আমি প্রথম নেশা করি শানুর বিয়ের আগের দিন, গায়ে হলুদের রাতে। বন্ধুদের একজন নিয়ে এল বোতল ভর্তি মদ আর সস্তায় কেনা গাঁজা। শানুদের বাড়িতে তখন স্পিকারে ডি.জে গান বাজছিল। গানের শব্দ আমার কানে এসে মাছির মত ভনভন করতে লাগল। আমি তাড়াতে পারছিলামনা। ভোতা এক শব্দ দূষণ হচ্ছিল কানের পর্দায়।
মুভিতে দেখতাম মদে পানি মিশিয়ে বা বরফ মিশিয়ে খায়। বন্ধু কোনো পানি মিশায়নি। বলল এগুলো কমদামি মদ, পানি মিশাতে হয়না।
গাঁজা পাতাকে কেচি দিয়ে কুচি কুচি করে সিগারেটের তামাক সাথে দিলে হাতের তালুতে রেখে বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ডলা। কী নিপুণ কারিগর তারা। আমার এভাবে শিখতে হলে তিনমাসের প্রশিক্ষন নিতে হবে।
গাঁজা সিগারেটের মত খাওয়ার দশ মিনিট পরই আমার দুনিয়ার কোনো খেয়াল নেই। তাদের সাথে কী বলে কী করেছি আমার মনে নেই। এতটুকু মনে ছিল একটু পর পর গলা শুকিয়ে যেত। তাদের মুখে পরদিন শুনেছি, রাতে নাকি আমি চিৎকার করে কান্না করেছি আর শানুকে ডেকেছি। বারবার নাকি বলেছি, শানু তুই আমাকে দেবদাস বানিয়ে দিলি। এর পর থেকে বন্ধুরাও নিয়ম করে দেবদাস ডাকা শুরু করল।
শানুর বিয়ের দিন সকালে আমি বন্ধুর ঘরে নাক ডেকে ঘুমাই। শেষ রাতে নাকি বমিও করেছি। সজাগ হয়ে শুনি রাতে বেশি মাতাল ছিলাম তাই বন্ধুটি তার ঘরেই শুইয়ে দিয়েছে। বাবা মায়ের কথা ভাবতেই শরীরের লোম দাড়িয়ে গেল। তারা যদি জানতে পারে তাহলে আমাকে মেরেই ফেলবে। বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম মুখে মদ গাঁজার গন্ধ বের হয় নাকি? সে উত্তর দিল দুই তিন দিনের বাসি সবজির গন্ধ বের হচ্ছে। শুনে গা গুলিয়ে যাচ্ছে। খড়কুটার ছাঁই দিয়ে দাঁত মেজে মুখ ধুয়ে লেবু পাতা মুখে দিয়ে রেখেছি কিছুক্ষন। হঠাৎ মনে হলো, আজ তো শানুর বিয়ে। আমি বের হতে চাইলে বন্ধু রবি বাঁধা দিল। সে বলল, মানুষ অন্য চোখে তাকাবে। কানাকানি করবে, কটুকথা বলবে। তার চেয়ে ভালো আজকের দিনটি দূরে থাক। সে দিনটি সত্যিই আমি দূরে কাটিয়েছি। রাতে এলাকায় এসেও দেখি মরিচা বাতিগুলো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। শানু অন্য কারো হয়ে যাবার সাক্ষী এই মরিচা বাতিগুলো।
শানুর বসবাস আমাদের এলাকাতেই। তাকে পছন্দ করি ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, শানু আমাকে কখনোই পছন্দ করতনা। আমার সাথে কথা পর্যন্ত বলতনা। হাজারবার মনে প্রশ্ন এনেছি, সে কেন আমার সাথে কথা বলবেনা? আমি তো তাকে ভালোবাসি। একবারও মনে হয়নি, তারও একটি মন আছে। তারও পছন্দ অপছন্দ থাকতে পারে। দিনের পর দিন শানুর জন্য রাস্তার ধারে, তাদের বাড়ির আশে পাশে ঘুরে বেরিয়েছি। পথ আগলে দাড়িয়ে দু’দিন প্রেম নিবেদন করেছি। হ্যাঁ, না কিছুই বলেছি। মাথা নিচু করে দিয়ে চলে যেত। এলাকার মানুষজন জানলে আমাকে সেরা উত্তক্তকারী বলে অপবাদ দিত। তবুও আমি কখনো শানুর মন পাইনি। আমিও শানুর কাছ থেকে অবাধ্য মনটি সরিয়ে ফেলতে পারিনি। মনে মনে ভাবতাম, চন্ডিদাস তো বারো বছর অপেক্ষা করেছিল রজকিনীর জন্য। আমিও অপেক্ষা করতে থাকি। হয়তো একদিন শানু ঠিকই আমার প্রেমে সাড়া দিবে। দিন যায়, মাস যায়, বছরও পেরিয়ে যায়। শানুর মনে আমার জন্য বিন্দুমাত্র জায়গা হয়না।
যেদিন শুনেছি শানুর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে সেদিন পাগলপাড়া হয়ে ছুটেছি শানুর সাথে একটু দেখা করার জন্য। এলাকার অনেকেই জানত আমি শানুকে পছন্দ করি। সেজন্য যার সাথে দেখা হয় সেই টিপ্পনি কেটে বলে, কিরে তোর নায়িকার তো বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। সে সময়টা কত কষ্টকর তা কেবল আমি জানি। আমি বহু চেষ্টা করেও শানুর সাথে দেখা করতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত বিয়েটা হয়েই গেল। শানু মনের ভিতর এতটাই গেঁথে ছিল যে মধ্যরাতে শানু শানু বলে ঘুম থেকে জেগে উঠতাম। দিন দিন আমার চেহারা, স্বাস্থ্যের অবনতি দেখে বাবা মায়ের মনে সন্দেহ ঢুকল। দুয়েকটা কানকথাও বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে। বাবা খুবই রাগী মানুষ। বড় হবার পরও কয়েকদিন আমার পিঠে লাঠি ভেঙ্গেছে। পিঠকে ধন্যবাদ, লাঠি ভাঙ্গলেও পিঠ ভাঙ্গেনি।
একদিন বাবা আমার মানিব্যাগের ভিতর সুঁই খুঁজে পায়। তখন আমি ইয়াবায় আসক্ত। সুঁই লাগত লাইটারের মধ্যে গেঁথে আগুন বাইরে আনার জন্য। সেদিন বাবা আমার হাত দুটি কষে বাঁধলেন খাটের পায়ার সাথে। দরজা লাগিয়ে দিলেন, মা তখন রুমের বাইরে। ঘরে কেবল আমি আর বাবা। এবারের লাঠি আর ভাঙ্গেনি। আমার পা মনে হয় ভেঙ্গে গেছে। খুঁড়িয়ে হেঁটেছিলাম চারদিন। জন্মের পর এত মার খাইনি। বাড়ি থেকে সম্পূর্ণ খরচ দেয়া বন্ধ করে দিল।
নেশাখোররা নেশা একবার শুরু করলে ছাড়তে সময় লাগে। একদিনে নেশা ছাড়া প্রায় অসম্ভব।
পকেটে টাকা নেই। কিন্তু নেশা করার সময় হলে তো পাগল পাগল লাগে। বন্ধুদের কাছ থেকে আর কয়দিন খাওয়া যাবে? এক বন্ধু একদিন বলল, আমাদের সবার হাতে ব্লেডে কাটা দাগ আছে। একমাত্র তোর নেই। তুই নামেই শুধু দেবদাস হইলি শানুর জন্য। হাত পা কাটতে পারিসনি, কেটে নাম লিখিতে পারিসনি। যদি কাটিস তাহলে আগামী চারদিনের নেশার টাকা আমি দেব। হাতের দিকে তাকিয়ে বড্ড মায়া হলো। না, আমি হাত পা কাটতে পারবনা। বাড়িতে দেখলে বাবা আবার আমাকে খাটের সাথে বাঁধবে।
সেদিন নেশা করেছি গভীর রাতে। ট্রাক ভর্তি পাথর এসেছিল। সে পাথর ট্রাক থেকে নামিয়ে চারজনে দুই হাজার টাকা পেলাম। মনে মনে ভাবলাম আজই বেশি করে নেশা করব, কাল থেকে আর করবনা। যদিও নেশা আর করবনা বলেছি বহুবার কিন্তু না করে থাকতে পারিনি। নেশা করে চোখগুলোকে লাল টকটকে করে প্রলাপ বকতাম। কখনো একা একা হাসতাম। কখনো কেঁদে কেঁদে আপন মনে শানুকে ডাকতাম। সে এক অন্য জগৎ। যে জগতে নিজেই নিজের রাজ্যের বাদশা। আর বাস্তব জীবনে আমি নিকৃষ্ট এক নেশাখোর।
একদিন খুব খারাপ লাগছিল। এক পয়সাও নেই আমার কাছে। নেশা করার জন্য নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। রাত তখন আটটা। বাবা ফিরেনি তখনো। আমি মায়ের কাছে আকুতি নিয়ে বললাম, মা চার পাঁচশত টাকা দাও। নয়তো আমি বাঁচবনা। প্রথমে রাগ দেখিয়ে বাইরে বের করে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। আমি বাইরে থেকে বলছি, মা আমি কিন্তু সত্যি সত্যিই মরে যাব। তারপর এই চার পাঁচশত টাকা লাগবে কাফনের কাপড় আনতে। মা দরজা খুললেন। আমার চুলে হাত বুলিয়ে বললেন, আমাদের মান সম্মান নষ্ট করলি তবুও নেশা করা ছাড়লিনা। এত বড় হবার পরও তোর বাবা এত মারল তবুও নেশা ছাড়লিনা।
নেশাখোর বন্ধুদের সঙ্গ ছাড়তে বললাম তবুও ছাড়লিনা। আর আজ বলছিস নেশা করতে না পারলে মরে যাবি। তো নেশা করে কী বেঁচে থাকতে পারবি? তোর মত সন্তান পেটে ধরে পাপ করেছিলাম? আমি কোনো উত্তর দিতে পারিনি। মায়ের চোখে পানি। মা নাকের নাকফুলটি খুলে দিল। বলল, সেদিন তোকে মারার পর থেকে তোর বাবা আমার কাছে এক টাকাও রাখেনা। তোর বাবার ধারণা আমি তোকে টাকা দেব। আমার কাছে কোনো টাকা নেই। যেদিন বাবা হবি সেদিন বুঝবি সন্তানের জন্য ভিতরটা কেমন লাগে। আজ মরে যাবার ভয় দেখাস। আর তোকে বাঁচিয়ে রাখতে ছোটবেলা থেকে কত কষ্ট করে এসেছি। নে, এবারও বাঁচিয়ে রাখি। এই নাকফুলটা বিক্রি করে দে।
আমি প্রথমে নিতে চাইনি। কিন্তু নেশা করার তীব্র ইচ্ছা সব মায়া মমতা ভুলিয়ে দিয়েছে। মায়ের চোখে পানি দেখেও কুলাঙ্গার আমি মায়ের নাকফুল নিয়ে রওনা হলাম নেশা করার জন্য। রাত তখন নয়টা বাজে। রিক্সায় উঠে বসে পড়লাম। কিছু দূর যেতেই রিক্সাওয়ালা ভাইয়ের মোবাইলে কল এল। রিসিভ করে তিনি জোরে বলছে, তুমি জানোনা নাকফুল না থাকলে স্বামীর অমঙ্গল হয়? এখন নাকফুল কেনার টাকা পাব কোথায়? ভালো করে খুঁজে দেখো।
অশ্রুভেজা মায়ের মুখটি আমার চোখে ভেসে উঠল। রিক্সাওয়ালা ভাইকে রিক্সা ঘুরাতে বললাত। নেমে মানিব্যাগ বের করে দেখি কোনো টাকা নেই আমার মানিব্যাগে। রিক্সাওয়ালা ভাই মানিব্যাগ দেখে কিছু না বলেই চলে গেল। আমি হাঁটছি বাড়ির দিকে। আমার মায়ের নাকফুল আমি বিক্রি করতে পারবনা। আবার মানিব্যাগ বের করলাম নাকফুলের জন্য। কিন্তু মানিব্যাগে নাকফুলটি নেই। কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে মানিব্যাগে রেখেছিলাম। একদিকে নেশা করতে না পারার যন্ত্রনা অন্যদিকে নাকফুল হারিয়ে ফেলে চুল টানছি। কী করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা। আমার চোখভরে জল এল।
রাত সাড়ে নয়টা। বাবা বাড়ি ফিরবেন সাড়ে দশটা বা এগারোটার দিকে। ঘরের বাতি জ্বালানো। মা ঘুমিয়ে পড়েছে এই সন্ধারাতে। জানালা দিয়ে দেখছি আমার ঘুমন্ত মায়ের নাকফুলটি নেই। মা হাসলে মনে হতো মায়ের নাকফুলটিও হাসত। সেই নাকফুল আমি নেশা করার জন্য নিয়ে গিয়েছিলাম। বাইরে বাতাস বইছে, মনে হচ্ছে ঝড় হবে। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আমি কুঁজো হয়ে রাস্তায় হাঁটছি আর মায়ের নাকফুল খুঁজছি। কবি আল মাহমুদের নোলক কবিতাটির কথা মনে পড়ছে। “আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে, হেথায় খুঁজি, হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।”
আমার মতো নেশাখোরদের কবিতার চরণ মনে হবার কথা নয়। আমি কত বড় বোকা। যে শানু কোনোদিন আমাকে ভালোবাসেনি তার কথা চিন্তা করে নেশার জগতে ডুবে রইলাম। যে আমার সাথে কোনোদিন কথা বলেনি আর আমি নেশা করে কেঁদে কেঁদে তাকেই ডাকি। কত বড় মূর্খ আর অপদার্থ আমি। গাল বেঁয়ে অঝর ধারায় জল নামছে চোখ থেকে। চোখে জ্বল ভর্তি থাকলে সামনের অনেককিছু অস্পষ্ট দেখায়। কিন্তু স্বচ্ছ চোখের পানিসহ আমি দেখতে পাচ্ছি ইটের ফাঁকে আমার মায়ের নাকফুলটি বিদ্যুৎ চমকানোর সাথে সাথে চিকমিক করছে। আমার খুশিতে আবারো কাঁদলাম। নাকফুলটি হাতে নিয়ে প্রতিজ্ঞা করলাম, আর কোনোদিন নেশা করবনা। যারা নেশা করে তাদের সাথে চলাফেরাই আজ থেকে বন্ধ। যে আমাকে কখনো ভালোবাসেনি তার জন্য নিজের জীবনটা অযথা নষ্ট করার কোনো মানে হয়না। যদি ভালোবাসত তবুও মায়ের চোখে পানি ঝরিয়ে সে মরিচিকার পিছনে দৌড়ানোর মানে হয়না। আমি নাকফুটি দুই আঙ্গুলে চেপে ধরে দৌড়ে বাড়ি এলাম। মা তখনো ঘুমে। আমি ডাকলাম, মা, মা দরজাটা একটু খুলো।
মা পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখে জানালায় তার একমাত্র ছেলে চোখভর্তি জল দিয়ে দাড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিয়ে জানতে চাইলেন, বাবা কী হয়েছে তোর? আমি মায়ের পা জড়িয়ে ধরে বললাম, মা আমি অনেক ভুল করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও। তোমার পদতলের জান্নাত রেখে আমি এতদিন জাহান্নামে দৌড়াইছি। মা আমাকে ক্ষমা করে দাও। মা আমাকে টেনে বুকে নিলেন। বললেন, আমি জানতাম আমার ছেলে একদিন ভুল পথ থেকে ফিরে আসবে। পৃথিবীর কেউ সেদিন সেই অপরূপ দৃশ্যটি দেখেনি। ছেলে তার মায়ের নাকফুল নিজ হাতে পরিয়ে দিচ্ছে।