প্রাপ্তি

প্রাপ্তি

– তোমার মেয়েকে বলতে পারোনা,এই ছাইয়ের পড়ালেখা ছেড়ে এবার যেন বিয়েতে রাজি হয়!আমার পক্ষে আর সম্ভব না এভাবে নিজের টাকাপয়সা আর জলে ফেলানো!

– এভাবে কেন বলছো? ছেলেদের পিছনে যেভাবে টাকা খরচ করো তার অর্ধেক ও তো মেয়ের পিছে দাওনা,এমনকি মেয়েটা ঠ্যাকায় না পড়লে একটা সুতোও চায়না! পড়া থেকে উঠে রান্না ঘরের দিকে যাচ্ছিলাম চা বানানোর জন্যে।এমনসময় বাবার এমন চিৎকার চেচামেচি শুনতে পাই।এটা অবশ্য নতুন না,তবে মাঝেমধ্যে ভাবি,আজ হয়তো আমাকে ছাড়া অন্য বিষয় নিয়ে ঝামেলা!কিন্তু না,রোজকার বিষয় আমিই।

সবচেয়ে বেশি যে কথাটা মাকে বাবার মুখে শুনতে হয়েছে তা হলো “অপয়া মেয়ে তোমার!” কথাটা বুকে তীরের মত এসে বিধতো।বহুবার মাকে জিজ্ঞেস করেছি,’আচ্ছা মা,বাবা আমায় সহ্য করতে পারেন না কেন? আমি কি বাবার মেয়ে না? ‘ না নির্লিপ্ত গলায় জবাব দিতেন,”ধুর বোকা মেয়ে!বাবারা অমন হালকা শাসন করেনই” আমি মা কে দেখতাম,বাড়ির সমস্ত কাজ একা নিজ হাতে করতে,সে কখনোই বাড়িতে কাজের লোক রাখার পক্ষে ছিলেন না।তার একটাই কথা,নিজের সংসারের কাজ অন্যকে দিয়ে করালে সংসারের প্রতি টান থাকেনা।মাঝেমধ্য ে মায়ের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতাম আর ভাবতাম,এই মানুষটা শেষ বয়সে যেন খুব সুখে দিন কাটাতে পারে!উপরওয়ালার কাছে সেই দোয়াই করতাম,যেন অন্তত মাকে আমি আগলে রাখতে পারি।ভাইদের দেখতাম সবসময় মায়ের সাথে চড়া গলায় কথা বলে,কিন্তু বাবা? সে মাকে ভীষণ ভালোবাসতেন,আমার বিষয় ছাড়া বাবাকে কখনোই মায়ের সাথে রাগ করতে দেখিনি আমি।

একদিন বাবার এমন রাগারাগি চেঁচামেচি সহ্য করতে না পেরে বলেছিলাম,এত যখন জারজের বাচ্চা জারজের বাচ্চা করো তাহলে আমায় এ বাড়িতে রেখেছিলে কেন?আমার বেলায় যতসব কার্পণ্য,ভাইদের বেলায় দুহাত ঢেলে দাও,আমার বেলায় এত বৈষম্য কেন?বাবা হয়ে বাবার কোন দায়িত্ব টা পালন করেছো তুমি?! সেদিন বোধহয় বাবা আমার কথা গুলো ঠিক মানতে পারেননি,আমার দিকে তেড়ে এসেছিলেন মারতে।মা দৌড়ে এসে আমার ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলেন,ওদিকে শুনতে পাচ্ছিলাম বাবার চিৎকার, একই সাথে সেঝো ভাইয়ের তাল মেলানো সুর। মেঝো ভাই আর বড় ভাইয়ের বুঝি সেদিন আমার প্রতি একটু মায়া লেগেছিলো,তাই তারা বাবা আর সেঝো ভাইকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলো।

মা সেদিন অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলেন,যে মা সবসময় আমাকে বাবার বকুনি থেকে বাচাতেন,সে সেদিন আমায় এলোপাথাড়ি থাপ্পড় মেরে নিজেকে শান্ত করেছিলেন,সবশেষে মা আমায় জড়িয়ে ধরে ভীষণ কেদেছিলেন। সেটাই বোধহয় আমার মাকে জড়িয়ে ধরার শেষ সুযোগ ছিলো।ওই ঘটনার পর আর কখনো বাবার সামনে যাইনি,এক টেবিলে বসে খাইনি।সবাই যখন রাতের খাবার একসাথে খেতো,আমি আমার ঘরে বসে কাঁদতাম,নিজেকে শক্ত মনের অধিকারী বানানোর দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় ছিলাম,জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার এক প্রতিজ্ঞা করছিলাম।

তারপর আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে রাজশাহী চলে আসি।গার্লস হোস্টেলে থাকতাম,আর মাঝেমধ্যে মা ফোন দিলে মায়ের সাথে কথা বলতাম।কেউ বিশ্বাস করবেনা,মা ছাড়া ওই পাঁচ বছরে পরিবারের কারো সাথে আমার কথা হয়নি।নতুন জায়গায় গিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ নতুন ভাবে গড়ে তুলবার এক আশা নিয়ে সামনে এগোই,প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলতাম না,দু একজন ফ্রেন্ড ছাড়া আর কেউ ছিলোনা আমার।নতুন জায়গায় কিভাবে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়, তাও সম্পূর্ণ একা, তা আমার থেকে কেউ ভালো বুঝবেনা।বলা যায় রাতদিন ২৪ ঘন্টা বই নিয়ে পড়ে থাকতাম,ভীষণ জেদ কাজ করতো,আমার জীবনটাই কেন এমন হলো!সুস্থ স্বাভাবিক একটা পরিবারে থেকেও কেন জারজ অপয়া আখ্যান পেতে হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন আমার দুজন মানুষই জুটেছিলো কপালে যারা কিনা এখনো আমার জীবনে জোকের মত লেগে আছে,এই মানুষগুলোর কথা না বললেই না। একজন আয়েশা,আরেকজন ফাতিন।এই দুইটা মানুষ বলতে গেলে আমাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেধে রেখেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ দিন এই দুটো মানুষ আমাকে জড়িয়ে ধরে যে কান্নাটা করেছিলো,আমার কানে এখনো ঝংকার দেয় ওদের কথা “নিলু,আত্মা এক হয়ে গেছে তোর সাথে আমাদের,বিশ্বাস কর নিলু,বুক ফেটে যাচ্ছে!কথা দে কখনো ভুলে যাবিনা!সারাদিন,সারা সপ্তাহ,সারা মাস এমনকি সারা বছর এক ভাবে যোগাযোগ রাখবি।”

এই পাগলগুলোকে নিজের জীবন থেকে সরিয়েই বা কি নিয়ে বাঁচবো আমি?কি ভেবে যেন তিনজনই রাজশাহীতেই থেকে গেলাম,এক জায়গাতেই তিনজন জব শুরু করি।দিন যায়,পরিবার থেকে আমি ততই দূরে সরে যেতে থাকি,এখন আর মায়ের সাথেও কথা হয়না,মাও ফোন দেয়না,আমি দিলেও কখনো মাকে পাই কখনো পাইনা।শুনেছি আমার তিন ভাই নাকি বিয়ে করেছে,বড় ভাই নাকি বিয়ে করে বউ নিয়ে বিদেশে সেটেল হয়ে গেছে,আর বাকি দুইজন দেশেই আছেন,আমাদের আগের বাড়িটাইতেই থাকেন তারা। তাহলে নিশ্চয়ই এবার মা বাবাও সুখে আছেন,মা কে এখন আর আমার জন্যে বাবার কাছে একগাদা ঝাড়ি খেতে হয়না,ভেবেই চোখের কোণে পানি জমে গেলো।

হঠাৎ একদিন দেখি একটা আননোন নাম্বার থেকে বারবার ফোন দিচ্ছে।রিসিভ করে শুনতে পেলাম,কোনো একটা বৃদ্ধাশ্রম থেকে ফোন দিয়েছে।আমাকে ফোন দেবার কারণ জানতে চাইলে তারা বললো,সেখানে নাকি আমার বাবা মা আছেন! আমার মাথায় রীতিমত আকাশ ভেঙে পড়ে।এটা কি করে সম্ভব!অনেক ভাবে তাদের বোঝাতে চেষ্টা করি,আমার বাবা মা আমার ভাইদের সাথে বাড়িতে থাকেন,বৃদ্ধাশ্রমে কেন থাকবেন?! তারা বলেন যে আমার মা-ই নাকি নাম্বার টা দিয়েছে।সব শুনে আমি ঢাকা ছুটে যাই আয়েশা আর ফাতিন কাউকে কিছু না বলে।সত্যি বলতে ওদের কে জানানোর মত ধৈর্য আমার ছিলোনা।

ট্রেনে করে ঢাকা চলে আসি,বহু খুজে যথারীতি সাথে পৌছাই,গিয়ে দেখি সত্যিই আমার বাবা মা সেখানে আছেন।মা আবারো সেদিন আমায় জড়িয়ে ধরে খুব কাদলেন,অথচ বাবা সেদিনও আমার সাথে দুটো কথা বললেন না,মুখ ফিরিয়ে ছিলেন।সেখানকার ম্যানেজার বললো বাবা মা কে এখান থেকে নিতে হলে নাকি অনেক ফর্মালিটিজ আছে,সবচেয়ে বড় কথা যারা তাদের এখানে রেখে গেছেন তাদের সিগনেচার লাগবে। মা-বাবাকে রেখে বাড়িতে যাই,ভাই দুটোকে খুব ভালোভাবে জিজ্ঞেস করলাম,তারা এমনটা কেন করলো!সবসময় বাবা যেখানে তার ছেলেদের প্রাধান্য দিয়েছেন,যে ছেলেদের জন্য নিজের সর্বস্ব ঢেলে দিতে দ্বিধা করেননি,সেই ছেলে গুলো কেন এমন করলো!

তারা আমার জবাব দিতে বাধ্য ছিলেন না।সিগনেচার দরকার, তারা সিগনেচার দিয়ে দায়মুক্ত হলেন।এখন কথা হচ্ছে এই বাবা মাকে নিয়ে ঢাকা শহরে আমিই যা যাবো কোথায়,আয়েশা আর ফাতিনকে ফোন দিয়ে সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম,যেহেতু ওদের বাড়ি আছে ঢাকাতে ওরা এক চান্সে রাজশাহী থেকে ঢাকা চলে আসে আমার জন্য। এছাড়া ঢাকাতে আমার পুরনো বান্ধবী মুন্নী ছিলো।এই তিনজনের সহায়তায় আমি একটা নতুন বাসা ভাড়া নেই,বাবা কে যে জিজ্ঞেস করবো কিছু তার অবস্থাও ছিলোনা।বাবা তবু আমার দিকে একটা বার ফিরে তাকাননি,৫ টা বছর যে তার মেয়েটা তার থেকে দূরে ছিলো,তার কোনো অনুভূতিই বোধহয় বাবার ছিলোনা। মাকে জিজ্ঞেস করলাম,তোমাদের বাড়ি থেকে বের করে বৃদ্ধাশ্রমে কেন রেখে আসলো? মা বললো ভাই ভাবিদের কাছে নাকি তারা বোঝা হয়ে গিয়েছিলো।

ঢাকায় অনেক কষ্টে একটা জব ম্যানেজ করি।ফাতিন আর আয়েশা যথারীতি রাজশাহী ফিরে যায়।এই আয়েশা মেয়েটাও না বড় অদ্ভুত, ফাতিনকে এত ভালোবাসে,তবু কিছু বলতে পারেনা এই ভয়ে, যদি বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যায়!
আমি আমার মত জব করছি,অফিস শেষে এসে বাবা মায়ের খেয়াল রাখা,দরকারী ঔষধপাতি দেয়া নেয়া- এইতো আমার কাজ।শরীর টা একদম লেগে যায় বিছানার সাথে।পেরে উঠছিলাম না,ভাবলাম একটা কাজের লোক রাখি।কিন্তু এই ঢাকা শহরে কাজের লোক পাওয়া কি আর এত সোজা!অনেক কষ্টে একজন পেলাম,আমাদের বাসাতেই থাকবে খাবে,সব কাজ করবে, কাপড়চোপড় ও আমিই দিবো,মাসে বেতনটাও দিবো,তবু যেন বাবা মায়ের খেয়াল রাখে এই শর্তে তাকে রাখলাম। মা বাবাকে না জানিয়ে আমি উকিলের কাছে দৌড়াদৌড়ি করছিলাম এই আশায় যে আমাদের বাড়িতে আমার ভাগটা আছে সেটুকু যদি অন্তত পাই,বাবা মা কে নিশ্চিন্তে রাখতে পারবো,নিজের বাড়ি ছেড়ে কেই বা পরের বাড়িতে থাকতে চায়!

মুন্নি ও এক উকিল হয়েছে,আর এদিকে ওর পরিচিত আরেক উকিল, এই দুজনের সাহায্যে আমি আমার অংশ টা পাই।এদিকে ভাড়া বাসাটা না করে দেই,বাবা মা কে কিছু না বলে দুজনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি,সেদিন প্রথম বাবা গাড়িতে আমার সাথে কথা বললেন,আমাদের যে আবারো বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবে সেটা বললেই পারতে,এটা তো জানাই ছিলো,মেয়ে হয়ে আর কত টানতে পারবে দুই বুড়ো বাপ-মাকে! বাবার কথা শুনে বুকটা ছিড়ে যাচ্ছিলো,তবু কিছু বলিনি। মায়ের দিকে তাকিয়েছিলাম,তার নিষ্পাপ চেহারায় সারা জীবনের ক্লান্তি ভর করে আছে,তাই দেখছিলাম।এমন সময় ফাতিন ফোন দিলো,

– হ্যালো,নিলু?
– হ্যা বল,কেমন আছিস!
– একদম তেল মারবিনা,নিজে থেকে তো খোজ নিবিই না, ফোন দিলে ভালোবাসা দেখাস?
– আরে না,বাসা গোছগাছ, এদিকে অফিস সব নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম।তা বল খবর কি তোদের?
– আছি ভালো।তা শুন,আমি আগামীকাল ঢাকায় আসছি,তোদের বাসায়।আপত্তি আছে?
– আরে ধুর গাধা, আপত্তি কিসের! চলে আয়না!

বাবা মায়ের সামনে ফাতিনকে আর বললাম না যে বাসা টা ছেড়ে দিয়ে বাড়ি যাচ্ছি।ঢাকার যে বিখ্যাত জ্যাম,তাতে একবার আটকা পড়লে ছাড়া পেতে বেশ বেগ পেতে হয়।জ্যামে বসে ভাবছি,আচ্ছা মা-বাবা যখন দেখবে তাদের কে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি,তারা কি রিয়্যাক্ট করবে? খুব খুশি হবে?

আচ্ছা এই সুযোগে কি আমার প্রতি বাবার সমস্ত ক্রোধ নিভে যাবে?ভাবতে ভাবতে কখন যে জ্যাম ছেড়ে গিয়েছে খেয়ালই করিনি।গ্লাস দিয়ে দেখতে পাচ্ছি,পেছনের সিটে ক্লান্ত মা আমার বাবার কাধে মাথা রেখে ঘুমুচ্ছে।
ইশ কি সুন্দর আমার মায়ের চেহারা!কি মায়াবী,ইচ্ছা করছিলো গাড়ি থামিয়ে পেছনের সিটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে থাকি। বিকেল চারটে নাগাদ বাড়ি পৌছে যাই,ওমা! মা বাবা দুজনই ঘুমাচ্ছে!হাসি পাচ্ছিলো খুব।আস্তে করে মাকে ডেকে তুলি,মা চারিদিকে তাকিয়ে খুব অবাক হয়!

– বাড়ির সামনে কেন আনলি?! যারা ফিরিয়ে দিয়েছে তাদের কাছে ফেলে রাখতে? নিজের কাছে রাখতে পারবিনা বললেই পারতি

মায়ের কথার শব্দে বাবা উঠে যায়,বাবা তো রেগে আগুন।তাদের কে শান্ত করে বললাম,আমার বাড়ির আমার অংশটায় তোমাদের রাখবো,আমি তোমাদের কাছে থাকবো,তোমাদের সমস্ত দেখভাল আমি করবো। বাবা অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন!যেন বিশ্বাসই করতে পারছেন না নিজের কানকে!তার সেই অপয়া জারজ মেয়ে তাদের জন্য এত কিছু করছে?বাবা মা কে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসাই,ভাই ভাবি আসে কথা বলতে,মা বাবা দুজনেই মুখ ফিরিয়ে নেয়। ভাই এসে বাবার পাশে বসতেই বাবা হুংকার ছেড়ে বলে উঠলেন,লাগবেনা তোদের!বাবা মা কে ফেলে দিয়েছিলি!এখন কেন আসলি পাশে বসতে!

ভাইয়ের চোখে আমি অপরাধবোধ দেখতে পাই। সবাইকে এক সাথে দেখে নিজের ভেতর মনে হচ্ছিলো,বহুদিন অনাবৃষ্টির পর আজ বৃষ্টি হচ্ছে। আমার দুই ভাই দুই ভাবি এসে বাবা মায়ের কাছে ক্ষমা চাইলো,বিদেশ থেকে বড় ভাইকেও দেশে আসার জন্যে বললেন মেঝো ভাই।ভাবতেই অবাক লাগছে,কোনোদিন ভেবেছিলাম, পুরো পরিবারটাকে আবার একসাথে দেখার সুযোগ পাবো! এই যে ভাইয়েরা এত কিছু করলো,নিজের সন্তানেরা বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার পরেও যখন ক্ষমা চাইলো বাবা মা কি অবলীলায় সবাইকে ক্ষমা করে দিলেন! ঘরের এক কোণায় দাঁড়িয়ে সবার একে অপরকে জড়িয়ে ধরে হাসি কান্না দেখছিলাম,এ যেন পুনর্মিলন,অন্যরকম পুনর্মিলন।দেখলাম,মা আমার দিকে তাকিয়ে কি মিষ্টি হাসি দিলেন,চোখে পানি,মুখে হাসি,এ যে ভীষণ আনন্দের হাসি!

বিকেল বেলা ছাদে চলে গেলাম,আগে ফুল গাছের খুব নেশা ছিলো,দেখলাম ভাই ভাবি সেগুলো নষ্ট করেন নি,নতুন করে আরো অনেক গাছ লাগিয়েছেন।বিকেল বেলা যখন ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিলাম,হঠাৎ করে কাধে কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে যাই,বাবা! বাবার চোখে পানি টলমল করছে,না আজ আমি একটুও কাদবোনা!ভীষণ শক্ত হয়ে গিয়েছি আমি।আমি আজ বাবার কাছ থেকে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর আদায় করবো! আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বোধহয় বাবা আমার চোখ দেখে সব বুঝে গিয়েছিলেন,বাবা আমার হাত দুটো মুঠোবন্দি করে চুমু খেতে খেতে বললেন,আমায় ক্ষমা কইরা দে মা!না বুঝে অজ্ঞ মূর্খের মত কত অন্যায় করছি তোর সাথে!আমারে মাফ কইরা দিবিনা মা?’

– বাবা, সন্তানের কাছে ক্ষমা চাইছো কেন,আমি কিছুই বলবোনা,শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর দাও?আমায় তুমি অপয়া কেন বলতে? সহ্য কেন করতে পারতেনা?
– মারে, আজ তোর সব প্রশ্নের উত্তর দিবো।

বাবা বলতে শুরু করলেন,তোর মাকে আমি বিয়ে করছিলাম অনেক ধুমধাম করে।আমার বাবা মা তোর মাকে খুব আদর করতো,তোর মাও তাদেত খু আদরযত্ন করতো।তাদের খুব শখ অন্তত এক নাতি আর নাতনীর মুখ তারা দেখে যেতে চান।তোর তিন ভাই হয়,এরপর খুব চাইছিলাম যেন একটা মেয়ে হয়।বেশ আল্লাহর কি অশেষ রহমত,তোর মা আবার কনসিভ করলো।

এমনসময় আমার অফিসের কাজে যেতে হলো বাইরে।আমি তোর মাকে এই অবস্থায় একলা রেখে চলে গেলাম বাইরে। দেশে যখন ফিরলাম তখন তোর মায়ের ৭ মাস চলছে,খুব যত্নাদি করা হয়,আমিও কখনো আর তারে একলাই রাখিনাই রে মা,আল্ট্রাসনোগ্রাফি তে যখন জানলাম মেয়ে হবে আমার খুশি আর দেখে কে! সময় ঘনাইয়া আসতে লাগলো,তোর মারে নিয়ে আমি আগে ভাগে হসপিটালে গিয়া রূম বুক কইরা রাখলাম,মা আর বাবারে বললাম ড্রাইভাররে বলতে, তাদের কে যেন হসপিটালে সময় হইলে নিয়ে আসে।এদিকে তোর নানা নানি আসলো হাসপাতালে।

প্রায় সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ তুই আসলি এই পৃথিবীতে। মারে আমি যে কি খুশি হইসিলাম,বিশ্বাস করবিনা!কিন্তু এরপরই শুনলাম সবচেয়ে কষ্টের খবর টা,মা বাবা গাড়িতে এক্সিডেন্ট করে,স্পট ডেড।বিশ্বাস কর আমার মনে হইতেসিলো দুনিয়ায় এর থেকে নিষ্ঠুর সংবাদ আর হইতে পারেনা। বলেনা,প্রচন্ড আঘাতের সময় মানুষের হুশ থাকেনা,ওই সময় তোরে দেইখ্যা মনে হইতেসিলো তোর আগমন শুভ না, তুই অপয়া।এরপর থেকে তোরে দেখতে পারতাম না,ব্যবসা কাজে কিছুতেই মন দিতে পারতাম না।ব্যবসায় লোকসান হইতে থাকে,আমার বিশ্বাস আরো শক্তপোক্ত হইতে থাকে যে তুই অপয়াই!

তোর মা আমারে অনেক বুঝাইতো,এইটাও কইতো,দেখবা শেষ সময়ে তোমার মাইয়াই তোমারে দেখভাল করবো!সেদিন তুচ্ছ করে দিতাম ওই কথা!কে জানতো,আমার এই অপয়া মাইয়াই যে আমারে তুলে দাড় করাইবো আবার!’
বাবা আর কথা বলতে পারছিলোনা,দোলনায় বসে বাবার কাধে মাথা রেখে বাবার হাত শক্ত করে ধরে খুব কেদেছিলাম সেদিন! সন্ধ্যার দিকে মা আর ভাবি আমাদের ডাকতে আসেন ছাদে।দূর থেকে ঠাট্টা করে বলে উঠলেন,এভাবে মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলে আমরা কি আর সময় পাই! সবাই হো হো করে হেসে উঠে।বাবা আমার কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে সবাইকে নিয়ে নিচে চলে গেলেন। মাগরীবের নামাজ পড়ে কেবলই বসলাম,দেখি ফাতিনের ফোন আবার,

– হ্যা বল? ঢাকা এসেছিস?
– হ্যা এসেছি,কাল আসছি তোদের বাসায়।
– তা ভালো,আয়েশা?ওকে আনলি না?
– ও আসেনি রে।
– আচ্ছা রাখছি,কাল চলে আসিস।

পরদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি ফাতিন বসে আছে ড্রয়িং রুমে, বাবার সাথে জমিয়ে আড্ডা দিয়েছে,।।ফাতিনকে দেখেই আয়েশাকে ফোন দিলাম, সে কেমন যেন মনমরা হয়ে উত্তর দিলো ব্যস্ত তাই আসেনি। তারপর ফোন রেখে ফ্রেশ হয়ে গেলাম ওদের মাঝে আড্ডা দিতে।আমার সামনেই ফাতিন বাবাকে বলে বসলো,আংকেল আপনার যদি আপত্তি না থাকে আকি নিলু কে বিয়ে করতে চাই। আমার মাথায় রীতিমতো আকাশ ভেঙে পড়ে! বাবা বললো,তোমরা যথেষ্ট বড় হয়েছো,তোমাদের ইচ্ছা থাকলে আমার আপত্তি নেই!

– ফাতিন, একটু বাইরে আয়। তোর সাথে কথা আছে। বাইরে আসার পর ওর গালে কষিয়ে এক থাপ্পড় মেরে বলি,
– তুই জানিস না? আয়েশা তোকে কত ভালোবাসে?
– বাসুক,আমি তো তোকে ভালোবাসি!এয়বছর অপেক্ষা করেছি,আজ ফিরিয়ে দিসনা প্লিজ!
-চলে যা এখান থেকে।এই জন্য এসেছিস আমার বাড়িতে?আর কক্ষণো আসবিনা!
– নিলু,এমন করবিনা,নিজেকে শেষ করে দিবো বলে দিলাম।
– যা ইচ্ছে কর। অন্তত আমাকে আর বিরক্ত করবিনা।

ফাতিনকে সেদিন যাতা বলে অপমান করে বিদায় দেই।তারপর ফোন নাম্বার টাও চেঞ্জ করে ফেলি।বাসার লোকজনকে বলেই দিয়েছিলাম ও আসলে যেন বলে আমি বাসায় নেই বা থাকিনা,ফোন নাম্বার যেন না দেয়।
ছেলেটা বারবার ফিরে গিয়েছে,কেদেছি বহুবার।ভালো যে আমিও বাসি,কিন্তু নিজের ভালোবাসা পাওয়ার জন্যে নিজের বন্ধুর সাথে বেঈমানী করাও যে আমার পক্ষে সম্ভব না।আমি যে জানি আয়েশা ওকে ভালোবাসে! জানিনা ফাতিন আরো কতবার এসেছে আমার বাসায়,আমি শুধুই প্রত্যাখ্যান করেছি, ভালোবাসা না পাওয়ার এক বিশাল হাহাকার নিয়ে কেদেছি,তবু বুঝতে দেইনি। মা প্রায়ই বলতো,ছেলেটাকে এভাবে ফিরিয়ে দিস না! মাকে কি করে বুঝাই আমি কতটা ভালোবাসি,আয়েশা তো আমার জন্যে কম করেনি,ওকেই বা কি করে ওভাবে ঠকাই! হঠাৎ একদিন আয়েশা ছুটে আসে হন্তদন্ত হয়ে!

– নিলু এটা তুই কি করলি! আজকে তোর জন্যে ফাতিনের মত একটা বন্ধু হারালাম!
– মানে কি! কি হয়েছে! তুই ওকে ভালোবাসিস বলেই ফিরিয়ে দিয়েছি!
– ফিরিয়ে দিয়েছিস না ছাই!

আমি ওকে ভালোবাসতাম বা যাই করতাম সেটা শুধুই ক্ষণিকের আবেগ ছিলো! আমার তো বিয়েও ঠিক হয়ে গেছে!এদিকে ফাতিন সুইসাইড করতে গিয়েছিলো,এখন হাসপাতালে ভর্তি। আয়েশার কথা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।মনে হচ্ছে কানের পাশ দিয়ে চিল উড়ে যাচ্ছে,গাড়ির হর্ণ বাশির আওয়াজ ফ্যানের শো শো শব্দ সব যেন কানের তালা ফাটিয়ে দিচ্ছে। তাল হারিয়ে ফেলছি আমি!ছুটে যাই ফাতিনের কাছে,মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো,ওর পাশে বসে সমানে কেদে যাচ্ছি আমি।

– ফাতিন একটু কি তাকাবি না? খুব যে ভালোবাসি তোকে!আমি ভেবেছিলাম,আয়েশা তোকে এত ভালোবাসে আমি কি করে ঠকাই ওকে!একটাবার তাকা! এর মধ্যে ডক্টর এসে যায়,আমাকে আয়েশা টেনে বাইরে নিয়ে আসে।কি আশ্চর্য ওরা আমাকে ফাতিনের কাছে আর থাকতে দিবেনা?আমার ফাতিন কি আমাকে ছেড়ে চলে গেলো? জানিনা কাদতে কাদতে কখন সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলাম,তাকিয়ে দেখি আমার পাশের বেডে ফাতিন,কি আশ্চর্য ওর হাতে না ক্যানোলা আর মুখে মাস্ক ছিলো! ও তো দেখছি দিব্বি সুস্থ!

– ফাতিন তুই! তুই না..
– আরে পাগলী সবটাই নাটক ছিলো। তোর মন গলাতে যে এত কিছু করতে হলো কে জানে বিয়ের পর আরো কত কি করতে হয়!

সবাই হেসে উঠে ওর কথা শুনে,এদিকে লজ্জায় আমার মুখ তুলে তাকাতে ইচ্ছে করছিলোনা। বেশ ঘটা করেই আমাদের বিয়ে টা হয়,সবচেয়ে বড় দায়িত্ব নিয়েছিলো আয়েশা,আমাকে সাজানোসহ যাবতী কাজ,সব প্ল্যানিং ও ওই করেছিলো। বিদায় বেলায় মনে হচ্ছিলো আমি কি যেন হারিয়ে ফেলছি,কলিজা ছেড়া এক কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছিলো। সবাইকে বিদায় দিয়ে যখন গাড়িতে উঠলাম,গ্লাসয়া যেই লাগাতে যাবো,খেয়াল করলাম,আয়েশা আশেপাশে নেই,ওইতো বারান্দায় দেখা যাচ্ছে! মেয়েটা চোখের জল লুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো বুঝি! ওকে দেখার আর সুযোগ হলোনা,গাড়িটা শো শো করে ছেড়ে দিলো।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত