লতিফার ভেজা শরীরটার দিকে তাকিয়ে আসগর আলী বিড়বিড় করে উঠে,
-বেহায়া মাগী! চুল মুছনের ঢং দেখ নায়িকা মৌসুমী ফেইল! লতিফা গামছায় চুল পেঁচিয়ে শরীর বেঁকিয়ে তাকায়,
-কিছু কইলা?
-কি কমু আবার! তোর ঘাটে গোসল না করতে গেলে হয় না?
– হ হয়! প্রত্যেকদিন পুকুর থিকা বালতি ভইরা পানি আইন্না দিও ঘরের কোণায় গোসল সারুম!
-কে? তুই আনতে পারস না?
-তোমার সংসারে বান্দী খাইট্টা মাজার হাড় ক্ষয় করছি হেতে হয় না? হাত -পা ভাইঙা ঘরে বইসা থাকি রান্ধনের যোগান দিব কেডা!
আসগর আলী কথা বাড়ায় না। উবু হয়ে গুম ধরে বসে থাকে। মুলির বেড়ার ঘর, টিনের ছাউনি। খসখসে সিমেন্টে লেপা মাটির ভিটে। পরিপাটি করে সাজানো বিছানা, আলনার কাপড় দেখলে বোঝা যায় এবাড়ির গৃহিনী বেশ গোছানো। বাচ্চাদের পড়ার টেবিল,রঙজ্বলা স্টিলের আলমারির পাশে একটা ছোট্ট ফ্রীজ! এখানে বিত্ত নেই তবে স্বাচ্ছন্দ্য আছে। আয়তাকার উঠানে পাশাপাশি ঘর তুলে আরো আট-দশ খানা পরিবার বাস করে৷ আসগর আলীর জ্ঞাতিগুষ্টি সব। আসগর আলীর ঘরের পাশে সুলতান শেখের রঙিন টিনের ভিটে পাকা ঘর। সুলতান শেখ আলীর চাচাতো ভাই বহুবছর আরব দেশ থেকে এসেছে। তার ঘর-গৃহস্থে বিত্তের ছোঁয়া। আসগর আলীর ইচ্ছা হয় জমানো টাকার সাথে কিস্তির টাকা তুলে একটা ঘর তোলা হোক। কাঠের পাটাতনের চকচকে টিনের ঘর।
-ছেলে দুটো বড় হচ্ছে।এক ঘর এক দুয়ারে আর কতদিন! লতিফাকে একথা বলতে মুখে ঝামটা মারে,
-হইছে, যে কয়ডা টেকা ভাইঙা ফেললে পোলা দুইডার ভবিষ্যত হইবে কি! টেকায় নজর দেবার ইচ্ছা ছাড়ান দাও ওগুলান তুমি কব্জা করতে গেলে খুনোখুনি হয়ে যাবে।
অন্যসব পুরুষ মানুষ হলে বান্দীর চুল ছিঁড়ে টাকা উদ্ধার করত।আসগর আলী পারে না সে বউকে খানিকটা ভয় পায়। লতিফা তার বউ হয়ে এসেছে সে বারো বছর আগের কথা। কতই বা বয়স ছিল চৌদ্দ-পনের। লতিফার বাবা-মা নেই, চাচার সংসারে মানুষ। আসগর আলীর মা ভেবেছিলেন ছুড়ি দেখতে শুনতে মন্দ নয়, বাপ-মা মরা মেয়ে স্বামীর কথায় সারাজীবন উঠবস করবে। লতিফার চাচা জুলহাস ব্যাপারী বলেছিল ভিন্ন কথা। বিয়ের দিন আসগর আলীর হাতে নরম একখানা হাত তুলে দিয়ে বলেছিল,
-আমগো লতু পাগলি আছে, ওর মাথায় রাগটা একটু বেশি।বাবা,তুমি ওরে দেখেশুইন্নে রাইখো। আসগর আলী আমলে নেয় নাই৷ ওতো কথার কথা বিয়ের সময় সবাই বলে। সে রাজমিস্ত্রীর কাজ করে।পয়সা খারাপ পায় না কিন্তু খাটতে হয় খুব। রাতে চৌকিতে গা এলিয়ে দেয়।
-বউ, এট্টু হাত-টা টিপ্পা দে। শরীর ব্যথায় কাইত হইতে পারি না। বালিশখানা মাথায় দিয়ে লতু পাশ ফিরে শোয়।
-সারাদিন আপনেও গতর খাটাইছেন আমিও খাটাইছি। আপনে বাইরে আমি ঘরে। চুপচাপ ঘুমান যান, শরীর টিপনের শক্তি নাই।
আসগর আলী তাজ্জব হয়ে যায়। নতুন বউয়ের মুখে একেমন কথা! তার বৃদ্ধা মা এখন সরিষার তেল গরম করে বাজানের শরীর মালিশ করে দেয়।আর তার বউ বলে শরীর মাজন একটা ব্যারাম। একদিন আরাম পাইলে অভ্যাস হইয়া যায়। লতিফা চঞ্চল। পুকুর থেকে মাটি তুলে ঘর লেপাঘষা করে, সারা বাড়ির মস্তবড় উঠান একা ঝাড়পোছ করে ঝকঝকে করো তুলে।আসগর আলী রাগ কর,
-তুই নতুন বউ মানুষ। উঠান ঝাট দিতে যাস কে?
-হ! হাঁটু হমান পাতায় তলাইয়া থাকে৷ তোমার মা-বইন কেউ পরিষ্কার করে না কেন!
-মাগী তুই মা তুইল্লা কস! আসগর আলী হাতের তালপাতার পাখা সজোরে তুলে ধরে। লতিফার চোখের দৃষ্টি স্বচ্ছ। চোখে চোখ রেখে বলে,
-গায়ে একবার হাত তুলে দেখ। তোমগো বাড়ির আমগাছের ডালে ফাঁসি দিয়া জেলের ভাত খাওয়ামু।
-দে গা, যা।
-হ! থানার পুলিশ পাছার মধ্যে বাইড়ানি দিলে বুঝবা মজা কারে কয়।
গ্রামের মহিলারা যেখানে দুইবেলা লাথি ঝাটা খেয়ে স্বামীর পা ধরে বসে থাকে। লতিফা সেখানে ব্যতিক্রম। মারতে এলে কোমরে আঁচল গুঁজে তেড়ে আসে।তাড়িয়ে দিতে চাইলে নিজেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়৷ আসগর আলী তবু লতিফার উপর রাগ করে থাকতে পারে না।
তাদের ভাইদের যেখানে যাকাতের টাকায় ভরসা করতে হয় সেখানে তার ঘরে রঙিন টিভি,ফ্রীজ শোভা পায়। বড় ভাই নিজের ভাগের জায়গা বিক্রি করে দেশান্তরি হল, আসগর আলী টিনের ঘরের স্বপ্ন দেখে৷ চৌদ্দ বছরের লিকলিকে কিশোরী জীবন নৌকার এত দক্ষ মাঝারি কে জানত! পাড়ার বউঝিরা কিস্তি তুলে স্বামীর হাতে তুলে দেয় আর লতিফা কিস্তির টাকায় বাড়ি বাড়ি ঘুরে কাগজ কিনে।বিকেলে পরের বাড়ির কথা কানাকানি আর উকুন বেছে সময় পাড় করে না। ঘরের দাওয়ায় মাদুর পেতে বসে ঠোঙা বানায়৷ ছেলেদুটোর স্কুলখরচ-বেতনের কথা আসগর আলীর ভাবতে হয় না। লতিফা আছে। আসগর আলী তবু বউয়ের উপর বিরক্ত হয়। ঘাটে শরীর ধুয়ে সুলতান শেখেন উঠান মাড়িয়ে আসতে হয়। সুলতান শেখ বাবু সেজে দাওয়ায় চেয়ার পেতে বসে থাকে।
-ভাবীর শরীরডা ভালা?
-জ্বী ভাই, ভালা। শরীরডা কেমন শুকনা শুকনা লাগে। বহেন, ঝুমুরের মা চা জ্বাল দেয়, এক কাপ চা খাইয়া যাইয়েন নে।
-ভেজা শরীরে কেমনে বহুম! বিকেলে আহুম নে।
-আইবেন কিন্তুক।
সুলতান শেখ মুখে কথা বলে, দুইচোখ লতিফার ভেজা শরীরটাকে গিলে খেতে চায়। ভেজা কাপড় থেকে ছলাৎ ছলাৎ পানি ঝরিয়ে লতিফা নিজেদের ভাগের উঠানে এসে গামছায় চুল প্যাঁচায়। সুলতান শেখ দূর থেকে আড়চোখে লতিফাকে লক্ষ্য করে। বিকেলে লতিফা অবশ্য চায়ের দাওয়াতে যায় না। সুলতান শেখ নিজেই আসে। ভদ্রলোক শৌখিন থাকতে ভালোবাসে।পরনে সাদা লুঙ্গি-পাঞ্জাবিতে দামী আতরের গন্ধ।
-ভাবী, ব্যস্ত নাকি? হাতের ঠোঙা রেখে লতিফা ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
-কী সৌভাগ্য! আপনে! বহেন বহেন।
চেয়ার আঁচলে মুছে লতিফা বসতে দেয়। সুলতান শেখ কথা বলে, ভাবী বলে সস্তা রসিকতাও চলে এতে দোষ নেই। লতিফা ঠোঙা বানায় আর হাসে। কাজ থেকে ফিরে এদৃশ্য দেখে আসগর আলীর অঙ্গ জ্বলে যায়। mসন্ধ্যায় আসগর আলী একটু বেশিই গম্ভীর। লতিফা একটু বেশিই উচ্ছ্বল।
-সুলতান ভাই অনেক কামের মানুষ।
-কেন?
-এত টেকা পয়সা।আবার আদম ব্যবসায় নামছে। দুবাই লোক পাঠাইব।
-তোমারে কেডা কইল?
-আমার লগে তো নিত্যিই কতা হয়। এক উঠানে ঘর।
-ও। আসগর আলী আর কথা বাড়ায় না। রাতে লতিফার গলা জড়িয়ে ধরলে ও বিরক্ত হয়,
-ছাড়ান দাও। পোলা দুইডায় ঘুম যায়।
-হে তো প্রত্যেক রাইতেই ঘুম যায়। এদিক ঘুরো!
-হুরো! বুড়া বয়সে ভিমরতি! ঘুম যাও! আসগর আলী পাশ ফিরে শোও। মাথার শিরা দপদপ করতে থাকে।
-কুজাতের ঘরে কুজাত! ছিলান জানি কোথাকার! জামাই ধরলে দোষ পরপুরুষরে গতর দেখাইতে সরম লাগে না!
আসগর আলীর রাতে ভালো ঘুম হয় না। ঘুমন্ত লতিফার গায়ে হাত রাখে।মাছের মত শীতল শরীর। লতিফার ঘুম ভাঙে না। আসগর আলী বিছানা ছেড়ে বারান্দায় এসে বিড়ি ধরায়। চকিতে সুলতান শেখের ঘরের দরজার খুলে সাদা স্যাণ্ডো গেঞ্জি গায়ে সুলতান শেখ উঠানে নেমে এদিক সেদিক তাকায়। আসগর আলীর মনের ভেতর সন্দেহ আরো পাকাপোক্ত হয়। এমন তো নয় সে ঘুমিয়ে গেলে সুলতান শেখ আর লতিফার গোপন অভিসার চলে। খোদা! বারো বছরের সংসার জীবনে এই সর্বনাশ লেখা ছিল তার কপালে! আসগর আলী পায়ে পায়ে ঘরে ঢুকে দরজায় খিল লাগায়। ছেলে দুটো চৌকিতে জড়াজড়ি হয়ে ঘুমাচ্ছে। লতিফার ঘুমন্ত শরীরটার দিকে তাকিয়ে আসগর আলীর ইচ্ছা হয়,
-একটা লাথি দিয়ে মাগীর শরীরটা খাট থেকে নামাতে। ঘুমের ভান ধরে! নটিগিরির জায়গা পায় না বজ্জাতটা।
সে নিজের শরীরটা যতটা সম্ভব লতিফার শরীর থেকে দূরত্বে রেখে শুয়ে পড়ে। কাল সকালে হয় সুলতান শেখের মাথা ফাটব নয়ত বান্দী মহিলা বাড়ি থেকে দূর হবে। থানা-পুলিশের ভয় দেখায়! কলঙ্কিনী মহিলার সাথে সংসার করার চেয়ে জেলের ভাত খাওয়া ভালো।
রাত গড়ায়। লতিফার ঘুম ভাঙে। নলকূপ থেকে খাবার পানি তুলে আনে, হাঁস মুরগীকে খাবার দিয়ে পরোটা ভাজতে বসে।এক ফাঁকে ঘর ঝাট দিয়ে ছেলে দুটোর ঘুম ভাঙায়৷ আধোঘুমে আসগর আলী সকল কাণ্ডকারখানা টের পায়। আজ তার সকাল সকাল উঠবার তাড়া নেই। দু একদিন কাজে না গেলে কি হয়! লতিফা কয়েকবার এসে ডেকে যায় সে সাড়া দেয় না।
বেলা দশটা বাজে। আসগর আলী আয়েশ করে জলচৌকিতে বসে নিম গাছের ডালা দিয়ে দাঁত ঘষতে থাকে আর দূর হতে লতিফারে লক্ষ্য করে।লতিফার পরনের নীল-হলুদ মিশেল প্রিন্টের শাড়ি, কচিপাতা রঙের ব্লাউজ ফর্সা বাহু খামচে ধরে আছে। তেল নিঙড়ানো পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল।এই সকালেও ও ফেয়ার এন্ড লাভলি ঘষেছে নাকি! গাল দু’খানা কেমন ফর্সা লাগে। গ্রাম্য মহিলাদের তুলনায় লতিফা বেশ পরিপাটি থাকতে ভালোবাসে। রোজ দুবার করে গা ধোয়, কায়দা করে শাড়ি পরে,ব্লাউজের শৌখিন ডিজাইন। ২৭ বছর বয়সেও লতিফার তলপেটে মেদহীন। আঁচলখানা কোমরে গুঁজে যখন উঠান ঝাট দিত আসগর আলীর নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হয়। এমন মেয়ে ব্যাপারী, মাতব্বরদের বাড়ির ঘরনী হয়, কপাল জোরে স্ত্রী পেয়েছে সে । আসগর আলীর দুঃখ হয়, কোনো সুখই চিরস্থায়ী না।
– তুই ঠোঙাই বানাবি? না কয়ডা খাইতে দিবি?
-তোমার দাঁত মাজন তো শেষই হয় না।
-রানছত কি?
-পান্তাভাত আছে খেসারি ডালের বড়া বানাইছি।চাইলে ডিম ভাইজ্জা দিমু।
-পোলা দুইডা খাইছে কি?
-ওগো রুটি ভাইজ্জা খাওয়াইয়া ইস্কুলে পাঠাইছি।
-মাগী,আমার লেগা আর দুইখানা রুটি ভাজলে কি তোর হাত ক্ষয় হয়া যাইত।
-ভাজতে হইলে ভাজত। এতগুলান ভাত আছে। হাঁসমুরগিতে খায়া শেষ হবে না।
আসগর আলী তেড়ে আসে। কাল রাতের তীব্র আক্রোশ শরীর ফেটে বেরিয়ে যেতে চায়। লতিফার চুলের মুঠি ধরে সামনে সাজানো স্তূপ করে সাজানো কাগজে লাথি মারে
লতিফা আকস্মিক রাগ দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায়।তার স্বামী তো এত সহজে রাগে না। ঝগড়া লাগলে তর্ক করে খুব কিন্তু কোনদিনও গায়ে হাত তুলে না। কিন্তু মাথায় ভীষণ ব্যথার অনুভূতি পেয়ে লতিফারও বোধজ্ঞান লুপ্ত হয়।মুরগির তাড়ানোর জন্যে লাঠি ছিল পাশে৷সেই লাঠি দিয়ে সজোরে আসগর আলীর পায়ে আঘাত করতে থাকে।
-বজ্জাতের পো,খাটাশের ঘরে খাটাশ! চুল ছাড় কইলাম নয়ত বাইড়াইয়া ল্যাংড়া বানাইয়া ফেলুম।
আসগর আলী দু’পা পিছিয়ে যায়। হাতের কব্জি ধরে মোচড় দিতেই লতিফা উ উ শব্দ করে হাতির লাঠি ছেড়ে দেয়,
-মাগী,তোর এতবড় সাহস! স্বামীর গায়ে হাত তুলছ! আজকা তোরে লাশ বানামু।
লতিফার সারা গায়ে ইচ্ছামত লাঠির বাড়ি পরতে থাকে। লতিফা দু’হাত দিয়ে মুখ আড়াল করে আর যতটা জোরে পারে চিৎকার করতে থাকে। চেঁচামেচির শব্দে লোক জড়ো হয়।পাড়ার মহিলারা এসে লতিফাকে উদ্ধার কর। ওর সারা শরীর লাঠির আঘাতে টকটকে লাল। লজ্জায় অপমানে কাঁদতে থাকে। বয়োজ্যেষ্ঠরা আসগর আলীকে বকতে থাকে। এরমাঝে সুলতান শেখ আসে। গলা খাকারি দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দেয়।
-নিজের বউরে মারন কাপুরুষের কাম। কোনো ভদ্রলোক বউয়ের গায়ে হাত তুলে না।
-তুই কোন ভদ্রলোকের বাল? পরের বউ দেখলে লেই কুত্তার মত জিব লে লে করে। সুলতান শেখ ভাবতেও পারে নাই তারমত পয়সাওয়ালা গণ্যমান্য লোককে এতবড় অপবাদ দেওয়া হবে।
-আসগর আমি তোর রক্তের ভাই লাগি। আর তুই আমারে কস কি!
-হক কথা কই! নিজের বউ বারো মাসের রোগী। পাড়ার বউগো হারাদিন তুই চোখ দিয়া চাটস!
-তবে রে, ছোটলোকের বাচ্চার মুখে এতবড় কথা! তোর মায় খাটত আমগো বাড়ি বান্দী।
কথায় কথায় বড় ঝগড়া লেগে যায়৷ পুরুষের ঝগড়ায় মেয়েদের থাকতে নেই। লতিফাকে সঙ্গে নিয়ে মহিলারা যে যার বাড়ি চলে যায়। লতিফার গায়ে মালিশ করতে করতে পাড়ার বউঝিরা শুনতে চায় কি বৃত্তান্ত! এত বড় ঝগড়া কি জন্যে! শক্ত-সামর্থ্য লতিফার চোখে আজ বাঁধ ভেঙে যায়। কাঁদতে কাঁদতে সবটা বলে৷ পাড়ার মহিলারা শুনে কেউ কেউ মাথা নাড়ে।
-তা দুইডা রুটি ভাইজ্জা দিতে কইছে দিতা। হেতের দোষ কি! পুরুষমানুষ ভালোমন্দ না খাইলে গতর খাটাইব কেমনে!
-হেই সুযোগটা দিল কই! তেড়ে মারতে আইল। আরেকজন কয়,
-যাই কও বুজি,স্বামীর গায়ে হাত তোলা মহাপাপ।সময় কইরা মাফ চাইয়া নিও। এইসব ছুটতে ছুটতে আসগর আলীর বড় ছেলেটা আসে
-মা বাড়ি চলো,আব্বায় সুলতান শেখের মাথা ফাডায়া ফেলছে।
লতিফার ছেলের পিছু পিছু দৌঁড়ে আসে। ঘটনা অর্ধসত্য।মাথা ফাটানোর জন্যে চ্যালাকাঠ নিয়েছিল পাড়ার লোকজন ছাড়ান দিছে।উঠোন লোকে লোকারণ্য। সুলতান শেখ নিজের সীমানায় উঠানে বসে হুমকি ধামকি দিচ্ছে।কিন্তু এদিকে আসার সময় সাহস পাচ্ছে না।আসগর আলী দাওয়ায় বসে বিড়ি টানছে। যেন কিছুতেই তার আর কিছু যায় আসে না। নানা রকম মন্তব্য করতে করতে ধীরে লোক কমতে থাকে। দুপুর হয়ে আসছে। লোকজন যার যার কাজে ব্যস্ততা বাড়তে থাকে। লতিফা চুলা ধরায়। ঝড় হোক তুফান হোক আর ঝগড়া লাগুক পেটে ভাতের যোগান তো দিতেই হবে।কলার মোচার বড়া, পুইশাক দিয়ে পুঁটি মাছের চচ্চড়ি,মাষকলাইয়ের ডাল। শয়তান বেটা মাষকলাইয়ের ডাল হলে এক প্লেট ভাত বেশি খায়। সকাল থেকে অভুক্ত। ছেলেটার স্কুল কামাই হল। উঠানে ঝিম ধরে বসে আসে। আসগর আলী ছেলেকে ডাকে।
-আয় আমার লগে।
-কই যামু আব্বা?
-আইতে কইছি আয়। ঘর থিকা দাও লইয়া আয়।
বাঁশ আর চাটাই দিয়ে বাপ-বেটা মিলে উঠানের এক মাথা থেকে অন্য মাথা বেড়া দিয়ে ফেলে। সুলতান শেখের বাড়ির একটা মাছিও যেন এ বাড়ির সীমানায় আসতে না পারে। সব কাজ শেষে ঘর্মাক্ত আসগর আলী পুকুর থেকে দুই বালতি এনে দাওয়ায় রাখে । লতিফাকে শুনিয়ে বলে
-যত খুশি মরার গোসল কর। ঘাটে গোসল করতে গেলে ঠ্যাঙ ভাইঙা ফালামু।