নয়ননীর

নয়ননীর

লন্ডনের মাটিতে ৮ টি বছর কেটে গেল দেখতে দেখতে।এত দিন পর দেশে যাবো।এই ভেবে নিজের আর ভালো লাগার শেষ নেই।কত দিন পর মায়ের মুখের হাসিটা দেখতে পাবো।যেই হাসিতে কোন ভেজাল নেই।মায়ের মুখের হাসি আমার শ্রেষ্ট উপহার।বাবার শাসন যেটা আমাকে এগিয়ে নিয়ে এসেছে স্বপ্ন পূরণের দ্বারে।প্রিয় মানুষগুলোকে এক পলক দেখার জন্য ছুটে যাওয়া।নিজের পছন্দমত কেনা-কাটা করে নিয়েছি প্রিয় মানুষগুলোর জন্য।দেশে যাচ্ছি সেটা কাউকে না জানিয়ে।আসলে একটু সারপ্রাইজ দিতে চাই বিশেষ করে মা-বাবা কে।প্লেনে সিট বেল্ট বেধে নেই,কিছু সময়রে মধ্যে প্লেনটি বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে।পাশের সিটে এক বয়স্ক ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় হয়।লোকটির গ্রামের বাড়ি সিলেট পরিচয়ের মধ্যেমে জানতে পারি।কিন্তু কথা শুনে বুঝার উপায় নেই যে ভদ্রলোকের গ্রামের বাড়ি সিলেট।

ফোনের গ্যালারিতে গিয়ে প্রিয় মানুষের ছবি গুলো দেখতে থাকি।একে একে সবার ছবি গুলো স্ক্রিনে আসছে আর মিটিমিটি হাসছি।বন্ধুদের সাথে যখন ফাইজলামি করতাম সেই সব দেখে হাসছি।কতই না বাঁদরামো করেছি ওদের সাথে বলার বাহিরে।ছবি দেখতে দেখতে নিজের চোখের কোণে পানি এসে যায়।স্ক্রিনে তখন প্রিয়ন্তি’র ছবিটা ছিলো।প্রিয়ন্তি’র এই ছবিটা সব থেকে বেশি প্রিয় ছিলো আমার।তাই প্রিয়ন্তি’র সব ছবি ডিলিট করে দিলেও এই ছবিটি পারি নি।ছবিটিতে প্রিয়ন্তি লাল একটা ওড়না মাথায় প্যাঁচানো,মুখে একটা মিষ্টি হাসি,নাকে নথ সব মিলিয়ে খুব সুন্দর লাগছিলো।প্রিয়ন্তি’র হাসিমাখা এই ছবিটি দেখে মন ভালো করতাম একটা সময়।কিন্তু আজ মন ভালোর বদলে চোখের কেণে পানি এসেছে।আমি অপলক তাকিয়ে আছি ছবিটার দিকে।চোখের পানি গড়িয়ে পড়তে দেখে ভদ্রলোকটি উকি মেরে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করে।ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছি,কিন্তু ভদ্রলোকটা প্রশ্ন জুড়ে দেয়।

-তোমার চোখে পানি কেন?
-দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে কিছু না বলে চুপ হয়ে যাই।

কিন্তু ভদ্রলোকটা বিষয়টা এত সহজে মেনে নিলেন না। এক প্রকার জোর করতে লাগলো, মেয়েটি কে ছিলো সেটা জানার জন্য। ভদ্রলোকের এমন প্রশ্নে নিজেকে আর সামলে রাখতে পারি নি।নিজের ভিতর জমে থাকা পুরনো ব্যথা যেন আবার জেগে উঠেছে।এ ব্যথা প্রিয় মানুষকে হারানোর ব্যথা।একটা পাজড়ের হাড় ভাঙার ব্যথা যে হাড় আজও জোরা লাগে নি।প্রতি রাতে ব্যথায় কাতরাতে হয়েছে।তবে এ গল্পে ছিলো না কোন ছলনা,ছিলো না প্রতারণার বিন্দু মাত্র অস্তিত্ব।ছিলোনা কোন শারীরিক চাহিদা। তারপরও হারাতে হয়েছে প্রিয় মানুষটা’কে।

তাহলে শুনুন গল্পটা এ হচ্ছে প্রিয়ন্তি।আমার প্রিয় মানুষের তালিকায় তার নাম প্রথম সারিতে।আমাদের সম্পর্কটা শুরু হয় এক কাকতালীয় ভাবে। আজ থেকে প্রায় ১৬ বছর আগে প্রিয়ন্তি’র সাথে আমার পরিচয় হয়।প্রথম পরিচয়েই প্রেম নিবেদন করি।প্রিয়ন্তিও সম্মতি জানায় আমার প্রেম নিবেদনে।আমি কল্পনাও করতে পারি নি আমাদের এভাবে প্রথম পরিচয়ে প্রেমের সম্পর্ক হয়ে যাবে। ভেবেছিলাম এ সম্পর্ক হয়তো বেশিদিন থাকবে না।তবে আমার এ ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয়।সম্পর্কটা দিনে দিনে গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে।এভাবে সুখের সময় গুনতে গুনতে ৪টি বছর পার হয়ে যায়।

কিন্তু এ সুখ বেশি সময় স্থায়ী হয় নি।আমার জীবনের সব থেকে বাজে সময় নেমে আসে।হটাৎ করে প্রিয়ন্তি’র সাথে কথা বলা বন্ধ হয়ে যায়।প্রিয়ন্তি’র সাথে কথা বলার মাধ্যেম ছিলো দুটি মোবাইলে ও ফেসবুকে চ্যাটিং। প্রতি রাত ৩ টা পর্যন্ত প্রিয়ন্তি’র একটা মেসেজ বা ফোনের অপেক্ষায় থাকতাম কিন্তু কোন ফোন বা মেসেজ আসতো না।নানান চিন্তা তখন মাথায় আসতো,চিন্তাগুলো সব সময় পজেটিভ ছিলো।তারপরও কেমন জানি লাগতো, প্রতি রাতে প্রিয়ন্তি’র নাম্বারে ৫-১০ টা ফোন দিতাম কিন্তু সংযোগ পেতাম না কারণ ফোন বন্ধ থাকতো। ফেসবুক আইডিতে লগ ইন হতো না।খুব কষ্ট হতো তখন সেই কষ্টের সাক্ষীও আছে অনেক কিছু। কিন্তু তরা শুধু নিরবে কান্না শুনেছে এবং ভিজেছে। যেমন মাথার নিচের বালিশ, চারপাশের দেওয়াল,আবার কখনো কখনো বৃষ্টিও সাক্ষী হতো।
(কিছু সময় চুপ করে থাকার পর) আচ্ছা জীবনে ডাক্টার হতে না পারলে বুঝি জীবনের কোন মানে নেই,জীবনের কোন মূল্য নেই??

-তোমার কথার মাঝে বেশ আক্ষেপের ছাপ দেখতে পাচ্ছি,একটু পরিষ্কার করে বলোতো।

প্রিয়ন্তির আম্মুু ইন্ডিয়ান একটা ছেলেকে পছন্দ করতো। যেমন ছেলে খুজছিলো তার মেয়ের জন্য তেমনটাই ছিলো।ছেলেটির নাম আদনান,ইন্ডিয়ান ডাক্টার।প্রিয়ন্তি’র আম্মুর বান্ধবীর মাধ্যেমে চেনা-জানা। সেই থেকে প্রিয়ন্তি’র আম্মুর সাথে ভালো সম্পর্ক।ছেলেটি আবার প্রিয়ন্তিকে পছন্দ করতো।এভাবে প্রিয়ন্তি পরিস্থিতির শিকার হয়ে আদনানের সাথে কথা বলতো।প্রিয়ন্তি’র আম্মুর জোরাজুরিতে কথা বলতো।যেই মেয়েকে আগে ফোন ধরতে দিতো না কিন্তু সেই তিনিই আজ ফোন রেখে যায়।আদনান মেসেজ দিলে নিয়ে যেত প্রিয়ন্তি’র কাছে।

তবে প্রিয়ন্তি চাইলে এ কথাগুলো গোপন করতে পারতো কিন্তু করে নি।আসলে প্রিয়ন্তি যা কিছুই করতো সব আমায় বলতো কিছুই গোপন রাখতো না। আর এটাও রাখে নি। জানেন সেদিন আমি আর প্রিয়ন্তি খুব কেঁদেছিলাম।দুজনে এক সাথে কেঁদেছিলাম, প্রিয়ন্তি কান্না করতে করতে বলেছিলো চলো আমরা পালায় যাই।আমি তখন সবে মাত্র এইচ.এস.সি দিয়েছি। আমি সেদিন প্রিয়ন্তিকে কোন উত্তর দিতে পারি নি।সেদিনের কান্নার আওয়াজ আজও আমার কানে বাজে। প্রিয়ন্তির বলা কথাগুলো এখনও আমার মনে গেঁথে আছে। জানেন কিছু কিছু বিষয় মেনে নিতে পারি নি আমি।সেজন্য আজ আমার চোখে পানি।প্রিয়ন্তি বলেছিলো আমি যদি আদনানের সাথে কথা বলতে থাকি তাহলে ওর প্রতি দূর্বল হয়ে যাবো।এটাও বলেছিলো যে এখন থেকে আমার দুজনকেই সময় দেওয়া লাগবে।আমার দুইটা বয় ফ্রেন্ড  হয় তুমি মেনে নাও, না হয় চলে যাও।জানিনা কথাটা মজা করে বলেছিলো কি না তবে সত্যি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম।প্রিয়ন্তি’র আম্মু বাংলাদেশ থেকে আদনানে’র জন্য কুরিয়া করে শার্ট-প্যান্ট পাঠিয়েছিল।

আমি কিছু বিষয় মেনে নিতে পারি নি।কি করে মেনে নিবো বলতে পারেন যে সময়টা আমাকে দেবার কথা ছিলো,সে সময়ে আদনানের সাথে কথা বলতো।হোক সেটা নিজের ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়।আদনানের নাম শুনলেই মন খারাপ হয়ে যেতো। তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম যদি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারি তাহলে প্রিয়ন্তির কাছে ফিরবো।তাই একটু একটু করে সরে আসি প্রিয়ন্তি’র থেকে।এছাড়া কোন পথ ছিলো না আমার।কারণ প্রিয়ন্তি’র আম্মু কখনও আমায় মেনে নিবে না কেননা আমি তো ডাক্টার নই। প্রিয়ন্তিকে এড়িয়ে চলতে শুরু করি।প্রিয়ন্তি ফোন দিতো কিন্তু কিছুটা অবজ্ঞা করে কথা বলতাম। প্রিয়ন্তি চেয়েছিলো আমার সাথে থাকতে ভালো বন্ধু হয়ে। আচ্ছা ভালোবাসার মানুষ কি ভালো বন্ধু হয়ে থাকতে পারে?পারলে হয়তো এতে কষ্টের পরিমাণটাই বেশি।তাইতো না বলে চলে আসি এই লন্ডনের মাটিতে।ভেবেছিলাম প্রিয়ন্তি’র থেকে দূরে গেলে হয়তো ভুলে যাবো কিন্তু বরাবরের মত এটাও হলো না।বরং ভুলার বদলে পুরোটা জুড়ে শুধু প্রিয়ন্তি’র বসবাস।আর এই ছবিটাই ছিলো আমার সব শক্তির অনুপ্রেরণা।। আহহহ!মিষ্টি হাসি,চোখেতে কজল কতই মায়াবী দেখায় প্রিয়ন্তিকে এই বলে একটা দীর্ঘ শ্বাস নেই।

আমি চেয়েছিলাম ওর পাশে থাকতে কিন্তু পারি নি সেটা ঐ আদনানের জন্য।ওর নাম শুনলেই বুকে চিন চিন ব্যথা হতো, খুব কষ্ট হতো।তবে জানেন কি লন্ডনে আসার পর প্রিযন্তি’র সাথে কোন যোগাযোগ হয় নি।আজ এত বছর প্রিয়ন্তি’র স্মৃতিগুলো আকড়ে ধরে কাটিয়েছি।।জানি না কোথায় আছে প্রিয়ন্তি,কেমন আছে কিচ্ছু জানি না।প্রিয়ন্তি’কে বলেছিলাম তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না কিন্তু ঠিকই ৮ টি বছর কাটিয়ে দিলাম প্রিয়ন্তিকে ছাড়া। চোখের পানি টপ টপ করে বেরিয়ে এলো।

ভদ্রলোকটা আমাকে তার বুকে টেনে নেয়।সান্তনা দিতে থাকে তবে এ সান্তনা যে আমি নিতে পারছি না।কি করে পারবো এত দিন নিজেকে নিজেই কত ধরণের সান্তনা দিয়েছি কিন্তু পারি নি।নিজেকে ওর থেকে দূরে রেখেছি হয়তো তবে মনের থেকে তো দূরে রাখতে পারি নি। প্রিয়ন্তি’র থেকে নিজেকে দূরে রাখার বিষয়টা আমকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিলো।নিজের ভিতর অনুশোচনা হচ্ছিলো।হয়তো ঠিক করেছি নতুবা ভুল করেছি এই ভেবে।
ভদ্রলোকটা আমাকে যাবার সময় একটা কার্ড দিয়ে যায়,যেখানে তার নাম,ঠিকানা,ফোন নাম্বার সবই আছে।

এয়ারপোর্ট থেকে একটা মাইক্রো নিয়ে গ্রামের দিকে রওনা হই।যেতে যেতে সকাল ৯ টা বেজে যায়।বাড়ির দরজার পাশে দাড়িয়ে মা!ও মা! মা রে! এভাবে ডাকতে থাকি।দরজা খুলার শব্দ শুনে লুকিয়ে থাকি।কারণ মায়ের মুখের হাসিটা দেখতে চেয়েছিলাম লুকিয়ে।দরজা খুলে মা কাউকে দেখতে পেল না। তখন মায়ের চোখে পানি এসে যায়।চোখের পানি দেখে নিজেকে আর লুকিয়ে রাখতে পারি নি দৌড়ে মায়ের কাছে ছুটে যাই। মা! ও মা! মা গো এইযে তোমার খোকা কাঁদছো কেন। আমাকে দেখেই আমার খোকা! আমার বাজান বলে চিৎকার দিয়ে জড়িয়ে ধরে। আর মা কেঁদেই যাচ্ছে, মা’কে সামলানোর চেষ্টা করি।

ও মা কাঁদছো কেন আমি তো ফিরে এসেছি মা।তোমার মুখের হাসি দেখার জন্য এলাম আর তুমি কাঁদছো।একটু হাসো মা! আমার এমন কথা শুনে মা আরো বেশি কাঁদতে থাকে।আসলে বুঝেনই তো কত দিন পর এলাম তারপর আবার না বলে। মা গো তোমার বাজানরে ভিতরে নিবা না। খুব খুদা লাগছে মা।তোমার হাতের রান্না অনেক দিন খাই না। কেন নেবো না আমার বাজান আইছে। আমার বাজানের লাইগা আমি রান্না করুম, আইজ আমার বাজানরে আমি নিজের হাতে খাওয়াই দিমু চল বাজান ঘরে চল। মা আব্বু কই? সুয়ে আছে বাজান,যা দেখা করে আয়।আমি তোর জন্য রান্না করি।

আব্বুর রুমে গিয়ে জড়িয়ে ধরি আব্বুকে। আমাকে দেখে আব্বুর চোখেও পানি এসে যায়। না আব্বু না কাঁদবা না, মোটেও কাঁদবা না। কিন্তু কে শোনে কার কথা একদম ছোট বাচ্চাদের মত কাঁদতে থাকে। এক হাত দিয়ে যতটা পারে আমাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে।আসলে আব্বু প্যারালাইজড হয়ে গেছে তো সে জন্য।আমি আব্বুর বুকে কিছু সময় সুয়ে থাকি।কতটা শান্তি লাগছে নিজের ভিতর বোঝাতে পারবো না। ছোট ভাগনিটা দৌড়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে বলে মামারে চকলেট আনছো আমার জন্যি? আম্মুরে এনেছি আপনার জন্য অনেক চকলেট এনেছি। ঐ ব্যাগ ভর্তি চকলেট শুধু আমার আম্মু একা খাবে। দুই গালে দুইটা চুমু দিয়ে শক্ত করে জড়ায় ধরে আমায়। তোরা খবর পেলি কি করে যে আমি আসছি। মা বলছে ফোন করে(আপু) দুলাভাই কই? বাহিরে ভ্যানের টাকা দিচ্ছে।

এই ভাবে পরিবারের সাথে কিছু সময় গল্প করি। মা সবার জন্য রান্না করা নিয়ে ব্যস্ত।আপুও মায়ের সাথে টুকিটাকি সাহায্য করতেছে। এই দৃশ্যটা কতদিন পর দেখলাম খুব ভালো লাগতেছে।মনটা একদম শীতল হয়ে যাচ্ছে,আসলে পারিবারিক ভালোবাসা এক অন্য রকম ভালোবাসা। মা-বাবা, ভাই বোনের সম্পর্ক সব থেকে উর্ধে।ছোট ভাই ও চলে আসে কিছু সময় পর ভার্সিটিটি থেকে। সবাই মিলে এক টেবিলে খেতে বসি।শেষ কবে একসাথে এক টেবিলে খেয়েছি মনে নেই।সব প্রিয় ভর্তাগুলো করেছে আমার জন্য।ভর্তা খুব পছন্দ করি আমি।মা নিজের হাতে সবাই কে খাওয়ায় দিচ্ছে।অনেক দিন পর তৃপ্তি করে খেলাম।খাওয়া শেষ করে একটু বিশ্রাম করি।

পুরোনো গ্রামীণ সিমটা তুলে নিয়ে আসি।সিমটা অন করি প্রায় ১২ বছর পর। রাগ হয়ে ভেঙে ফেলে ছিলাম।এই নাম্বারটা প্রিয়ন্তি জানতো। অন্যগুলোও জানতো তবে বেশির ভাগ এই সিম দিয়ে কথা হতো। সিমটা অন করে প্রথমে সিলেটি কাকাকে ফোন দেই,পরিচয় দেওয়ার আগেই চিনে নেয়।কিছু সময় কথা বলার পর রেখে দেই।পুরোনো সব সিম অন করে বন্ধুদের ফোন দিতে থাকি।বিকালের দিকে সবাই মিলে এক সাথে আড্ডা দেই।ওদের কাছে প্রিয়ন্তি’র খবর জানতে চাই কিন্তু কেউ বলতে পারে না।আড্ডা শেষ করে বাসায় ফিরি।পুরোনো ডায়েরিটা খুজেতে থাকি,কারণ ডায়েরিতে প্রিয়ন্তি’র আম্মুর নাম্বার লিখে রেখে ছিলাম।নীল মলাটের ডায়েরিতে লাল রঙের কালিতে লিখে রেখেছিলাম আমার সব আবেগময় কথাগুলো।নীল মলাটের ডায়েরির প্রথম পাতায়ই প্রিয়ন্তি’র আম্মুর নাম্বারটা লেখা ছিলো।নাম্বারটায় বেশ কয়েকবার কল দেই কিন্তু বন্ধ পাই।প্রতিদিন দু-একবার করে ফোন দিতাম বন্ধই থাকতো।
হটাৎ সেই সিলেটি কাকার ফোন আসে।উনার মেয়ের আগামীকাল গায়ে হলুদ,পশুদিন বিয়ে।ফোন দিয়ে যেতে বলেন, আমি সম্মতি জানাই যাবার জন্য।কারণ সিলেটে আগে কখনও যাও হয় নি ওখানের চা বাগান,উচু পাহাড় দেখার খুব সখ।মনটাও ভালো নেই তাই রাজি হয়ে গেলাম।

উনার দেওয়া কার্ডের ঠিকানা অনুযায়ী গুগল ম্যাপের সাহায্যে পৌছে যাই।আমার যেতে যেতে বিকাল হয়ে যায়।বাড়ি ভর্তি মেহমান, উনার ছোট ছেলে আমাকে উপরের একটা রুমে নিয়ে যায়।নীল কালারের পাঞ্জাবী পরে হলুদের জন্য তৈরী হই।নামতে একটু দেরিই হলো।আমি এক কোণায় চেয়ারে বসে ফোনের নোটপ্যাডে গল্প লিখছি।এমন সময় মিঃ জামিল সাহেব আমাকে ডাক দেন বাবা তুমি হুলুদ দিবে না তোমার বোন কে? মিঃ জামিল সাহেবের এমন দাবি মূলক কথায় বসে থাকতে পারি নি।সকলে অপরিচিত তো তাই লজ্জা হচ্ছিলো। মিঃ জামিল সাহেবের ছোট মেয়ের নাম মুনা।হলুদের বাটি থেকে একটু হলুদ নিয়ে মুনাকে মাখিয়ে দেই।তবে মুনার পাশের মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে বেশ সময় ধরে।আমারো চেনা চেনা লাগছে মেয়েটা কে।প্রিয়ন্তি’র ছোট বোন প্রিয়ার মত মনে হচ্ছে।কিন্তু ও এখানে কি করে?  তুমি প্রিয়া না?  হ্যা প্রিয়া।আপনি নিরব ভাইয়া তাই না?? হুমমম নিরব।কেমন আছো তুমি? এই তো ভালো আপনি? আছি আল্লাহ যেমনটা রেখেছে। মাম্মা তোমাকে আম্মু ডাকছে? নিরব ভাইয়া আপুর মেয়ে মেহজাবিন। প্রিয়ন্তি’র মেয়ে,মেহজাবিন। আমি কোলো তুলে নেই।আচ্ছা মামুনি তোমার আম্মু কোথায়?  বাবাইর সাথে গল্প করছে। ভাইয়া আমি একটু আসছি।

চলো মামুনি আমরা একটু ঘুরে আসি।আমি মেহজাবিন কে নিয়ে দোকানের দিকে যাই।ওর সাথে একটু দুষ্টামি করি।খুব মিষ্টি দেখতে একদম প্রিয়ন্তি’র মতই।হাসিটাও ওর মায়ের মতই।মামুনি তুমি কি খাবে? আচ্ছা তুমি কে যে তোমার থেকে খাবার নিবো? বাবাই বলেছে অপরিচিত কারো থেকে কিছু না নেই বুঝেছো।কিন্তু আমি খেলতে পছন্দ করি তাই তোমার সাথে এসেছি। ওরে পাকা বুড়ি রে, আমি তোমার আম্মুর বন্ধু হই।তোমার আম্মু আমায় চেনে।তোমার আংকেল হই, এবার নিবে তো? হুমম!নিবো তবে আম্মুর জন্য একটা টাইগার নিতে হবে তাহলে।কারণ টাইগার আম্মুর খুব পছন্দ। আচ্ছা তোমার যা ইচ্ছা হয় নেও মামুনি। অনেক সময় হয়েছে মেহজাবিন কে নিয়ে বেরিয়েছি।

এই যে মামুনি এবার চলো বাসায় ফেরা যাক। তোমাকে দেখতে না পেলে আবার সবাই চিন্তা করবে। বাড়ির ভিতর ঢুকতেই প্রিয়া দৌড়ে আসে মাম্মা বলে আপনি না বলে মেহজাবিনকে কোথায় নিয়ে গেছিলেন কান্না জড়িত কন্ঠে।আমি তো মামুনি কে নিয়ে ঘুরতে গেছিলাম।তোমরা একা রেখে গেছিলে তাই তো ভাবলাম একটু ঘুরে আসি। আমরা অনেক মজা করেছি তাই না মামুনি।প্রিয়ন্তিও চলে আসে সাথে আদনান, প্রিয়ন্তির মা ও আসে। আমি প্রিয়ন্তির চোখের দিকে তাকাতে পারি নি অনুশোচনায়। মেহজাবিনকে কোলে তুলে নেয় প্রিয়ন্তি বুঝতে বাকি নেই কতটা ভালোবাসে মেয়েকে।আদনান হিন্দিতে কি জানি বললো বুঝতে পারি নি।কারণ হিন্দি কম পারি সেজন্য।প্রিয়ন্তি আমাকে চিনেছে কি না জানি না,তবে ওর চোখটা হয়তো আমাকে কিছু বলতে চাচ্ছিলো। তখনই মিঃ জামিল সাহেব ডাক দেয়। নিরব এদিকে আসো তো বাবা। আমি প্রিয়ন্তি’কে অতিক্রম করে জামিল সাহেবের কাছে যাই।

বাবা তুমি একটু এদের খাবার পরিবেশন করো,আমি একটু আসছি।পিছনে আর ফিরে তাকায় নি,কারণ আমার চোখের পানি প্রিয়ন্তি’কে দেখাতে চাই না।চাই না ওর সুখে সংসারে দুঃখের কারণ হতে।খাবারের টেবিলে প্রিয়ন্তি,আদনান,প্রিয়ন্তি’র আম্মু-আব্বু ওদের খাবার পরিবেশন করতে হবে।ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও করতে হলো।প্রিয়ন্তি এবার হয়তো চিনে নিয়েছে।প্রিয়ন্তির খাবারে কোন মনোযোগ নেই সেটা বুঝতে বাকি নেই।আমি আর নিজেকে সামলাতে না পেরে মুনার চাচাকে পরিবেশনা করতে বলে দূরত বেরিয়ে যাই।বাড়ির উঠানটা বেশ বড় তাই সামনে একটু এগিয়ে যাই কারণ কষ্টগুলো ধোয়ার সাথে উড়িয়ে দিতে হবে।পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে একটা সিগারেট ধরিয়ে নেই।আপন মনে টানতে থাকি এমন সময়..

-সিগারেট খেয়ে কি লাভ পাও(কিছুটা ভেজা সুরে)
-লাভ-ক্ষতির হিসাব অনেক আগেই ভুলে গিয়েছি।
-তাই বলে সিগারেট খাবে!জানো এটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর?
-হুমম জানি!লেখাই আছে।
-তাহলে খাও কেন?
-কারণ প্রতিটা টানে ভিতরের জমে থাকা কষ্টগুলো চুষে নিয়ে ধোয়ার সাথে হাওয়া মিলে যায়।
-কথা দিয়েছিলে কখনও সিগারেট খাবে না।
-কথা!সে তো তুমিও দিয়েছিলে। সিগারেটটা ফেলে দেই কারণ প্রিয়ন্তি সিগারেটের গন্ধ সহ্য করতে পারে না।

-কেন এমনটা করলে তুমি,তোমার সাথে যোগাযোগ করার জন্য কত চেষ্টা করেছি।কেন করলে তুমি বলো কেন? কেন?
-হারানো জিনিস খুজতে।কিন্তু খুজতে গিয়ে চিরতরে হারিয়ে ফেলেছি। যাই হোক তোমার মেয়েটা একদম তোমারমত হয়েছে।
-কথা ঘোরাচ্ছো।
-সে তো তোমার থেকেই শিখেছি।  কি মিষ্টি দেখতে তোমার মেয়েটা।নামটাও রেখেছো আমার পছন্দের নাম।
-মেয়ের বাবা তোমার হবার কথা ছিলো।
-হুমমম! ছিলো।

নাহ কাঁদা যাবে না,প্রিয়ন্তি’কে আমার দূর্বলতা প্রকাশ করা যাবে না অন্যদিকে মাথা ঘুরিয়ে চোখটা মুছে নেই।এমনি ভাবে অনেক কথা হয়। আমাদের কথাগুলো প্রিয়ন্তি’র আম্মু শুনে নেয়।আমি প্রিয়ন্তি’র আম্মুকে দেখে চলে আসতে যাই কিন্তু আমাকে যেতে দেয়নি। প্রিয়ন্তিকে যেতে বলে সাথে সাথে প্রিয়ন্তি মুখটা আড়াল করে চলে যায়।আমি প্রিয়ন্তি’র চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকি।প্রিয়ন্তি’র চোখের ভাষা বুঝি খুব বুঝি।আমাকে ছাড়া ভালো নেই সেটা বুঝিয়ে গেল।আমাকে হয়তো দোষী বানিয়ে গেলো ওর দু ফোটা চোখের পানি।

-আচ্ছা নিরব আমি তো প্রিয়ন্তির মা তাই না বলো।
-জি
-মা হিসাবে আমি কি কোন ভুল করেছি তুমি কী মনে করো?আমি কি আমার মেয়ের ভালো চাইতে পারি না?প্রতিটা মা-বাবা চায় তার ছেলে-মেয়ে যেন ভালো থাকে সুখে থাকে।সারাজীবন লালনপালন করে বড় করেছি আমাদের কি কোন আশা থাকে না?
-হ্যাঁ আপনার দিক থেকে আপনি ঠিক আছেন।আচ্ছা আপনি বলতে পারবেন আপনার মেয়ে সুখে আছে?
-হুমমম বলতে পারবো সুখে আছে,খুব সুখে আছে।
-আপনার ধারণা ভুল।হয়তো সব দিক থেকে সুখে আছে কিন্তু মনের দিক থেকে?

মনে যদি শান্তি না থাকে হাজার হাজার কোটি টাকা থাকলেও সুখে থাকে না।কখনও জানতে চেয়েছেন আপনার মেয়ে কি চায়?সব সময় আপনাদের আশাটা পূরন করতে চেয়েছেন। যার জন্য প্রিয়ন্তি তার নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে দিয়েছে শুধু আপনাদের আশার জন্য,আপনাদের চাওয়ার জন্য।একটি বার কি জানতে চেয়েছেন প্রিয়ন্তি কি চায়? চান নি! কারণ আপনারা মনে করেন মেয়ের কোন ইচ্ছা বা মতামত থাকতে পারে না।আমরা কষ্ট করে বড় করেছি আমরা যেটা করবো সেটাই মেনে নিবে।কখনও জানতে চেয়েছেন প্রিয়ন্তি’র মেয়ের নাম কেন মেহজাবিন রেখেছে? নামটা ছিলো আমার পছন্দের নাম।আমরা ঠিক করেছিলাম যে আমাদের মেয়ের নাম মেহজাবিন আর ছেলের নাম জুনায়েদ রাখবো।প্রিয়ন্তি আপনাদের সম্মানের কথা ভেবে,আপনাদের মনে কষ্ট দেবে না বলে তার জীবনের এত বড় ত্যাগ স্বীকার করেছে।কারণ ও আমাকে যতটা ভালোবাসে তার থেকে বেশি আপনাদের।আপনাদের ভালোবাসা,মুখের হাসির জন্য আপনাদের মতামত মেনে নিয়েছে।আপনাদের উচিৎ ছিলো প্রিয়ন্তি কি চায় সেটা জানার। আমি এমন কিছু করবো না যে আপনাদের সম্মানহানি হয়।

আমাকে ক্ষমা করবেন যদি আমার কথাতে কষ্ট পেয়ে থাকেন।ভালো থাকুন আপনারা। এটা বলার পর এক মূহুর্ত দাড়াই নি।কোন উত্তরও শোনারও অপেক্ষা করি নি। নিজের ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে যাই কারণ চাই না আমার জন্য কোন ঝামেলা তৈরী হোক।প্রিয়ন্তি ও আদনানের সম্পর্কটা নষ্ট হোক।কিছু দূর যাবার পর মিঃ জামিল সাহেব আমার সামনে হাজির হয়।জামিল সাহেবের সাথে আদনান ও প্রিয়ন্তির আব্বুও আছে।কোন প্রকার প্রশ্ন ছাড়াই জামিল সাহেব আমাকে ধমক দিয়ে বলেন।আজ যদি তোমার নিজের বোনের বিয়ে হতো তুমি কী পারতে এমন করে চলে যেতে? পারতে তুমি? জামিল সাহেবের কথার কোন উত্তর আমার জানা নেই। তাই উনাদের সাথেই ফিরে যাই,বিয়েটা শেষ হলে চলে আসবো।

প্রিয়ন্তি লাল শাড়ী পড়েছে, আমি নীল পাঞ্জাবী।লাল আমার পছন্দ, নীল প্রিয়ন্তি’র।প্রিয়ন্তির পাশেই আদনান দুজনকে খুব ভালোই মানিয়েছে।মেহজাবিন আংকেল বলে ছুটে আসে আমার কাছে।আমি কোলে তুলে নেই মেহজাবিনকে।ছোট করে দুইটা চুমো খাই মেহজাবিনের গালে।চোখটা তখনও আমার ভেজা ছিলো।আংকেল বাবাইকে ঘোরা হতে বললে ঘোড়া হয় না তুমি হবে ঘোড়া? আমি একটু ঘোড়ায় চড়বো। অবশ্যই মামুনি, আমি সকলের সামনে ঘোড়া হয়ে যাই।মেহজাবিন খুশিতে লাফাতে থাকে।আমি মেহজাবিন কে কিছু সময় পিঠে নিয়ে ঘোড়ার মত হয়ে হামাগুড়ি দিতে থাকি।প্রিয়ন্তি’র চোখটা লাল বর্ণের হয়ে যায়।চোখে পানি টলমল করছে।আমি আমার দুফোটা চোখের পানি বিসর্জন দিয়ে ক্ষমা চেয়ে নেই চোখের ভাষাতেই। আমার আর মেহেজাবিনের এই দৃশ্যটা সবাই বেশ উপভোগ করতেছে।সবাই হাততালি দিয়ে আমাদের উৎসাহ দিচ্ছে।আমি না হয় মেহজাবিন মামুনির ঘোড়া নামেই আখ্যায়িত হয়ে থাকি।আমার এই টাট্টুঘোড়া হবার সাক্ষী না হয় ওরা সকলে হয়ে থাকুক। প্রিয়ন্তি’র আম্মু হয়তো নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে সেজন্য হয়তো চোখে পানি।যেটা আমার চোখ থেকে আড়াল করতে পারে নি।

আজ আর আমার মনে কোন কষ্ট নেই।কোন অভিমান নেই কারো উপর।শুধু ভালোবাসার মানুষটা ভালো থাকুক এটাই এখন আমার চাওয়া।ভালো থাকুক মেহজাবিন মামুনিটা।প্রিয়ন্তি’কে উৎসর্গ করে এই কবিতাটা আজ এই নিশিতে,নির্ঘুম আমি থাকি রে, বন্ধ ঘরে থাকি যখন, চুপিচাপি কাঁদি তখন। বৃষ্টি হয়ে চোখের জলে,ভেজে বালিশের তল, বলছি তবে বন্ধু তুমি,সুখে থাকো চিরকাল। নীল মলাটের ডায়েরিতে লিখবো নতুন গল্প, গল্পে তুমি থাকবে তবে,চোখের জলে হবো সিক্ত। সুখের থাকো ভালো থাকো,বাঁধো সুখের ঘর, আমার এই গল্পের নাম না হয় নয়ননীর থাক।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত