ঝরা পাতার কথাগুলো

ঝরা পাতার কথাগুলো

প্রায় ৫৭ বছর আগে এই বাড়িটাতে যখন প্রথম পা রাখি,তখনকার জৌলুষ ছিল দেখার মত। বিশাল বড় এই বাড়িটা। আজকের এই মফস্বল শহর তখন এমন ছিল না। ছোটখাট একটা গ্রাম, আর তার ছিল ঐশ্বর্য। সহজ সরল গ্রামের মানুষগুলোর মনে আনন্দের কমতি ছিল না, ভালবাসার কমতি ছিল না।

গ্রামের মেঠোপথগুলো সব এসে এখানেই শেষ হয়ে যেত। আর কিচ্ছু ছিল না চারপাশে। কেবল গাছপালার সারি, বনজঙ্গল । আর তার মাঝে মাঝে দুএকটা বাড়িঘরের মাথাগুলো উঁকি দিতে দেখা যেত। রাতের বেলায় জায়গাটাকে ভূতের আড্ডাখানা মনে হত। নিকষ কাল অন্ধকারের মাঝে টিমটিমে জ্বলতে থাকা ওই কুঁড়েঘরগুলোর অস্তিত্ব অন্ধকারকে আরও গাঢ় করে তুলত। ভয়ার্ত সেই অন্ধকারের বুক চিরে মাথা উঁচিয়ে তখন দাঁড়িয়ে থাকত এই “বড়বাড়ি”। এখন আর কিছুই নেই সেসব। সাদা ফ্লুরোসেণ্টের আলোয় এখন সব পরিষ্কার দেখা যায়। কেউ আর এখনঅন্ধকারকে ভয় করে না। রাতের বেলায় আকাশের বুকে সগর্বে জ্বলতে থাকা চাঁদটাকেও আর আগের মত দেখা যায় না। কৃত্রিম আলোর বন্যা চাঁদকেও আজ ছাপিয়ে যায়, বহুগুণে।

কিন্তু বাড়ির পাশটায় বয়ে যাওয়া ছোট্ট নদীটা এখনো তেমনই আছে। নিরবধি তার বয়ে যাওয়া। এখনো তার কুলকুল রব থামে নি। শত চেষ্টা করলেও এই বহমান স্রোত কখনো থামবে বলেই মনে হয় মাঝে মাঝে। এই নদীটার মতই, একটা জায়গা এখনো বদলে যায় নি। তুমি চলে যাওয়ার পর, যেমন ছিল তেমনই রেখে দিয়েছি। দক্ষিণের সেই “হাওয়া” ঘরটা, তোমার আর আমার সবসময়ের প্রিয় সেই ঘর সেই ঘরে এখনো জানালাটা আছে। তুমি খুব ঠাট্টা করতে, আমি নাকি একদিন এই জানালা দিয়ে অন্য কারো সাথে পালিয়ে যাব। আমার খুব প্রিয় ছিল এটা। কিন্তু তুমি কখনোই শান্তিমত আমাকে এখানে বসতে দিতে না।

ঝড়ের রাতগুলো, যখন সবকিছুই উড়ে যেত, আমি এখানে এসে বসে থাকতাম। কাউকে কিচ্ছুটি না বলে। প্রথম প্রথম তুমি খুব হয়রান হয়ে যেতে। একসময় আবিস্কার করলে, আমার ‘নিরুদ্দেশ’ হওয়ার কাহিনি, কি রাগটাই না করেছিলে সেদিন ১৪ বছরের আমি যখন এই বাড়িটায় পা দেই, আমার তখন পুতুল খেলার বয়স। কিছুই বুঝি না, সংসার কাকে বলে, দায়িত্ব কাকে বলে। আসলাম, তোমার কাছে। লাল টুকটুকে শাড়ি পরে এতোগুলো গয়না গায়েমাথায় জড়িয়ে সেদিন তোমার কাছে একেবারে চলে আসি।কি ভয়, কি নিদারুণ সংকোচ ছিল আমার ভেতর! তুমি, এই এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়া প্রথম ছেলে, জমিদার বংশ। কতকিছু বলা হয়েছিল আমাকে, তোমার সাথে সমঝে চলতে, সবসময় আদবকায়দা বজায় রেখে চলতে,আর কখনোই, তোমার কথার উপর কথা না বলতে।

আমি এমনিতে, ছোট্ট একটুখানি আমি, শেষ হয়ে ছিলাম। কি করব আমি এতো বড় বাড়িতে? কে আমাকে একটু মূল্য দেবে?এক ফুঁৎকারে তুমি সব উড়িয়ে দিতে পারতে, তাই দিলে। তখনকার ওই অস্থির সময়টাতে,যখন দেশ বদলাচ্ছে, সমাজ বদলাচ্ছে, মানুষের চিন্তাগুলোও বদলে যাচ্ছে, কারো কপালে তখন এমন বর জুটেছিল কিনা, জানি না। আমার জুটেছিল। আমার ওই খেলার বয়সটায়, আমি তোমাকেই আমার খেলার সাথী বানিয়ে নিলাম। বেশ অনেকগুলো বছর আমি তোমাকে পাইনি। তুমি পড়াশুনা করার জন্য বাইরে চলে যেতে। কিন্তু যখন ফিরে আসতে, আমার ঈদ হয়ে যেত। ওই কয়টা দিনের জন্য আমি সারাটা সময় অপেক্ষা করতাম। তোমার প্রতীক্ষায় কিন্তু প্রতীক্ষার সময়গুলোও কত সুন্দর ছিল!!

কতজায়গায় ঘুরেছি আমরা, তোমার কি মনে পড়ে? সময় পেলেই তুমি আমাকে ঘুরতে নিয়ে যেতে। এ বাড়ি, ও বাড়ি এই আসাযাওয়াতেই সীমাবদ্ধ ছিল অন্দরমহলের মেয়েদের জীবন। কিন্তু, আমি! ঘুরে বেরিয়েছি সাতসমুদ্দুর, তোমার হাত ধরে। তুমি আমাকে এতো কেন ভালবাসতে? আমার হাসি তোমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল। আমি ইচ্ছে করেই তাই বেশি বেশি হাসতাম তোমার সামনে। তোমার অবাক মুগ্ধ চোখের চাহনি দেখতে খুব ভাল লাগত, খুব। আমাদের প্রথম সন্তান আহসানের জন্মের সময়টা কখনোই ভুলব না। প্রথম সন্তান, প্রথম মা হওয়ার অনুভূতি, সেই সাথে প্রথমবারের মত প্রসববেদনার যন্ত্রণা। উফ! এতো কষ্ট আমি কখনো সইতে পারব, চিন্তা করিনি। আঁতুড় ঘরে আমি তারস্বরে চিৎকার করছি। আমার চিৎকারে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে যাচ্ছে।

আমি তো জানতাম, তুমি সইতে পারবে না। তাই যা কোনদিন ঘটেনি, তাই ঘটল। আঁতুড় ঘরের দরজা হাট করে খুলে তোমার ঢুকে যাওয়া সবাই তোমাকে ভয় পেত, তাই কেউ কিছু বলে নি। আমাদের প্রথম সন্তানকে আমরা দুইজনই একসাথে প্রথম দেখি। সেদিন বুঝি, ভালবাসার কি অসীম ক্ষমতা নিয়ে তুমি জন্মেছ। আহসানকে প্রথম কোলে নিয়ে তোমার অঝোর ধারায় কান্না, আমার এখনো মনে পড়ে। এরপর নিতির আসা। একে একে সুপ্তি, ধারা, মেহরান, আফসান আর নিধির সাথে সাথে আমাদের ভালবাসায় ভরা ঘর কানায় কানায় ভরে উঠে। দিনগুলো যে কেটে যায়। কোনফাঁকে সময়গুলো পথ পাড়ি দিয়ে চলে গেছে,বুঝতে পারি না। আমাদের ভালবাসার সম্পদগুলো বড় হয়, যে যার যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এমনটাই হওয়ার কথা।

অন্তত আহসানটা যেন সাথে থাকে, তুমি চেয়েছিলে। সবসময় আমরা যেমন চাই, তেমনটাকি হয় বল! তোমার বিশাল সংসার, একসময় শূন্য হয়ে পড়ে। প্রাণচঞ্চল বাড়িটায় একসময় মানুষের জায়গা দেয়া যেত না। অথচ, আস্তে আস্তে সব স্তিমিত হয়ে পড়ে। মানুষগুলো একসময় হাতে গুনে ফেলা যেত। খাঁ খাঁ করতে থাকে বাড়ির উঠোন। শূন্য উঠানে আর কেউ খেলা করে না, গাছপালাগুলো মনমরা হয়ে পড়ে থাকে, কার প্রতীক্ষায়, কে জানে। কিন্তু চিলেকোঠার দক্ষিণের এই ঘরটা, আমি বদলাতে দেইনি। কাউকে ঢুকতে দিতাম না এখানে। কেবল আমার আর তোমার প্রবেশাধিকার ছিল এই জায়গাটায়। নিশ্চুপ নিস্তব্ধ প্রকৃতি দেখতাম আমরা, হররোজ। একা একা বসে বসে এখনও সময়গুলো পার করি তেমন করেই।

তোমার আমাকে দেয়া বড় সিন্দুকের বাক্সটায় আজকে একটা ডাইরি পেলাম।ধুল জমেছে অনেক মলাটে লেখাগুলো ধুসর হয়ে যাচ্ছে। কত কত কথা, আর কত কত ব্যথা যে জমা হয়ে আছে এর পাতায় পাতায়! অনেক অনেক দিন পর, স্মৃতিগুলো নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। বয়সের হয়তোবা রেখা পড়েছে গালে, কিন্তু মস্তিষ্ক এখনো ধোঁকা দেয় না। আজ সেই উজানের হাওয়া দেয়া জানালাটার পাশে বসে তোমাকে খুব মনে পড়ছে।নীল আকাশে তারাদের মাঝে তোমাকে খুঁজে ফিরছি, জানো। কোথায় আছ তুমি বলতো? অনেকগুলো দিন তোমাকে ছেড়ে কাটালাম। ছেলেমেয়েগুলো চায়, তাদের কাছে চলে যাই। কিন্তু তাদের কেমন করে বুঝাই, আমার পক্ষে সম্ভব না।

এই বড় বাড়িটাকে আগলে রাখার যে দায়িত্ব আমাকে দিয়ে গিয়েছ, আমি কেমন করে তা ছেড়ে যাই? এখানে তো তোমার স্পর্শ লেগে আছে, তোমার গন্ধ মিশে আছে। আমি কেমন করে এসব ছেড়ে যাব বলতে পার? আমি তোমার বাড়িটাকে বদলে যেতে দেইনি। যেমনটি ছিল, ঠিক তেমনটি রয়েছে। তুমি এসে একবার দেখে যাও, তোমার সবকিছু আমি যত্নে রেখেছি। সব ছেড়ে চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত, এমনই থাকবে। সবই একসময় বদলে যায়। ভালবাসা বদলায় না। যেমনটা তোমার ভালবাসা বদলে যায়নি, যেমন আমার ভালবাসা তোমার জন্য, বদলায় নি।

আর বদলায়নি, নদীটার একটানা করুণ সুরে বয়ে চলার গান। শান্তসুনিবিড় এই স্রোতধারা এখনো জানান দিয়ে যাচ্ছে, সে বেঁচে আছে, থাকবে। নদীর তীরে দাঁড়িয়ে, বাড়ির দিকে মুখ করে চেয়ে থেকে, তোমার গলাফাটানো,” ওগো বউ, শুনতে কি পাও?” চিৎকার… আমি যেন এখনো শুনতে পাই। মাঝে মাঝেই একটাবার বলে যাওতো, তুমি কি শুনতে পাও?

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত