প্রায়ই রাতে দাদীর রুমের জানালা নাকি এমনি এমনি খুলে যায়। শোঁ-শোঁ করে বাতাস আসে। জানালার পর্দা পতপত শব্দ করে তার ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। একটা বাচ্চা ছেলের ছায়া গ্রিলের ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে বলে, “পান খাবেন দাদীমা? মিষ্টি জর্দা দিয়ে পান বানিয়ে এনেছি।” দাদীর এই উদ্ভট কথা কেউ বিশ্বাস না করলেও আমি করেছি। বিস্মিত ভাব নিয়ে বলেছি, “ছেলেটার কাছ থেকে পান চেয়ে খাও না কেন তুমি?” দাদী মুখ বাকিয়ে বলেছেন, “আমি কি মিষ্টি জর্দার পান খাই? আমি তো খাই জাফরানি জর্দা।” তিনি তিন বছর যাবত বিছানায় শয্যাশায়ী। চোখে চশমা দিয়েও ঝাপসা দেখেন। শরীরের ঘ্রাণ কিংবা পায়ের শব্দে মানুষ চিনেন।
আমি নিঃশব্দে তার ঘরে ঢুকলেও বলবেন, “কে? রাকিব না?” “হ্যাঁ দাদী।””চোরের মতো ঘরে ঢুকিস কেন? তুই কি চোর? দেখতো, আমার ঘরের সিলিং ফ্যানটায় কি হয়েছে? শুধু ঘ্যাটর-ঘ্যাটর শব্দ হয়!” “মিস্ত্রি এনে দেখাবো দাদী আমি এসবের বুঝি না।” “তুই না ইন্জিনিয়ারিং পড়িস? তাহলে কেমন ইন্জিনিয়ার হবি?” দাদী ভুল করে জোহরের নামাজ আছরের সময়ে পড়েন আবার আসরের নামাজ মাগরিবে। কিছুই তার মনে থাকে না। কিন্ত আমি যে ইন্জিনিয়ারিং পড়ছি সেটা তিনি ভুলেন না কিভাবে সে এক রহস্য! প্রতিদিন সকালে রিফাত ভাই (আমার আপন ভাই) আর আমি তাকে ধরাধরি করে ইজি চেয়ারে শুইয়ে দেই। যতক্ষণ বসা অবস্থায় থাকেন অনবরত যাকে কাছে পান তার সাথে প্যানপ্যান করতে থাকেন।
বেশীরভাগ কথাবার্তা বলেন আম্মুকে উদ্দেশ্য করে।এই যেমন “বউ মা! একদিন তোমাকেও আমার মত বুড়ো বয়সে ইজি চেয়ারে শুয়ে থাকতে হবে। সেটা কি মাঝেমধ্যে তুমি ভাবো? নাকি সারাক্ষণ ভাত তরকারি রান্না করলেই চলবে?” আম্মু বিরক্ত হয়ে বলেন, “আপনি কি আরেক কাপ চা খাবেন। তাহলে বলুন চা বানিয়ে দেই।” “তুমি যে চিনি ছাড়া আমাকে চা বানিয়ে দাও সেটা কি মুখে দেওয়া যায় বউমা? তার উপর চা পাতি দাও হালকা করে। অবিকল গরম পানির মতন লাগে।” আম্মু তখন আরও বিরক্ত হয়ে যান। দাদীর কথার বেশি উত্তর দেন না। হয়তো উত্তর দেয়ার প্রয়োজন মনে করেন না। বৃদ্ধা মানুষ! যার স্মৃতিশক্তি ক্রমশ লোপ পাচ্ছে। গুছিয়ে কথা বলার চিন্তা শক্তিও নষ্ট হয়ে গেছে। তার সাথে কিসের এত কথা?
আমি সময় পেলেই কিছু সময় দাদীর কাছে যেয়ে বসি। সবসময় যে তিনি উদ্ভট কথা বলেন তা কিন্তু নয়। মাঝেমধ্যে তিনি আমার পড়াশুনা আর রিফাত ভাইয়ের চাকরির খবরাখবর নেন। চাচাতো-ফুফাতো ভাইবোনদের সাথে হাসিতামাশা করেন। সপ্তাহে একদিন শুক্রবার আমরা সব ভাইবোনরা একসাথ হয়ে দাদীর মুখের গল্প শুনি। কখনো টোনা-টুনির গল্প, কখনো মহুয়া সুন্দরীর গল্প আবার কখনো কাজলরেখার গল্প। প্রত্যেকটা গল্প শুনেই “ফুলি” গুমরে কাঁদে। ও হ্যাঁ, ফুলির কথা বলতে ভুলে গেছি। ফুলি আমার দুঃসম্পর্কের ফুফাতো বোন। সেলিনা ফুফুর মেয়ে। এইবার এস.এস.সি পরীক্ষা দিয়েছে। দাদা-দাদী সেলিনা ফুফুকে দত্তক নিয়ে নিজের মেয়ের মতো বড় করে বিয়ে দিয়েছিলেন। ফুলির জন্মের এক বছর পরই ফুফা মারা যান। তারপর থেকে ফুলি আর ফুফু আমাদের বাড়িতেই থাকেন।
পরীক্ষা শেষে অবসর সময় পার করার কারনে দাদীর বেশীরভাগ সময় দেখাশুনার দায়িত্ব আজকাল ফুলির উপর। দাদীরও কথাবলার জন্য একজন মানুষ সবসময় পাশে প্রয়োজন পড়ে। ধৈর্য্য নিয়ে কেইবা আর শুনবেন তার কথা?
আমিও মাঝেমাঝে শুনি ফুলি আর দাদীর কথোপকথন। দাদী বলেন, “বুঝলি ফুলি তোর দাদাকে আজ স্বপ্নে দেখেছি। সাদা এক ঘোড়ায় চড়ে আমাকে হাত ইশারায় ডাকছেন। তার পরনে সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা। অবিকল বিয়ের সময় তাকে দেখতে যেমন রাজকুমারের মত লেগেছিল সেরকম নূরানী চেহারা। আমি মনে হয় আর বেশিদিন বাঁচবো না।” ফুলি সেই কথা শুনে উঁ-উঁ করে কেঁদে উঠে। “বেশীদিন বাঁচবেন না”- কথাটা তিনি গত তিন বছরে এতই বেশি বলেছেন যে ফুলি ছাড়া আর কারো মনে আঘাত হানে না।
ফুলি আগ্রহ নিয়ে যখন স্বপ্নের শেষটুকু শুনতে চায়।তখন দাদী সবকিছু ভুলে যেয়ে বলেন, “এই মেয়ে কে তুমি? আমার ঘরে কীভাবে ঢুকেছো। আবার ফুচফুচ করে কান্না করছ। রিফাত ! রাকিব! তোরা সব কই।ঘরের মধ্যে এক চোর ঢুকে বসে আছে।” তখন দাদী হাতের কাছে যা পান তাই ছুড়ে মারেন।তখন তাকে ঘরের মধ্যে তালাবদ্ধ করে রাখতে হয়। দিনদিন শরীরের অবনতির সাথে দাদীর পাগলামিও বাড়তে থাকে। দাদীর মাথা পুরো খারাপ হওয়ার আগেই আম্মু তাকে ছাদের চিলেকোঠার ঘরে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। ফুলি কাঁদতে কাঁদতে দাদীর জিনিসপত্র গুছিয়ে দেন। দাদী সেই কান্না দেখে বলেন “এই লতিফা! এই তুই কাঁদছিস কেন? আমি কি সারাজীবনের জন্য শশুড়বাড়ি যাচ্ছি? মাঝেমধ্যে আসবো না?”
আব্বুর কাছ থেকে জানতে পারি লতিফা নামের দাদীর এক ছোট বোন ছিল। কিশোরী বয়সেই মেয়েটি কুকুরের কামড়ে জলাতঙ্ক হয়ে মারা যায়।দাদীর তার কথা মনে পড়লেই কাঁদতেন। আজকাল বেশীরভাগ সময় কথা বলার সময় লতিফার নাম নিয়ে কাঁদেন। সেই কান্নার শব্দ চিলেকোঠার ঘর থেকে আমরা শোবার ঘরে বসে শুনতে পাই।
খাবার খাইয়ে দেয়ার সময় দাদীকে নিয়ে মহাবিপদে পড়তে হয়। দু’লোকমা মুখে দিয়েই বাচ্চাদের মত করে বলবেন, “খাবোনা! খাবোনা! বললাম তো খাবোনা। বৌমা লবন আর মশলা ছাড়া এসব কি রান্না করে? এসব তো গরু ছাগলেও খেতে পারবেনা আর আমি তো মানুষ।” ফুলি যখন বুঝিয়ে শুনিয়ে তাকে খাবারের পর ঔষধ খাইয়ে দেয় তার কিছুক্ষণ পরেই বক করে বমি করে সব ফেলে দেন। বাথরুম করে দাদী বিছানাপত্র নষ্ট করে ফেলেন। সবকিছু সেলিনা ফুফু পরিষ্কার করলেও আম্মুকে বলতে শুনি, “আম্মার তিনজন ছেলের বউ থাকতে সব কষ্ট আমাকে কেন করতে হবে। মেজ ছেলের কাছেই বুড়ি সারাজীবন পড়ে থাকবে কেনো? মেজ ছেলে কি সোনা দিয়ে বাঁধানো?”
বড় চাচা, ছোট চাচা কিংবা ফুফুরা এটা-ওটা কিনে দেখতে আসলেও নিজ থেকে কেউ দাদীকে নিজের কাছে রাখার কথা বলেন না। বড় বড় কথা সবাই বলতে পারেন কিন্তু দায়িত্বর মত কঠিন কাজ কেউ নিতে চান না। অমাবশ্যার রাতে দাদী প্রচণ্ড চেঁচামেচি শুরু করেন কেন জানা নেই। চিৎকার করে বলেন, “ছাদের রেলিং ধরে সাদা শাড়ি পড়ে কে দাঁড়িয়ে আছিস? কে কে? কথা বলছিস না কেন?” চিলেকোঠার জানালা দিয়ে যখন দাদীর দিকে করুন চোখে তাকাই তখন তিনি বাচ্চাদের মত বিছানা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে নেমে বলেন, “লক্ষী সোনা চাঁদের কণা, দরজাটা খোল। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে আমি বৃষ্টিতে ভিজবো।” শেষ দিনগুলোতে দাদীর খুব কষ্টে কাটে। সমস্ত শরীরের কাপড় খুলে নগ্নভাবে বসে থাকতেন। আমি তাই ছাদে গেলেও খুব একটা চিলেকোঠার সে দিকটায় যেতাম না। একদিন পড়ন্ত বিকেলে ছাদে দাঁড়িয়ে বাড়ির পোষা কবুতরগুলোকে ধান ছিটিয়ে দিচ্ছিলাম। চিলেকোঠার জানালা থেকে দাদী বললেন, “এই রাকিব এদিকে আয়।”
আমি কবুতরের দিক থেকে চোখ না সরিয়েই বললাম, “ডাকছ কেন দাদী?” “তোকে এই দিকে আসতে বলেছি আয়। আমার গায়ে কাপড় আছে। আর যদি নাও থাকতো কিছু হত না। আমি তোর দাদী। দাদী-নাতির মধ্যে লজ্জা নেই। ছোটবেলায় কতবার তোকে আমি ন্যাংটা করে গোসল করিয়ে দিয়েছি তোর মনে নেই? প্রসাব করে বিছানাপত্র ভিজিয়ে ফেলতি আমার।” জানালার কাছে যেয়ে দেখি সত্যি দাদী বেগুনি পাড়ের সাদা একটা শাড়ি পড়ে জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছেন। আমি অবাক হয়ে বললাম,”শাড়ি কে পড়িয়ে দিয়েছে?” “আজ শরীরটা একটু ভালো। ‘ফুলি’ আমাকে গোসল করিয়ে এই শাড়িটা পড়িয়ে দিল। শাড়িটা চিনিস তো? গত ঈদে তোর ছোট ফুফু কিনে দিয়েছিল।” “তোমাকে সুন্দর লাগছে দাদী।”
দাদী মাথার ঘোমটা টেনে বললেন, “তুই জানিস আমি ফুলির বয়সে অসম্ভব রূপবতী ছিলাম। তোর দাদা যখন বিয়ের জন্য আমায় দেখতে এসেছিল প্রায় পনের মিনিট হাঁ করে তাকিয়ে বলেছিলেন, আমি আর কোথাও মেয়ে দেখাবো না। এখানেই বিয়ে করবো। হিহিহি” বহুদিন পরে দাদীকে হাসতে দেখে আমার চোখ ভিজে উঠল। চোখ মুছতে মুছতে বললাম, “তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো দাদী তাহলে তোমাকে আর চিলেকোঠার ঘরে থাকতে হবে না।” “আমার একটা কথা রাখবি?” “অবশ্যই রাখব।” “তুই আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আয়। শুনেছি সেখানে আমার মত আরও বুড়ো মানুষ আছে। এখানে থাকলে আমি মৃত্যুর আগে এক চামচ পানিও খেয়ে মরতে পারব না। তোর বাপ-চাচারা সম্মানের ভয়ে দিয়ে আসছেন না। তুই দিয়ে আসলে কোনো ক্ষতি নেই।”
প্রথমে কেউ রাজি না হলেও পরে সবার সম্মতিতে দাদীকে আমিই “বৃদ্ধাশ্রমে” রেখে আসি। ফুলি সেদিন এমনভাবে কাঁদল যেন দাদী পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। দাদীকে রেখে চলে আসার সময় তিনি বললেন, “যদি সম্ভব হয় আমার আরেকটা শেষ কথা রাখিস। ফুলিকে বিয়ে করিস। তাহলে তোর বাবা মাকে কেউ বুড়ো বয়সে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাবেন না। আমি কাউকে অভিশাপ দেই না কিন্তু প্রকৃতি বড় নিষ্ঠুর অভিশাপ দিয়ে দেয়।” বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার সতেরো দিন পরেই ঘুমের মধ্যে দাদীর মৃত্যু হয়। ঊননব্বই বছর আগে জমিদার বংশে দাদীর জন্ম হয়েছিল। শিক্ষিত এবং বিত্তশালী ছেলেমেয়েরা থাকা সত্ত্বেও তিনি একা একা মারা গেলেন। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত ছুঁই ছুঁই। আমি কবুতরকে খাবার দিচ্ছি। মনে হচ্ছিল সত্যি চিলেকোঠার ঘরে কেউ সাদা শাড়ি পড়ে দাড়িয়ে আছেন। দাদীর মৃত্যুর পর ফুলি পাথরের মতো হয়ে গিয়েছিল। দাদীর শেষ কথা রাখতে ফুলিকে আমি বাবা মায়ের অমতেই বিয়ে করে ফেলি। যার পরিনতিতে আমাকে বাড়ি ছাড়তে হয়।
পনের বছর পর।
বাবার মৃত্যুর পর রিফাত ভাইয়া ভাবীকে নিয়ে দেশের বাইরে চলে যান। মাসের মধ্যে একবার ইচ্ছে হলে ফোন দেন ইচ্ছে না হলে দেন না। আম্মু বুড়ো হওয়ার আগেই অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়েন। বেশীরভাগ সময় বারান্দার হুইল চেয়ারে আমার সাত বছরের মেয়ে “পিংকির” সাথে খেলা করে সময় কাটান। ফুলি প্রায়ই আমাকে মনে করিয়ে দেয় আম্মুর জন্য “Zero-Calorie sugar free tablets” নিয়ে আসতে। আম্মুর ডায়াবেটিস কিন্তু তিনি যে চিনি ছাড়া চা খেতে পারেন না।
‘সমাপ্ত’