আনু
সাল ১৯৫৩।
হুজুর বাড়ির মেয়ে আনু, এই বাড়িতে এগারো বছর পার হবার আগেই সব মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়।
পাত্রকে অবশ্যই আরবি শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে, বয়স কোন ব্যপার না। মেয়েরা কেউ স্কুলে যায় না। মক্তবে ঐ বয়সে যত টুকু আরবি শেষ করা যায়, ততটুকুই তাদের পড়ালেখার দৌড় ।
কিন্তু আনু’র বাপজান নুরুজ্জামান শিক্ষিত এবং একটু আধুনিকমনা। সে দেশ বিদেশ ঘোরা মানুষ, রেঙ্গুনে তার কাপড়ের ব্যবসা। আনু’র বয়স আট , পাঁচ আর তিন বছর বয়সী আরও দুই বোন আছে তার ।
হঠাৎ, আনু’র দাদিজান অসুস্থ হয়ে মারা গেলে বাপজান তাদের এই সময়টাতে সাথে করে রেঙ্গুন নিয়ে যান। তিনি চায়ছিলেন না, আর মাত্র দুই বছর পর মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসা শুরু হোক। আনু’র মা তোতার আট বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল, নুরুজ্জামানের সাথে। তাই সে জানে ছোট মেয়ে বিয়ে দেয়া কতটা অনুচিত।
তাদের প্রথম সন্তান দুনিয়ার আলো দেখেনি, ভাবতে চাননা তিনি , ঐসব দু:স্বপ্নের দিনগুলি।
সবাই রেঙ্গুনে বসবাস শুরু করে, আরম্ভ হয় তাদের নতুন জীবন যাত্রা।
আনুর জন্য হুজুর রাখেন বাপজান। আরবি আর উর্দু কিতাব পড়ান হুজুর , আরেকজন মাস্টার এসে বাংলা,ইংরেজি আর অঙ্ক শেখান। বাইরের বাচ্চাদের সাথে মিশে সে বার্মা ভাষাও শিখে নেয়, তবে স্কুলে না যাওয়ায় সে ভাষা লিখতে পড়তে পারতোনা আনু ।
আনু’র স্মৃতি শক্তি ভালোই , সে তাড়াতাড়ি সব মুখস্ত করে নিতে পারে। সুরা ইয়াসিন, মূলক , আর রাহমান মুখস্ত হয়ে যায় তার , উর্দু লিখতে পড়তে শিখে ফেলে, সাথে বাংলাও।
আনু’র বারো বছর হয়, মা এবার নুরুজ্জামান কে বলেন,
-এবার দেশে চলে গেলে ভাল হয়, মেয়ে বড় হচ্ছে , সবাই তাকে চিনুক, প্রস্তাব আসা শুরু হোক। বয়স বেশি বেড়ে গেলে তো বিয়েও হবেনা।
– বার বছর মাত্র, কি বল এসব!
-ঠিকই বলি, এখন বিয়ে না দিলে না দাও, তবুও দেশে চলে যায়, মেয়ে দেশের হাব ভাব শিখুক।
অগত্যা নুরুজ্জামান রাজি হয়, তোতাই রাজি করায় তাকে।
দেশে যাবার সময় আনু’র আরেকটা ছোট বোনের সংখ্যা বাড়ে, আরেকজন মায়ের পেটে আছে, ভাই না বোন জানেনা তখনো ।
নুরুজ্জামান সবাইকে দেশে রেখে আবার নিজের ব্যবসাকেন্দ্র রেঙ্গুন চলে যান।
কয় মাস পর আনু’র ছোট একটা ভাই আসে পৃথিবীতে। চারবোনের এক ভাই, অতি আদরের। চারবোন কাড়াকাড়ি করে আদর করে তাকে। আর আনু’র তো জান সে, নাম ইউসুফ।
আনু’র জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসা শুরু হয়। আনু’র মা তার বাপজানের কাছে খবর পাঠিয়ে জানতে চান, কেমন হবে। নুরুজ্জামানের পছন্দ হয়না, তিনি চান ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত, কম বয়সী একজন পাত্রকে কন্যা দান করবেন। আর মেয়ের বয়সও আরেকটু বাড়ুক ।
এদিকে আনু’র চাচাতো, জ্যাঠাতো সব ছোট বোনদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। গ্রামের মানুষ, আত্মীয় স্বজন নানা কথা বলছেন,
-মেয়ে আইবুড়ো বানিয়ে শেষে ঘরেই বসিয়ে রাখতে হবে, চৌদ্দ প্রায় চলছে, এতো দেরি কেউ করে ! ঘোর কলিকাল…।
শেষ পর্যন্ত নুরুজ্জামানের একটা প্রস্তাব মনপুত হয়।
দুই মায়ের এক আদুরে , বাংলা, ইংরেজি জানা অল্প বয়সী , সুদর্শন পাত্র সে। সতেরো বছর বয়সে ছেলেকে বিয়ে করিয়ে সংসারমুখি করতে চায় বিধবা দুই মহিলা। ছেলের ব্যবসায়ী বাপ অল্প বয়সেই আল্লাহর পেয়ারা হয়ে গেছেন।
কিন্তু নুরুজ্জামানের শর্ত , আরও একবছর যাক , ছেলে মেয়ে দুইজনই আরেকটু বড়, বুদ্ধিমান হোক ।
শর্ত মঞ্জুর , মেয়ে তাদের পছন্দ, ছেলেরও। আকদ দিয়ে রাখেন তাদের। মিলামেশা ,আসা যাওয়া হোক ছেলে মেয়েতে, সমস্যা কি?
সদ্য যুবা লোকমান তার কিশোরী বউ আনুকে একদিন না দেখে যেন থাকতে পারবেনা মনে হয়। সে তার গ্রামের সমবয়সী , ছোট, বড় সব বন্ধু, পাড়াতো ভাইদের নিয়ে দুই দিন পর পর নৌকা নিয়ে দুইঘণ্টা ভ্রমন করে আনু’র বাড়ি চলে যায়। নৌকা ছাড়া ঐখানে যাবার আর কোন যানবাহন ছিলোনা।
দুই ঘণ্টা সময়টা পার হতে দশ ঘণ্টার মত দীর্ঘ সফরের পথ লাগত লোকমানের। পথ যেন শেষ হতে চায় না কিছুতেই। নৌকা আনু’র ঘাটে ভিড়তে চায় না মনে হয়। তার মনে হয়, নৌকা নড়ছেই না, শুধু ভেসে আছে।
বন্ধুরা তার অস্থিরতায় হাসে, মজা করে।
ঘাটে নৌকা ভিড়লে, আনু’র গ্রামের দুষ্ট ছেলে পুলে আনু’র দুলা আসছে, দুলা আসছেরে….
চিল্লাতে চিল্লাতে দৌড়ে গিয়ে আনু’র ঘরে খবর দিয়ে আসে।
কিশোরী আনু লজ্জায় লাল হয়, প্রতিবেশী চাচি তেল নিয়ে বসে আনু’র চুল বেধে দিবে বলে। সবসময় ওর চুলে এত্ত গিঁট দেখে তিনি রাগ হন।
-তোমার মেয়ের চুলে এতো গিঁট হয় কেন, আনুর মা?
অস্থির তোতা জবাব দেয়,
-আল্লাহ জানে, শ্বাশুড়ি তো বলতেন, যার চুলে গিঁট, তার ভাগ্যে সতীন। আল্লাহ ভালো করুক, আমার আনু’র যেন তা না হয়।
-আমিও তাই শুনেছি গো, তাই তো বলি, এতো গিঁট ভালো লক্ষন না…
তোতা’র এখন অনেক কাজ, নতুন জামাই আসছে, সাথে বন্ধুরাও। খাতির যত্ন যেন কম না হয়।
অনেক কষ্টে সে চাল দেখিয়ে দুইটি মুরগী ধরেছে, আরেকটি ধরতে পারলে ভালো হতো। ছোট দেবরের হাতে কুড়ি পয়সা বকশিস দিয়ে বাজারের স্লিপ আর কয়টা টাকা ধরিয়ে দিয়েছে ইতিমধ্যেই ।
রাতে আনু আর তার মা সবার জন্য সামনের রুমে দুইটি পাটি বিছিয়ে বিছানা করে দেয়।
লোকমান সব বন্ধুদের বাইরে থেকে ঘুরে আসতে বলে।
এই সুযোগে কিছুক্ষণ আনু’র হাতটি ধরে বসে থাকে। এতেই যেন সব সুখ, এত লম্বা পথের ক্লান্তি ভুলে যায় সে এই মুহূর্ত পাওয়ার লোভে।
বন্ধুরা বেড়ার ফাঁক দিয়ে নিঃশব্দে চেয়ে থাকে তাদের প্রেম কাহিনী। নিঃশ্বাস ফেলতেও ভুলে যায় তারা, কিন্তু আশানুরূপ কিছু না দেখে নিরাশ হয়।
একদিনের জায়গায় তিন চারদিন থেকে যায় সবাই মিলে। প্রতিদিন পিকনিকের মতো মজা হয়। আনু’র গ্রামের আরও কজন বড় ভাই এসেও যোগ দেয় আড্ডায়।
কিন্তু মাসে এমন আসা যাওয়া অনেকবার হতে থাকলে তোতার বাররোটা বাজে। জমা টাকা শেষ হয়ে যায় সব। রেঙ্গুন থেকে টাকা আসতে তো সময় নেয়। সে তার গয়না বিক্রি করতে থাকে কিন্তু নতুন জামাইকে না করতে পারেনা। বলতে পারেনা ,বাবা তুমি একা আসো কিংবা এতো ঘনঘন এসোনা!
বয়স কম জামাই’র, কি বলতে কি ভেবে বসে আবার!
সবাই তো বলছে,
-এতো অল্প বয়সী ছেলেকে মেয়ে বিয়ে দিচ্ছো, তা কি ভালো হল? মন থাকবে উড়ো উড়ো। ভ্রমর হয়ে না উড়ে যায় নানা ফুলে…।
এসব শুনে মনে মনে ভীত হয় তোতা।
এক বছর পার হয়।
১৯৬০ সাল, নুরুজ্জামান আসেন, মেয়েও পনেরো বছরের হয়।
তখন তো অত ঘটা করে বিয়ে হতোনা। না ছিল কোন উপহার দেয়ার রেওয়াজ। তবুও মেয়েকে সাজিয়ে দেন তিনি। দামী কিছু গালিচা আর প্রয়োজনীয় জিনিসও দেন নুরুজ্জামান।
বিদায় বেলায় ছোট ভাই ইউসুফ কে ছেড়ে কিছুতেই যেতে মন চায় না তার। ভাই বোনদের জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁদে সে। আর মা আর বাপজানকে জড়িয়ে ধরেও।
নৌকায় চড়ে কিশোরী বধু সেজে চলে নতুন ঠিকানায়। হৃদয়ে একরাশ আশা, প্রেম, ভালবাসা, স্বপ্ন…
সারাপথ বাইরে তাকিয়ে থাকে সে, মুখ বের করে। মুগ্ধ হয়ে দেখে নদী,নদীর পাড় , নৌকা, মানুষ, ভেসে যাওয়া গাছের ডাল, ছেঁড়া সেন্ডেল, মরা পশু কত কি!
আর মনে মনে ভয়ও পাচ্ছিলো আর ভাবছিলো,
চুলের বেশি গিঁট আর জটে কি সত্যি সতীন হয়? শেষপর্যন্ত লোকমান কি তাকে ভালবাসবে? অন্য কেউ তার ভালবাসায় ভাগ বসাতে আসবেনা তো ?
১৭.০৫.১৭