনেক কষ্টে ছেলের বিদেশ যাবার টাকার ব্যবস্থা করলেন৷ মমিনুল তাকে আশ্বাস দিল বড় ভাই ডেকে৷ বলল চিন্তা করবেন না ভাইজান৷ আপনের পোলা মাইনে আমারও পোলা৷ ভাল কাজেই ওরে পাঠামু৷ দোকানে কাম করব শহীদুল৷ আমার চেনা মানুষের দোকান….

পাঁচমাসের মধ্যে সব ব্যবস্থা হয়ে গেল৷ মন্তাজ মিয়া যেতে চেয়েছিলেন বিমান বন্দরে৷ মমিনুল বলল ভাইজান আমি আছি৷ আমার লোকরা এরে ভাল হোটেলে রাখবে৷ আর পোলায় তো আপনের লগে মোবাইলে কতা কইবই! সমস্যা নাই৷

চোখে স্বপ্ন নিয়ে মা’কে কাঁদিয়ে শহীদুল ঢাকা গেল৷ ওর ছোট বোনটা তখন কাঁদছিল৷ ছোট ভাইটা অবশ্য এসব বোঝে না৷ সে খুশী৷ তার ভাই বিদেশ যাচ্ছে৷ তার বায়না বিদেশ থেকে তার জন্যে একটা হেলিকপ্টার পাঠানো লাগবে যেটা রিমোট দিয়া উড়ানো যায়৷ শহীদুল ঢাকা পর্যন্ত তার সাথে যোগাযোগ করেছে৷ বাইরে থেকে একবার কথা বলেছিল পৌঁছানোর পর৷ এর পরে আর কথা হয়নি৷ বলেছিল বাজান পেলেইন থাইকা নামছি৷ গাড়ি আইয়া নিয়া যাবে আমাগো৷ চিন্তা কইরেন না৷

ছেলে যাবার এক সপ্তাহ পর সকালে তিনি মেছওয়াক করছিলেন৷ হঠাৎ ভেতর থেকে উনার স্ত্রী’র চিৎকারে মনের মধ্যে কেন জানি ধ্বক করে উঠলো৷ পড়িমরি করে ভেতরে আসলেন৷

উনার স্ত্রী উনাকে মোবাইল দেখিয়ে চিৎকার করে কান্না করছেন আর শুধু বলছেন আমার শহীদুল আমার শহীদুল, ও শহীদুলের বাপ…..

কাঁপা হাতে মন্তাজ মিয়া মোবাইলটা কানে লাগাতেই শুনলেন ছেলের আর্তনাদ৷ বাজান বাজান গো……. আমারে বাঁচান…….।
তিনি চিৎকার করে বললেন তোর কি হইছে রে শহীদুল, ও আব্বা তুই এমনে চিৎকার করতিছিস ক্যান!

অন্য আরেকজনের ভারী গলা শোনা গেল শহীদুলের চিৎকার ছাপিয়ে! সে বলল ছেলেকে জিন্দা চাইলে আমরা যেমনে বলব অমনেই করবি, ওখন ফোন রাখ৷ পরে বলব কি করতে হবে…..

শহীদুলের মা মূর্ছা গেলেন৷ মন্তাজ মিয়া বন্ধ ফোনে কান লাগিয়ে বলেই চলেছেন আব্বা, শহীদুল আব্বা গো…. শহীদুল……

দালাল -২

ঘটনা মোটামুটি ভয়াবহ৷ শহীদুল কে একটা জায়গায় বন্দী করা হয়েছে৷ হাত পা বেঁধে পেটানো হচ্ছে৷ এই খবরটাই সকালে ফোনে দেওয়া হয়েছে ওর বাড়িতে৷ শহীদুলের বাবা অজ্ঞান হয়ে বিছানায় পড়ে গেছেন৷ মনোয়ারা বেগম শহীদুলের মা চোখ মুছে মন্তাজ মিয়ার মাথায় পানি ঢালছেন৷ ক্ষণে ক্ষণে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুচছেন৷

একটু ধাতস্ত হবার পর মন্তাজ মিয়া উঠে বসলেন৷ তিনি মনোয়ারা বেগমকে বললেন বউ শহীদুল এর একি হইল৷ বিদেশ আমার পোলারে কে আটকাইল৷

মনোয়ারা বেগম বললেন আমি কেমনে কব শহীদুলের বাপ! আমি কেমনে কব৷
মন্তাজ মিয়া বললেন ইদ্রিসরে খবর দেও৷ দেখ ইদ্রিস কি বলে!

মনোয়ারা বেগম মহিদুল মানে শহিদুল এর ছোট ভাই কে বললেন তুই দৌঁড় পাইরা তোর ইদ্রিস মামার কাছে যা৷ ওখন দোকান খুলব সে৷ তাড়াতাড়ি আইতে কবি৷

মহিদুল আইচ্চা বলে দৌঁড় দিল৷ সব বুঝতে না পারলেও বড় ভাই যে বিদেশে বিপদে পড়েছে সেটা ভাল ভাবেই বুঝতে পেরেছে৷
ইতোমধ্যে প্রতিবেশীরা উঁকি ঝুঁকি দেওয়া শুরু করেছে৷ ওরা সকালে এই চিৎকার চেঁচামেচি শুনে কৌতুহলী৷ দু’চারজন ভেতরে এসে মন্তাজ মিয়া ও মনোয়ারা বেগমের কাছ থেকে কিছুটা জেনে নিয়েছেন৷

খবর ছড়িয়ে পড়ল মুহূর্তে৷ একান ওকান করে যে খবর শেষপর্যন্ত সবার কাছে পৌঁছল সেটা মূল ঘটনার চেয়েও ভয়াবহ৷ অনেকে বলতে শুরু করল শহীদুলের আঙুল কেটে বাসায় পাঠানো হয়েছে, কেউ বলছে শহীদুল মারা গেছে কেউ বলছে সে কিডনেপ হয়েছে৷

ইদ্রিস মনোয়ারা বেগমের মামাত ভাই৷ মহীদুলের কাছে খবর পেয়েই ছুটে এসেছে৷ এসে দেখল বাড়ির অবস্থা ভয়াবহ৷ প্রতিবেশীরা সবাই মন্তাজ মিয়ার ঘরের বারান্দা আর ঘর দখল করে বসে আছে৷ সামনের ঘরে মন্তাজ মিয়া দিশেহারা দৃষ্টিতে বসে আছেন৷ উপরে পাখা চললেও মরিয়ম শহীদুলের বোন, তাদের বাবাকে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করছে৷ তারপরও মন্তাজ মিয়া ঘেমে নেয়ে একাকার!

ইদ্রিস বলল দুলাভাই কি সমস্যা?
মন্তাজ মিয়া চোখ খুললেন৷ উনার চোখ টকটকে লাল৷ বললেন ওরা শহীদুলরে পিটাইতেছে রে ইদ্রিস, আমার শহীদুল চিৎকার পারতেছে রে….

ইদ্রিস উনার কাঁধে হাত রাখল৷ বলল আপনি টেনশান করবেন না৷ বু’জির সাথে কথা বলে দেখি৷ আপনি শুয়ে থাকেন৷
মন্তাজ মিয়া আবার শুয়ে পড়লেন৷ ইদ্রিস ভেতরের ঘরে গেল৷ মহিদুলকে ডাক দিল সে৷ ইদ্রিস বুঝতে পেরেছে এরা কেউই সকাল থেকে কিছু খায়নাই৷ মন্তাজ এর হাতে দু’শ টাকা দিয়ে বলল তুই সামনের হোটেল থাইকা পরোটা আর ভাজি লইয়া আয়৷ আগে সবাইরে কিছু খাওয়াই৷

ইদ্রিস ঠান্ডা মাথার মানুষ৷ সে বুঝতে পেরেছে শহীদুলের বিদেশ গমন সংক্রান্ত কোন ব্যাপারই হবে৷
আগেই সে মন্তাজ মিয়ারে বলেছিল সাবধানে ভেবেচিন্তে কাজ করতে৷ মন্তাজ মিয়া সম্ভবত আবেগের ঠেলায় সে সময়ে তার কথা শোনেনি৷

মনোয়ারা বেগম বসে বসে কাঁদছিলেন৷ পাশের বাড়ীর দুই মহিলা বসে উনাকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করছিলেন৷ ইদ্রিস গলা খাকরি দিয়ে বলল আপারা আপনেরা একটু পাশের ঘরে যান, বু’জীর সাথে আমি একটু একা কথা কব৷
ইদ্রিসকে দেখেই তিনি বিলাপ শুরু করতে যাবেন, ইদ্রিস বলল বু’জি কান্না থামান৷ আমারে পুরা ঘটনা খুলে বলেন৷ কান্নাকাটি করে লাভ নাই৷ ব্যাপারটা আমাকে বুঝতে দেন৷

মনোয়ারা আঁচল চাপা দিয়ে আবার কান্না করতে লাগলেন৷
ইদ্রিস ধমকের সুরে বলল বু’জি! কান্না বন্ধ করেন৷ ঘটনা কি খুলে বলেন৷
মনোয়ারা বেগম সকালে পাওয়া কল সহ সবকিছু খুলে বললেন ইদ্রিস কে৷
ইদ্রিস বলল ওরা বলছে আবার কল করবে?
মনোয়ারা মাথা নাড়লেন৷

ইদ্রিস বলল তাহলে আমরা ওদের কলের জন্য অপেক্ষা করি৷ আপনি দুলাভাইরে নিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যান৷ প্রেসার মাপায়ে ওষুধের ব্যবস্থা করেন৷ এই ফোনমোন আমি দেখতেছি৷

তার আগে কিছু মুখে দিয়ে যান৷ মহিদুল রে পরোটা আর ভাজি আনতে পাঠাইছি৷
আইচ্চা যাউক হাসপাতালে যেতে হবে না৷ আমি দেখি কি ব্যবস্থা করা যায়…

ইদ্রিস মোটামুটি আধাঘন্টায় এই বাসার অবস্থা স্বাভাবিক করে ফেলল৷ শহীদুল এর ছোট ভাইবোন দুটোকে খাইয়ে মনোয়ারা আর দুলা ভাইকে বসাল খাওয়াতে৷ এরমধ্যে ইদ্রিস তার স্ত্রীকেও ফোন করে আনিয়ে নিয়েছে৷ সে এখন বোন আর বোন জামাইকে দেখছে৷ পরিচিত এক ডাক্তারের সাথে কথা বলে অনুরোধ করেছে একটু এক্ষুনিই ঘুরে যেতে৷ এখানকার পরিস্থিতিটা অবশ্য বলতে হয়েছে৷

ডাক্তার বলেছেন হাতের কাজ শেষ করেই আসছেন৷ দুলাভাই এর এমনিই প্রেসার আছে৷ ঘরে থাকা প্রেসারের ওষুধ দুটো খাইয়ে দিতে বলেছে তার স্ত্রীকে৷

প্রতিবেশীদের বলেকয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে৷
ঘরের পরিস্থিতি একটু ঠান্ডা হলে ওর দোলাভাইএর মোবাইলটা নিয়ে বসল সে৷ ওরা বলেছে ফোন করবে৷ সেই ফোনের অপেক্ষায়ই সে বসে আছে৷

ঘরটা নীরব৷ দেয়াল ঘড়ির টিকটিক শব্দটা শোনা যাচ্ছে৷
অপেক্ষার প্রতিটি প্রহর দীর্ঘ মনে হচ্ছে৷ হঠাৎ ফোন টা বেজে উঠল৷
ইদ্রিস জীবদিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বাটনে চাপ দিয়ে বলল হ্যালো…..

দালাল -৩

ফোন নামিয়ে রেখে ইদ্রিস গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়৷
মনোয়ারা আর মন্তাজ মিয়া চোখে ভয় কৌতুহল যন্ত্রণা আর জিজ্ঞাসার মিশেলে তার দিকে তাকিয়ে থাকে৷
কাঁপা কাঁপা গলায় মন্তাজ মিয়া বলেন ওরা কি কইল ইদ্রিস? পোলাডা ঠিক আছে তো!
ইদ্রিস কথা বলে না৷

এবার মনোয়ারা বললেন ফোঁপাতে ফোঁপাতে… ইদ্রিস কথা কস না ক্যান!
ইদ্রিস অন্যমনষ্ক ভাবে বলে হু! আপা… দুলা ভাই… আমারে কিছু কন?

মনোয়ারা এবার শব্দ করে কেঁদে ওঠেন৷ মন্তাজ মিয়া ধমকের সুরে বলেন শহীদুলের কি খবর কইল হেরা! বলে হাঁপাতে থাকেন৷
ইদ্রিস বলে দুলাভাই, আপা হেরা দুইলাখ টাকা চায়৷ দুইদিনের মইধ্যে যোগাড় করে দেওন লাগবো৷ দুইদিন পরে আবার মোবাইল করবে৷ না দিতে পারলে…..

ও আল্লাহ… গো……মনোয়ারা চিৎকার করে ওঠেন কথা শেষ হবার পূর্বেই৷
এবার ইদ্রিস ধমক দেয় তির বোন কে৷ চুপ বুজি! চুপ….

দুলাভাই মন্তাজকে উদ্দেশ্য করে বলে আপনেও আর কোন কথা কবেন না৷ আমারে ভাবতে দেন৷
মন্তাজ মিয়া ফিসফিস করে বলেন আমার কাছে আছে কিছু!

ইদ্রিস বলে দুলাভাই টাকা সমস্যা না৷ আমারও মাল কিননের টাকা আছে৷ কিন্তুক টাকা দেওনটা সমস্যার সমাধান না৷
শহীদুল দেশে থাকলে একটা কথা ছিল৷ টাকা দিয়া ছাড়ায়ে আনতাম তারপরে ব্যবস্থা নিতাম৷

কিন্তু শহীদুল আছে বাইরে৷ দেশের বাইরে৷ তুমরা বলতেছো সে মালয়েশিয়ায়৷ কিন্তুক আমার মনে হয় না সে মালয়েশিয়ায় আছে৷ তুমরা ভুল জানো!

তুই কেমনে বুঝলি ইদ্রিস?
আমি বুঝি নাই দুলাভাই আমার মন কইতেছে!
মন্তাজ মিয়া হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন৷ বললেন হালারফো দালাল রে ধরি গিয়া….
ইদ্রিস বলল,
দুলাভাই মাথা ঠান্ডা করেন৷
দালালরে এক্ষন ধরলে হেরা সাবধান হয়ে যাবে৷ আপনের ছেলেরে মাইরাও ফেলতে পারে! এই সব কামই করবেন না৷ এইডা শহীদুলের জীবন মরণের প্রশ্ন৷

মন্তাজ মিয়া আবার ধপ করে বিছানায় বসে পড়লেন৷
ইদ্রিস বলল আপনেরা এসব নিয়ে কোন কথা কারও সাথে কবেন না, আবার বলতেছি কোন কথা কারও সাথে কবেন না৷
টাকার যোগাড় করেন৷ যদি কিছু লাগে আমিও দিতেছি৷ ধরেন গিয়া একলাখ একলাখ বিশ যোগাড় করেন, বাকিটা রাইতে আমি আনতেছি৷

এখন আমি যাই৷ দেখি কিছু ব্যবস্থা করা যায় কি না!
বের হবার পূর্বে নিজের স্ত্রী কে ডেকে বলল তুমি হেগো লগে থাক৷ আমি আসতেছি৷ আর হুন বউ, এবার ফিসফিস করে বলল মাঝেমইধ্যে বাইর হয়া দেখবা ঘরের আসেপাশে এমন কেউ ঘুরে কি না, যাগোরে আগে এই পাড়ায় দেহ নাই!
ইদ্রিসের বউ বলল আমি কেমনে বুঝুম? এডি আমার বুঝনের কতা!
ইদ্রিস বলল তুমি নজর রাইখো৷ বুঝলে বালা, না বুঝলে নাই! আমি ওহন যাই….

ইদ্রিস ওর আপা’র বাসা থেকে বের হবার সময় মহিদুলকে পেল৷ মার্বেল খেলছে৷ ডাক দিল তাকে৷
মহিদুল বলল জে মামুজান!

ইদ্রিস বলল অপরিচিত কাউরে ঘুরঘুর করতে দেখলে চেহারা দেইহা রাখবি৷ কিন্তুক সাবধান কিছু যেন কেউ টের না পায় আর এই ধর,
বলে দশটাকার একটা নোট বের করে দিল মহীদুলের হাতে৷
আবার বলল সাবধান!
তোর ভাইয়ের কতাও কিন্তুক কাউরে কবি না৷
কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবি বিদেশে কাম করতে যায়ে ভাই এর হাত কাটছে৷ চিকিৎসা হইতেছে! বুঝলি?
মহিদুল ঘাড় কাত করে৷
চিন্তামগ্ন ইদ্রিস দোকানের দিকে পা বাড়ায়৷

দালাল (৪)

ইদ্রিস একসময় রাজনীতি করত৷ প্রবল ভাবেই করত৷ বাবার মৃত্যুরপর সংসারের হাল ধরতে যেয়ে আস্তে আস্তে রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসে৷ এবং একসময় বুঝতে পারে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তই আজ তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে৷ তার সাথের হালিম পুলিশের গুলিতে মারা গেছে৷ মজিদ পঙ্গু৷ বাবার ব্যবসার হাল ধরাতেই সে সম্ভবত বেঁচে গেছে৷ নিজের রাজনৈতিক পরিচয় এখন সে আর জাহির করে না৷ এলাকার স্থানীয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা একসময় তার বন্ধু ছিলেন৷ মাস ছ’য়েক আগে তিনি এ এলাকায় এসেছেন৷ বাজারে হঠাৎ একদিন তিনি ইদ্রিসকে বলেছিলেন এই তুই ইদ্রিস না! প্রথমে ইদ্রিস হকচকিয়ে গিয়েছিল৷ ইউনিফর্ম পরা লোকটা বলছিল আবে হালায় চিনলি না আমি মালেক! মুহাম্মদ মালেক! তোরা আমারে তেলাচুরা ডাকতি৷
ইদ্রিস বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে হেসে ফেলেছিল৷ প্রায় আটবছর পর দেখা৷ শরীরে ভারী হয়ে গেছে মালেক৷ আগে তার মাথা আর শরীরে তেল চকচক করত৷ এখন চুল পড়ে টাক চকচক করে৷

সেই থেকে অবশ্য বাজারে আসলেই মালেক সাহেব ইদ্রিসের দোকানে বসতেন৷

ইদ্রিস এখনও শহীদুলের কথা মালেককে জানায়নি৷ কেননা দুপুরের দিকে মনোয়ার কল করেছিলেন৷ বলেছিলেন তাদের কাছে আরেকটা কল এসেছে এবং লোকটা বলেছে তারা যদি পুলিশকে জানায় তাহলে শহীদুলকে মেরে বালিতে পুঁতে ফেলবে!
মনোয়ারা কাঁদছিলেন৷

ইদ্রিস বলল আপনে ঐ নাম্বারটা দেন৷ মনোয়ারা মহিদুলের সাহায্য নিয়ে নাম্বারটা ইদ্রিসকে দিলেন৷
ইদ্রিস যে তাদের ওখানে এসেছিল, সেটাও নাকি ওরা বলেছে এবং আর যেন না আসে সেটাও বলেছে৷ মনোয়ারা বুদ্ধি করে বলেছেন দু’লাখ টাকা তিনদিনে ক্যামনে যোগাড় করব৷ ইদ্রিস এসেছিল টাকার ব্যবস্থা করতে!

ওরা বলেছে সাবধান এই লোক(ইদ্রিস), যেন থানাপুলিশের কাছে না ঘেঁষে!
সন্ধ্যা হয় হয়৷ কাগজে লেখা দুটো নাম্বারের দিকে ইদ্রিস তাঁকিয়ে আছে৷
এই দুটো নান্বার দেশের ভেতরের৷ আর সকালে চিৎকার শোনানো নাম্বারটা বাইরের!
কোন দেশের?
এই মুহূর্তে তা জানার চেষ্টা করছে না সে৷
দোকানের সাহায্যকারী ছেলেটাকে ডাক দিল সে৷ বলল তোর মোবাইল আছে সাথে?
সে বলল যে আছে৷

ইদ্রিস বলল তোর মোবাইলে ত্রিশটা টাকা দিয়া আয়৷ আর পরে যেন আরও একশটাকা ঢুকায় দোকান থেকে! সেইটা বইলা টাকা দিয়া আসবি৷ বুঝছস৷
ছেলেটা মাথা নাড়ায়৷
ইদ্রিস বলে দোকানে বসবি না৷ আসার সময়ে সিঙ্গারা নিয়া আসবি আর চা৷
রিক্সাস্ট্যান্ডে মতিরে পাইলে কবি দশটার দিকে… না না এগারটার দিকে যেন দোকানে আহে!
ছেলেটা ঘাড় কাত করে চলে গেল৷

তার মহাজন একটু পাগলা কিছিমের তবে লোক ভাল৷ ক্যান আজকা তার মোবাইলে টেকা ভরতে বলছে সেটা সে জানে না৷ ত্বয় কারণ আছে নিশ্চয়ই৷

রাত এগারোটার দিকে দোকান বন্ধ করে মতির রিক্সায় উঠে ইদ্রিস৷ বাজার প্রায় শুনশান৷ দোকানের ছেলেটার মোবাইল সে আগেই নিয়ে নিয়েছে৷

নিজের মোবাইলটাতে চার্জও দেয় নি৷ ওটা বন্ধ হবার যোগাড়৷
বাড়ীর সামনে ইদ্রিস নেমে যায়৷ মতিরে পয়সা দেয়৷ কিছু না বলে দরোজায় কড়া নাড়ে৷
আজ বাড়ীর সামনের বারান্দার বাতিটাও জ্বলছে না৷ বোধকরি কেটে গেছে৷ ইদ্রিস ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়৷ ইদ্রিসের স্ত্রী সন্ধ্যায়ই মনোয়ারা বেগমের বাড়ী থেকে চলে এসেছিল৷

রাত প্রায় বারটা মালেকের বাসার সামনে মতি রিক্সা থামিয়ে নামে৷ সেন্ট্রিকে বলে মালেক সাহেবরে বলেন ইদ্রিস আসছে! ব্যাপার খুব গুরুতর!

ওর কন্ঠে নিশ্চয়ই এমন কিছু ছিল যেটা সেন্ট্রিকে স্পর্শ করে৷ না হয় রাত বারটায় একটা রিক্সাওয়ালার কথায় সে স্যার কে ডাকতে যেত না৷

কোঁচ থেকে বের করে একটা সিগারেট ধরায় ইদ্রিস৷
মতির রিক্সা রাস্তার অন্ধকারে একটা কোনায় দাঁড় করিয়ে কাপড় আর জায়গা বদল করে ইদ্রিস৷ সেটা আগে থেকেই ঠিক করা৷
বারান্দার বাতিটাও এজন্য জ্বলেনি৷ মতি ইদ্রিসের ঘরে ঢুকে পেছন দিয়ে বেরিয়ে গেছে৷ আর ইদ্রিস মতি সেজে চলে এসেছে মালেক সাহেবের বাসার সামনে৷

ইদ্রিসের ধারণা শহীদুলকে যারা সরিয়েছে তারা তার উপরও লক্ষ্য রাখছে!
মালেক সেন্ট্রি’র সাথে দের হয়ে আসে৷ ইদ্রিসকে এই অবস্থায় দেখে অবাক হয় কিন্তু কিছু বলে না৷ ছাত্রজীবন থেকেই সে ইদ্রিস কে চেনে৷ ইদ্রিস বিনাপ্রয়োজনে এমন করবে না৷

মালেক ফিসফিস করে বলল সমস্যা কি!
ইদ্রিস বলল আপনের জিনিসগুলা ভিতরে রাইখা আসি স্যার!
মালেক বললেন ও আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে, আস!
ইদ্রিস মালেক সাহেবের বাসার ভেতরে চলে গেল৷
সোফায় বসে হাঁপ ছাড়ল৷ তারপর বলল মালেক আগে পানি খাওয়া৷ এত পথ রিক্সা চালায়ে হয়রান হয়ে গেছি! হেরা যে ক্যামনে এই ডা টানে, আল্লাহ মালুম!

আর হোন, আরেকটা লোক আসব , মানে এই রিক্সা চালক৷ সেন্ট্রিরে কয়া রাখ!
মালেক হেসে বলল তোর অভ্যেস আর যায় নি, যায়নি আঞ্চলিকটানে তোর কথা বলা!
এখন তাড়াতাড়ি বলে ফেল এত রাতে এসব নাটক করার মানে?

ইদ্রিস পানি খেয়ে নিঃশ্বাস ফেলে বলল অবস্থা গুরুতর৷ দাঁড়া কইতেছি৷
এরপর শহীদুলের ব্যাপারটা পুরোটা সে ভেঙে বলল৷ তিনটে ফোন নাম্বার লিখা কাগজটা দিল৷
তারপর বলল মালেক একটা জিনিস দেখছিস, দুইডা নাম্বারই বাংলাদেশের! মাইনে হেরা দেশথাইকাই অপারেট করতিছে!
মালেক গম্ভীর ভাবে বলল হুমম৷ মানুষগুলো যে কেন কিছু না বুঝে শোনে এসব ফাঁদে পা দেয়..

দালাল -৫

মালেক প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে ইদ্রিসকে প্রশ্ন করল আচ্ছা এসব পরে হবে আগে আমারে একটা কথির জবাব দে, তুই ঘটনা জানছস সেই সকালে এখন রাত প্রায় একটা৷ এত সময় পরে আর এই নাটক কইরা আমার এখানে আসছস ক্যান? যদ্দূর জানি তুই দরকার না পড়লে কিছু করস না কীন্তু আইজ তোর কি হইছে!

তাছাড়া তোর যা বুদ্ধি, এই সামান্য ব্যবসা নিয়া পইড়া রইছস ক্যান? পড়াশোনাও তো মনে হয় শেষ করসনাই! তোর ব্যাপারটা কি?
ইদ্রিস বলল মালেক তুই জানস আমি একসময় রাজনীতি করতাম৷
মালেক মাথা নাড়ল৷
ইদ্রিস বলছে মনে আছে গন্ডগোলের সময় আমারে ফাঁদে ফেলানোর লাইগা কি করা হইছিল!
মালেক আবারও মাথা নাড়ল৷

ইদ্রিস বলল সেই ষড়যন্ত্রে আমাগো দলেরই কিছু পোলাপাইন জড়িত ছিল৷
সেদিন যে মেয়েটাকে ওরা উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল তাঁকে উদ্ধারের জন্য কেউ যাইতে রাজি হয় নাই৷ আমি গেছিলাম৷ মেয়েটার দোষ আছিল হেই আমার লগে কয়ডা কতা কইছিল৷ ওরা মনে করছিল মেয়েটার সাথে আমার….

আমি ঠিকই মেয়েটাকে উদ্ধার করি৷ আর হের পরে মেয়েটারে নিয়া জায়গাটা ছাড়ি৷ অবশ্যই তার অনুমতিতে৷ নিজের দেশে মানে নিজের বাড়িতে চলে যাই৷ বাবা তখন শয্যাশায়ী৷ চারিদিকে ছড়ায়ে পড়ছিল আমি নিখোঁজ! মনে আছে৷
মালেক সাহেব বললেন হুঁ.

আমি আমার বাপেরে বাঁচাইতে পারি নাই৷ বাপের মাতাত হাত দিয়া কছম কাটছিলাম আমি আর রাজনীতিতে ফিরব না৷
এই মন্তাজ দুলাভাই আর মনোয়ারা আপা হেই সময়ে আমারে এখানে নিয়া আসছে৷ কেউরে কিছু জানতে দেয় নাই৷ গঞ্জে ব্যবসা সে নিজে দাঁড় করায়ে দিছে৷ আমি থাইকা গেছি৷

আচ্ছা বাদদে৷ এইসব পরে একদিন বলব৷ শুধু হুইনা রাখ হেগো কাছে আমি ঋণী৷ আইজ হেগো একটা বিপদ৷ ভাগ্নেটা বিদেশ বিঁভুইয়ে কে বা কারা আটকায়ে রাখছে হেরে৷ মুক্তিপণ চায়৷ আমার মনে হয় শুধু শহীদুল না, এমন আরও অনেক পোলাপাইন ওইহানে আটকায়ে আছে৷ এরা বড় একটা চক্র৷ বেশ বড়৷

তোর কাছে সকালে আসি নাই কারণ আমি আপার বাসা থাইকা বের হইয়া দোকানে যাই৷ দুপুরের দিকে আপার বাসা থেইকা মোবাইলে কল আসে৷ আপা আর দুলাভাইরে শাঁসানো হইছে৷ পুলিশের লগে কিংবা আমার লগে যদি যোগাযোগ করে তাইলে শহীদুল রে আর ফিইরা পাওন যাবে না৷

আপা বুদ্ধি কইরা কইছে আমারে ডাকাইছে টেকার লাইগা৷ বুঝছস!
তার মানে কি দাঁড়ায়! ফোন আহনের পর থেইকা নজর রাখা হইতেছে আমাগো উপরে৷
হেরা চায় না পুলিশের কাছে যাই৷

আর ওই মমিনুল দালালরে কিছু জিজ্ঞেস করতে বি ধরতে বারণ করছি আমিই৷
কারণ একটারে ধরলে বাকিগুলা সতর্ক হয়ে যাবে৷ শহীদুলরে পুরা গায়েব করে দিবে৷ আমি তিনটা নান্বার যোগাড় করে এখানে আসছি৷ খেয়াল কইরা দেহিস যেই রিক্সাড্রাইভার রে লইয়া আসছি সে গায়ে গতরে দেখতে আমার মতনই৷ মাঝরাস্তায় আমার কাপড় পরাইয়া হেরে বসায়ে দিছি৷ ঘরে ওরে ঢুকায়ে দিছি৷ বউ পেছনদিকে হেরে বাইর কইরা দিছে৷ আমি রিক্সা লইয়া তোর এখানে আসছি৷

মালেক মিটিমিটি হাসছে৷
ইদ্রিস বলল হাসছ ক্যান!
মালেক বলল তুই ঠিকমত পড়াশোনা করলে গোয়েন্দাবিভাগে চাকরী পাইতি৷ তোর বুদ্ধিতে অহনও জঙ ধরে নাই রে ইদ্রিস!
ত্বয় যেইডা করছস, খুব বালা কাম করছস৷

আমি এখান থেকে খুব বেশী ব্যবস্থা নিতে পারব না৷ তবে এটা উপরে জানাতে পারব৷
আচ্ছা শহীদুলের কাগজ পত্র আছে?
মানে কোনধরণের বিদেশ যাবার কাগজ পত্র কই কি করছে না করছে কোন ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে কি করছে না করছে এইসব আরকি৷

পরনের ময়লা গেঞ্জি উপরে তোলে লুঙ্গির গিঁট আর পেটের মাঝ বরাবর থেকে কিছু কাগজ বের করল ইদ্রিস৷ বলল আছে৷ আমি সকালেই নিয়া বের হইছি৷ ত্বয় ভিসা লাগানোর কাগজ নাই! মানে ফটোকপি নাই৷ ওরা নাকি ঢাকা যাবার পরে পাসপোর্ট দিছে৷ এইটা অবাক ব্যাপার৷ দুলাভাই তখন আমারে জানায়নাই ব্যাপারটা৷

মালেক বলল তুই এখন বাসায় যা৷ আমি দেখছি৷ তোকে জানাব৷ দু’ইদিন পরে টাকা লাগবে৷ সেটির যোগাড় কর৷ লাগলে আমারে বলিস৷

ইদ্রিস মাথা নাড়ল৷ মানে লাগবে না৷
মালেক আবার বলল এরা টাকা সরাসরি নেবে বলে মনে হয় না৷ যেটা করবে সেটা হল ব্যাংক একাউন্ট নাম্বার দিবে বিকাশ বা অন্য ধরণের একাউন্ট নাম্বার দিবে বলেই আমার বিশ্বাস৷

ইদ্রিস মাথা দোলাল৷ ঠিক বলছিস৷ আর আরও একটা কাজ করবে, সেটা হল ভেঙে ভেঙে বিভিন্ন একাউন্টে টাকা দিতে বলবে৷ সবগুলা একাউন্টের হদিস বের করতে হবে৷ না হলে হবে না৷
একটু চিন্তা করে ইদ্রিস বলল মালেক আমি ভাবতেছি অন্য কতা!
কি কথা? মালেক প্রশ্ন করল৷

ইদ্রিস চিন্তিত মুখে বলল আমার মনে হয় ওরা শহীদুল রে এত তাড়াতাড়ি ছাড়বে না৷ অবস্থা যা হইছে এরা এরপরে আরও টেকা চাইবে৷

মালেক চিন্তিত মুখে বলল মিছা কস নাই রে মিছা কস নাই….

দালাল- ৬

থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মালেক সাহেব এবং শহীদুলের মামা ইদ্রিসের ভূমিকা আপাতত এখানেই শেষ৷ মালেক সাহেব গোপনে যে কাগজ পত্র আর প্রমাণ পাঠিয়েছিলেন সেই কাগজপত্র আর প্রমাণ সহ কাজে নামে গোয়েন্দা বিভাগ৷ উত্তরা মডেল থানায় পুলিশের পক্ষ থেকে শহীদুলের মা কে বাদী করে একটা মামলা দায়ের করা হয়৷

মুক্তিপণ চেয়ে ফোন করা হয়েছিল বারই ফেব্রুয়ারী ২০১৯ এ৷

১৪ ই ফেব্রুয়ারী দালাল চক্রের কথা অনুযায়ী কয়েকটি বিকাশ একাউন্ট এবং দুটি ব্যাংক একাউন্টে দু’লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়৷ এর তিন ঘন্টা পর আবার সেই বিদেশী নাম্বার থেকে কল আসে এবং শহীদুলকে করা টর্চারের চিৎকার শুনিয়ে আরও দু’লক্ষ টাকা দাবী করা হয়৷

গোয়েন্দা পুলিশ অবশ্য এর তিনদিন আগে থেকেই প্রাপ্ত সকল নাম্বার শহীদুলের বাবার নাম্বার সহ সবকিছু ট্রেস করে৷ সেই সূত্রধরে বিকাশ নাম্বার এবং এবং ব্যাংক একাউন্টের প্রয়জনীয় সকল তথ্য উদ্ধার করে৷ পনেরই ফেব্রুয়ারী ছিল শুক্রবার৷ ১৪ তারিখে কিডনেপাররা বলে সতেরই ফেব্রুয়ারী রবিবারে আরও দু’লাখ টাকা জমা করার৷ কিন্তু গোয়েন্দা পুলিশের টীম দেশের তিন জায়গায় অভিযান চালায় ষোলই ফেব্রুয়ারী একইযোগে একই সময়ে এবং বিকাশ ও ব্যাংক একাউন্টের সূত্র ধরে চারজন মানুষকে ওরা গ্রেফতার করে৷ একজন হলেন সেই দালাল যিনি শহীদুলকে কাগজপত্র ঠিক করে দিয়েছিলেন, নোয়াখালী থেকে গ্রেফতার করা হয় শফিউল্লাহ, বরগুনা থেকে এহসান রাসেল এবং ঢাকা থেকে গুলজার হোসেন কে৷

সফিউল্লাহর মাধ্যমে সেই টর্চার সেল এ জাহিদ নামক একজন লোকের সাথে কথা বলা হয় এবং সফিউল্লাহর নির্দেশেই সে ঢাকা গামী বিমানের টিকেট কেটে শহীদুল কে সেই বিমানে উঠিয়ে দেয়৷ মার্চের চার তারিখে শহীদুল নিজের পরীবারের সাথে মিলিত হয়৷ বাবা মা শহীদুল কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন৷

পরবর্তিতে শহীদুল পুলিশ এবং পত্রিকার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে যে বিবৃতি দেন সেটি নিচে শহীদুলের বয়ানে তুলে ধরা হল…

শহীদুলের কথায় যাবার আগে পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলি, এটি কোন সাজানো গল্প নয়৷ এটি একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা৷ আমি স্থান কাল পাত্র নাম তারিখ এসব বদলে দিয়েছি শুধু৷ শহীদুল তার বাবা ও মা এবং গ্রেফতার কৃত দালালদের সকল বিবৃতিই সত্য৷

#শহীদুলের_জবানবন্দী
#ওরা_আমাকে_রড_দিয়ে_পেটাত

মমিনুল দালাল এর কথার ফাঁদে বা প্রলভোনে পড়ে মালয়েশিয়ায় একটা ভালো চাকুরীর জন্য দ্রুত পাসপোর্ট করে চারলাখ টাকা মমিনুল কে দেই৷ সেটা একেবারে প্রথম দিকেই৷

তাদের কথা অনুযায়ী লাগেজ নিয়ে নির্দিষ্ট দিনে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌঁছাই৷ বিমান বন্দরের বাইরে মমিনুল আমাকে বলে মালয়েশিয়া ফ্লাইট হবে আমার৷

কিন্তু ভিতরে যেয়ে হোঁচট খাই৷ জানতে পারি আমার ফ্লাইট দুবাই এর! দালাল মমিনুল কে ফোন দিলে সে বলে “বাবা যাও৷ কোন সমস্যা নাই৷ লিবিয়া খোলা আছে, বৈধ ভাবে থাকবা, কোন সমস্যা নাই৷ এরপর ভয়ে ভয়ে উঠে পড়ি দুবাইগামী ফ্লাইটে৷ দুবাই এয়ারপোর্টে পৌছানোর পর জাহিদ নামে এক বাংলাদেশী তরুণ আমাকে রিসিভ করে৷ পরে দুবাই থেকে বাসে করে নিয়ে যায় তিউনিসিয়ায়৷ সেখান থেকে একই ভাবে নিয়ে যায় লিবিয়ার বেনগাজি শহর লাগোয়া মরুভূমিতে৷

সেখানে পৌঁছে বড় ধরণের ধাক্কা খেলাম৷ দেখি সেখানে আটকে আছেন শতাধিক বাংলাদেশী তরুণ৷ তাদের একজনের সাথে কথা বলে জানতে পারি এটি দালাল চক্রের ( বাংলাদেশী ) নির্যাতন সেল৷ এখানে আটকে রেখে অত্যাচার করা হয় মুক্তিপণের জন্য৷ আর নির্যাতনের সময় আর্তচিৎকার মোবাইল ফোনে শোনানো হয় স্বজনদের!

যেদিন আমি যাই সেদিন বিকেলে ঐ দেশের এক দালাল আমাকে বুটজুতা পরে লাথি মারতে থাকে৷ এরপর হাত পা বেঁধে হাঁটু পায়ের তলায় ও গিরায় গিরায় পেটায়৷ এভাবে দশ মিনিট ধরে পেটাতে থাকে৷ পরদিন সকালে বাড়িতে ফোন দিয়ে দুই লাখ টাকা নিতে বলল৷ নির্যাতন সহ্য না করতে পেরে আমি রাজি হই৷ পরে দালাল জাহিদের ফোনে (নির্যাতন সেলে অবস্থান কারী) মায়ের সঙ্গে কথা বলি৷ এবং তারা টাকা দেবার ব্যবস্থা করেন৷ কিন্তু টাকা দিয়েও মুক্তি মিলল না৷ তারা আরও টাকার জন্য অত্যাচার করা শুরু করল৷ আরও দু’লাখ টাকা চায় ওরা৷ সময় মত টাকা না পেয়ে আমার উপর চলে অমানুষিক নির্যাতন৷

এরপর কি জানি হয় দালাল জাহিদ কয়েকদিন পর আমাকে বিমানে তুলে দেয়৷ আমি মার্চে এসে ঢাকা পৌঁছে বাড়ী যাই৷

#ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমীশনার সাহেবের বক্তব্য…
ভারপ্রাপ্ত থানা কর্মকর্তা মালেক সাহেব এবং শহীদুলের পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে দালাল চক্রের চার সদস্যকে আমরা গ্রেফতার করি, ফাঁদপেতে৷ রিমান্ডে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়৷ জিজ্ঞাসাবাদে ওরা স্বীকার করেছে মালয়েশিয়া সহ বিভিন্ন দেশে ভালো চাকুরীর লোভ দেখিয়ে কৌশলে ভিজিট ভিসায় নিরীহ লোকদের লিবিয়ায় নিয়ে যায় ওরা৷ পরে টর্চার সেলে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় করে থাকে৷

গ্রেফতারকৃত মমিনুলের মাধ্যমে লিবিয়ায় টর্চার সেলে অবস্থানকারী জাহিদের সাথে মোবাইল ফোনে কথা হয়৷ পরে মমিনুলের নির্দেশেই শহীদুল কে দেশে পাঠানো হয়৷ এ ঘটনায় আগেই বিমানবন্দর থানায় মামলা হয়েছে৷ তিনি আরও বলেন, গোয়েন্দা পুলিশের তৎপরতায় সেই টর্চার সেল থেকে আরও ৪০ বাংলাদেশী মুক্ত হয়েছে৷ গ্রেফতারকৃতরা স্বীকার করেছে তাদের মতো আরও বেশ কয়েকটি চক্র সক্রিয় আছে৷ আমরা তাদেরও গ্রেফতারের তৎপরতা চালাচ্ছি৷”
(তথ্য সুত্র দৈনিক যুগান্তর। ইচ্ছে করেই কিছু বিষয় এবং নাম উল্লেখ করা হয় নি)

মালেক সাহেব এবং ইদ্রিসের সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তে শহীদুল মায়ের কোলে ফেরত এসেছে৷ ইদ্রিস তার ব্যবসায় আবার সক্রিয় হয়েছে৷ মাঝে মধ্যে মালেক সাহেব আর ইদ্রিস তাদের পেছনের জীবনের গল্প করেন৷ পড়ন্ত বিকেলে নদীর পাড়ে সূর্যাস্ত দেখে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন৷

শহীদুল মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছে৷ সবাই কে সন্দেহ করে৷ বাড়ী থেকে বলতে গেলে বের হতে চায় না ৷
ইদ্রিস তার বোন আর বোন জামাইকে বলেছেন আপাতত ওরে ঘাটানোর দরকার নাই৷ একটু সময় দেন৷ পরে আমি আমার ব্যবসায় ওরে ঢুকায়ে দিবো৷

শহীদুল জানালা দিয়ে একফালি আকাশ দেখে৷ ঘুমের মধ্যে দূঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে উঠে৷
বাকি রাত মনোয়ারা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে ভোর হবার অপেক্ষায় থাকেন….

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত