আয়েশা নিজেকে খুবই সুখি ভাবেন।
তার চার ছেলে মেয়ে সবাই সারাক্ষণ তাকে ঘিরে থাকে। সকালের নাস্তা আর রাতের ভাত খাওয়া সবসময় এক সাথেই হয়। সন্তানদের কলেজ ভার্সিটি, কাজের চাপের কারণে দুপুরে তাকে একা খেতে হয়। কারণ তার স্বামী আলম সাহেব কখনোই পরিবারের কারো সাথে খেতে পারেন না । তিনি এখন অবসর জীবন যাপন করছেন এবং তার খাওয়া দাওয়া সবার আগে, তিনি বেশিক্ষণ খিদে সহ্য করতে পারেন না।
সন্তানদের সাথে তার গভীর মমতা নয়, গভীর দূরত্ব।
আর তিনি ভাবেন, তাদের মায়ের সাথে দুনিয়ার সব ভালবাসা। দিন নাই, রাত নাই মা ছেলে মেয়ে যখনই একত্রিত হয়,খালি তাদের আড্ডা চলে। পাঁচ জনের একটা গ্রুপ যেন। ওখানে আলম সাহেবের কোনো অস্তিত্ব নাই।
ওনার মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে ওদের সাথে গিয়ে বসতে। বিশেষ করে লোড শেডিং এর রাতে। তখন তার একা সময় কাটেনা। দিনের বেলা দুইটা পত্রিকার দরকারি সব লেখা পড়ে ফেলেন। আর রাতের একা সময়টাতে তিনি খুঁটিনাটি সব পড়েন ।
বাড়ি ভাড়া, পড়াইতে চাই, নিঁখোজ সংবাদ, ছোটদের আসর, বিনোদনে কোন নায়িকা পোয়াতি, কাদের ডিভোর্স হলো কিংবা প্রেম বিচ্ছেদ সব গলাদকরণ করেন।
কিছুই করার নাই। টেলিভিশনে শুধু খবরটা দেখেন। কারণ, উনি যতক্ষণ ঐ রুমে থাকেন কোনো ছেলে মেয়ে টেলিভিশন দেখতে আসেনা। শুধু আয়েশা তার পাশে মনোযোগী শ্রোতা হয়ে বসে থাকে। সেও চুপচাপ থাকে তখন। দুনিয়ার সব কথা তো ছেলেমেয়েদের জন্য জমা রাখছে। অনেক সময় তিনি সবাইকে ডাকতে চান।
বড় গাধাকে যদি তিনি টিভি দেখতে ডাকেন,
“অ টিটু , নাটক শুরু হয়েছে আয়৷” বলে।
সে জবাব দেয়,
“না আব্বু টায়ার্ড একটু রেস্ট নিচ্ছি।”
“এখানে টিভি দেখতে দেখতে রেস্ট নে।”
“না, ঠিক আছি।”
তখন তিনি অন্য ছেলে মেয়েদের ডাকেন। যথাক্রমে উত্তর আসে,
“আমার পরীক্ষা।”
“আমার হোমওয়ার্ক শেষ হয়নি।”
আরেকজন আর কিছু না পেয়ে বলবে।
“মাথা ব্যথা, টিভি দেখলে আরো বেশি খারাপ লাগবে ।”
বউয়ের জবাব আসে কখনো,
“হাতের কাজটা শেষ করেই আসছি।”
উনি তখন টিভি বন্ধ করে, পেপার নিয়ে বসেন, পড়াইতে চাই এর এড দেখেন।
উনি ঐ রুম থেকে যাবার দেরি, সব ছেলে মেয়ে টিভি’র রুমে হুমড়ি খেয়ে পড়বে । রেস্ট, পরীক্ষা, হোমওয়ার্ক, মাথা ব্যথা মুহূর্তেই সব হাওয়া। উনি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। দূরত্ব বেশি বেড়ে গেছে!
আচ্ছা, সবাই থাকে পর ভাবে কেনো!? কখনো তিনি যদি তাদের আড্ডায় যান, ওরা সবাই চুপ হয়ে যায়, ওদের সব কথা মুহূর্তে শেষ হয়ে যায়। তখন একজন একজন করে উঠে চলে যেতে থাকে আসর থেকে। আবার একেকজন একেক কাজের অজুহাত দেখায়। শুধু মাত্র আয়েশা বসে থাকে। আলম সাহেব তখন বলেন,
“কি বলছিলে এতক্ষণ তোমরা?”
“কিছুনা।” আয়েেশা বলেন।
“তো এতক্ষণ তো কথার আওয়াজ শুনছিলাম মনে হলো । ”
“ওরা ভাই বোনদের কথা। কার কি ভালো লাগে না লাগে, এসব শুনে কি করবে?”
“তবুও বলো৷
আচ্ছা, আমি আসলে ওরা চলে যায় কেনো?”
“তোমাকে সংকোচ করে তাই।”
“তোমাকে তো করেনা। আমাকে কেনো?”
“তুমি যে সারাজীবন ওদের সাথে দূরত্ব রেখে চলেছ। সব কথার আদান প্রদান তো আমাকেই দিয়ে করাতে৷”
“এখন সব দোষ আমার। ভালো ভালো৷”
“মন খারাপ করছো কেনো?”
“করবোনা, কি বলো! একা একা রুমে ভালো লাগে? আসলাম তোমাদের সাথে দুইটা কথা বলবো, কি বলছো শুনব, তা না। সবাই এক এক করে চলে গেল।”
“আমি ওদের বলে দিব, আর যেন এমন না করে।”
“থাক, বলে কি হবে। ভালোবাসা মন থেকে আসতে হয়, জোর করে আদায় করা যায়না৷”
“তুমি তো ভালোবাসো, ওরাও কিন্তু বাসে। তোমার ছেলে মেয়ে তোমার মতো প্রকাশ করতে জানেনা, এই যা।”
“হুম, হয়তো।” তিনি বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন ।
আলম সাহেবের মন খারাপ হয়ে যায়। সাথে আয়েশারও। ছেলেমেয়েদের এমন করা উচিত হয়নি।
একদিন আলম সাহেবের হঠাৎ সারা শরীরে ঘাম দিতে দিতে মাথা ঘুরে পড়ে যান। বন্ধের দিন সব ছেলে মেয়ে ঘরে একসাথে আছে। তাড়াতাড়ি টিটু টেক্সি ডেকে হসপিটাল নিয়ে যান। সাথে সব ছেলে মেয়েও গাদাগাদি করে আসে মনে হয়। হসপিটালে চোখ খুলতেই দেখে সবার লাল জবা’র মতো উৎসুখ চোখ বাপের চোখ খোলার অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে। তখন হঠাৎ করেই ছেলেমেয়েদের জন্য আরো গভীর মমতায় তার বুকটা ভরে উঠে।
রাতেই হসপিটাল থেকে চলে আসেন। তেমন কিছু নয়, প্রেসার কম হয়ে গিয়েছিল। শরীরে নাকি লবনের ঘাটতিও! এমন রোগের কথা আগে শুনেননি তিনি। সারাজীবন ছিটা লবণ খেয়ে এলেন!
পরদিন সকালে সবাই কাজ, কলেজ, ভার্সিটি যাবার আগে একবার করে তার রুমে উঁকি দিয়ে যায়। কিছু জিজ্ঞেস করতে বোধহয় সংকোচ লাগছে সবার। তবুও আলম সাহেবের তাদের উঁকি দিয়ে দেখাটাও এত্তো ভালো লাগলো! রাতে সবাই প্রতিদিনের মতো লোডশেডিং আড্ডা দেয়। ছোটমেয়ে ডাকতে আসে।
“আব্বু, আমাদের সাথে বারান্দায় বসতে আসো৷”
“যা তোরা, আমি আসছি।”
আলম সাহেবের দু’চোখ নিজের অজান্তেই ভিজে উঠে। উনি দু’মিনিট দেরি করেই যান।
“কি গল্প চলছে আজ? হু?”
“আব্বু তুমি নাকি একবার পুকুরে ডুবে গিয়েছিলে, দাদী বলেছিল আম্মুকে৷”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, দাঁড়া তোদেরকে সে গল্পটা বলি৷”
আজ আলম সাহেব ভাবেন, তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষ।