কফিনবন্দী

কফিনবন্দী

“বাবা, বাবা… ও বাবা…… আর একটা গল্প শুনবা”?(আরিশা) “না মা অফিস থেকে এসে তোমার গল্প শুনবো। বাবার এখন অফিসের সময় হয়ে গেছে এখন রাখছি, রাগ করবা না প্লীজ”।

– না বাবা, আর একটা গল্প শুনতে হবেই, এই গল্পটা শুনো প্লীজ,,,,? (আরিশা)

– সত্যি আম্মু অনেক সময় লেট হয়ে গেছে। আজ অফিসে গেলে বকা শুনতে হবে।

– আচ্ছা, বাবা তাহলে তুমি একটা গান শুনাও আমাকে, না হয় কান্না করবো, স্কুলে যাবো না। কিছু খাবোও না।

– আম্মুরে তোকে নিয়ে আর পারলাম না। আচ্ছা কোন গানটা বলবো?

– বাবা তুমি আমার জন্মদিনে যে গানটা রেকর্ড করে দিয়েছিল সেই গানটা বল।

– ও…ও…গতবার তোমার জন্মদিনে যে গানটা দিয়েছিলাম???

– হ্যা, এখন শুরু কর।

আরিশার বাবা গান গাইলো,,,,(যদি মন কাদে তুমি চলে এসো) গানটা বলে আরিশার বাবা ফোনটা রেখে দিবে, তাই আরিশাকে বললো, “আম্মু এখন রাখবো, তুমি কিন্তু খাবে, স্কুলে যাবে, আর রাতে কথা বলবো, বায় বায়।

– আচ্ছা বাবা, সাবধানে যাবে।

অফিসের ডিউটির টাইম ১৫ মিনিট অতিক্রম হয়ে গেছে। আরিশার সাথে ফোনে কথা বলতে বলতে প্রায় এমন লেট হয়। আরিশার বয়স ৮ বছর মাত্র। আরিশা এবার তৃতীয় শ্রেণীতে। ছোট হলেও তার কথায় যেকোনো কেউ মুগ্ধ না হয়ে পারে না। যাকেই তার ভালো লাগে তাকেই গল্প শুনায়। স্কুলের শিক্ষকরা প্রায় আরিশার গল্প শুনে। গত জুন মাসে “জেলা শিশু গল্প প্রতিযোগিতায়” আরিশা প্রথম হয়েছে। তার শিক্ষক, প্রতিবেশী সবাই তাকে নিয়ে অনেক গর্ব করে। তাকে সবাই গল্পরাণী বলে ডাকে।’গল্প রাণী’ নামটা জেলা প্রশাসক আরিশার গল্প শুনে মুগ্ধ হয়ে দিয়েছিল। তারপর থেকে অনেকেই গল্প রাণী বলে ডাকে। প্রতি রাতে আরিশার আম্মু আরিশাকে একটা করে গল্প শুনাতে হয়। তা না হলে আরিশার চোখে ঘুম ধরে না। আর আম্মুর থেকে গল্প শুনে মুখস্থ করে আরিশা তার আব্বুকে গল্প শুনায়।

প্রতিদিন আব্বুকে গল্প না শুনালে আব্বুর মনে শান্তি আসে না। আরিশার আব্বু সারাক্ষণ ভাবে কখন যে মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে নিতে পারবো…..! আরিশার বাবা সৌদিআরব প্রবাসী। আরিশার বয়স যখন ২ বছর ৩ মাস তখন তিনি সৌদিআরব যান। সৌদিআরবে একটা ঔষধের এক বড় ফার্মেসীতে চাকরি করেন। বেতন মোটামুটি ভালো। প্রথম ৪ বছর কাগজপত্র ছিলো না। তখন অবৈধভাবে কাজ করতো। এখন এক বছর হলো কাগজপত্র হয়েছে।

মেয়েকে দেশে গিয়ে বুকে জড়িয়ে নেওয়ার প্রচন্ড ইচ্ছে। কিন্তু পারছে না। এখন ইনকাম ভালো তাই যেতে চাইলেও পারছে না। অনেক টাকা ঋণ হয়ে গেছে, ৬ থেকে সাত মাস লাগবে ঋণ শোধ করতে। তাই আর ৬/ ৭ মাস পর যাবে ভাবছে। ছয় সাত মাসে মোটামুটি ঋণ শোধ করতে পারবে, তাই অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

প্রতিদিন ‘ইমো’ দিয়ে ভিডিও কল না করলে বাবা মেয়ের পরিতৃপ্তি নেই। অফিস থেকে আসার সাথে সাথে মোবাইলের ডাটা চালু করে আগে আরিশার সাথে কথা বলতে হয়। আরিশাও এই সময়টা বাবার সাথে কথা বলার জন্য ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। আর আম্মুকে বলে, “বাবা কখন কল দিবে, এতো লেট করে কেন, আম্মু তুমি একটু দেখো না…?

– আরিশা তোমার বাবা অফিস থেকে আসলেই তোমাকে কল দিবে অপেক্ষা কর। হয়তো এখন পথে, তুমি শুয়ে থাকো, আসলে কল দিবে। আর তখন কথা বলতে পারবে।

– না, আমি আমার ছেলের সাথে কথা না বলে ঘুমাতে যাবো না। আমি ঘুমালে তুমি কথা বলতে পারবে,তাই আমাকে ঘুমাতে বলতেছো। আমি বাবাকে সব বলে দেবো। বলবো তোমাকে যেন আর টাকা না দেয়। তুমি আমাকে নিয়ে হিংসা কর। সব বলে দেবো হুমম। তখন বোঝবা। বাবাকে আরো বলবো তোমাকে যেন অনেক বকা দেয়।

– আচ্ছা বলে দিও।

এমন সময় মোবাইলে বাবার কল চলে আসলো।

– হ্যালো বাবা, বাবা, ও বাবা।

– কিগো আম্মু, কেমন আছো তুমি?

– বাবা বাবা আম্মু একদম পঁচা। আমাকে কি বলে জানো?

– কি বলেছে? বকা দিছে?

– হ্যা,অনেক বকা দিলো, বলে আমি যেন ঘুমিয়ে যাই। তারপর আমি ঘুমিয়ে গেলেতো আম্মু তোমার সাথে কথা বলতে পারবে। আমি তোমার সাথে কথা বলি দেখে আম্মু হিংসা করে। তুমি আর আম্মুকে টাকা দিবা না। আর আম্মুকে অনেক বকা দিবা।

– আচ্ছা বকা দিবো এবং টাকাও দেবো না। (মাহবুব সাহেব অফিসের পোষাক খুলতে খুলতে বলতে লাগলেন)

– বাবা, তুমি অনেক ভালো, লাভ ইউ বাবা উম্মাহ

– লাভ ইউ টু,, উম্মাহ। আম্মু রাতের খাবার খেয়েছো?

– না বাবা একটু পরে খাবো। তুমি ফ্রেশ হয়ে তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। তারপর কল দিও। এখন কিরণমালা শুরু হয়ে গেছে। বায় বায়,,,,

– আচ্ছা বায়।

রাত দশটা বাজতে ১৫ মিনিট বাকি। মোবাইলে কল আসলো। আরিশার আম্মু মোবাইলের কল রিসিব করতে চাইলো, বাট আরিশা দিলো না।

– হ্যালো বাবা, বাবা,,, ও বাবা

– আম্মু কেমন আছো?

– হুম,ভালো আছি। তুমি খেয়েছো?

– হ্যা, আম্মু খেয়েছি। কি কর তোমরা?

– আমরা শুয়ে শুয়ে টিভি দেখতেছি আর তোমার জন্য অপেক্ষা করতেছি। আব্বু জানো কাল আমাদের স্কুলে বার্ষিক ক্রিয়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে। আমি কাল দৌড় খেলা আর বিস্কুট খেলা দেবো, তোমার কি মনে আছে?

– হ্যা আম্মু মনে আছেতো। সকালেতো একবার বলছো। আমি দোয়া করি যেন আমার আম্মুটা খেলায় জয়লাভ করতে পারে।

– আচ্ছা তো গল্প শুনবা?

– হ্যা আম্মু শুরু কর।

তারপর গল্প শেষ করে আরিশা ঘুমিয়ে যায়। পরদিন বিস্কুট খেলায় দ্বিতীয় ও দৌড় খেলায় প্রথম হয়েছে। আজ আরিশা অনেক হ্যাপি। রাতে বাবা কল দিলো,,

– হ্যালো বাবা, বাবা __ও বাবা..?

– হ্যা আম্মু কেমন আছো তুমি?

– তোমার আম্মু অনেক হ্যাপি, আজ আমি প্রথম ও দ্বিতীয় পুরষ্কার পেয়েছি।

– তাই, আলহামদুলিল্লাহ । কি পুরষ্কার পাইছো আম্মু?

– বাবা, একটা বড় প্লেট আর অনেক সুন্দর একটা পানির গ্লাস। বাবা তুমি দেখবা?

– হ্যা পিক তুলে দাও।

আরিশার আম্মু পিক তুলে পাঠিয়ে দিলো। তারপর কিছু কথা বলে মোবাইল রেখে দিলো। দীর্ঘ ৬ বছর পর আরিশার বাবা দেশে আসবে। আগামিকাল ফ্লাইট। আজ আরিশার সাথে কেন যেন অনেক কথা বলতেছে। আরিশার আম্মু আরিশার থেকে মোবাইল নিয়ে আরিশার বাবাকে বকা দিতে লাগলো, কালতো আসবে তখন কথা বলতে পারবে,এখন একটু ঘুমাও। মেয়েটাকেও ঘুমাতে দাও। কয়টা বাজলো দেখছো? ১২:১৭।

– এই দিকে আরিশা কান্না শুরু করলো। আরো কথা বলবে।

কান্না থামাতে ব্যর্থ হয়ে আবার মোবাইল দিলো। চলছে বাবা মেয়ের প্রেম। প্রেমের গভীরতা আজ একটু বেশি। না, একটু না।আজ প্রেমের গভীরতা খুব বেশি।

– আচ্ছা বাবা, আমাকে তোমার বুকে নিতে ইচ্ছে হয়?

– হ্যা মা খুব ইচ্ছে হয়রে।

– আমাকে তোমার বুকে নিয়ে আদর করতে ইচ্ছে হয়?

– হ্যা মা খুব ইচ্ছে হয়।

– বাবা আমি তোমাকে ঘুম পারিয়ে দেবো। তুমি ঘুমাবে তো আমার কোলে?

– হুমমম ঘুমাবো। তোমার কোলে ঘুমাবো বলেইতো আসতেছি (কথা বলার সময় বাবা চোখের জল ছেড়ে দিলো।)

– বাবা, বাবা,, ও বাবা,,,, আমার না তোমার কোলে উঠার অনেক সখ। আমাকে কোলে নাও না প্লীজ। এখন নাও। তুমি পাখি হয়ে আসতে পারো না। এতো লেট কেনো হয় বাবা?

– আম্মু আসতেছিতো, একটা রাত অপেক্ষা কর,তারপর সারাক্ষণ তোমাকে কোলে রাখবো।

– আব্বু আমি একটা বুদ্ধি করেছি, আম্মু, তুমি আর আমি মিলে সেলফি তোলবো। আর ছবিটা অনেক বড় করে আমার রুমে রাখবো। কেমন হবে বলতো?

– অনেক সুন্দর হবে।

– বাবা আমার বন্ধুরা যখন তাদের বাবাদের কোলে উঠে, আমার তখন বড্ড বেশি কষ্ট হয়। তুমি এতো দুরে থাকো কেন? আচ্ছা বাবা আমার যেমন কষ্ট হয় তোমারও কি তেমন কষ্ট হয়?

– হ্যারে মা,অনেক কষ্ট হয়।

– বাবা তোমাকে নিয়ে স্কুলে যাবো, আমার বন্ধুদের দেখিয়ে দেবো যে আমারও বাবা আছে, যাবেতো?

– হ্যা আম্মু যাবো। তোমার যা যা করতে ইচ্ছে হবে তাই করবো।

– প্রমিজ কর বাবা।

– প্রমিজ করলাম।

– বাবা, তুমি কিছু বল না কেন? চুপ কেন? আমি যা প্রশ্ন করি তার উত্তর দাও, আর কিছু বল না কেন? তোমার কি ঘুম পায়? আচ্ছা তো ঘুমাও।

– না আম্মু, একটুও ঘুম পায় না। আজ কেনো যেনো শুধু তোমার কথা শুনতে ইচ্ছে হয়।

– বাবা তোমার কোলে একটু ঘুমাবো, আমাকে কোলে নাও না, তারাতারি আসতে পারোনা? মেয়ের এই কথাটা শুনে বাবার চোখে জল চলে আসলো।

– আম্মু আর একটা রাত অপেক্ষা কর,তারপর সব হবে। আচ্ছা আম্মু তুমি ঘুমিয়ে পড়। অনেক রাত হয়েগেছে। (তখন রাত প্রায় ১টা)

– আচ্ছা বাবা আম্মুর সাথে কথা বলো। আম্মু ধর আব্বু কথা বলবে।

– এখন স্বামী আর স্ত্রীর কথোপকথন।…..

– তোমরা বাবা মেয়ে কি শুরু করলে? এতো কথা বলতে হয়?

– দেখবা আমার মেয়েটা অনেক বড় হবে। আমাকে আজ কাঁদিয়ে দিলে।

– হুম, আমিও তোমাদের কথা শুনেছি,আমার চোখেও জল চলে আসলো। তো ঘুমিয়ে যাও। সকালে কল দিও।

– শুনো, আজ তোমাদের সাথে শুধু কথা বলতে ইচ্ছে হয়। আর একটু কথা বলো প্লীজ।

– আচ্ছা তো বল।

এভাবে কথা বলতে বলতে প্রায় ঘড়ির কাটা চারটায় পৌছে যায়। তারপর দুজনে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে বিমানে উঠার আগে কল দেওয়ার কথা। সকাল ১০টা হয়ে গেল কোন কল আসে নি। তাই আরিশার আম্মু কল দিলো, বাট কল ধরল মাহবুব সাহেবের ছোট ভাই মোতালেব। মোতালেব আরিশার আম্মুকে বলল, “ভাবী ভাইয়ার প্লাইট আজ ক্যানচেল হয়ে গেছে। এখন রাখেন পরে কল দেবো। এখন ভাইয়া অফিসারদের সাথে কথা বলতেছে। আরিশার আম্মু মোবাইলটা রেখে দিলো।

অবশেষে মাহবুব সাহেব দেশে আসলেন। আজকে আরিশার বাবাকে দেখার জন্য শতশত মানুষের ভীর। আরিশাদের ঘরে পা রাখারও যায়গা নেই। কেন যেন কারও মুখে হাসি নেই। সবাই যেন পৃথিবীর মূল্যবান কিছু হারিয়েছে। আরিশার বাবা আরিশার কাছে আসলো। খুব কাছে আসলো। আরিশাও বাবার কাছে গেলো,,,আর বলতে লাগলো,, “বাবা, বাবা,,,ও বাবা,, তুমি এখন এই কফিন বক্সে ঘুমিয়ে কেন? আমাকে কোলে নিবা না? আমরা না সেলফি তোলবো? বাবা তুমি উঠো, আমাকে তোমার কোলে নাও। তুমি এখনও ঘুমিয়ে কেন, আমার স্কুলে যাবে না? আমার বন্ধুদেরকে বলবো আমারও বাবা আছে। তুমি না প্রমিজ করলে আমার সাথে স্কুলে যাবে। কি হলো উঠো,,,,?

বাবা তুমি না প্রমিজ করলে আমার কোলে ঘুমাবে? তুমি এই কফিন বক্সে শুয়ে আছো কেন? আমার কোলে এসে ঘুমাও। বাবা তুমি কি জানো আমি তোমার জন্য একটা গিফট কিনেছি? তুমি দেখলে অনেক অবাক হবে। কি হলো বাবা, আমার রাগ হচ্ছেতো তুমি উঠো,,,। এখন কান্না করবো. তুমিতো আমার কান্না শুনতে পারো না। কি হলো আজ তুমি আমার কান্না শুনেও উঠো না কেন?????

ঐ দিন রাতে আরিশার বাবা আরিশার সাথে কথা বলার পর আরিশার আম্মুর সাথে কথা বলে। তারপর আরিশার ছবি বুকে নিয়ে শুয়ে থাকে। মেয়েকে নিয়ে অতিরিক্ত আবেগে এক সময় হার্ট এ্যাটাক করেন। রুমে একা থাকতেন বলে কেউ তাকে হাসপাতালেও নিতে পারে নি। রাতেই তার মৃত্যু হয়। হাত থেকে তার মেয়ের সেই ছবিটা গোসলের সময়ও কেউ সরাতে পারে নি। খুব শক্ত করে আকরিয়ে ধরেছিলেন আরিশাকে। আরিশার মত এমন শতশত মেয়ের স্বপ্ন কফিনবন্ধী হয়ে আছে। কফিনবন্ধী আরিশার বাবার ভালোবাসা, কফিনবন্ধী একটা জীবন, আসলে এমন শতশত জীবন কফিনবন্ধী। কফিনবন্ধী অনেক আশা, প্রত্যাশা।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত